বুধবার, ৫ জুন, ২০১৩

এমন বাণিজ্য চলতে পারে না


বাণিজ্য বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটি সম্মানের বিষয়ও বটে। পবিত্র ধর্ম ইসলামেও বাণিজ্যকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং যারা সৎভাবে বাণিজ্য করে তাদের জন্য পরকালে বিশেষ সম্মানের স্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে বাণিজ্যের যে চেহারা, তাতে জনমনে শঙ্কার সাথে সাথে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্নও। তবে এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, বাণিজ্যের কারণে আমাদের দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে এবং অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করেছে। সাধারণভাবে আমাদের বাণিজ্য ও বণিকদের ব্যাপারে জনগণের ধারণা খুব একটা ভালো নয়। এমন অবস্থায় দেশে শুরু হয়েছে আরেক বাণিজ্য, যার নাম গ্রেফতার বাণিজ্য।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বর্তমানে ‘অজ্ঞাত’ আসামি নিয়ে চলছে পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্য। সহিংসতা ও রাজনৈতিক মামলাকে ঘিরে গত কয়েক মাসে এ বাণিজ্য ব্যাপকহারে বেড়েছে সারা দেশে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রেফতার বাণিজ্য ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। অজ্ঞাত আসামি হিসেবে টার্গেট করা হচ্ছে এলাকার অবস্থাপন্ন পরিবারের সদস্য, ব্যবসায়ী এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের। এদের আটকের পর রাজনৈতিক মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে পুলিশ। অর্থাৎ আটকের পর গ্রেফতার না দেখিয়ে, আদালতে চালান না দিয়ে, থানা থেকে বড় অংক আদায় করে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সব জেলার বেশির ভাগ উপজেলায়ই নতুন করে ধরপাকড় শুরু করেছে পুলিশ। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক মামলাগুলোকে পুলিশ এখন ব্যবহার করছে টাকা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে। এ কারণে মামলার মূল আসামীদের চাইতেও এখন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘অজ্ঞাত’ আসামীরা। এতে সাধারণ মানুষ চরম হয়রানির শিকার হচ্ছে। পুলিশের এমন গ্রেফতার অভিযানে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে পুলিশের ওপর গ্রামবাসীর হামলার এটি একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। উল্লেখ্য যে, ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর থেকে ২০ জেলায় দেড় শতাধিক মামলায় প্রায় ২ লাখ মানুষকে আসামী করা হয়। এর মধ্যে নাম উল্লেখ আছে প্রায় সাড়ে চার হাজার জনের মাত্র। আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি পুলিশের সোর্স নামধারী চক্র ও থানাকেন্দ্রিক দালালরা চষে বেড়াচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আসামী করার হুমকি দিয়ে তারা টাকা আদায় করছে, আবার টাকা না পেয়ে নাম ঢুকিয়ে দিচ্ছে আসামীদের তালিকায়। ক্ষেত্র বিশেষে নেয়া হচ্ছে ব্যক্তিগত শত্রুতার বদলাও। জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে এসব আসামীর তালিকায়। পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন স্থানে শাসক দলের তৃণমূল নেতারা পুলিশের কাছে আসামীদের তালিকা দিচ্ছেন। এছাড়া আসামী শনাক্ত করার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাদের উপর নির্ভর করছে পুলিশ। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক শত্রুতার শিকার হচ্ছে মানুষ।
সুশাসনের অভাবে এখন দেশ জুড়ে গ্রেফতার বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে যেসব তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা দেশের পরিস্থিতিকে আরো অস্থির করে তুলতে পারে। এমনিতে অনেক ক্ষেত্রে সরকারি দলের ঠ্যাঙ্গানো বাহিনীতে পরিণত হওয়ায় পুলিশের ভাবমর্যাদা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। আর এখন যে হারে দেশজুড়ে গ্রেফতার-বাণিজ্যের কারণে সাধারণ মানুষ জুলুম-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তাতে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক জায়গায় পুলিশের ওপর জনগণের সহিংস আচরণে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা গেছে। এমন পরিস্থিতি কোনো গণতান্ত্রিক দেশে চলতে পারে না; যে বিষয় আইনসম্মত নয় এবং যাতে জনদুর্ভোগ বাড়ে, জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়, তা নিবারণের দায়িত্ব তো সরকারের। তবে ট্র্যাজেডি হলো, অনাকাক্সিক্ষত ঐসব কর্মকা-ের সাথে সরকার ও সরকারি দলের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি জড়িত। সরকার আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজের ভুল শুধরানোর উদ্যোগ নিলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে। সরকারের মধ্যে তেমন শুভবুদ্ধির উদয় হয় কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads