নির্বাচন, পৃথিবীর এ অঞ্চলের তথা বাংলাদেশ নামের এ ভূখণ্ডের অতি পরিচিত একটি
বিষয়। বর্তমান সময়ে কারো মুখে ‘ভোট’ শব্দটি উচ্চারিত হলেই এ দেশের
একজন অন্ধ ব্যক্তিও বোঝেন আসল খেলাটা কী!
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে আমরা ভোট নামের বিষয়টির সাথে
পরিচিত। ইংরেজ শাসনামলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে এ দেশের একশ্রেণীর লোক
ভোট দেয়ার সুযোগ পায়। প্রথমে নিম্ন-প্রাইমারি (দ্বিতীয় শ্রেণী পাস), পরে উচ্চ-প্রাইমারি
(চতুর্থ শ্রেণী পাস) লোকেরাও ভোট দিতে পারতেন। পরে প্রোপার্টি কোয়ালিফিকেশনের (সম্পত্তির
মালিকানা) ভিত্তিতে অর্থাৎ যারা জমিদারকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা দিতেন তারাও
ভোটার হতেন। এরপর স্থানীয়-সরকারের ‘ইউনিয়ন বোর্ড’ চালু করা হলে
সেখানে যারা নিয়মিত বার্ষিক ট্যাক্স দিতেন (সেই সময়ের এক টাকার আট ভাগের এক ভাগ
অর্থাৎ দুই আনা)। পরে এরাও ভোটার হিসেবে গণ্য হতেন। পরে মিউনিসিপ্যালিটি গঠন আইন
জারি হওয়ায় ওই মিউনিসিপালিটিতে যারা ট্যাক্স দিতেন, তারাই ভোটার
হিসেবে তালিকাভুক্ত হতেন। ব্রিটিশ আমলে এভাবেই যোগ্যতার ভিত্তিতে, অনেকটা গোঁজামিল
দিয়েই তদানীন্তন ‘লেজিসলেটিভ কাউন্সিল’ (আইন পরিষদ) নির্বাচনের
ভোটার তালিকা তৈরি করা হতো। ১৯৪৬ সালে ভারত বিভক্তি আইনের মাধ্যমে যে গণভোট হয়, সেখানে অনেকটা
সার্বজনীন ভোটাধিকারের রূপ চলে আসে। প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ উভয়ই ভোটাধিকারের
সুযোগ পান। অবশ্য প্রাপ্তবয়স্কদের সূত্র বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছিল।
এ অঞ্চলের বিগত দেড় শতাব্দীর ভোটের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা
যায়, ভোটার তালিকা তৈরি বা ভোটার চিহ্নিত করার বিষয়টি হচ্ছে নির্বাচনের
প্রথম শর্ত। কারণ ভোটারেরাই হচ্ছেন নির্বাচনী খেলার আসল খেলোয়াড়। বিভিন্ন
নির্বাচনী আইনের প্রতিটিতে, কারা ওই নির্বাচনে ভোটার হতে পারবেন বা হওয়ার যোগ্যতা রাখেন, তার মাপকাঠি
সঙ্গতকারণেই সেখানে সংযুক্ত রয়েছে। নির্বাচনের স্বরূপের ওপর যোগ্য ভোটারদের নিয়ে
ভোটার তালিকা তৈরি বাধ্যতামূলক।
বর্তমানে বাংলাদেশে বেশ কয়েক ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছেÑ সংসদ-সদস্য নির্বাচন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, সিটি করপোরেশন
নির্বাচন, মিউনিসিপ্যালিটি নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন এবং ইউনিয়ন
পরিষদ নির্বাচন।
এ েেত্র বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবিধানে স্থানীয়
সরকারের ধ্যান-ধারণায় প্রতিটি জেলায় জেলায় জেলা পরিষদ গঠনের নির্দেশ রয়েছে।
সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদের মর্মানুযায়ী স্থানীয় সরকারের প্রত্যেকটি স্তরের
কার্যক্রম কেবল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়েই পরিচালিত হওয়ার কথা। কিন্তু কার্যত
তা ৪০ বছরেও হয়নি। আজ পর্যন্ত কোনো সরকার, রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক নেতা; এমনকি যারা সংবিধান
তৈরির কাজ করে নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেনÑ তারাও সংবিধানের এই ধারাগুলো অকার্যকর করার জন্য সরকারে বা বিরোধী
দলে থাকাকালে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেননি। বরং তাদের পোষ্য আমলাদের প্রশাসক বানিয়ে
ওই সব প্রতিষ্ঠান চালিয়ে নেয়াই শ্রেয় বলে মনে করছেন। যত দিন পর্যন্ত স্থানীয়
সরকারের ওই সব প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ সংবিধানের বিধান অনুযায়ী নির্বাচিত
প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালিত করা না যাবে, তত দিন পর্যন্ত আসল
গণতন্ত্রচর্চার ভিত রচিত হবে না, হতে পারে না।
যেহেতু সংবিধানে ‘রিপাবলিক’ শব্দটির বাংলা ‘প্রজাতন্ত্র’ করা হয়েছে, সেহেতু রাজনীতিবিদেরা ও প্রশাসনে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ, ওপর থেকে তৃণমূল
পর্যন্ত প্রত্যেকেই নিজেদের রাজা ভেবে রাজনৈতিক মতা প্রয়োগ ও যাবতীয় কর্মকাণ্ড
চালিয়ে যেতেই অনেক বেশি আগ্রহী। মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও প্রকৃতপে এরা
প্রত্যেকেই রাজার মনমানসিকতা নিয়ে চলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ছোট্ট কথায়
বলতে গেলে বলা যায়, সংবিধান প্রণয়নকারীরা অজ্ঞতাবশত সংবিধানে রাজতন্ত্রের বিষ-বীজ পুঁতে
রেখেছেন। আজ যা রাজতন্ত্রী বৃে পরিণত হয়েছে! কাজেই সংবিধানে বাংলায় লেখা ‘প্রজাতন্ত্র’কে মেরে ফেলে তৎস্থলে ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ বলে উল্লেখ করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা
বিষয়টি নিয়ে একটু ভেবে দেখলে কৃতার্থ হবো।
সব নির্বাচনে ভোটার হওয়ার যোগ্যতার ভিত্তিতে পৃথক পৃথক ভোটার তালিকা
তৈরির বিধান রয়েছে। এমনকি ভোটার তালিকা কিভাবে তৈরি করা হবে সে সম্পর্কে একটি
সাধারণ আইনও রয়েছে।
বাংলাদেশ সংবিধানে ১২২ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্য নির্বাচনে কারা ভোটার
হতে পারবেন, তা বর্ণিত রয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও ওই সংবিধানের বিধান
অনুযায়ী একটি আইন রয়েছে। সংসদ সদস্য নির্বাচনে (Representation of the pepole Order, 1972 -G (P.O. No 155 of
1972)), যা পরে সংসদে আইন হিসেবে গৃহীত
হয়েছে) বাংলাদেশ সংবিধানকে অনেকটা পুনরুল্লেখ করে সেখানেও ভোটার হওয়ার যোগ্যতা
বর্ণিত হয়েছে।
সংসদ-সদস্যদের এই নির্বাচন একটি সামগ্রিক নির্বাচন। বর্তমানে সংসদের ৩০০
সদস্যকে প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকার তালিকাভুক্ত ভোটারেরাই নির্বাচিত করবেন। সেই
মতে, সারা দেশের এই ৩০০ নির্বাচনী এলাকার মাত্র একটি এলাকাতেই
যোগ্যতাসম্পন্ন একজন ভোটার কেবল একবারই তালিকাভুক্ত হতে পারবেন। যেমন ঢাকা-১ নির্বাচনী
এলাকায় বসবাসকারী ভোটার হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি ওই এলাকাতে কেবল একবারই
ভোটার হতে পারবেন। তিনি বাংলাদেশের আর অন্য কোনো নির্বাচনী এলাকায়ই ভোটার হতে
পারবেন না। অর্থাৎ সিঙ্গল এন্টির ভিত্তিতে একজন এক নির্বাচনী এলাকাতে মাত্র একবারই
ভোটার হতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট আইনে সেই বিধানই রয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শুধু সংসদ
সদস্যরাই ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত হবেন। সংসদ সদস্যের নাম তার ব্যালট পেপারে
লিখিত থাকে। কাজেই সেখানে গোপন ভোটের প্রশ্নই আসে না।
প্রত্যেকটি সিটি করপোরেশনের জন্য পৃথক পৃথক আইন রয়েছে। ওই আইনগুলোতে
কারা ভোটার হওয়ার যোগ্যতা রাখেন তা-ও উল্লেখ রয়েছে। এক সিটি করপোরেশনের নির্বাচন
এবং অন্য একটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন এক নয়। কারো যদি বিভিন্ন সিটি করপোরেশনে
ঘরবাড়ি থেকে থাকে অথবা তিনি যদি সেখানে নিজের নামে ট্যাক্স দিয়ে থাকেন, তাহলে সংশ্লিষ্ট
আইনের বিধানানুযায়ী তিনি অবশ্যই ওই সিটি করপোরেশনের ভোটার হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।
তেমনিভাবে ত্রেবিশেষে একজন বাংলাদেশী একাধিক সিটি করপোরেশনে, জেলা পরিষদে, উপজেলা পরিষদে, মিউনিসিপ্যালিটিতে
বা ইউনিয়ন পরিষদে ভোটার থাকতে পারেন এবং সেটাই তার আইনানুগ-অধিকার।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদের মূল বিষয়ই হচ্ছে ‘লোকাল গভর্নমেন্ট ’, যাকে বাংলায় বলা উচিত ছিল ‘স্থানীয় সরকার’। কিন্তু এর বাংলা করার সময় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাকে করা হয়েছে ‘স্থানীয় প্রশাসন’। স্থানীয় সরকারের আলোকে
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান স্থানীয় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হওয়ায়
প্রটোকলে তিনি ওই এলাকার ১ নম্বর ব্যক্তি। প্রশাসনের কোনো উচ্চপদস্থ ব্যক্তি ওই
ইউনিয়ন পরিদর্শনে বা অন্য কোনো কাজে এলে চেয়ারম্যানের ওই চেয়ারটি তার সম্মানে
তার বসার জন্য ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ ওই এলাকার তিনিই সর্বোচ্চ
সম্মানিত ব্যক্তি। সব সরকারি কর্মকর্তার ঊর্ধ্বে তার স্থান। কিন্তু ‘স্থানীয় প্রশাসন’ এর ধ্যান-ধারণায় প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে থানার দারোগার অবস্থানও
ওই চেয়ারম্যানের চেয়ে উঁচুপর্যায়ে বিধায় তার আগমনে চেয়ারম্যানের চেয়ার ওই
দারোগার সম্মানে ছেড়ে দিতে হয়। অর্থাৎ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মান
স্থানীয় প্রশাসনে নিয্ক্তু ব্যক্তিবর্গের নিচে ফেলে দেয়া হয়েছে। অনুরূপ কারণেই
উপজেলা পরিষদকেও কার্যকর করতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকা
সত্ত্বেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে জেলা পরিষদও গঠন করার কোনোরূপ উদ্যোগ আজো
নেয়া হয়নি। তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার এ দেশে ইংল্যান্ডের ধাঁচে স্থানীয় সরকার
কর্মকাণ্ডের সূচনা করে। সে দিক দিয়ে আমাদের সংবিধানের ওই দুটো অনুচ্ছেদ
পর্যালোচনা করলে এটা সুস্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশীরা যে
অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন বা কোনো প্রকার ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদি
কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবেন, তারা নিজেরাই বার্ষিক চাঁদা বা ট্যাক্স দিয়ে একটি ফান্ড গঠন করবেন
এবং সেই ফান্ড তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে ওই অঞ্চলে বসবাসকারী নাগরিক
জনগোষ্ঠীর কল্যাণে উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয়িত হবে। সঙ্গতকারণেই সরকারের প থেকেও
কিছুটা বার্ষিক সহায়তা ওই ফান্ডে আসবে। এটাই ‘লোকাল গভর্নমেন্ট’ বা স্থানীয়
সরকার গঠনের মূল দর্শন।
যদিও ব্রিটিশ সরকার এই দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় দেশের দেশীয়-সম্পদের
বেশির ভাগ (এমনকি তামার একটি পয়সাও রেখে যায়নি) ঝেড়েঝুড়ে তাদের নিজেদের দেশে
নিয়ে গিয়েছিল, তারাও কিন্তু এ দেশের প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে
ধ্বংস করে দিয়ে যায়নি। ওই সব প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ডের
বিরাট প্রভাব স্থানীয় আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অগ্রগতি ও আঞ্চলিক উন্নয়নের ধারা
গতিশীল রেখেছিল। ওই ধারার বদৌলতেই এ অঞ্চলের নির্বাচনের প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের
আস্থা সৃষ্টি হয়। ভোটার হওয়ার যোগ্যতা, ভোট প্রক্রিয়ার পরিচ্ছন্নতা ও
ভোট দেয়ার স্বচ্ছ কাঠামো গড়ে ওঠে।
আমরা স্কুলে পড়ার সময় তদানীন্তন ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচনে শতভাগ
স্বচ্ছতা দেখতে পেয়েছি। যদিও তখন সার্বজনীন ভোটের ধ্যান-ধারণা ভোট প্রক্রিয়ায়
সংযুক্ত হয়নি, তার পরও সীমিত যোগ্যতার ভোটারেরা নির্বিঘেœ প্রার্থীদের সামনেই রিটার্নিং অফিসারের কাছে (যিনি সাধারণত
ম্যাজিস্ট্রেটের মতার অধিকারী সার্কেল অফিসারের দায়িত্বে থাকতেন) প্রার্থীদের নাম
উল্লেখ করে বা আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে ভোট দিতেন। রিটার্নিং অফিসার প্রার্থীর
নামের পাশে দাগ কেটে ভোটটি টুকে রাখতেন। সেভাবে ভোট গণনা করে কে কে নির্বাচিত
হয়েছেন, তিনি তৎণাৎ জানিয়ে দিতেন। ওই ধরনের ভোটে কোনো গোপনীয়তা ছিল না। বরং
স্বচ্ছতা ছিল অনেক, যার কারণে প্রার্থী ও ভোটারের মাঝে কোনো ধরনের মানবিক মূল্যবোধের
হেরফেরও হতো না। নির্বাচন শেষে সবাই এক হয়ে একসাথে ইউনিয়ন বোর্ডের কার্যক্রম
সফলতার দিকে নিয়ে যেতেন। ভোট দেয়ার ও ফলাফল ঘোষণার স্বচ্ছতার কারণে নির্বাচিত
প্রতিনিধি ও পরাজিত প্রার্থীদের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ ও সঙ্ঘাতের ত্রেও তৈরি
হতো না। যা ছিল নির্বাচন ও নির্বাচন-পরবর্তী ভোটার ও প্রার্থীর মধ্যকার সহনশীলতার
এক অভূতপূর্ব উদাহরণ! এক কথায় বলতে গেলে ওই এলাকার
নির্বাচনের প্রার্থীরা নিজেরাই নিজেদের সমাজের একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার
চেষ্টা করতেন। তাদের পরিচিতিটাও সেভাবেই ছিল। ওই স্থানীয় সরকার নির্বাচনই ছিল এ
অঞ্চলের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধি নির্বাচনের অন্যতম ভিত।
এখনো বিশ্বের অনেক অনুন্নত দেশেই নির্বাচন সম্পর্কে জনগণের সুস্পষ্ট
ধারণার অভাব রয়েছে। আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকাকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে
নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা দেয়ার জন্য জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে আমাদের নির্বাচন
কমিশনের অনেক কর্মীকে পাঠিয়েছিলাম। এরা সবাই সেখানে সততা ও কর্মতৎপরতার দৃষ্টান্ত
রেখে কমিশনের জন্য অনেক সুনাম অর্জন করে এনেছিলেন। দণি-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে
নির্বাচন কী, সেটাই সে দেশের জনগণের ধারণার মধ্যে ছিল না। তাদের বিভিন্ন ধরনের লোভ
দেখিয়ে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসতে হতো। এমনকি বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকেও আমাদের
পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোর ভোটারদের অবস্থাও প্রায় একই রকম ছিল। ১৯৯১ সালে
অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনেও ওই সব জেলার জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে হয়েছিল।
আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসে নির্বাচন কমিশনের
অন্য দু’জন কমিশনারসহ ওই সব পার্বত্য জেলায় ভোটারদের প থেকে উত্থাপিত
বিভিন্ন অভিযোগ সরেজমিন পর্যবেণ করতে যাই। ওই অঞ্চলের ভোটার প্রতিনিধিদের সাথে
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে মতবিনিময় করি। তখন আলোচনা সভায় সংশ্লিষ্ট
কর্মকর্তা ও হেডম্যানদের তরফ থেকে এ কথা বলা হয়, সুদীর্ঘ দিনের প্রথা অনুযায়ী
সংশ্লিষ্ট হেডম্যানদের মাধ্যমে অরণ্য অঞ্চলের ভোটারদের সরকারের প থেকে ভোটকেন্দ্রে
এসে ভোট দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। ওই ডাকে সাড়া দিয়ে তারা সপরিবারে ভোটের দিন
ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হোন ও প্রচলিত রীতি মোতাবেক ভোট দিন। তারা ওই রূপ আহ্বানকে ‘রাজার প থেকে আমন্ত্রণ’ বলে গণ্য করে। সে জন্য প্রথানুযায়ী তারা একটা সম্মানী পান। তা ছাড়া
তাদের পরিবারের সদস্যসহ সবাইকে রাজা অর্থাৎ সরকারের তরফ থেকে একবেলা খাবার
ব্যবস্থা করতে হয়।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে আমি তখন তদানীন্তন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে এ
বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করি। তার কাছ থেকে সম্মতি নিয়ে ওই পার্বত্য অঞ্চলের
প্রত্যেক ভোটারের জন্য ৫০ টাকা করে সম্মানী, ভাত, গোশত ও সবজি
দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে প্রত্যেক ভোটার পরিবারকে দুই থেকে আড়াই কেজি করে
প্যাকেটের মধ্যে দেয়ার ব্যবস্থা করি। একটি আলোচনা সভায় এ ঘোষণাটি দেয়ার সাথে
সাথে ওই সরল প্রকৃতির ভোটারদের প্রতিনিধিরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। এর পর এরা আমার
কাছে অঙ্গীকার করেন যে, নির্বাচনের দিন এরা অবশ্যই ওই অঞ্চলের ভোটারসহ সবাইকে ভোটকেন্দ্রে
উপস্থিত করে এদের ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করবেন।
সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই বলতে পারি আমাদের দেশের
জনগণ নির্বাচন সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। কিন্তু রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, নির্বাচন কমিশন ও
নির্বাচন পরিচালনাকারী ব্যক্তিবর্গের সততা এবং নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার
অভাবে বর্তমান সময়ের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে আশানুরূপ গ্রহণযোগ্য ফলাফলের
অভাব পরিলতি হয়। বলতে গেলে এটি অসমীচীন হবে না যে, এ দেশের ভোটারেরা তাদের
ভোটাধিকার প্রয়োগের েেত্র অবশ্যই সততা ও স্বচ্ছতার পে থাকেন। কিন্তু বর্তমান
নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন তাদের (ভোটারদের) এই বিশেষ
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ ও পরিবেশ তৈরি করে দিতে সম
হয়নি। দেশের নির্বাচন কমিশন শুধু নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা নিয়েই বেশি
ব্যতিব্যস্ত থাকে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব স্তরের ভোটারদের প্রাধান্য দিতে
প্রায় অপারগ। যদিও নির্বাচনের আসল খেলোয়াড়ই হচ্ছেন ভোটার। তারা না থাকলে
নির্বাচনে প্রার্থী বা নির্বাচন পরিচালনাকারীদের কর্মকাণ্ডের কোনো অবকাশই থাকে না।
তবে এ কথাও স্মরণযোগ্য, এ দেশে ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও উদাহরণ রয়েছে।
নির্বাচনে ভোটারদের নানা অভিযোগ
১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন, পরে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি
উপনির্বাচন, সিটি করপোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটি ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে
গিয়ে আমার কাছে নি¤œলিখিত অভিযোগ উঠেছিলÑ
প্রতিটি নির্বাচনে ভোটারদের তরফ থেকে একই ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হতো
যেÑ ক. ভোটার তালিকা ঠিক নয়, খ. যোগ্যতাসম্পন্ন অনেকের নামই
ভোটার তালিকায় ওঠেনি, গ. বয়সের গোলমাল, ঘ. বাবা বা স্বামীর নামের গোলমাল, ঙ. ছেলেমেয়ের চেয়ে মা-বাবার
বয়স কম ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভোটার তালিকা তৈরির সংশ্লিষ্ট আইনগুলো আমাদের দেশের প্রোপটে যথেষ্ট
নয়। অনেকটা ধামাধরা ধরনের। কেবল রুটিনমাফিক প্রশাসনিক কাজের জন্য প্রণীত। যারা
দেশের সচেতন মালিক, সংশ্লিষ্ট আইনে তাদের কোনো দায়দায়িত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। অন্য
দিকে তারা যেন প্রশাসনের কৃপার পাত্র। রাজকর্মচারীরা তাদের অনেকটা প্রজা বলেই মনে
করেন।
ভোটারদের দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কে প্রশাসনিক কর্তৃপরে দৃষ্টিভঙ্গি
সম্পূর্ণ নেতিবাচক তথা নেগেটিভ।
যদিও বেশির ভাগ েেত্র নির্বাচন পরিচালনায় সম্পৃক্ত সরকারের
প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের দৃশ্য বা অদৃশ্য নানাবিধ বেআইনি কর্মকাণ্ডের জন্য
ভোটকেন্দ্রে বা নির্বাচনী এলাকায় নানা গোলযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে, কিন্তু কার্যত ওই
সব কর্মকর্তা নিরীহ ভোটারদের ওপর মিথ্যে দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের করণীয় পাশ
কাটিয়ে যান। বেশির ভাগ নির্বাচন পরিচালনাকারীরা চিন্তা-চেতনায়, মাঠপর্যায়ের
কর্মকাণ্ডে দৃশ্যতই মনে করেন নির্বাচনটা তাদের, ভোটাররা শুধু উপল মাত্র।
অনুরূপভাবে মতাসীন সরকারের নেতানেত্রী ও কর্মীরাও ধারণা পোষণ করেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের
দায়িত্ব সরকারের। তাদের ইচ্ছানুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা ও ফল ঘোষণা করতে হবে।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাও মনে করেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের
দায়দায়িত্ব এককভাবে তাদের অর্থাৎ নির্বাচনটাই তাদের। ভোটারদের কোনোভাবেই
নির্বাচন পরিচালনায় সম্পৃক্ত করতে এরা চান না; যদিও নির্বাচনের আসল খেলোয়াড়
ভোটারেরাই। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কেবল উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে ধোয়া তোলেন যে, নিরপে ব্যক্তি
ছাড়া কোনো আইনসিদ্ধ সুস্থ নির্বাচন সম্ভব নয়। এরা প্রায় বুঝতেই চান না, স্বাধীন
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কোনো নাগরিকই নিরপে নয়। রাষ্ট্রপতি, নির্বাচন কমিশনার, রিটার্নিং অফিসার, প্রিজাইডিং
অফিসার, পুলিং অফিসার ও আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সদস্যরা সবাই প্রাথমিকভাবে
দেশের নাগরিক হয়েছেন বলেই নিজ নিজ স্থলে বা পদে থেকে দায়িত্ব পালনে সম হয়েছেন।
এরাও ভোটার। এদেরও পছন্দ করার অধিকার রয়েছে। এরা সবাইকে ভোট দেন না। বিশেষ বিশেষ
প্রতীকের প্রতি ঝোঁক থাকার নাগরিক অধিকার তাদের রয়েছে। সেই দিক দিয়ে মানসিকভাবে
কেউ নিরপে নয়। গণতান্ত্রিক চর্চায় এটিই স্বাভাবিক। সেখানেই গণতন্ত্রের সুন্দর
রূপটি নিহিত রয়েছে। কাজেই তাদের নিয়ে নির্বাচনে নিরপেতা বজায় রাখার চিন্তাটি
বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ব্যক্তিনিরপেতা অসম্ভব, তবে নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে
নিরপে করা শত ভাগ সম্ভব। বেশির ভাগ েেত্র সন্ত্রাসীরা রাতের আঁধারের সুযোগে
ভোটকেন্দ্রে গোলযোগ সৃষ্টি করে ভোট কারচুপির সুযোগ করে দেয়। কেন্দ্রে ভোট গণনার
সময় অনেক েেত্রই পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা যায় না; তা ছাড়া কোনো
গোলযোগকারী ইচ্ছা করে আলো নিভিয়ে দিয়েও গোলযোগ সৃষ্টি করে থাকে। ভোটকেন্দ্রে
ভোটগ্রহণ ও গণনার যে সময় নির্ধারণ করা হয় তাতে করে প্রায় েেত্রই সন্ধ্যার পর
অথবা রাত্রিতে ভোটগণনার কাজটি শুরু করতে হয়। সে েেত্র ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও
গণনাকারীরা নিশ্চিন্ত মনে কাজটি করতে পারেন না। নির্বাচনের সবচেয়ে জরুরি বিষয়টি
হচ্ছে সঠিকভাবে ভোট গুণে ফলাফল ঘোষণা করা। সেই কাজটি বর্তমান বাংলাদেশের প্রোপটে
রাতের আঁধারে করতে যাওয়া মোটেই সমীচীন নয়। নির্বাচনের ব্যয় কমানো এবং তারই সাথে
লোকবল কমানোর প্রশ্ন তুলে প্রায় েেত্রই কয়েক হাজার ভোটারদের জন্য একটি কেন্দ্র
নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। অনেক েেত্রই ভোটগ্রহণ শেষ করা ও গণনা করা গভীর রাত
পর্যন্ত চলে। সেটিও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যাঘাত ঘটায়।
আরেকটি জরুরি বিষয়Ñ যেহেতু
প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার স্থানীয় থাকেন না, সেহেতু এরা
কেন্দ্রে ভোটারদের চেনেন না। পোলিং এজেন্টদের ভোটার শনাক্ত করার ওপর তাদের নির্ভর
করতে হয়। পোলিং এজেন্টদের মধ্যেও একটি অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। কোনো মূলপ্রার্থীর
সপে সহযোগী হিসেবে বেশ কিছু প্রার্থী দাঁড় করানো হয়; এরা সবাই মিলে
পোলিং এজেন্টদের নিয়োগ দিয়ে কেন্দ্রে জাল ভোট দেয়ার সুযোগ করে দেয়। যেমন : কোনো
জাল ভোটদাতাকে বেশির ভাগ পোলিং এজেন্ট বলেন সে সঠিক ভোটার, আসলে সে সঠিক
নয়। কোনো বিশেষ প্রার্থী অর্থ দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীকে ওই প্রার্থীর পে
কাজ করার জন্য প্রভাবিত করে ফেলেন। দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও
অনেকে ভোট দিতে পারেন না। ভোটকেন্দ্র যে এলাকায় অবস্থিত সে এলাকাবাসীর একটি
প্রভাব ভোটকেন্দ্রে সব সময়ই থাকে। বাংলাদেশের প্রোপটে এক ভোটকেন্দ্রের আওতায়
বিভিন্ন এলাকা, মহল্লা ও গ্রামের ভোটারদের মাঝেও রেষারেষি থাকে। সে জন্য অনেকে ওই
ভোটকেন্দ্রে ভোট দেয়া নিরাপদ বলে মনে করেন না। অনেক েেত্রই এসব ভোটার ভোট দিতে
উৎসাহিত হন না। ভোটগ্রহণ, ভোট গণনাসহ প্রতিটি পদে পদে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস প্রকটভাবে
পরিলতি হয়।
দীর্ঘ দিন ধরেই লোকজনকে দলীয়করণের মাধ্যমে প্রভাবিত করে ফেলা
হয়েছে। সেহেতু ওই সব লোকের সহায়তায় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কোনো নির্বাচন
অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই দলীয় প্রভাবমুক্ত প্রশাসন দিয়ে
কোনো নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান প্রোপট চিন্তা করলে ভবিষ্যতে এ ব্যাপারটি
আরও প্রকট হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে হয়। রাজনৈতিক সূত্র
ধরে সরকারি কর্মকর্তাদের ওএসডি করা কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলি করা, প্রমোশন আটকিয়ে
রাখা বা প্রমোশন দেয়া ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের অনেকটা পরোভাবে রাজনৈতিক কর্মী
হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এই উগ্র দলীয়করণের প্রভাব থেকে সরকারি-বেসরকারি
কর্মকর্তাদের প্রভাবমুক্ত করা মোটেই সম্ভব নয়। কারণ এর সাথে উগ্র ব্যক্তিস্বার্থ
উদ্ধার ও অবৈধ অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ সংযুক্ত রয়েছে। প্রিজাইডিং ও পুলিং অফিসারেরা
অনেক েেত্রই স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তির মাধ্যমে মানসিক চাপে থাকেন।
স্থানীয় ভোটারেরা চোখের সামনে ভোট কারচুপি হতে দেখেও অসহায় বোধ করেন। এরা
রাজনীতি সম্পর্কে অত্যন্ত কদর্য এবং বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে থাকেন। বাংলাদেশের
রাজনৈতিক-সামাজিক প্রোপটে বর্তমানে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাধ্যমে
কোনো সরকারের আমলেই, তা রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সরকারই হোক না কেন, সুষ্ঠু নিরপে
নির্বাচন করা সম্ভবপর নয়। এর কারণগুলো নি¤œরূপÑ
ক. ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭২ সালের প্রেসিডেন্টের ৯ নম্বর আদেশের মাধ্যমে
ওএসডি সংস্কৃতি শুরু হয়। দর্শন ছিল ‘যাকে দেখতে নারী তার চলন বাঁকা’। তখন থেকেই সরকারি ও আধাসরকারি কর্মচারীদের রাজনৈতিক সরকারের প্রতি
আস্থার ধস নামে। বিগত সব সরকার, তথা সামরিক সরকারসহ, মতায় এসে কোনোরূপ যুক্তি ছাড়াই যত্রতত্র ওই অস্ত্রের ব্যবহার করায়’ বলতে গেলে প্রায় সব কর্মচারীই তাদের সততা বজায় রেখে কর্মদতা
বাড়ানোর স্পৃহা হারিয়ে ফেলেন এবং কেবল ‘কর্তা বুঝে কর্ম, করার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এই ভাইরাস সরকারি, বেসরকারি তথা
সর্বস্তরের কর্মচারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। দ্রব্যমূল্যের অস্থিরতা ও ঊর্ধ্বগতি
তাদের দুর্নীতিপরায়ণ হতে উৎসাহ জোগাচ্ছে। সব স্তরে দুর্নীতি জ্যামিতিক হারে বেড়ে
চলেছে। সততা প্রায় মৃত। কর্মোদ্যম ম্রিয়মাণ।
খ. বর্তমান আমলাদের মধ্যে বিএনপি আমলে যারা ওএসডি ছিলেন বা প্রমোশন
পাননি বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থার শিকার হয়েছিলেন, তারা আওয়ামী লীগ আমলে
পুনর্বাসিত হয়েছেন এবং যারা নতুন চাকরি পেয়েছেন সবাই সঙ্গতকারণেই পলিটিক্যালি
সারচার্জড (দলীয় রাজনৈতিক আবহে বিশেষভাবে প্রভাবিত)। ওই সব কর্মচারীকে বলার
প্রয়োজন নেই যে, নির্বাচনে তাদের পে কাজ করতে হবে। এরা নিজেদের পেটের দায়েই দলের
স্বার্থে নির্বাচনে যেকোনোরূপ কারচুপি করতে দ্বিধাবোধ করবে না বা করতে পারে না।
এরা রাখঢাক না করে অত্যন্ত নগ্নভাবেই কারচুপির আশ্রয় নেবে। মেরেপিটেও তাদের রোখা
যাবে না। এ সময় নির্দলীয় সরকার থাকলে হয়তো বা কিছুটা রাখঢাক থাকবে। কিন্তু
দলীয় সরকার থাকলে কারচুপির জন্য হবে পোয়াবারো।
গ. নির্বাচনের সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ইতোমধ্যে যে
মনমানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠেছেন। তাতে করে গুলির বা ফাঁসির আইন করেও তাদের মাঝে সততা
ফিরিয়ে আনা যাবে না। ১৯৯১ সালে আমার প্রস্তাবেই প্রণীত ‘নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ
বিধান আইন, ১৯৯১’ প্রয়োগ করেও ‘মাগুরার নির্বাচন’কে প্রশ্নবিদ্ধের ঊর্ধ্বে
রাখতে পারিনি। এ দেশের আমলারা তাদের মাথার ওপর অন্য কেউ লাঠি ঘুরাক, তা কোনো দিনই হতে
দেবে না। এরা মগডালের নিনি বরইটিও খাবে, আবার মাটিতে যেটি ঝরে পড়বে, সেটিও কুড়িয়ে
নেবে। অন্য কাউকেই ধরতে দেবে না।
বাংলাদেশ সংবিধানে অনর্থক ‘রিপাবলিক’ শব্দটি ঢুকিয়ে যেমন একটি
মৌলিক সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছে, তেমনিভাবে ‘রিপাবলিক’-এর বাংলা ‘প্রজাতন্ত্র’ করে সমগ্র জাতির মাঝে ‘রাজা-প্রজার’ সম্পর্কের বীজ বপন করে আরও বড়
সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এটার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। গ্রিক রাজনৈতিক দর্শনের ‘দার্শনিক রাজার’ ধ্যান-ধারণা বর্তমান বিশ্বকাঠামোতে অচল। সাদামাটা ‘ডেমোক্র্যাটিক বাংলাদেশ’ এবং বাংলায় ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ বলাই যথেষ্ট ছিল।
সেই সুবাদে আজ এখানে রাজতন্ত্রের বীজ পুনঃঅঙ্কুরিত হয়ে ধীরে ধীরে মহীরুহে পরিণত
হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সিভিল-সার্ভেন্ট ও তাদের সহযোগীরা মনে করে চলেছেন, তারা নিজ নিজ
কর্মকাণ্ড পরিচালনায় প্রত্যেকেই ‘রাজা’। সেভাবেই এরা অন্যদের প্রতি আচার-আচরণ করে চলেছেন। একবারও মনে করছেন
না ‘রাজনীতি’ রাজার নীতি নয়। এটি ‘নীতির রাজার’ সমাহার। সুনীতির
ব্যবহারকারীরাই রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে টেলিস্কোপ
মাইক্রোস্কোপের সাহায্য নিলেও ওই সুনীতির রাজনীতিবিদ খুঁজে পাওয়া বড়ই দুষ্কর।
ঘ. অনেকেই অপরিপক্ব ধ্যান-ধারণায় নিছক আনুমানিক ভিত্তিতে মনে করেন
খুব কড়া কড়া আইন করে নির্বাচন কমিশনকে সব মতা দিয়ে দিলেই সুষ্ঠু নির্বাচন
অনুষ্ঠিত হবে। এরূপ চিন্তার কোনো ভিত্তি নেই। এটি একটা অলীক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই
নয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন