রবিবার, ২৩ জুন, ২০১৩

স্বদেশ যেন পলাশীর প্রান্তর


২৩ জুন পলাশী বিপর্যয়ের দিন। পলাশী বিপর্যয় একটি ঘটনা বা দুর্ঘটনা নয়, এটা ছিলো ইতিহাসের বাঁক ঘুরানোর একটি দিন। এদিন ইতিহাসের প্রভাব বিস্তারকারী একটি দিন। যে ইতিহাস আমাদেরকে ভাবায়। বারবার পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য করে, যে ইতিহাস আমাদের ভবিষ্যৎ পথ রচনায় হয়ে উঠে বিশ্লেষণের অনিবার্য উপাদান।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার দিন নয়। কারণ এটি কোন যুদ্ধ ছিলো না। এ ছিলো ষড়যন্ত্রের এক কালো থাবা। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দোলা এ ষড়যন্ত্র এবং চরম বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে পরাজিত এবং নিহত হয়েছিলেন। সেদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নবাব সিরাজউদ্দোলাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্যে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। লর্ড ক্লাইভ, উমিচাঁদকে নবাবের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করেন। নবাবের প্রধান সেনাপতি মীরজাফর ছিলেন একজন বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি। নবাব আলীবর্দীর সময় হতেই মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কুখ্যাতি ছিল। এ কারণে তাকে কয়েকবার শাস্তিও পেতে হয়েছে, কিন্তু আলীবর্দীর ভগ্নিপতি ছিলেন বলে বৃদ্ধ নবাব তাকে ক্ষমা করে পুনরায় সেনাপতি পদে বহাল রাখেন। কিন্তু মীরজাফরের স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি। মুর্শিদাবাদের মসনদের প্রতি তার লোভ ছিল। সিংহাসনের লোভে তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যোগ দেন।
ষড়যন্ত্রকারীগণ জগৎশেঠের বাড়িতে গোপন বৈঠক করেন। এই বৈঠকে অংশ নেয়, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, মীরজাফর, রাজবল্লভ এবং আরো কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। ইংরেজ কোম্পানীর এজেন্ট ওয়াটসন গোপনে জগৎশেঠের বাড়িতে এই বৈঠকে মিলিত হয়। বৈঠকেই নবাব সিরাজকে সরিয়ে মীর জাফরকে বাংলার মসনদে বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওয়াটসন এই কাজে ইংরেজদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা এ ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে মীরজাফরকে অপসারিত করেন এবং আব্দুল হাদী খানকে সে পদে নিয়োগ করেন। কিন্তু জগৎশেঠ ও অন্যান্য বিশ্বাসঘাতকদের পরামর্শে নবাব মীরজাফরের বাড়িতে গিয়ে তার নিকট ইরেজদের বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্যে আবেদন জানান। মিরজাফর পবিত্র ধর্মগ্রন্থের নামে অঙ্গীকার করলেন। নবাব তাকে বিশ্বাস করে আবার প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করলেন। বিবেকহীন ও লোভী মীরজাফরকে বিশ্বাস করে নবাব মারাত্মক ভুল করলেন। তিনি মীরজাফরের সাথে আপোষ না করে তাদেরকে বন্দী করলেই সেইদিন তাদের সে ষড়যন্ত্র ধ্বংস হয়ে যেতো।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময়ে বিশ্বাসঘাতকদের সাফল্যের কারণ ছিলো জনসাধারণের মধ্যে দেশাত্মবোধের অভাব। তাছাড়া মীরজাফর, জগৎশেঠ জানতেন যে, তাদের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষ থেকে কোন প্রতিবাদ হবে না। তাছাড়া বিশ্বাসঘাতকতা যে কোন যুগে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। জনসাধারণ শিক্ষিত এবং আত্মসচেতন হলেই যে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করতে সাহস পাবে না তা নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ১৯৪০ সালে নাৎসী জার্মানী যখন নরওয়ের ওপর আক্রমণ করে তখন কুইজলিং নামক এক নরওয়েজিয়ানও হিটলারকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। কুইজলিং শব্দটি এমন মীরজাফরের মত বিশ্বাসঘাতকদের সমার্থক। কুইজলিং যে একজন ব্যক্তির নাম- এ কথাও অনেকে ভুলে গেছে। তবে, কুইজলিং মীরজাফরের মতো তার মসনদে বেশিদিন টিকতে পারেনি। হিটলারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে তার পতন ঘটে।
বিশ্বাসঘাতকতার বহু রূপ থাকতে পারে। একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা তমদ্দুনিক স্বাধীনতা যারা বিকিয়ে দিতে চায় তারাই বিশ্বাসঘাতক। দেশের প্রতি সমাজের প্রতি তাদের আনুগত্য নেই। এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকতার কারণ নানা প্রকারের হতে পারে। কেউ রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের আশায় বিদেশী শক্তিকে দেশে ডেকে নিয়ে আসে। কেউ ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করে মুনাফা লাভের জন্য। এ লোভে পড়ে তারা দেশ ও জাতিকে পরাধীন করতেও দ্বিধা করে না। আবার কেউ নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে বিজাতীয় সংস্কৃতিকে আলিঙ্গন করে। এসব বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছুই নয়। পলাশীর ইতিহাস ব্যর্থতার ইতিহাস। এ ব্যর্থতা নবাব সিরাজের নবাবী হারানোর ব্যর্থতা নয়। সেটা স্বাধীনতা রক্ষার ব্যর্থতা। বাঙালি জাতির জাতিগত ঐতিহাসিক ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতার মূল কারণই হলো একশ্রেণীর মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার ফসল।
জাতীয় ঐক্য ও স্বাধীনতা রক্ষার পবিত্র দায়বোধ সম্পর্কে অসচেতনতা আমাদের ঐতিহ্য ও বিকাশকে কিভাবে কালমালিপ্ত করে সেটা যথার্থভাবে উপলব্ধিই হচ্ছে পলাশীর শিক্ষা। কি কারণে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়েও মাত্র তিন হাজার সৈন্যের কাছে সেদিন নবাব পরাজিত হয়েছিলেন সেটার মূল্যায়নের সময় এসেছে। তা না হলে আজকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের চ্যালেঞ্জকে আমরা স্বচ্ছভাবে অনুধাবন করতে পারব না। সেদিন স্বাধীনতার শত্রুদের স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। এ কারণেই অলক্ষ্যে স্বাধীনতা হারিয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতা সম্পর্কে তদানীন্তন সমাজ ও দেশপ্রেমিকরা নবাবের মৃত্যুকে নিছক ক্ষমতার হাত বদল বলেই ভেবেছিল। নবাবের লাশকে মুর্শিদাবাদের রাস্তায় ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ানো হয়েছিল জনমনে তার প্রতি ঘৃণা এবং অশ্রদ্ধা সঞ্চারের জন্যে। অথচ প্রকৃত সত্যকে জনতার কাছে এবং ইতিহাসের পাতায় তুলে ধরবার জন্যে কোন দায়িত্বশীল কণ্ঠ বা কলম বা নেতৃত্ব তখন পাল্টা পথ করে নিতে ব্যর্থ হয়।
আজও একইভাবে দারিদ্র্যবিমোচন, সেবা ও উন্নয়নের নামে একশ্রেণীর এনজিও আমাদের স্বকীয়তা, স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নতুন জাল বুনতে শুরু করেছে। এরা সেবার নামে হচ্ছে উন্নয়ন সহযোগী। হচ্ছে সরকারী কর্মকা-ের অংশীদার। নানান ফোরাম গঠন করে তারা তখন একটি শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করতে প্রস্তুত হচ্ছে। এদের অপতৎপরতা আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক উন্নতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির বুনিয়াদ, পরিবার ও সমাজ ঐতিহ্যের গৌরব ইত্যাদি ধ্বংসের জন্যে একটি অগ্রসরমান শক্তি। এরা নারীকে পুরুষের বিরুদ্ধে, ধর্মকে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে। তারা সারা দেশে বানিয়েছে বহু ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ, বসিয়েছে অসংখ্য কাশিমবাজার কুঠি। ওরা এখন কৃষ্ণদাস, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভদের চরিত্রে অভিনয় করে। তাদের কারণে আজকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আমাদেরকে দিল্লীর তুষ্টি আর অতুষ্টির হিসাব কষতে হয়। ফলে আজ স্বদেশ যেন পলাশীর প্রান্তর।
দুঃখজনক হলেও সত্য আজো আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে ষড়যন্ত্র হয়। ষড়যন্ত্র হয় জাতিকে খ--বিখ- করে দেয়ার। দেশপ্রেমিক মানুষদেরকে নবাব সিরাজের মতো লাশ বানাতে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নির্যাতন করা হয়। জনগণকে তা বুঝতে দেয়া হয় না। এখন সময়ের কলমও সাহসী ও বস্তুনিষ্ঠতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ। কেবলমাত্র ফরমায়েশী লেখায় ইতিহাসের পাতা আবর্জনার স্তূপ হয়ে পড়েছে। সেই আবর্জনার স্তূপ আর বিভ্রান্তি সরিয়ে প্রকৃত সত্যকে তুলে আনার এবং লিখবার সৎ ও সাহসী কলম বড়ই বিরল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads