স্বভাবসুলভ কায়দায় হয়তো বা শেষবারের মতো দেশবাসীর সাথে একটা
নিষ্ঠুর তামাশা করলেন শেখ হাসিনার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। সাধারণ
নির্বাচনের বছরে বাজেটে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হবে, বাজেট বিশারদ
সুশীলজনেরা এমনটা ধরে নিয়েছিলেন। ব্রাত্যজনেরাও ভেবেছিলেন, নির্বাচনের বছরে
শুল্ক বা কর বাড়বে না, বাজারদর আর শনৈঃশনৈ বাড়বে না। এখন সবাইকেই তাক লাগিয়ে দিয়ে
অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব অশোভনীয় ‘আশাবাদের বাজেট’ হিসেবে যে ‘পরাবাস্তব’ অর্থবিল পেশ করেছেন, তাতে নিজ ‘মস্তিষ্কের উর্বরতা’ দিয়ে তিনি একটি
প্রবাদবাক্যের ল্যভেদ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। প্রবাদবাক্যটি চালু করেছেন মনগড়া
নাটকের মার্কিন চলচ্চিত্রকার লেভিন সাহেব, আর এবারের বাজেট প্রসঙ্গে সেটি
উদ্ধৃত করেছেন সংবাদ ভাষ্যকার সৈয়দ সামসুজ্জামান। তার তরজমা- ‘সব লোককেই সব সময়ের জন্য বোকা
বানানো যায় যদি প্রচারবাদ্য ঠিক থাকে আর বাজেটের অঙ্ক বিরাট হয়’। বিরাট অঙ্কেরই ২,২২,৪৯১ কোটি টাকার
বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জন্য। কিন্তু তার
দুর্ভাগ্য, কিছু খয়ের খাঁ ছাড়া আর কোনো লোককেই বোকা বানাতে পারেননি তিনি। এক
বাক্যে সুশীলসমাজের চাঁইরা বলেছেন- বাজেট ভারসাম্যহীন; এই বাজেট
বাস্তবায়নযোগ্য নয়। কোথা থেকে বহুমুখী পদ্মা সেতুসহ ভৌতিক অবকাঠামো নির্মাণের
বৈদেশিক মুদ্রা ও প্রযুক্তির সংস্থান হবে, বিশ্বব্যাংকের সাথে কোনো
সমঝোতা না হওয়ায় আদৌ বৈদেশিক ঋণ বা অনুদান সুনিশ্চিত কি না, কোথা থেকে কিভাবে
দেশের সরকারি বেসরকারি ব্যাংকগুলো বাজেটের চাহিদা মোতাবেক ১৪,৩৩৫ কোটি টাকার
দীর্ঘমেয়াদি ঋণ আর ১১,৬৩৮ কোটি টাকার স্বল্পমেয়াদি ঋণের মোট ২৫,৯৯৩ কোটি টাকার
হাতির খোরাক জোগাবে, তাতে শিল্পোৎপাদনের চলতি ব্যাংক হিসাবে আর আমদানি বাণিজ্যের ঋণপত্রের
হিসাবে অপূরণীয় ঘাটতি দেখা দিয়ে কলকারখানা ব্যবসাপাতি দোকানপাট লাটে উঠবে কি না, কিংবা সাধারণভাবে
ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় তারল্য সঙ্কট দেখা দিয়ে জাতীয় উৎপাদন নিদারুণভাবে বিঘিœত হবে কি না, এসব বিবেচনার
কোনো কিছুরই ঠিক ঠিকানা নেই। সবটাই গোঁজামিল। সুধীসমাজের বাজেট বিশারদেরা সমস্বরে
বলছেন, মূল্যস্ফীতি বাড়বে। আর জনসমাজের ব্রাত্যজন দেখছেন, বাজেট পেশ হওয়ার
পর থেকেই গুঁড়াদুধ, ভোজ্যতেল, ডাল, মাছ, মসলাপাতির দাম শনৈঃশনৈ বাড়তে শুরু করেছে। মুরগি আর শুকনা মরিচের
দামও বেড়েছে, তবে সেটা বাজেটের জন্য না আবহাওয়ার জন্য, তা নিয়ে মতভেদ
আছে। বাজেট মাসের শেষ নাগাদ এই দরবৃদ্ধির হিড়িক তীব্র হয়ে উঠবে বলে ধারণা খুচরা
ব্যবসায়ীদের।
মতাসীন জোটের খয়ের খাঁ শীর্ষ ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানে পরিণত
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) বলেছে, চলমান বাস্তবতায়
(তথা সামষ্টিক অর্থনীতিকে দুর্নীতি, অব্যবস্থা ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের
দায়গ্রস্ত যে পর্যায়ে বর্তমান সরকার নিয়ে এসেছে তাতে) উন্নয়ন চাহিদার আশা
পূরণে ২০১৩-১৪ সালের জন্য ঘোষিত বাজেটের ল্যমাত্রা অনুসরণ ছাড়া গত্যন্তর নেই।
ধান্দাবাজ শীর্ষ ব্যবসায়ীরা খুশি, পুঁজিবাজারে কালো টাকা
বিনিয়োগের সুযোগ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আবাসন খাতের কালো টাকা বিনিয়োগেও সুযোগ
দেয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। এ জন্য কালো টাকার মালিকদের শুধু অতিরিক্ত ১০ শতাংশ
হারে জরিমানা গুণতে হবে। আগ্রহী কোনো কালো টাকার মালিক জমি বা প্লট কেনার েেত্র
চুক্তি মূল্যের ১০ শতাংশ টাকা দিলেই আর কোনো কর দিতে হবে না। তবে তাদের একাধিক জমি
বা প্লট কিনতে হলে দিতে হবে ২০ শতাংশ অর্থ; সেটাও তারা না দিয়ে পারবে
বেনামিতে খরিদ রেজিস্ট্রি করে। এ জন্য অর্থবিলে নতুন একটি ধারাও সংযুক্ত করা
হয়েছে।
তথা জাতীয় অর্থনীতিকে কালো টাকার দৌরাত্ম্যনির্ভর করার নাশকবৃত্তি
শেষ বাজেটেও বজায় রেখেছেন আবুল মাল আব্দুল মুহিত সাহেব। তবে ব্যাংক ঋণের প্রশ্নে
সরকারের খয়ের খাঁ এফবিসিসিআই-এর নেতারাও অনেকে সাংবাদিকদের কাছে অনানুষ্ঠানিকভাবে
বলতে শুরু করেছেন, সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিলে দেশের
শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে; বেসরকারি খাতের
শিল্পোদ্যোক্তারা চাহিদামতো ঋণ পাবেন না; এতে এক দিকে নতুন কোনো
শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন হবে না; অন্য দিকে ব্যাংক ঋণে সুদের হার আরো বেড়ে যাবে। অর্থনীতিবিদেরা
বলছেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়লে মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে
থাকবে। এতে সাধারণ মানুষের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এমনিতেই
সুদের সর্বোচ্চ সীমা তুলে দেয়ায় ব্যাংকগুলো ১৮ থেকে ২২ শতাংশ হারে সুদ নিচ্ছে।
উচ্চ সুদের কারণে ব্যবসায়-বাণিজ্যের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে শিল্প
বিনিয়োগব্যয় ও পণ্য উৎপাদন খরচ। অথচ নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিশেষ করে চলমান
রাজনৈতিক অস্থিরতায় রফতানি খাতসহ বিভিন্ন সেক্টর প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে
দেউলিয়াপনার মুখোমুখি হচ্ছে। যদি ২৬ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে নেয়া হয় তাহলে
নতুন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান হবে না। কর্মসংস্থানও হবে না। ছোট ও মাঝারি
শিল্পপ্রতিষ্ঠান খুবই ঝুঁকিতে পড়বে।
অন্য দিকে বাজেটের উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি
পূরণ করতে বিদেশী উৎস থেকে নতুন অর্থবছরে ২৩,৭২৯ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার
ল্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। এর মধ্যে ৯,৩৩১ কোটি টাকা বিদেশী ঋণ পরিশোধের
পর নিট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪,৩৯৮ কোটি টাকা। অথচ
বিশ্বব্যাংক ও দাতাগোষ্ঠীর সাথে যে অবিশ্বাস ও তিক্ততার সম্পর্ক হাসিনা সরকার
পাকিয়ে বসে আছে, তার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে জেদ দেখিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে
দুর্নীতির চেষ্টায় অভিযুক্ত সেতু বিভাগের সাবেক সচিবের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ
প্রত্যাহার করে বাজেটের মাসেই তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করেছে সরকার বাহাদুর। ফলে
প্রত্যাশিত বা কেতাবি বৈদেশিক ঋণগুলোর প্রকৃত অর্থের ছাড় চিঠি চালাচালি করে শেষ পর্যন্ত
কবে মিলবে সেটা বলা যায় না। এসব অনাসৃষ্টি অনিশ্চয়তার মধ্যে বাজেটের বাস্তবায়ন
যে কঠিন হবে সে কথা এবং অর্থমন্ত্রী যে সর্বদাই কল্পনাবিলাসী শখের বাজেট দেয়ার ‘পাগলামি’তে (প্রধান বিরোধী দল বিএনপি
মহাসচিবের মন্তব্য) ভোগেন সে কথাও নিজ মুখেই কবুল করেছেন আবদুল মুহিত সাহেব। খোদ
অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রদানোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘অনেকেই বলেছেন, এটি জনতুষ্টির বাজেট, উচ্চাভিলাষী বাজেট, ঋণনির্ভর বাজেট
কিংবা ভোটার তুষ্টির বাজেট। আমি এর সাথে দ্বিমত করছি না। এবার বাজেট উচ্চাভিলাষী
হয়েছে বটে তবে… বর্তমান মহাজোট সরকারের সব
বাজেটই উচ্চাভিলাষী হয়েছে। বিগত সময়ে সব উচ্চাভিলাষী বাজেটই বাস্তবায়িত হয়েছে’ (ফাঁকিজুকির বাস্তবায়ন আর কি)।
‘এটাও বাস্তবায়নযোগ্য
উচ্চাভিলাষী বাজেট। তবে বাজেটের বড় দুর্বলতা হচ্ছে বাস্তবায়ন (অম্লান বদনে এমন
স্ববিরোধী আপ্তবাক্য বলে গেলেন অর্থমন্ত্রী)। ঝুঁকি হচ্ছে, রাজনৈতিক
অস্থিরতা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার। বিভিন্ন সময়ে নানা ইস্যুতে ‘কম্প্রোমাইজ’ করতে হয়েছে। যেমন- কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া, জনপ্রশাসন ও
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার না করা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের
লোকসান বন্ধ করতে না পারা, সিএনজি ও এলএনজির মূল্য সমপর্যায়ে নিয়ে না আসা ইত্যাদি।’
এভাবে ব্যষ্টিগত ও সমষ্টিগত উভয় পর্যায়ে দেশবাসীকে একটা খেলাখেলা
বাজেট দিয়ে তার প্রতিক্রিয়ায় মনস্তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় সঙ্কটের অর্থনৈতিক
ফাঁপরে ফেলেছেন অর্থমন্ত্রী। তারপর প্রকাশ্যেই তিনি তার বাজেটের ‘দুর্বলতা’র দায় স্বীকার করলেন। কিন্তু
তাতেই কি দেশবাসীর ভাগ্য নিয়ে তার নিষ্ঠুর পরিহাসের পাপমোচন হয়েছে? লোকের চোখে হয়নি, তবে তার নেত্রীর
চোখে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার মহাজোটেরই বৃহত্তর বলয়ভুক্ত সুশীল গোষ্ঠীর বাজেট
সমালোচনায় উত্তেজিত হয়ে বলেছেন, ‘কিছু কিছু আঁতেল শ্রেণী আছে
তাদের কিছুই ভালো লাগে না, যা কিছুই ভালো কাজ সরকার করে তার সব কিছুই তারা খারাপ চোখে দেখে।
তাদের অনেকেই বলছেন এই বাজেট উচ্চাভিলাষী। অবশ্যই এই বাজেট উচ্চাভিলাষী। জনগণের
কল্যাণ ও উন্নয়নে আমাদের উচ্চাভিলাষ রয়েছে। তা না হলে রাজনীতি করি কিসের জন্য?’
‘দেশকে দরিদ্র রেখে
কনসালট্যান্সির মাধ্যমে টাকা কামাতেই বাজেটের সমালোচনা। কেউ কেউ সমালোচনা করে বলেন, এটা রাজস্ব
আদায়নির্ভর বাজেট। আমি বলি, রাজস্বনির্ভর বাজেটই তো আমরা দিয়েছি। আর কত বিদেশী সাহায্যনির্ভর
বাজেট দেবো। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমরা তো রাজস্ব আদায় করেই দেশকে গড়ে
তুলতে চাই। আমরা কি ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াব। ভিার ঝুলি
নিয়ে দেশটা থাকলে এ শ্রেণীর লোকদের সুবিধা হয়। বাংলাদেশ যত দরিদ্র থাকবে তাদের (সমালোচকদের)
তত সুবিধা হবে। কনসালট্যান্সি করে খেতে পারবে। দেশকে গরিব দেখাতে পারলে তারা একটা
চাকরি পেতে পারে। আমরা চাই বাংলাদেশ আত্মমর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।’
‘(এ ছাড়া) আমাদের দেশে একটি শ্রেণী আছে, যাদের মতায় যাওয়ার খায়েশ
আছে, কিন্তু জনগণের কাছে যাওয়ার সাহস নেই, ভোটে দাঁড়ানোর মতা নেই।
সাংবিধানিক পদ্ধতি তাদের ভালো লাগে না। তারা চায় যেকোনোভাবে দেশে অস্থিতিশীলতা
লেগে থাকুক। কেউ কেউ দল করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। এর আগে তারা মাইনাস টু
ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। কারণ দেশের জনগণ তাদের সাথে নেই। তত্ত্বাবধায়কসহ
বিগত সরকারগুলো সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক
উপদেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষকদের তৎপরতা আগামীতে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।’ কিন্তু আঁতেল শ্রেণীর বাইরে ভোক্তা জনসাধারণের যে বিশাল সমাজ
বিদ্যমান, যারা বাজেট পাস হতে না হতেই বাজারদর বৃদ্ধির দামামায় চোখে সর্ষেফুল
দেখছে, তাদের কী ভরসা দেবেন প্রধানমন্ত্রী?
অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে প্রশাসনের ‘সব শিয়ালের এক রা’ তোলার হুকুম জারি করে মতা কেন্দ্রীভূত করেছেন, যার ফলে
জাতিরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন, গতিশীলতা হারিয়েছে বেশির ভাগ
সরকারি কার্যক্রম, সে সম্পর্কে প্রশ্ন তোলায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, দেশের বুদ্ধিজীবী
ও সুশীলসমাজের ‘মস্তিষ্কের উর্বরতা’ কমে গেল কি না তা
নিয়ে আমরা আতঙ্কিত।
এ দিকে মৃদু সমালোচনামুখর প্রিন্ট মিডিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য
অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রস্তাবে নিউজপ্রিন্টের ওপর বাড়তি আমদানি শুল্ক চাপিয়েছেন।
ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে মুঠোর মধ্যে রাখার জন্য বিটিআরসি বা বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন
রেগুলেটরি কমিশনের প্যাঁচানো আইনের খড়গ তো রয়েছেই। তবে তারই ফাঁকে টেলিবিতর্কে
সামান্য যেটুকু সমালোচনা সেটাও সহ্য হচ্ছে না মতাসীন নেতাদের। শেখ হাসিনার দলীয়
মহাসচিব ৭ জুন দলীয় আলোচনা সভায় সরকারের সাবেক সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খানের একটি টেলিভিশন মন্তব্যকে কটা করে বলেছেন, ‘কেন যে এতগুলো টেলিভিশনের লাইসেন্স দিলাম! এত টকশো! ইউরোপ-আমেরিকাতেও
এত টকশো হয় না। এসব টকশোর বক্তাদের ইতিহাসটা কি ব্যর্থতার ইতিহাস! তারা
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন, একটা নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে
পারেননি। গণতন্ত্রের কথা বলায় শেখ হাসিনাকে জেলে যেতে হয়েছে। আকবরকে (আকবর আলি
খান) তো জেলে যেতে হয়নি। তাদের তো একদিনও বিচারিক আদালতে হাজিরা দিতে হয়নি।’
দেখা যাচ্ছে, পোষ্য, চাটুকার আর অন্ধ অনুসারী ছাড়া দেশের আর সবারই বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ
ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার অর্থমন্ত্রী ও তার দলীয়
সাধারণ সম্পাদক। বাজেটের ফলাফল কী হবে না-হবে, আদৌ তার বাস্তবায়ন হবে কি না, তা নিয়ে যে
তাদের মাথাব্যথা নেই সেই ইঙ্গিতও স্পষ্ট করেই দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। বাজেট
প্রস্তাবোত্তর সংসদীয় দলের সভায় তিনি বলেন, ‘২৫ অক্টোবরের পর নবম সংসদের আর কোনো অধিবেশন বসবে না। ২৫ অক্টোবর এই
সরকারের মেয়াদ শেষ হবে। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে (সংবিধানের পঞ্চদশ
সংশোধনী অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগে থেকে নির্বাচনপ্রক্রিয়া
শুরু হবে। এই ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি নবম
সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। সে অনুযায়ী আগামী ২৫ জানুয়ারি সংসদের পাঁচ বছর মেয়াদ
পূর্ণ হবে)।
‘বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া
বেশি বাড়াবাড়ি করলে তার ছেলে তারেক রহমান ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার
চার্জশিটভুক্ত আসামি ও আইভি রহমানের হত্যাকারী। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায়
সে রেহাই পাবে না।’
অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীর ফর্মুলা মেনে নিয়ে নির্বাচনে না এলে সংসদীয়
বিরোধী দল নেতার ছেলের ফাঁসি হবে, এই হুমকি দিলেন প্রধানমন্ত্রী। আর অর্থমন্ত্রীকে পরো আশ্বাস দিলেন, বাজেটের জন্য তার
জবাবদিহিতার মেয়াদ থাকবে চার মাসেরও কম, তাই ‘ঋণং কৃত্যা ঘৃতং পীবেত’ যথার্থ পন্থা। যেহেতু এই সরকার সংবৎসর মতায় থাকবে না, সেহেতু বাজেট পূর্ণাঙ্গ
বাস্তবায়নের বালাই নেই; সুতরাং কাল্পনিক বাজেটের কেতাবি পোলাও-কোর্মায় ইচ্ছেমতো ঘি ঢালতে
অসুবিধা কোথায়?
বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা’কে অর্থবিলে নির্দেশিত ল্য অর্জনের পথে সমূহ ঝুঁকি হিসেবে উল্লেখ
করেছেন। ৭ জুন দলীয় আলোচনা সভায় সেই উদ্বেগকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, ‘(তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা
পুনর্বহালের দাবিতে) সংসদে দেয়া মুলতবি প্রস্তাব প্রত্যাহার করে বিএনপি আলোচনার
পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আলোচনার আর কোনো সুযোগ নেই। (বিএনপি বলছে, সমঝোতা ছাড়া
মুলতবি প্রস্তাব সংসদে ভোটে দিলে সরকার অনায়াসে সেটা বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনীর
বৈধতা জায়েজ করবে, সেই ফাঁদে সংসদীয় বিরোধী দল পা দেবে কেন?) যথাসময়ে
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগামী নির্বাচন সাংবিধানিক ও
গণতান্ত্রিকভাবে (পঞ্চদশ সংশোধনী মোতাবেক) হবে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না।’
কিন্তু যেভাবে চলতি কর্মসপ্তাহেরও দ্বিতীয় দিন সারা দেশে পিকেট
ছাড়াই হরতাল হয়েছে (সেটা যতই ঢিলেঢালা হোক), আর যেভাবে শাপলা চত্বরের ‘গণহত্যা’র ইন্টারনেট ছবি সাজিয়ে
হেফাজতে ইসলামের পোস্টার ইত্যাদি আবার দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শিত হচ্ছে, তাতে নির্বিঘেœ পঞ্চদশ সংশোধনী মোতাবেক একতরফা নির্বাচন করে পার পাওয়া মতাসীন জোটের
পে সম্ভব হবে না বলেই মনে করছেন বেশির ভাগ রাজনৈতিক ভাষ্যকার। তাদের মধ্যে একজন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ
আইনজীবী ড. তুহিন মালিক লিখিতভাবে সংশয় প্রকাশ করেছেন যে, সম্ভবত শেখ
হাসিনার নিজেরই সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে মতার লড়াইয়ের ঝুঁকি নেয়ার ইচ্ছা নেই।
তার জন্য অঘোষিত বিকল্প পথ রয়েছে। সেই বিকল্প পথের নীলনকশা ফাঁস করেছেন ড. তুহিন
মালিক। লিখেছেন: ‘জটিল এক সাংবিধানিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর
মতা হস্তান্তর ও মেয়াদ নিয়ে। এতে আছে, সংসদ ভেঙে গেলেও প্রধানমন্ত্রী
ইচ্ছা করলে পরবর্তী কয়েক বছর বা ২০২১ সাল পর্যন্ত মতায় থাকতে পারবেন। আশ্চর্য
হলেও সত্য যে, সংবিধানই তাকে এ মতা দিয়েছে। সংবিধানের ৫৭(৩) অনুচ্ছেদ মতে, প্রধানমন্ত্রীর
উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই
মতায় বহাল থাকবেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর বর্তমান সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ মতে, ‘সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে মেয়াদ অবসানের কারণে
সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার েেত্র ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; তবে শর্ত থাকে যে, এই দফা অনুযায়ী
অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ উক্ত দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত
না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।’ বর্তমান বিশ্বে এ ধরনের নির্বাচন পদ্ধতি একটি বিরল ঘটনা। কেননা এভাবে
তিন মাস আগে নির্বাচিত নতুন এমপিরা আগের এমপিদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপো
করবেন। অর্থাৎ একই সময়ে একই আসনে দু’জন এমপি থাকবেন। শুধু তাই নয়, নির্বাচনের সময় এমনকি
নির্বাচনের পরেও ডিসি, এসপি, ইউএনওরা এ সরকারের অধীনেই থাকবেন। প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বস্তরে
বর্তমান সরকারের লোকজন দিয়েই নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশনেরও তাদের নির্দেশনার
বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। তাই নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকারের পপাত থাকবে
অবশ্যম্ভাবী। অন্য দিকে অন্য কোনো দল নির্বাচনে জয়ী হলেও প্রধানমন্ত্রী মতা না
ছাড়লে করার কিছু থাকবে না, যদি না তিনি স্বেচ্ছায় মতা হস্তান্তর করেন।
‘(অন্য দিকে) সংসদের বিভিন্ন আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে আইনি
বাহাস চলছে নির্বাচন কমিশনে। সরকারি দলের এমপিরাও মন্ত্রীদের দায়ী করছেন এই
সীমানা নিয়ে। সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে
তাকে কেন্দ্র করে কেউ সুপ্রিম কোর্টে মামলা করলে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল আটকে
যেতে পারে। এ জটিলতার কারণে নির্বাচনের ওপর আদালতের স্থিতাবস্থা আসতে পারে। আগামী
বছরের জানুয়ারিতে সংসদের মেয়াদ শেষ হলে সংসদ সদস্যরা না থাকলেও প্রধানমন্ত্রী
যেহেতু থাকবেন, তাই তিনি ওই সময়ে ১০-১৫ জন অনির্বাচিত উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়ে
রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবেন অনায়াসে। এভাবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আগামী কয়েক
বছর বা ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে আদালতের
শরণাপন্ন হলে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ হিসেবে তা
আদালতের বৈধতা পেতে পারে। কেননা তিন মাসের জন্য সাংবিধানিক মেয়াদ নির্ধারণ করা
বিগত ওয়ান-ইলেভেনের সরকারও সেভাবেই বৈধতা পেয়েছে।
যেহেতু আমাদের বর্তমান সংবিধানের কোথাও তত্ত্বাবধায়ক বা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলা নেই, তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে
কোনো কারণে সংলাপ বা গ্রহণযোগ্য কোনো সমঝোতা না হলে নিশ্চিতভাবেই সরকারকে
সাংবিধানিক পদ্ধতিতে যেতে হতে পারে। এ েেত্র সঙ্ঘাত-হানাহানিতে না গিয়ে সরকার
সংবিধানের বিদ্যমান এ বিধানের সুযোগটি নিতে চাইতে পারবে। কেননা ১৯৭৫ সালে তৎকালীন
আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে কোনো ধরনের নির্বাচন ছাড়াই ওই
সময়ের সব সংসদ সদস্যকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত ঘোষণা করে। সেই সাথে
কোনো ধরনের নির্বাচন ছাড়াই আজীবনের জন্য রাষ্ট্রপতি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানকে। সবই তখন করা হয় সংবিধান সংশোধন করেই। তাই অযথা নির্বাচন না করে
বছরের পর বছর মতায় থাকার বিধান যখন পঞ্চদশ সংশোধনীতে করা আছে, তখন সরকার কেনই
বা নির্বাচন দিতে যাবে?
কিন্তু দেশের মানুষ কি নির্বিবাদে শেখ হাসিনাকে পঞ্চদশ সংশোধনীর এই
বাকশালী ফাঁদের ফায়দা তুলতে দেবে?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন