‘ঊর্ধ্বতনদের মাসোহারা দিতেই ঘুষ খাই’ শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে দৈনিক ইত্তেফাকের ৮ জুন সংখ্যায়। ব্যবসায়ীকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত এক পুলিশ কর্মকর্তা ঘুষ খাওয়া প্রসঙ্গে উপরোক্ত বক্তব্য রাখেন। সাম্প্রতিক সময়ে চাহিদা অনুযায়ী ঘুষ দিতে না পারায় ব্যবসায়ীদের হত্যাকা-ের ঘটনায় আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে। ইত্তেফাকের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, সাভার ও সোনারগাঁও থানার হেফাজতে দুই তরুণ ব্যবসায়ীকে শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। পুলিশের চাহিদা অনুযায়ী ঘুষ দিতে না পারায় জীবন দিতে হয় ঐ দুই ব্যবসায়ীকে। এক ব্যবসায়ী হত্যাকা-ে এসআইসহ পাঁচ পুলিশকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপর ব্যবসায়ীর হত্যাকা- ধামাচাপা দেয়ার জন্য চলছে নানা ষড়যন্ত্র। হত্যাকা-ের এসব ঘটনায় একদিকে পুলিশের ইমেজ যেমন ক্ষুণœ হচ্ছে, তেমনি জান-মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা নিয়ে মানুষের মনে সৃষ্টি হচ্ছে আতঙ্ক।
উল্লেখ্য যে, সাভার ও সোনারগাঁও থানায় পুলিশ হেফাজতে খুন হয়েছে তরুণ ব্যবসায়ী শামীম সরকার (৩৪) ও শামীম রেজা (৩৫)। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে এই দুই ব্যবসায়ীকে হত্যা করা
হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এদিকে খোদ রাজধানীতে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক উপ-কমিশনারের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ধরে নিয়ে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ চলে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। অবশেষে গুলশানের এক ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে এক কোটি টাকা আদায়ের ঘটনায় অভিযোগের সত্যতা মেলে। এসব ঘটনা নিয়ে পুলিশ প্রশাসনে এখন তোলপাড়। পুলিশের অভিযুক্ত এক কর্মকর্তা শীর্ষ এক কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে বলে দেন যে, ‘স্যার আপনাদের অর্থাৎ এসপি ও ডিআইজিদের পদে পদে ঘুষ নেয়া বন্ধ করতে হবে। তাহলে থানায়ও ঘুষবাণিজ্য অনেক কমে যাবে।’ এ প্রসঙ্গে এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিমাসে থানা থেকে এসপি ও ডিআইজিদের নির্ধারিত হারে ঘুষের প্যাকেট পৌঁছে দিতে হয়। এই ঘুষ না দিলে সৎ অফিসার হলেও অসৎ অফিসার হিসেবে তার এসিআরএ ঐ কর্মকর্তা উল্লেখ করে দেন। ৯৮ ভাগ থানায় নিরীহ মানুষ কিংবা বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ধরে এনে ঘুষ আদায়ের বাণিজ্য চলে। চেয়ার ঠিক রাখতে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতাকেও ঘুষের ভাগ দিতে হয়। চার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, রাজধানী ঢাকা ও আশপাশে কিংবা চট্টগ্রামে কিছুসংখ্যক থানায় একেক ওসি বদলি হয়ে আসতে এসপি, ডিআইজি এবং শীর্ষ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিতে হয়। একইভাবে কোনো কোনো রেঞ্জের ডিআইজি এবং জেলার এসপি বদলি হতে শীর্ষ প্রশাসনকে উৎকোচ দিতে হয়। আর এ উৎকোচ নেয়ার জন্য শীর্ষ প্রশাসনে ‘বহিরাগত ক্যাশিয়ার’ থাকে। এই ক্যাশিয়ারের কাছে নির্ধারিত উৎকোচ জমা দেয়ার পর তিনি শীর্ষ কর্মকর্তার কাছে গ্রীন সিগন্যাল দেন। কয়েক থানার ওসি ঘুষের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এসপি আর ডিআইজির জন্য ঘুষ আদায়ের ধান্দায় সারা দিন যায়। এতে মামলার তদন্ত ও থানার অন্যান্য কাজ দারুণভাবে ব্যাহত হয়।
দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্টে পুলিশের হাতে ব্যবসায়ী হত্যাকা- প্রসঙ্গে ঘুষের যে চিত্র উঠে আসলো তা শুধু অন্যায় ও বেআইনী নয়, অতিশয় নিষ্ঠুরও বটে। একটি স্বাধীন দেশের পুলিশ প্রশাসনে এমন বেপরোয়াভাবে ঘুষবাণিজ্যের ধারা অব্যাহত থাকে কেমন করে? আর এ ঘুষবাণিজ্যে যদি কোনো পুলিশ অফিসার জড়িত হতে না চায় তাহলে তাকে এসিআর-এর মাধ্যমে অসৎ অফিসার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমন বাস্তবতা শুধু সংশ্লিষ্ট অফিসারের জন্যই নয়, জাতির জন্যও বড় ট্রাজেডি। পুলিশের দায়িত্ব যেখানে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন, সেখানে ঊর্ধ্বতনদের ঘুষের চাহিদা মেটাতে থানায় নিরীহ মানুষ ও বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর চালানো হয় অত্যাচার। লক্ষণীয় বিষয় হলো, থানার ওসিকে চেয়ার ঠিক রাখতে ঊর্ধ্বতন অফিসারদের ঘুষের চাহিদা মেটানোর সাথে সাথে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদেরও ঘুষের ভাগ দিতে হয়। এভাবে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা মিলে ঘুষবাণিজ্যের তৎপরতায় জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে যে আতঙ্কজনক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তাতে সাধারণ মানুষ ও বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের শান্তিতে বসবাসের সুযোগ নেই। এমন দিন বদলের জন্যই কি মানুষ বর্তমান সরকারকে ভোট দিয়েছিল? সরকার তো সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণকে শান্তি-নিরাপত্তা ও উন্নত জীবনমান উপহার দেয়ার ওয়াদা করেছিল। সরকার এ ওয়াদা পালনে ব্যর্থ হয়েছে এবং সরকারের পুলিশ ও সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা বরং জনজীবনে দুর্ভোগের মাত্রা বৃদ্ধিতেই তৎপর রয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্টে সেই দুর্ভোগের যে চিত্র ওঠে এসেছে, তাতে সরকারের ও পুলিশ প্রশাসনের বোধোদয় ঘটবে কি না জানি না। তবে বোধোদয় ঘটলে জাতির সাথে সাথে সরকারেরও মঙ্গল হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন