আমাদের মতো দেশে প্রধানমন্ত্রীর ডিজায়ার বা চাওয়া মানেই হ্যাঁ না
হয়ে যাওয়া, না হ্যাঁ হয়ে যাওয়া। অথচ আমাদের সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে এতটা
ক্ষমতাও দেয়নি, এতটা কর্তৃত্বপরায়ণও বানায়নি। তাহলে প্রশ্ন উঠবে, প্রধানমন্ত্রী কি
আগাম নির্বাচন করার কথা বলে সীমা অতিক্রম করলেন? হয়তো এই ঘোষণা দিয়ে
কিস্তিমাত করার মতো কোনো গোপন পরিকল্পনাও তিনি নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী
রাজনীতিবিদ। একটি বড় দলের প্রধান। ঐতিহ্য ও অবস্থানগত কারণে অসম্ভব ধরনের
ক্ষমতাধর। নিজের সুবিধার রাজনীতির জন্য তিনি বহুমাত্রিক ভাবনা থেকে মাঠ সাজাতেই
পারেন। নানা ধরনের কৌশল নিয়ে বিরোধী দলকে অপ্রস্তুত কিংবা নাকালও করে দিতে পারেন।
নিজের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য বিরোধী দলের পাকা ধানে মইও দিতে পারেন। আবার বিরোধী
দলের যাত্রাভঙ্গের জন্য নিজের নাকও কাটতে পারেন; কিন্তু সংবিধান উপেক্ষা করে
নতুন করে জাতিকে সংবিধান বহির্ভূত কিছু গেলাতে পারেন না বোধ করি।
এখন নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, প্রধানমন্ত্রীর ডিজায়ারেই কি
সব হওয়া সম্ভব, না উচিত। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাতেই কি নির্ধারিত হয়ে যাবে জাতীয়
সংসদের মেয়াদ? চাইলেই কি প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দিতে পারেন? এই মতা কি
প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র। এসব প্রশ্নের জবাব দেবে সংবিধান।
এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগেই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার
সীমাবদ্ধতা জেনে রাখা ভালো, নয়তো আমরা তত্ত্বীয় আলোচনায় সংবিধান বুঝতে চেষ্টা করব; কিন্তু বাস্তবতা
আড়ালেই থেকে যাবে। এর আগে প্রধান দু’টি দলের নেতৃত্বের কাঠামোর ভেতর নেত্রীদের ক্ষমতার পরিধি বোঝার
চেষ্টা করাও জরুরি। মাইনাস টু’র মাজেজা না বুঝলে এমন আলোচনাই বৃথা। প্রধানমন্ত্রীর আগাম ঘোষণার বহু
অর্থ হতে পারে : ক. বিরোধী দলকে অপ্রস্তুত করে দেয়া; খ. দাবি-দাওয়া
মুলতবি রেখে নির্বাচনে মনোযোগ দিতে বাধ্য করা; গ. নিজ দলের জনশক্তিকে
প্রস্তুতির সিগন্যাল দেয়া; ঘ. নিজের আত্মবিশ্বাস উপস্থাপন করা ও ঙ. সরকার ক্ষমতাপাগল নয় এমন
ধারণা দিয়ে জনগণের সহমর্মিতা আদায় করা।
এখনো কেউ কেউ দুই নেত্রীকে অসহ্য বিবেচনা করছেন। তাদের ক্ষমতার
মেয়াদ বেঁধে দেয়ার প্রশ্ন তুলছেন। অপর দিকে রাজনীতিতে আগামী নির্বাচন টান টান
উত্তেজনার প্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি জাতীয় ঐকমত্যের সুর
তুলেছে। এমন পটভূমি মাথায় রেখেই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিবেচনায় নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী আগামী ২৫ অক্টোবর সংসদ ভেঙে দেয়ার কথা বলেছেন। জাতীয়
সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় তিনি এই বক্তব্যটি দিয়েছেন। এ ধরনের
বক্তব্য দেয়ার আগে তিনি নিশ্চয় হোমওয়ার্ক করেছেন। তার ভাষায় ২৫ অক্টোবরই হবে
এই সংসদের শেষ কার্যদিবস। অথচ আমাদের সংবিধান জাতীয় সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর
নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সংবিধানের ৭২(৩) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ
হইতে ৫ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে।’ সংবিধানের এ
বিধান সামনে রেখে দেখা হলে নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি।
এই হিসাব অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ এই সংসদের মেয়াদ শেষ হবে। প্রধানমন্ত্রীর
বক্তব্য বা ঘোষণা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ২৫ অক্টোবর সংসদ ভেঙে দিলে তিন মাস আগেই
সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যায়। এখন প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা এবং সংবিধান কোনটি
আক্ষরিকভাবে অনুসৃত হবে।
সংবিধানে সংসদ বিলুপ্তির স্পষ্ট নির্দেশনা হচ্ছেÑ প্রথমত, সংবিধানের ৭২(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে; দ্বিতীয়ত, ৫৭(২) অনুচ্ছেদ
অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারালে সেই অবস্থায়
অন্য কাউকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন হিসেবে পাওয়া না গেলে। ৫৭(২) অনুচ্ছেদে
যা বলা হয়েছে, ‘সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন হারাইলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ
করিবেন কিংবা সংসদ ভাঙ্গিয়া দিবার জন্য লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দান
করিবেন এবং তিনি অনুরূপ পরামর্শ দান করিলে রাষ্ট্রপতি, অন্য কোনো সংসদ
সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন নহেন এই মর্মে সন্তুষ্ট হইলে, সংসদ ভাঙ্গিয়া
দিবেন।’ এ বিধান মানলে সংসদ ভেঙে দেয়া
প্রধানমন্ত্রীর কোনো স্বেচ্ছাধীন মতা নয়। তিনি শুধু সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের
সমর্থন হারালেই রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দিতে বলতে পারেন বা বলবেন। এ বলার আক্ষরিক
অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রপতিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন হারানোর কথা লিখিতভাবে
জানাতে হবে। বর্তমান জাতীয় সংসদে এই অবস্থা নেই। প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন হারানোর
কোনো প্রশ্নই ওঠে না, সম্ভাবনাও নেই। অধিকন্তু প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দেয়ার কথা বললেই
রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিতে পারেন না। এখানেও সংবিধান অনুসৃতির প্রশ্ন রয়েছে। যত
দিন সংসদের বিধিবদ্ধ মেয়াদ আছে তত দিনের জন্য অন্য কোনো সংসদ সদস্যের প্রতি
সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন আছে কি না, তা তিনি খতিয়ে দেখতে বাধ্যÑ অন্তত আনুষ্ঠানিকতার স্বার্থে হলেও। আজকের রাষ্ট্রপতি সাবেক স্পিকার।
তিনিও জানেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে চাইবেন সংসদ সদস্যরা হয়তো সেভাবেই
সমর্থন দেবেন; কিন্তু সেটি সংবিধানের অনুসৃতি হবে না। ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না
সংবিধানকে সংরণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করা হবেÑ এমন শপথবাক্য পাঠ
করে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীরা দায়িত্বভার নিয়েছেন।
তাহলে এখন প্রশ্ন উঠবে, প্রধানমন্ত্রী কি সংবিধান
জানেন না। না মানেন না। এ প্রশ্নের সোজাসাপটা জবাব হবে তিনি সংবিধান জানেন, তবে মানেন নিজের
ও দলের সুবিধামতো। এখানেই আমাদের গণতন্ত্র হোঁচট খেয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে। আইনের
শাসন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হওয়ার এটাই মূল কারণ।
রাজনৈতিক দল ক্ষমতা চর্চার সুযোগ পেলে হাতছাড়া করবে নাÑ এটাই মোদ্দা কথা। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ক্ষমতার রাজনীতি শিয়ালের মত
ধূর্ত হয়। নেকড়ের মত হিংস্র হয়। এ জন্য ম্যাকিয়াভ্যালিকে দুষে লাভ নেই। এই
ভদ্রলোক ক্ষমতার রাজনীতির চরিত্র চিত্রণে শাসক ভাবনার সত্যিকার রূপকার। তিনি
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির হওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন না। তাই শাসকদের কোনো পিউরিটান
ক্যারেক্টার তার চিন্তায় ধারণ করার প্রশ্নই ওঠে না।
মজার ব্যাপার, মহাজোটকে টেনে হেঁচড়ে ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কেউ নামতে
বাধ্য করছে না। বরং গণতন্ত্রের ভাষায় অনুরোধ জানাচ্ছে, ব্যর্থতার দায়
নিয়ে কেটে পড়তে, অপশাসনের দায় নিয়ে সরে পড়তে। পদত্যাগ, ক্ষমতাত্যাগ, সরে দাঁড়ানোর
দাবি, অনুযোগ, অনুরোধ, চাপ প্রয়োগ ও আহ্বানের শেষ সীমা পর্যন্ত এখনো অতিক্রম করেনি।
আলটিমেটাম বিরোধী দল দেবেই। চাপ প্রয়োগ করবেই। এটা বিরোধী দলের রাজনৈতিক অবস্থান।
এ ধরনের ট্রামকার্ড অতীতেও খেলার চেষ্টা করা হয়েছে। বঙ্গভবনের অক্সিজেন বন্ধ করার
হুমকি দেয়া হয়েছে। অসহযোগ আন্দোলন করে রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। লগি-বৈঠার
তাণ্ডব সৃষ্টি করা হয়েছে। অফিসগামী মানুষকে দিগম্বর করা হয়েছে। পেট্রল ঢেলে বাস
পুড়িয়ে মানুষ মারা হয়েছে। জনতার মঞ্চ বানিয়ে নৈরাজ্যের জন্ম দেয়া হয়েছে। সেই
তুলনায় আজকের বিরোধী দল দুগ্ধপোষ্য শিশু। বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছে তারা
রাজপথের রাজা। ক্ষমতার চেয়ারেও আনকোরা নয়। আজকের বিরোধী দলে যারা আছে তারা
রাজপথে মিউ মিউ, ক্ষমতায়…।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মনে করে বিরোধী দল তছনছ হয়ে আছে, হামলা-মামলায়
কাবু। জামায়াত-শিবির মাঠছাড়া, নেতৃত্বহীন। প্রশাসনে সুবিধাপ্রাপ্তরা সামনের কাতারে। আপদগুলো বিদায়
হয়েছে। অনেকেই ওএসডি। অবশিষ্টরা নিজেদের সুবিধা সংরক্ষণের জন্যই সরকারকে সাহায্য
করবে। তা ছাড়া এবার সরকার গঠনের পর অসংখ্য দলীয় ক্যাডার ও শুভাকাক্সীকে সুবিধা
পাইয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই সুবিধাপ্রাপ্ত, উচ্ছিষ্টভোগী, করুণাপ্রাপ্ত ও
চাটারদলভুক্তরা নিজেদের গরজেই মহাজোটকে আবার ক্ষমতায় আনতে চাইবে। বিদেশীদেরও
সরকার বঞ্চিত করেনি। জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ঠেকানোর নামে শেষ পর্যন্ত হেফাজতকেও অসহ্য বিবেচনা করেছে। তাই
কিছুটা আপস, কিছুটা ছাড় দিয়ে বিদেশীদের সামনে হাত কচলে সমর্থনে টেনে আনতে
পারবে। ক্ষমতার সুবিধা সাথে যোগ করলে মহাজোটকে ঠেকায় কে? এ ধরনের ভাবনা
থেকে সরকারপ্রধান আগাম ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে সিম্প্যাথিও পেতে চান। রাজনীতির ভাষায়
এমন সিম্প্যাথি আশা করা গর্হিত কাজ নয়। অনেক দেশেই গণতান্ত্রিক সরকার কৌশলগত
কারণে আগাম নির্বাচন করে ক্ষমতায় ফিরে আসতে চেষ্টা করে। এটা কোনো নজিরবিহীন কাজ
নয়। তবে বাস্তব অবস্থা দুয়ে দুয়ে চারের মতো মিলে যাবে কি না সেটাই প্রশ্ন।
মহাজোট সরকার আরো এক মেয়াদ ক্ষমতা চাইলে জনগণ সেটা দেবে কি না ভোটেই
প্রমাণ মিলবে। তবে রাজনীতির ব্যাকরণ ও বাস্তবতা বলে ভোটারদের এতটা বিগড়ে দিয়ে
কোনোকালে কেউ ক্ষমতা ফিরে পায়নি। তারপরও নির্বাচনই যখন সরকার পরিবর্তনের কাক্সিত
ব্যবস্থা তখন জাতীয় স্বার্থেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জরুরি। তার চেয়েও জরুরি
বিরোধী দলকে পোষ মানিয়ে নির্বাচনে আনার মতো সমতল মাঠ প্রস্তুত করা। একতরফা কিংবা
বিরোধী দলকে অবজ্ঞা করে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। যে পথে হাঁটুক মহাজোট সরকারকেই
এখন রাজনৈতিক জট খোলার দায়িত্ব নিতে হবে। নয়তো জট না খোলার দায়ও বর্তাবে
সরকারের ওপর।
ক্ষমতা ঝর্ণাধারায় পড়ে থাকা নুড়িপাথরের মতো। লক্ষ বছর পানিতে
ভিজেও এক কাতরা পানি পায় না। এর অর্থ পাথরের ভেতর পানি যায় না। ক্ষমতাধরেরা
মানুষের মধ্যে বসবাস করেও মানুষের মন বুঝতে পারে না। এ জন্যই বলা হয়, ক্ষমতা মানুষকে
অন্ধ ও বেপরোয়া করে দেয়। ক্ষমতা শাসকদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ক্ষমতা
ছাড়তে কিংবা ছেড়ে নামতে যে মই লাগে, সেটাও শাসকেরা ভুলে যায়। এই
ভুলে যাওয়ার খেসারতটাই বিপর্যয়কে ডেকে নিয়ে আসে।
এখন নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, প্রধানমন্ত্রীর ডিজায়ারেই কি
সব হওয়া সম্ভব, না উচিত। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাতেই কি নির্ধারিত হয়ে যাবে জাতীয়
সংসদের মেয়াদ? চাইলেই কি প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দিতে পারেন? এই মতা কি
প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র। এসব প্রশ্নের জবাব দেবে সংবিধান।
এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগেই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার
সীমাবদ্ধতা জেনে রাখা ভালো, নয়তো আমরা তত্ত্বীয় আলোচনায় সংবিধান বুঝতে চেষ্টা করব; কিন্তু বাস্তবতা
আড়ালেই থেকে যাবে। এর আগে প্রধান দু’টি দলের নেতৃত্বের কাঠামোর ভেতর নেত্রীদের ক্ষমতার পরিধি বোঝার
চেষ্টা করাও জরুরি। মাইনাস টু’র মাজেজা না বুঝলে এমন আলোচনাই বৃথা। প্রধানমন্ত্রীর আগাম ঘোষণার বহু
অর্থ হতে পারে : ক. বিরোধী দলকে অপ্রস্তুত করে দেয়া; খ. দাবি-দাওয়া
মুলতবি রেখে নির্বাচনে মনোযোগ দিতে বাধ্য করা; গ. নিজ দলের জনশক্তিকে
প্রস্তুতির সিগন্যাল দেয়া; ঘ. নিজের আত্মবিশ্বাস উপস্থাপন করা ও ঙ. সরকার ক্ষমতাপাগল নয় এমন
ধারণা দিয়ে জনগণের সহমর্মিতা আদায় করা।
এখনো কেউ কেউ দুই নেত্রীকে অসহ্য বিবেচনা করছেন। তাদের ক্ষমতার
মেয়াদ বেঁধে দেয়ার প্রশ্ন তুলছেন। অপর দিকে রাজনীতিতে আগামী নির্বাচন টান টান
উত্তেজনার প্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি জাতীয় ঐকমত্যের সুর
তুলেছে। এমন পটভূমি মাথায় রেখেই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিবেচনায় নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী আগামী ২৫ অক্টোবর সংসদ ভেঙে দেয়ার কথা বলেছেন। জাতীয়
সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় তিনি এই বক্তব্যটি দিয়েছেন। এ ধরনের
বক্তব্য দেয়ার আগে তিনি নিশ্চয় হোমওয়ার্ক করেছেন। তার ভাষায় ২৫ অক্টোবরই হবে
এই সংসদের শেষ কার্যদিবস। অথচ আমাদের সংবিধান জাতীয় সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর
নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সংবিধানের ৭২(৩) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ
হইতে ৫ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে।’ সংবিধানের এ
বিধান সামনে রেখে দেখা হলে নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি।
এই হিসাব অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ এই সংসদের মেয়াদ শেষ হবে। প্রধানমন্ত্রীর
বক্তব্য বা ঘোষণা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ২৫ অক্টোবর সংসদ ভেঙে দিলে তিন মাস আগেই
সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যায়। এখন প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা এবং সংবিধান কোনটি
আক্ষরিকভাবে অনুসৃত হবে।
সংবিধানে সংসদ বিলুপ্তির স্পষ্ট নির্দেশনা হচ্ছেÑ প্রথমত, সংবিধানের ৭২(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে; দ্বিতীয়ত, ৫৭(২) অনুচ্ছেদ
অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারালে সেই অবস্থায়
অন্য কাউকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন হিসেবে পাওয়া না গেলে। ৫৭(২) অনুচ্ছেদে
যা বলা হয়েছে, ‘সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন হারাইলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ
করিবেন কিংবা সংসদ ভাঙ্গিয়া দিবার জন্য লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দান
করিবেন এবং তিনি অনুরূপ পরামর্শ দান করিলে রাষ্ট্রপতি, অন্য কোনো সংসদ
সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন নহেন এই মর্মে সন্তুষ্ট হইলে, সংসদ ভাঙ্গিয়া
দিবেন।’ এ বিধান মানলে সংসদ ভেঙে দেয়া
প্রধানমন্ত্রীর কোনো স্বেচ্ছাধীন মতা নয়। তিনি শুধু সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের
সমর্থন হারালেই রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দিতে বলতে পারেন বা বলবেন। এ বলার আক্ষরিক
অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রপতিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন হারানোর কথা লিখিতভাবে
জানাতে হবে। বর্তমান জাতীয় সংসদে এই অবস্থা নেই। প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন হারানোর
কোনো প্রশ্নই ওঠে না, সম্ভাবনাও নেই। অধিকন্তু প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দেয়ার কথা বললেই
রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিতে পারেন না। এখানেও সংবিধান অনুসৃতির প্রশ্ন রয়েছে। যত
দিন সংসদের বিধিবদ্ধ মেয়াদ আছে তত দিনের জন্য অন্য কোনো সংসদ সদস্যের প্রতি
সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন আছে কি না, তা তিনি খতিয়ে দেখতে বাধ্যÑ অন্তত আনুষ্ঠানিকতার স্বার্থে হলেও। আজকের রাষ্ট্রপতি সাবেক স্পিকার।
তিনিও জানেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে চাইবেন সংসদ সদস্যরা হয়তো সেভাবেই
সমর্থন দেবেন; কিন্তু সেটি সংবিধানের অনুসৃতি হবে না। ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না
সংবিধানকে সংরণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করা হবেÑ এমন শপথবাক্য পাঠ
করে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীরা দায়িত্বভার নিয়েছেন।
তাহলে এখন প্রশ্ন উঠবে, প্রধানমন্ত্রী কি সংবিধান
জানেন না। না মানেন না। এ প্রশ্নের সোজাসাপটা জবাব হবে তিনি সংবিধান জানেন, তবে মানেন নিজের
ও দলের সুবিধামতো। এখানেই আমাদের গণতন্ত্র হোঁচট খেয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে। আইনের
শাসন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হওয়ার এটাই মূল কারণ।
রাজনৈতিক দল ক্ষমতা চর্চার সুযোগ পেলে হাতছাড়া করবে নাÑ এটাই মোদ্দা কথা। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ক্ষমতার রাজনীতি শিয়ালের মত
ধূর্ত হয়। নেকড়ের মত হিংস্র হয়। এ জন্য ম্যাকিয়াভ্যালিকে দুষে লাভ নেই। এই
ভদ্রলোক ক্ষমতার রাজনীতির চরিত্র চিত্রণে শাসক ভাবনার সত্যিকার রূপকার। তিনি
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির হওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন না। তাই শাসকদের কোনো পিউরিটান
ক্যারেক্টার তার চিন্তায় ধারণ করার প্রশ্নই ওঠে না।
মজার ব্যাপার, মহাজোটকে টেনে হেঁচড়ে ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কেউ নামতে
বাধ্য করছে না। বরং গণতন্ত্রের ভাষায় অনুরোধ জানাচ্ছে, ব্যর্থতার দায়
নিয়ে কেটে পড়তে, অপশাসনের দায় নিয়ে সরে পড়তে। পদত্যাগ, ক্ষমতাত্যাগ, সরে দাঁড়ানোর
দাবি, অনুযোগ, অনুরোধ, চাপ প্রয়োগ ও আহ্বানের শেষ সীমা পর্যন্ত এখনো অতিক্রম করেনি।
আলটিমেটাম বিরোধী দল দেবেই। চাপ প্রয়োগ করবেই। এটা বিরোধী দলের রাজনৈতিক অবস্থান।
এ ধরনের ট্রামকার্ড অতীতেও খেলার চেষ্টা করা হয়েছে। বঙ্গভবনের অক্সিজেন বন্ধ করার
হুমকি দেয়া হয়েছে। অসহযোগ আন্দোলন করে রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। লগি-বৈঠার
তাণ্ডব সৃষ্টি করা হয়েছে। অফিসগামী মানুষকে দিগম্বর করা হয়েছে। পেট্রল ঢেলে বাস
পুড়িয়ে মানুষ মারা হয়েছে। জনতার মঞ্চ বানিয়ে নৈরাজ্যের জন্ম দেয়া হয়েছে। সেই
তুলনায় আজকের বিরোধী দল দুগ্ধপোষ্য শিশু। বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছে তারা
রাজপথের রাজা। ক্ষমতার চেয়ারেও আনকোরা নয়। আজকের বিরোধী দলে যারা আছে তারা
রাজপথে মিউ মিউ, ক্ষমতায়…।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মনে করে বিরোধী দল তছনছ হয়ে আছে, হামলা-মামলায়
কাবু। জামায়াত-শিবির মাঠছাড়া, নেতৃত্বহীন। প্রশাসনে সুবিধাপ্রাপ্তরা সামনের কাতারে। আপদগুলো বিদায়
হয়েছে। অনেকেই ওএসডি। অবশিষ্টরা নিজেদের সুবিধা সংরক্ষণের জন্যই সরকারকে সাহায্য
করবে। তা ছাড়া এবার সরকার গঠনের পর অসংখ্য দলীয় ক্যাডার ও শুভাকাক্সীকে সুবিধা
পাইয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই সুবিধাপ্রাপ্ত, উচ্ছিষ্টভোগী, করুণাপ্রাপ্ত ও
চাটারদলভুক্তরা নিজেদের গরজেই মহাজোটকে আবার ক্ষমতায় আনতে চাইবে। বিদেশীদেরও
সরকার বঞ্চিত করেনি। জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ঠেকানোর নামে শেষ পর্যন্ত হেফাজতকেও অসহ্য বিবেচনা করেছে। তাই
কিছুটা আপস, কিছুটা ছাড় দিয়ে বিদেশীদের সামনে হাত কচলে সমর্থনে টেনে আনতে
পারবে। ক্ষমতার সুবিধা সাথে যোগ করলে মহাজোটকে ঠেকায় কে? এ ধরনের ভাবনা
থেকে সরকারপ্রধান আগাম ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে সিম্প্যাথিও পেতে চান। রাজনীতির ভাষায়
এমন সিম্প্যাথি আশা করা গর্হিত কাজ নয়। অনেক দেশেই গণতান্ত্রিক সরকার কৌশলগত
কারণে আগাম নির্বাচন করে ক্ষমতায় ফিরে আসতে চেষ্টা করে। এটা কোনো নজিরবিহীন কাজ
নয়। তবে বাস্তব অবস্থা দুয়ে দুয়ে চারের মতো মিলে যাবে কি না সেটাই প্রশ্ন।
মহাজোট সরকার আরো এক মেয়াদ ক্ষমতা চাইলে জনগণ সেটা দেবে কি না ভোটেই
প্রমাণ মিলবে। তবে রাজনীতির ব্যাকরণ ও বাস্তবতা বলে ভোটারদের এতটা বিগড়ে দিয়ে
কোনোকালে কেউ ক্ষমতা ফিরে পায়নি। তারপরও নির্বাচনই যখন সরকার পরিবর্তনের কাক্সিত
ব্যবস্থা তখন জাতীয় স্বার্থেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জরুরি। তার চেয়েও জরুরি
বিরোধী দলকে পোষ মানিয়ে নির্বাচনে আনার মতো সমতল মাঠ প্রস্তুত করা। একতরফা কিংবা
বিরোধী দলকে অবজ্ঞা করে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। যে পথে হাঁটুক মহাজোট সরকারকেই
এখন রাজনৈতিক জট খোলার দায়িত্ব নিতে হবে। নয়তো জট না খোলার দায়ও বর্তাবে
সরকারের ওপর।
ক্ষমতা ঝর্ণাধারায় পড়ে থাকা নুড়িপাথরের মতো। লক্ষ বছর পানিতে
ভিজেও এক কাতরা পানি পায় না। এর অর্থ পাথরের ভেতর পানি যায় না। ক্ষমতাধরেরা
মানুষের মধ্যে বসবাস করেও মানুষের মন বুঝতে পারে না। এ জন্যই বলা হয়, ক্ষমতা মানুষকে
অন্ধ ও বেপরোয়া করে দেয়। ক্ষমতা শাসকদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ক্ষমতা
ছাড়তে কিংবা ছেড়ে নামতে যে মই লাগে, সেটাও শাসকেরা ভুলে যায়। এই
ভুলে যাওয়ার খেসারতটাই বিপর্যয়কে ডেকে নিয়ে আসে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন