গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে গণতন্ত্রের ব্যারোমিটার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, বর্তমান গণতান্ত্রিক (!) সরকারের আমলে গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর খড়গ নেমে আসছে নানাভাবে। শুধু যে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল বন্ধ হচ্ছে তা নয়, টকশোর আলোচকদের ওপরও নেমে আসছে জীবননাশের হুমকি। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে টকশোতে অংশগ্রহণকারি ২৬ জন আলোচক তাদের প্রতি সন্ত্রাসীদের হুমকি-ধমকি ও প্রাণনাশের হুমকিতে গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছেন। হুমকিদাতা সন্ত্রাসীদের শনাক্ত করে তাদের শাস্তির দাবিতে গত ২১ জুন তারা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, কোনো ধরনের ধমক বা হুমকি টেলিভিশন টকশোর মাধ্যমে জনসাধারণের ইচ্ছার প্রতিধ্বনি ঘটানো থেকে তাদের বিচ্যুত করতে পারবে না। বিবৃতিদাতারা আরো বলেন, এসব সন্ত্রাসী তৎপরতা মত প্রকাশের অধিকার ও বাক-ব্যক্তির স্বাধীনতার প্রতি চরম আঘাত এবং নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ওপর মারাত্মক হুমকি।
ভাবতে অবাক লাগে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রের দাবিদার সরকারের আমলে টেলিভিশন টকশোতে আগত দেশের প্রাগ্রসর ব্যক্তিদের সন্ত্রাসীদের ধমকি ও প্রাণনাশের হুমকিতে উদ্বেগ জানাতে হয়। মত প্রকাশের কারণে যদি টেলিভিশন টকশোর আলোচকদের জীবননাশের হুমকি প্রদান করা হয়, তাহলে দেশের গণতন্ত্র কেমন অবস্থায় আছে তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। দেশের এমন অবস্থায় এখন উদ্বেগ প্রকাশ করছেন প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা, প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, মতিউর রহমান চৌধুরী, নূরুল কবীর, শিক্ষাবিদ ড. পিয়াস করিম, ড. আসিফ নজরুলের মত ব্যক্তিরা। লক্ষণীয় বিষয় হলো, টকশোর আলোচকদের প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার মত পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের কর্তা-ব্যক্তিরা টেলিভিশন টকশোর বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করে আসছিলেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা-নেত্রীরাও টকশোর আলোচকদের বিরুদ্ধে বিদ্রƒপাত্মক মন্তব্য করেন। ক্ষমতাসীনদের ক্রমাগত আক্রমণাত্মক বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু অনাকাক্সিক্ষত ও সন্ত্রাসী ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। গত ১০ জুন রাতে ড. তুহিন মালিক একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে অংশগ্রহণ করার সময় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে তার গাড়িতে সশস্ত্র হামলা হয়। তার গাড়ি ভাঙচুরের সময় মারধর করা হয় ড্রাইভারকে। সন্ত্রাসীরা তুহিন মালিককে অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ ও প্রাণনাশের হুমকি দেয়। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পিয়াস করিমকে টেলিফোনে প্রাণনাশের হুমকি এবং টকশোতে অংশ না নেয়ার জন্য শাসানো হয়। এছাড়া নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবিরকেও নানাভাবে হুমকি দেয়া হয়।
আমরা জানি, মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা একটি গণতান্ত্রিক সরকারের কর্তব্য। মত প্রকাশ করতে গিয়ে যদি সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা প্রাণনাশের হুমকিতে পড়েন, তখন বোঝা যায় সরকার তার দায়িত্ব পালন করছে না। আর যখন লক্ষ্য করা যায়, সরকার নিজেই মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে খড়গ হস্ত তখন এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, গণতন্ত্রের পথ ছেড়ে সরকার ফ্যাসিবাদের পথে হাঁটছে। এমন আচরণের মাধ্যমে সরকার শুধু সংবিধান, মৌলিক অধিকার ও নির্বাচনী ইসতেহারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় না, অবস্থান নেয় গণআকাঙ্কার বিরুদ্ধেও। প্রসঙ্গত আজ এ বিষয়টিও স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন যে, সরকারের চাটুকারিতা করা সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের কাজ নয়। বরং দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত সরকারের সমালোচনার মাধ্যমে দেশ ও জনগণের স্বার্থরক্ষাই সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব। এমন প্রয়াসকে সরকার কিংবা সরকারি ঘরানার শুভবুদ্ধির কোনো মানুষ খারাপ ভাবতে পারে না। অথচ আমরা এখন তেমন চিত্রই লক্ষ্য করছি। টকশোর আলোচকদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনরা ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং এখন ক্ষমতাধর সন্ত্রাসীরা তাদের জীবননাশের হুমকি দিচ্ছে। এরপরও কি আমাদের বলতে হবে যে, আমাদের সরকার গণতান্ত্রিক সরকার এবং আমাদের সমাজ গণতান্ত্রিক সমাজ? টেলিভিশন টকশোতে অংশগ্রহণকারি আলোচকরা যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা আমাদের শাসকদের বোধোদয় ঘটাতে সক্ষম হবে কিনা জানি না। তবে বোধোদয় ঘটলে তা সরকারের জন্য যেমন মঙ্গলজনক হবে, তেমনি মঙ্গলজনক হবে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্রেও।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন