বর্তমান সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হই-হই করছে। কী এদের অর্জন? কোনো সজ্জন আছেন
যারা একেবারে লম্বা তালিকা তৈরি করতে পারেন। আমি খেটে খাওয়া পথের মানুষ। আমি
কোদালকে কোদাল ছাড়া আর কোনো নামে ডাকতে শিখিনি। ফলে আমি যখন বিগত পাঁচ বছরের দিকে
ফিরে তাকাই, তখন কেবলই ধু-ধু মরুভূমি দেখি। পদ্মায় পানি নেই, তিস্তায় পানি
নেই। আরো ৫৪ নদী বাঁধের ফাঁসে হাঁসফাঁস করে মরছে। অথচ এ সরকারের কলসি-কানার কী যে
এক আজব প্রেম তারা কেবলই বলে যাচ্ছে, রয়ে গেছে সব।
ভারতীয় ঠগেরা কেবলই মুলো দেখায় কিংবা নাকের ওপর মুলো ঝুলিয়ে দেয়।
ঝুলিয়ে দিক বা না দিক একটি কাজ তারা করেছে তা হলো শেখ হাসিনাকে ২০২১ সাল পর্যন্ত
ক্ষমতায় রেখে বাংলাদেশকে তাদের করায়ত্ত রাষ্ট্রে পরিণত করার ফন্দি-ফিকির
সম্পূর্ণ করে ফেলেছে।
উফ্, কী না করছে এরা। কার্যত বিনা মাশুলে পুরো বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এক
করিডোর পরিকল্পনা করেছে এরা। বাংলাদেশের নদীর প্রবাহ বন্ধ করে সেখান দিয়ে বহু
টনের লরি যাতায়াতের বন্দোবস্ত করেছে। বাংলাদেশ সরকার বলেছে, ‘জানি না তো, কেমন করে এমন হলো’। নদীর দুই পারের লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন পণ্য নিয়ে এসে অবর্ণনীয়
কষ্টে এপার ওপার করেছে। কিন্তু ভারতীয় বিশাল বিশাল পরিবহনযান একেবারে বুক চিতিয়ে
সে পথ ধরে ত্রিপুরা চলে গেছে। মাশুল নেই। নদী আমার, জমিন আমার, পানিরপ্রবাহ
আমার। তার মাঝ খান দিয়ে সেই পানিপ্রবাহ বন্ধ করে কোন দুর্বৃত্তরা চিতিয়ে চলাচল
করল কেউ তা জানতে পারল না।
যে দিন খবর প্রকাশিত হলো, কেউ জানে না যে কে দিলো বাঁধ।
কেউ যদি না-ই জানে, তাহলে তিতাসের বুকে বাঁধ করেন। কেন আমার দেশের মানুষ পণ্য আনা-নেয়ার
জন্য গরুর গাড়ি, ঠেলাগাড়ি, মিন্তি এসব নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভোগান্তির শিকার হবে? কেন আমার জলপথে
আমি চলতে পারব না নির্বিঘ? সব কিছু হাঁসফাঁস। কোথায় যেন
গোপনীয়তা। কোথায় যেন ‘নির্বোধ’ জনগণকে ধোঁকা দেয়ার আয়োজন।
আমার দেশ সম্পাদক নতুন করে জেলে আছেন বছরাধিককালেরও বেশি সময় ধরে।
তিনি ওই বাঁধের পাশে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, এ ভূমি আমার, জমিন আমার, এতে প্রবাহিত
পানি আমার। সেই পানির ওপর দিয়ে চলাচলকারী যানবাহন আমার ও আমার স্বজনের। আসুক আজ
দেখি কে রোখে! তারপর তিনি কোদাল হাতে প্রতীকী প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ওই বাঁধ
নির্মাণের বিরুদ্ধে। এখনকার মাহমুদের সপক্ষে দুর্নীতি দিতে গেলে কত যে কুণ্ঠা। কত
যে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু মনে হয় সেদিন এই নিমুরোদেরা কোথায়
যে ছিলেন। আজ যারা বড় কথা বলছেন তাদের কেউ কি বলতে পারবেন নিজ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব
রক্ষায় ওভাবে জনগণকে উজ্জীবিত করে এক কোদাল মাটি কেটেছিলেন? মাহমুদুর রহমানের
নাম যেন ভাসুরের নাম। না নিতে পারলেই বাঁচোয়া। নাম নিলে যদি মহাভারত তার শুদ্ধতা
হারায়। আমরা এমনই এক শিক্ষাবঞ্চিত, আত্মমর্যাদাবঞ্চিত, সমাজের মানুষ
হিসেবে নিজেদের কুপ্রতিষ্ঠিত করেছি। এবং ধারণা করি ভবিষ্যতের লড়াইগুলোতে সৈন্যসামন্ত
জোগাড় করা বেশ কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ আমরা আমাদের তরুণ শিশুদের ইতিহাস ভুলিয়ে
দিয়েছি। কখনো কখনো মনে হয় কারা এই ইতর, যারা দেশ শাসন করছে, কারা এই ইতর যারা
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে, কারা এই ইতর যারা ফররুখ আহমদের
বদলে শরৎচন্দ্রে কুত্তা-প্রেমকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। কোথায় ফররুখের সাত সাগরের
মাঝি বা পাঞ্জেরি আর কোথায় শরৎচন্দ্রের কুত্তা অতিথি। এভাবেই সত্য ধ্বংস হচ্ছে। ‘সত্যকে আজ হত্যা করে
অত্যাচারীরা খাড়ায়/নাই কিরে কেউ সত্য সাধক বুক খুলে আজ দাঁড়ায়?’
এই সরকারের অপগণ্ড মন্ত্রীরা শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে
সাজিয়েছেন যে, সত্য কী সেটা আমার পরবর্তী প্রজন্ম কিছুতেই জানতে পারবে না। শত শত
বছরের কি ঐতিহাসিক ভিত্তি ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জাতিসত্তা গড়ে উঠেছে।
হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা স্বাধীনতার জন্য সে কী যে অকুতভয় লড়াই
করেছে, সেই ইতিহাস নেই শিশু-কিশোরদের পাঠ্যবইয়ে। হঠাৎ এসব নিম্ন রুচির
প্রায় অশিক্ষিত মন্ত্রীদের এমন কী দায় দাঁড়াল যে এর সবই পরিবর্তন করে ফেললেন? আমার এসএসসি
পুরোটা এবং এইচএসসির অনেকাংশই পাকিস্তান আমলে সম্পন্ন করেছি। পাকিস্তানিরা ভারতের
সাথে এত শত্রুতার সাথেও আমাদের পাঠ্যতালিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতীভূষণ বন্দোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কামিনী রায়, প্রভাত কুমার
মুখোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকের লেখার সাথে কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ, ইসমাইল হোসেন
শিরাজী, আনোয়ারা’র লেখক নজিবর রহমান সাহিত্য রতœ, ড. মুহাম্মদ
শহীদুল্লাহ, কাজী দীন মুহাম্মদ প্রমুখের লেখা পড়েছি। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ দুপিঠই
জানতে পেরেছি। এতে কোনো ক্ষতি হয়নি। অর্থাৎ পাকিস্তানি শাসকেরা শিক্ষাব্যবস্থাকে
ছোট্ট হাঁড়িতে ফেলে মাটিতে পুঁতে আজীবনের জন্য পঙ্গু করে দিতে চাননি। এ দিক থেকে
তাদের খানিকটা সাবাসী দেয়া যেতে পারে। এ জন্য আশা করি আমি পাকিস্তানি দালাল বলে
চিহ্নিত হবো না। তবে কেউ যদি সেভাবে বিচার করতে চায় করুক। ইসমাইল হোসেন শিরাজীর
ভাষায় মৃত্যু পর্যন্ত যাতে বলে যেতে পারি, ‘যাহাকে সত্য বলিয়া বুঝিয়াছি তাহা বলিবই। হয় সত্যের জয় হইবে না
হয় সে চেষ্টায় আমার প্রাণ যাইবে’।
কখনো কখনো মানুষের জীবনে এমন সন্ধিক্ষণ আসে যাকে ক্রান্তিকাল বলতে
হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধে ছিল এমনই এক ক্রান্তিকাল। সব অপ্রস্তুত। সবাই তাকিয়ে আছে
শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে। তিনি যেই ডাক দেবেন সে ডাকে
সাড়া দেবে কোটি মানুষ। সেভাবেই সবাই প্রস্তুত। কিন্তু রাত ৮টার মধ্যে তিনি তার
ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবন খালি করে দিয়েছিলেন। সবাইকে যার যার মতো নিরাপদ
আশ্রয়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সর্বশেষ আ স ম আবদুর রব তার কাছে জানতে
চেয়েছিলেন তিনি (শেখ মুজিবুর রহমান) কী করবেন। শেখ মুজিব বলেছিলেন, তোরা নিরাপদ
আশ্রয়ে চলে যা। আমি আমার ব্যবস্থা করে রেখেছি। সে ব্যবস্থাটা যে কী ২৫ মার্চ মধ্য
রাতে আমরা তা দেখেছি। শেখ মুজিব নিরাপদে পাকিস্তান বাহিনীর সামরিক গাড়িতে চড়ে
তার প্রিয় হোল্ড অল নিয়ে চলে গিয়েছিলেন পাকিস্তান।
সে ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন কেন? তাহলে কী
চেয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, ৭ মার্চের ভাষণে এ কথা সত্য শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলাম যে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির
সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। শেখ মুজিবুর রহমানের এই বাক্যকে চূড়ান্ত বাক্য মেনে নিলে কিংবা
স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে মানলে তাহলে তৎকালীন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের সাথে
তার আলোচনা আগেই ভেঙে যেত। তিনি হয়তো ইয়াহিয়া খানকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, এ কথা না বললে
বাংলাদেশের বামপন্থীরা তার নেতৃত্ব কিছুতেই মানবে না। জেনারেল ইয়াহিয়া খান এই
সত্য উপলব্ধি করেছিলেন। ফলে ২৪ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে
আলোচনা জারি রেখেছিলেন। কিন্তু এ কথাও তো সত্য যে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৮টা
পর্যন্ত টেপ রেকর্ডার নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানের পিছু পিছু
ঘুরেছিলেন। বলেছিলেন, আপনি শুধু একটি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। প্রয়োজন হলে বাজাব, প্রয়োজনে নয়।
জবাবে শেখ মুজিব তাকে বলেছিলেন আমি যদি এই ঘোষণা দেই তাহলে ওরা আমাকে
রাষ্ট্রদ্রোহী বলার সুযোগ পাবে। আমি ওদের সে সুযোগ দিতে চাই না। শুনতে একেবারে
রুব্বান যাত্রার তাজেলের বাবার মতো শোনায়। কিন্তু যে দেশে অনিবার্য যুদ্ধ শুরু
হতে যাচ্ছে সে দেশের ‘মহানায়ক’ শত্রুপক্ষের কাছে ওমন ভাষায়
আত্মসমর্পণ করেছে। এরপর সব কিছু ছত্রখান। কিন্তু যুদ্ধ কি পড়ে থাকে? যে যুদ্ধ
অনিবার্য ছিল তা ঘটেই গেছে। সে জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের প্রয়োজন হয়নি। যুদ্ধ
থেমে থাকেনি। সে যুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষক-জনতা, কামার-কুমার-ক্ষেতমুজর, ডোম-চাড়াল সবাই
অংশ নিয়েছেন। এই যুদ্ধ ব্যক্তি হিসেবে কাকে কী দেবে সে কথা কেউ ভাবেননি। তাদের
লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা। আমাদের রাষ্ট্র আমরাই পরিচালনা করব। ভিন দেশের দাস হবো না।
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদের আলাদা পতাকা আর সীমানা
দিয়েছে, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আমাদের সার্বভৌমত্ব। এখন থেকে ৪২ বছর আগে আমরা
টগবগে তরুণ ছিলাম। বাংলাদেশী জাতির ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন ছিলাম। ফলে যুদ্ধ করে
নতুন প্রজন্মের হাতে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ তুলে দিয়েছি আমানত হিসেবে। আমার
মৃত্যু হবে। আমার সন্তানেরা কি যে চেতনায় একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আমরা
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম সে একই চেতনায় বলীয়ান হয়ে বুলন্দ আওয়াজ
তুলবে : বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। (নাকি অমন চিঁকার মতো গলায় আমার পরবর্তী প্রজন্ম ‘বাংলাদেশ চিরজীবী হোক’ বলবে?)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন