আগামী ১৫ জুন বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেটে
একযোগে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। স্থানীয় ও নির্দলীয়
নির্বাচন হলেও ইতোমধ্যে এ নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতির হাওয়া লেগেছে। ১৪ দল ও ১৮ দলীয়
জোট নেমেছে নিজ নিজ জোটের প্রার্থীর প।ে এমপি, মন্ত্রীরাও চার সিটি করপোরেশন
এলাকায় বিধিমালা ভঙ্গ করে বিভিন্ন প্রোগ্রাম করছেন। বিরোধী দলের জাতীয় নেতারাও
বসে নেই। তারাও যাচ্ছেন ভোট চাইতে। তবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা সুযোগ-সুবিধা
পাচ্ছেন বেশি। প্রশাসন, দলীয় ক্যাডার, মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব ও স্থানীয় নেতাদের দাপট ইত্যাদি তারা
ব্যবহার করতে পারছেন দক্ষতার সাথে। ১৮ দলীয় জোটের প্রার্থীরা এ েেত্র পিছিয়ে
আছেন।
এই নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীরা জিতলেও লাভ আর না জিতলেও লাভ।
জিতলে স্থানীয়ভাবে আওয়ামী রাজনীতি আরও শক্তিশালী হবে। আগামী নির্বাচনে প্রশাসনকে
হয়তো শতভাগ কব্জায় রাখা যাবে। পরাজিত হলে তারা এটিকে তাদের ‘দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু
নির্বাচন করা যে সম্ভব’ এর নজির হিসেবে প্রমাণ করার
চেষ্টা করবে। মিডিয়া দিয়ে বলাতে থাকবে, হাসিনার অধীনে শতভাগ নিরপে
নির্বাচন করা সম্ভব। অতএব বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের
দাবি আর জানানোর দরকার নেই।’ বিদেশিদেরও অনেকে
হয়তো সরকারের পে বগল বাজাবে। এই নির্বাচনে সরকারি দলের হার-জিত উভয়ই লাভজনক হলেও
বিরোধী জোটের হার-জিতের মধ্যে কী পাওয়া যাবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। এই সরকারের
আমলে কোনো ইস্যুকে কাজে লাগাতে পারেনি বিরোধী দল। সরকারের দিন যত শেষ হয় তত
বিরোধীদের তেজ বাড়ে, এই দৃশ্য এখন আর দেখা যাচ্ছে না। দিন যত শেষ হচ্ছে সরকারের তেজ ততই
বাড়ছে। এতগুলো ব্যর্থতা তাদের কোনোভাবেই যেন স্পর্শ করছে না।
চার সিটি কপোরেশনের ভোটারদের সামনে এখন বিশাল সুযোগ। তারা এ
নির্বাচনে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে এই সরকারের সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে
পারেন। একটি গণতান্ত্রিক দেশে ব্যালট বা ভোটই হওয়া উচিত অন্যায়ের প্রতিবাদের
অন্যতম ভাষা। যেহেতু এই নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আবহ ধারণ করেছে, সেহেতু ভোটারেরা
জাতীয় বিষয়গুলো মাথায় রেখে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
সরকারের বিরুদ্ধে দুটি হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ খুব জোরে উচ্চারিত হয়েছে।
গত ৫-৬ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার কর্মীর ওপর সরকারি
বাহিনী যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তা এক কথায় নজিরবিহীন ও জঘন্য। ওই রাতে ঠিক কতজন
মানুষ মারা গেছে, তার হিসাব পাওয়া যায়নি। হেফাজতের প থেকে ‘কয়েক হাজার মানুষ’ নিহত হওয়ার দাবি করা হয়েছে। আমরা দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মিডিয়ার
কল্যাণে শাপলা চত্বর ও তার আশপাশে বেশ কিছু লাশ পড়ে থাকার ছবি দেখেছি। আল-জাজিরায়
সরকার কর্তৃক লাশ গুমের রিপোর্টও করা হয়েছে। সরকার এই হত্যাযজ্ঞকে যেভাবেই পাশ
কাটাতে চাক না কেন, সাধারণ মানুষ এতে সন্তুষ্ট নন। হেফাজতের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির ওপর
এভাবে বর্বরোচিত আক্রমণকে বিবেকবান মানুষেরা মেনে নিতে পারছেন না। চার সিটি
করপোরেশনের ভোটারেরাও বিষয়টি মনে রেখেছেন। তারা ভোটের মাধ্যমে এর প্রতিবাদ করতে
পারেন। অপর দিকে, গত ২৮ ফেব্র“য়ারি থেকে মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহে শতাধিক লাশ পড়েছে বাংলাদেশে।
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণা হওয়ার পর এর বিরুদ্ধে বহু
স্থানে জনগণ রাস্তায় নেমে এলে সরকারি বাহিনী তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়।
বিএনপিসহ বিরোধীরা এটিকেও ‘গণহত্যা’ বলে দাবি করেছেন। ওই সময়ে
একদিনেই ৬০ জন মানুষ পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রথম
পুলিশের গুলিতে এত লোকের প্রাণহানি ঘটেছে একইদিনে। যারা ওই সময় নিগ্রহের শিকার
হয়েছেন তাদের ভোটের মাধ্যমে নীরব প্রতিবাদ করা উচিত। গণহত্যার অভিযোগ ছাড়াও গুম-খুনের
ব্যাপক অভিযোগ আছে এই সরকারের বিরুদ্ধে। তন্মধ্যে বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীকে
গুম, গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যা, বিশ্বজিৎ
হত্যাকাণ্ড, নাটোরের বিএনপিদলীয় চেয়ারম্যান বাবুকে পিটিয়ে হত্যা, সাংবাদিক সাগর-রুনির
হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি ছিল টক অব দ্য কান্ট্রি।
মামলা, হামলা আর রিমান্ডÑ এই তিনটি বিষয়ও
বর্তমান সরকারের ইমেজ নষ্ট করেছে। বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা
দিয়ে গণগ্রেফতার চলছে এই আমলে। শুধু তা-ই নয়, রিমান্ডের নামে ভয়াবহ
নির্যাতনের অনেক অভিযোগ আছে পুলিশের বিরুদ্ধে। গ্রেফতারকৃত অবস্থায় আসামিকে পঙ্গু
করা, গুলি করে মারারও অভিযোগ আছে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি দেলাওয়ার
হোসেনকে রিমান্ডে নিতে নিতে পুলিশও হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দেলাওয়ারকে
রিমান্ডে নেয়ার ঘটনা কোনো দিন হয়তো গিনেস বুকেও ঠাঁই পেতে পারে। রিমান্ডে নিয়ে
হেফাজত নেতা মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরীর অবস্থা তো আশঙ্কাজনক করে ফেলা হয়েছে। তার
ওপরও নেমে এসেছিল ভয়াবহ নির্যাতনের খড়গ। বিএনপির চেয়ারপারসন ছাড়া বড়-ছোট সব
নেতাই ‘জেলের ভাত খেয়েছেন’ একাধিকবার। জেল
আর হাসপাতাল বিএনপি নেতাদের বর্তমান ঠিকানাÑ এমন কথাই এখন
বাজারে চালু। জামায়াতের নেতা-কর্মীদের অবস্থা তো আরও খারাপ। তাদের অবর্ণনীয়
দুরবস্থার ফিরিস্তি এখানে তুলে ধরা সম্ভব নয়। ছাত্রলীগের তাণ্ডব যে কত ভয়াবহ তাও
টের পেয়েছে দেশের জনগণ। যেখানে বিরোধী দল সেখানেই তারা চাপাতি, বন্দুক আর লাঠি
নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সারা দেশে হামলা ও নির্যাতনের রেকর্ড করেছে তারা।
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা দ্বিতীয়বারের মতো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
অকুতোভয় সৈনিক ও এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান আজ জেলে আবদ্ধ। রিমান্ডে নিয়ে তার
ওপরও ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছে। মাহমুদুর রহমানের বৃদ্ধা মায়ের বিরুদ্ধে
মামলা হয়েছে। আমার দেশের কয়েক শ’ সাংবাদিক কর্মী
এখন বেকার। পত্রিকার প্রেস খুলে দেয়ার দাবিতে তারা দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। দিগন্ত
টেলিভিশন ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করা হয়েছে অন্যায়ভাবে। দিগন্ত টেলিভিশন বরাবরই
বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও অনুষ্ঠান দিয়ে নিরপেতা বজায় রেখে চলছিল। ইসলামিক টিভি ছিল
প্রোগ্রাম নিয়ে। ইসলামি প্রোগ্রাম ছাড়া ওই টিভির অন্য প্রোগ্রাম তেমন
গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তার পরও সরকার এ দু’টি চ্যানেলের টুঁটি চেপে ধরেছে। ওই দু’ চ্যানেলের
কর্মীরাও আজ বেকার হয়ে অনিশ্চয়তার মুখোমুখি।
ব্যাপক দুর্নীতি
দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে মতায় এলেও এই সরকার দুর্নীতিতে
এখন আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত। এই সার্টিফিকেট বিশ্বব্যাংক দিয়েছে। পদ্মা
সেতু স্বপ্নই রয়ে গেল। মাঝখান থেকে বাংলাদেশের কপালে এঁকে দিয়েছে দুর্নীতির
কলঙ্কতিলক। শেয়ারবাজার, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, রেলওয়ের কালো বিড়াল, ডেসটিনি, গার্মেন্ট শিল্পে
ধস এবং বিভিন্ন খাতে এবং দুর্নীতিতে দেশ এখন পথে বসেছে। ‘ঘরে ঘরে চাকরির বদলে লাশ
পেয়েছি’ এমন কথা ক্ষোভে দুঃখে বলেন
অনেকেই। রানা প্লাজার ঘটনা অবাক করেছে বিশ্বকে। কেউ কেউ এটিকে ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড
বলেছে। কেউ বলেছে ‘গণহত্যা’। বর্তমানে এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে ঘুষের কারবার হয় না। চার
দিকে ব্যাপক চাঁদাবাজি তো আছেই।
নজিরবিহীন মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, লুটতরাজ, শিাঙ্গনে জ্বালাও-পোড়াও, শিকদের মারধর, ভারতের কাছে এ
দেশের স্বার্থ বিকানো, ভারত কর্তৃক নারায়ণগঞ্জে পোর্ট করার টেন্ডার আহ্বানসহ অসংখ্য
অন্যায়ের আমলনামা এখন জনগণের হাতে। তারা এখন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে এর জবাব
ব্যালটের মাধ্যমে দিতে পারে। এর মাধ্যমে তারা জানিয়ে দিতে পারে আগামী জাতীয়
নির্বাচনে কী হতে পারে তার একটি প্রাক-বার্তা। কেউ কেউ বলতে পারেন, যেখানে সুষ্ঠু
নির্বাচন না হওয়ার আশঙ্কা আছে, সেখানে এই ভোটের কোনো দাম নেই? আমরা বলব, জনগণ যদি সত্যিই
ঐক্যবদ্ধভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদে এগিয়ে আসেন, তাহলে অনেক ম্যাকানিজমই বিফল
হতে বাধ্য। শেষ করছি রাসূল সা: একটি হাদিস দিয়ে, ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো অন্যায় দেখে সে যেন তা হাত দিয়ে (সর্বশক্তি) প্রতিহত
করে। যদি তা না পারে তাহলে সে যেন মুখ দিয়ে প্রতিবাদ করে। সে যদি তাও না পারে, তাহলে যেন অন্তর
দিয়ে অন্যায়কে ঘৃণা করে। আর অন্তরে ঘৃণা করা ঈমানের দুর্বলতম অবস্থা।’
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন