বিনয়ের অবতার শেখ শাদিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এত বিনয় ও আদব তিনি কোথায় শিখলেন। জবাবে বলেছিলেন, বেয়াদবের কাছে আদব শিখেছেন, দুর্বিনীতের কাছে শিখেছেন বিনয়। অথচ আমরা বেয়াদবের কাছ থেকে আরো বেশি মাত্রার সবক নিচ্ছি। পারস্যের এই কবি সম্রাট বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে আমাদের জন্য দরদমাখা দুঃখবোধ নিয়ে বিস্ময়ের সাথে তাকাতেন। জীবিত নেই নীতিবাগীশ ইশবও। আরেক নীতিনিষ্ঠ জ্ঞানের সবকদাতা কাউন্ট লিউ তলন্তয়ও পরলোক গমন করেছেন অনেক আগেই। এখন সবাই ধর্ম ও নীতি মানার ভান করেন, মানেন না। অনেকেই নসিহত করেন, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি না করার জন্য। তারাই আবার ধর্ম নিয়ে শুধু রাজনীতি করেন না, রীতিমতো ধর্ম নিয়ে ব্যবসায় নেমে পড়েছেন। দেশের আলেম-ওলামা পীর-মাশায়েখদের ধর্ম শেখাচ্ছেন তারাই। ফল দাঁড়িয়েছে বকধার্মিক, অধার্মিক ও অসাম্প্রদায়িক চৈতন্যের ফেরিওয়ালাদের সাম্প্রদায়িকতা চিহ্নিত করা সহজ হয়েছে; কিন্তু দেশ ভরে গেছে নোংরামিতে।
এখন সংসদে ও রাজনীতির অঙ্গনে সুবচন নির্বাসনে চলে গেছে। সর্বত্র নোংরা কথার দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের উপরিকাঠামোর মানুষেরা মূল্যবোধের আকালে পড়েছে। যিনি যত বেশি ক্ষমতাবান তিনি ততই দুর্বিনীত। যিনি যত বড় পদবির অধিকারী তার মুখ থেকে ততই কুৎসিত অশ্রাব্য ও কটুভাষার বাণী নিঃসরণ হতে দেখছি। সাধারণ মানুষ হতবাক ও বিস্ময়ে দেখছে, দেশের প্রধান নীতিনির্ধারক ও ভিন্নমতের সম্মানিত লোকদের অসম্মান করছেন, সর্বত্র সম্মানিত লোকেরা অসম্মানিত হচ্ছেন। মুই কার খালু, সুদখোর, কেয়া হনুরে, রাবিশ-বোগাস এসব ভাষা মহারথীদের মুখ থেকে নিঃসৃত হয়। প্রতিপক্ষকে যুক্তি ও তথ্য দিয়ে কাবু করার চেয়ে অশালীন, অশ্লীল ও অশ্রাব্য ভাষায় বধ করার জন্য সংসদ এখন নজিরবিহীন অবস্থানে পৌঁছে গেছে। সবাই আশা করছেন, গলাবাজি ও ঠোঁটের জোরে জয় পাবেন। অথচ জিহ্বা ও ঠোঁটের সংযমই সংযত হওয়ার প্রথম সবক। এই সবক কেউ মানছেন না। আমরা জানি না এভাবে সুবচনকে নির্বাসনে পাঠিয়ে নোংরামিকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে কার লাভ হচ্ছে। সাধারণ মানুষ বলছে কিংবা বলতে বাধ্য হচ্ছেÑ হে ধরণী দ্বিধা হও। কবিরা অনেক আগেই বলেছেনÑ হে পৃথিবী নিরাময় হও, কিন্তু হচ্ছে না। ধর্মে আছে, কোনো জাতির নেতা ও ক্ষমতাবানেরা যখন শ্লীল-অশ্লীল ভাবনা থেকে সরে যায় তখন গজব অনিবার্য হয়ে যায়। আমরা কি শালীনতা বর্জনের দায় থেকে জন্ম নেয়া গজবের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি? দেশে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, কেউ কারো সম্মান ও সম্ভ্রমের তোয়াক্কা করছে না। এ অবস্থাটা সাধারণের মধ্যে এখনো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে না পড়লেও নেতানেত্রী ও মন্ত্রীদের মধ্যে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের সংসদীয় ভাষা তো দূষিত হয়ে পড়েছে। সঙ্গত কারণেই বলতে হচ্ছেÑ হে বাংলাদেশ, নিরাময় হও।
সংসদে নারীর ক্ষমতায়নের নামে নারীরা এবার আদিম সুরতে যা দেখালেন তাতে কৃষক-মজুর-খেটে খাওয়া মানুষ নিজেদেরকে গরিব ভাবলেও ভদ্র ভাবতে পারছেন। দরিদ্র হলেও নিজেদেরকে রুচিবান ও সুশীল হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন, ক্ষমতাহীন হলেও নিজেদেরকে মনোদৈহিক দিক থেকে বিকারগ্রস্ত কিংবা বিকলাঙ্গ না ভেবে সৌভাগ্যবান ও সুস্থ হিসেবে পাচ্ছেন। কথা দিয়ে কথার মোকাবেলা, যুক্তি দিয়ে যুক্তির জবাব দেয়া, বুদ্ধি দিয়ে বুদ্ধির মোকাবেলা সব যুগেই স্বীকৃত পন্থা। রাজনীতির বাইরেও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় হার-জিতের খেলা পুরনো।
ইতিহাসখ্যাত বীরবল, গোপাল ভাঁড়, নাসিরউদ্দিন হোজ্জা ও ভানু চক্রবর্তীদের বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ ছিল। অশ্লীল বক্তব্যও শ্লীলতার প্রলেপ পরিয়ে পরিবেশন করতেন। তীর্যক বাক্যবাণও যুক্তি ও শ্লীলতার সীমা অতিক্রম করত না। যুক্তি ও কথার মারপ্যাঁচে তারা ভাঁড়ামি করলেও একটা নৈতিক বাঁধন মেনে চলতেন। আমাদের সুশীল রাজনীতিবিদেরা যেন সেই কাতারেও নেই। সেই মানেও নেই। তারা রুচিহীনতার মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। তাই আবার বলছিÑ হে দয়াময়, বাংলাদেশকে এই মহামারী থেকে নিরাময় দাও।
অসংযত ও নোংরা আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে আমাদের দেউলে করার জন্য। অযোগ্য লোকেরা এখন ক্ষমতাধর। যার যে যোগ্যতা নেই তাকে সেই দায়িত্ব দেয়ার কারণেই পরিস্থিতি এ পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিযুক্ত হন দলীয় ক্যাডার ভাবনা থেকে; শিক্ষা, প্রজ্ঞা, মনীষা ও মানবীয় গুণাবলির বিচারে নয়। তাদের মুখে ঘৃণার ওয়াক থু ছিটালেও চেয়ার ছাড়েন না। ছাত্ররা রক্ত দিয়ে আল্পনা এঁকে সরে যাওয়ার তাড়া দিলেও সরে দাঁড়ান না। শিক্ষক ছাত্রীর ধর্ষক, বিচার হয় না। দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী দেশপ্রেমের সনদ পান; দুদক দেয় কিন হওয়ার সার্টিফিকেট। টেন্ডার বাজ হন ছাত্রনেতা। চাঁদাবাজ হন জাতির নেতা। এই আমলে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিললÑ যিনি কিনা নির্লজ্জের মতো কথা বলেন, জাজ্বল্যমান সত্যকে আড়াল করেন। এমন বিচারপতি পাওয়া গেলÑ সম্মান লুণ্ঠনের প্রতিযোগিতাই যার নেশা। এমন দুদক চেয়ারম্যান পেলামÑ যিনি শুধু অথর্ব ও মেরুদণ্ডহীনই নন, নিজের ব্যর্থতাকেও উপভোগ করতে ভালোবাসেন। মাছের মতো আমাদের পচনটাও মাথা থেকে শুরু হয়েছে। নয়তো রাজনীতিবিদেরা এতটা পরোয়াহীন, নির্লজ্জ ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠতেন না। ক্ষমতার রাজনীতির প্রতি মোহ অনেকেরই থাকে। ক্ষমতার চার পাশে সুবিধাবাদীর জন্ম নেয়াও স্বাভাবিক। দুর্নীতির প্রসারও একটা সীমা পর্যন্ত মেনে নেয়ার গরজ থাকে। কিন্তু অশ্লীলতা মানতে হবে কেন? শালীনতা পরিহার করতে হবে কার স্বার্থে? সংসদে অসংসদীয় বক্তব্য দিয়ে পরিস্থিতি এভাবে উত্তপ্ত করা হবে কেন? আমরা ভালো করে জানি, গানের লোক আইনপ্রণেতা হয়ে গেছেন। যিনি আইনের ভাষা বুঝবেন না, তিনি সংসদীয় আচরণ করবেন কিভাবে। নাটকের লোক তো সংলাপ বোঝবেন, আইনের মারপ্যাঁচ জানবেন কিভাবে। সিনেমার লোক তো সংসদীয় আঙিনায় ঠাঁই পাওয়ারই কথা ছিল না। কলেজের সীমা অতিক্রম করেননি, এমন মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী বডিতে ঠাঁই পেয়েছেন। অর্থনীতি বোঝেন না, শুধু দলীয় ক্যাডার হওয়ার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালক বানিয়ে দিলে ব্যাংক লুণ্ঠন ঠেকাবে কে? তারা তো ঠগবাজের মতো চাণক্য আর কৌটিল্য শাস্ত্রের পাণ্ডিত্য দেখিয়ে পার পেতে চাইবেনই। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে অযোগ্য লোক বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা জনগণের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। তাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে দুর্নীতি, অনিয়ম হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে। সুশাসনের পরিবর্তে দুঃশাসন, নিয়মের পরিবর্তে অনিয়ম, বিচারের নামে অবিচার দেশ-জাতিকে গ্রাস করে বসে আছে।
যেদিন মধ্যরাতের টিভি টকশোকে সিঁধেল চুরির সাথে তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করলেন, সেদিন বুঝেছিলাম এ জাতির কপালে অনেক দুঃখ আছে। স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। সরকার সমালোচনা ও ভিন্নমত মোটেও সহ্য করবে না। গণতন্ত্রের কথা বলবে, মানবে না। ভিন্নমত দমন করতে দ্বিধা করবে না। আইনের শাসন শিকায় উঠবে। বাস্তবে ঘটল তাই। এখন পাণ্ডব দল টকশোর উপস্থাপক ও অথিতিদের দাবড়ানোর দিকেও নজর দিয়েছে। যদিও শেষ বেলায় বিরোধী দলকে সীমিত আকারে সহ্য করতে হচ্ছে। এটাও করা হচ্ছে শুধুই আতঙ্কিত হওয়ার মতো ভবিষ্যতের কথা ভেবেই। সবারই স্বীকার করা বোধ করি জরুরি হয়ে পড়েছে যে, সাধারণ মানুষের মন বোঝার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। বেশ ক’টি জরিপ আগাম সতর্ক বার্তা দিয়েছে। কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফলও পরিস্থিতি বোঝার মতো প্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছে। এখনো বোধোদয় না ঘটলে পরিস্থিতি কার নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে সেটা বলা হয়তো কঠিন, কিন্তু ক্ষমতার তখত যে উল্টে যাবে তা তো নিশ্চিত করে বলা সম্ভব।
এক-এগারো যেন মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের বাঘের গল্পের মতো। যেদিন সত্যি সত্যি বাঘ আসবে সেদিন পালানোর মতো অবস্থা থাকবে কি না জানি না, তবে আমরা আর কোনো এক-এগারো চাই না। অনেক দুর্বল ও নিপীড়ক নির্বাচিত সরকারও অসাংবিধানিক সরকারের চেয়ে ভালো। তাই সংসদকে নোংরা কথামালা দিয়ে উত্তপ্ত করে নয়, যুক্তি ও তথ্যের সাথে সত্যের প্রাণপ্রাচুর্য দিয়ে প্রাণবন্ত করে তুলুন। পরের দিকে থু থু ছিটিয়ে লাভ নেই, নিজের গায়ে মাখতে হয়। ডুব দিয়ে পায়খানা করলেও নিজের মাথায় নিতে হবে। তাই সোজাসাপটা নির্বাচনের পথে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ তৈরি করুন। জনগণ যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় ভরসা পায়, তা নিয়ে আর কোনো নোকতা নয়Ñ সমঝোতার পথ ধরে অগ্রসর হোন। এখন রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ে তুললে সবার লাভ। সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি করলে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের বিষাক্ত ছোবল থেকে সবাই রেহাই পাবেন। নয়তো ক্ষোভের আগুনে সবাইকে দগ্ধ হতে হবে। আওয়ামী লীগ জিয়াকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে যে বিতর্কের সূচনা করেছে, তারই ফলোআপ ভক্তরা কুরুক্ষেত্রের উপজীব্য বানিয়েছে বঙ্গবন্ধু ও জিয়াকে। অথচ কাউকে ছোট করে কাউকে বড় করা যায় না। অপরকে সম্মান না করলে সম্মান পাওয়া যায় না। জিয়াকে ছোট করা কোনো দলের মিশন হলে, সেই দলের নেতারা ধোয়া তুলসী থাকবেন কিভাবে। জিয়াকে অবজ্ঞা, অস্বীকার কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে বঙ্গবন্ধুকে মহান করা যাবেÑ এ ভাবনা ভুল। বঙ্গবন্ধু ও জিয়া কেউ কারো প্রতিপক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী নন। যার যার আসনে তারা স্ব স্ব অবদানের জন্যই নন্দিত। তাদেরকে তাদের জায়গায় রেখে নিজেদের পথচলা নিরাপদ করুন। বঙ্গবন্ধু ও জিয়া কবর থেকে উঠে এসে আমাদেরকে উদ্ধার করবেন না। তারা ত্রাণকর্তা সেজেও আর আসবেন না। তাদের আত্মাকে শান্তিতে থাকতে দিন। আমাদের শান্তির পথ আমাদেরই রচনা করতে হবে। সেই পথ রচনা করার শক্তি, সাহস ও নৈতিক বল না থাকলে পথ আগলে না থেকে সরে দাঁড়ান। নতুন প্রজন্ম তাদের তারুণ্যনির্ভর স্বপ্নকে বাস্তব করতে সাহসী ও কাক্সিত ভূমিকা পালন করবে ইনশাআল্লাহ।
সংসদে নারীর ক্ষমতায়নের নামে নারীরা এবার আদিম সুরতে যা দেখালেন তাতে কৃষক-মজুর-খেটে খাওয়া মানুষ নিজেদেরকে গরিব ভাবলেও ভদ্র ভাবতে পারছেন। দরিদ্র হলেও নিজেদেরকে রুচিবান ও সুশীল হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন, ক্ষমতাহীন হলেও নিজেদেরকে মনোদৈহিক দিক থেকে বিকারগ্রস্ত কিংবা বিকলাঙ্গ না ভেবে সৌভাগ্যবান ও সুস্থ হিসেবে পাচ্ছেন। কথা দিয়ে কথার মোকাবেলা, যুক্তি দিয়ে যুক্তির জবাব দেয়া, বুদ্ধি দিয়ে বুদ্ধির মোকাবেলা সব যুগেই স্বীকৃত পন্থা। রাজনীতির বাইরেও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় হার-জিতের খেলা পুরনো।
ইতিহাসখ্যাত বীরবল, গোপাল ভাঁড়, নাসিরউদ্দিন হোজ্জা ও ভানু চক্রবর্তীদের বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ ছিল। অশ্লীল বক্তব্যও শ্লীলতার প্রলেপ পরিয়ে পরিবেশন করতেন। তীর্যক বাক্যবাণও যুক্তি ও শ্লীলতার সীমা অতিক্রম করত না। যুক্তি ও কথার মারপ্যাঁচে তারা ভাঁড়ামি করলেও একটা নৈতিক বাঁধন মেনে চলতেন। আমাদের সুশীল রাজনীতিবিদেরা যেন সেই কাতারেও নেই। সেই মানেও নেই। তারা রুচিহীনতার মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। তাই আবার বলছিÑ হে দয়াময়, বাংলাদেশকে এই মহামারী থেকে নিরাময় দাও।
অসংযত ও নোংরা আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে আমাদের দেউলে করার জন্য। অযোগ্য লোকেরা এখন ক্ষমতাধর। যার যে যোগ্যতা নেই তাকে সেই দায়িত্ব দেয়ার কারণেই পরিস্থিতি এ পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিযুক্ত হন দলীয় ক্যাডার ভাবনা থেকে; শিক্ষা, প্রজ্ঞা, মনীষা ও মানবীয় গুণাবলির বিচারে নয়। তাদের মুখে ঘৃণার ওয়াক থু ছিটালেও চেয়ার ছাড়েন না। ছাত্ররা রক্ত দিয়ে আল্পনা এঁকে সরে যাওয়ার তাড়া দিলেও সরে দাঁড়ান না। শিক্ষক ছাত্রীর ধর্ষক, বিচার হয় না। দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী দেশপ্রেমের সনদ পান; দুদক দেয় কিন হওয়ার সার্টিফিকেট। টেন্ডার বাজ হন ছাত্রনেতা। চাঁদাবাজ হন জাতির নেতা। এই আমলে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিললÑ যিনি কিনা নির্লজ্জের মতো কথা বলেন, জাজ্বল্যমান সত্যকে আড়াল করেন। এমন বিচারপতি পাওয়া গেলÑ সম্মান লুণ্ঠনের প্রতিযোগিতাই যার নেশা। এমন দুদক চেয়ারম্যান পেলামÑ যিনি শুধু অথর্ব ও মেরুদণ্ডহীনই নন, নিজের ব্যর্থতাকেও উপভোগ করতে ভালোবাসেন। মাছের মতো আমাদের পচনটাও মাথা থেকে শুরু হয়েছে। নয়তো রাজনীতিবিদেরা এতটা পরোয়াহীন, নির্লজ্জ ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠতেন না। ক্ষমতার রাজনীতির প্রতি মোহ অনেকেরই থাকে। ক্ষমতার চার পাশে সুবিধাবাদীর জন্ম নেয়াও স্বাভাবিক। দুর্নীতির প্রসারও একটা সীমা পর্যন্ত মেনে নেয়ার গরজ থাকে। কিন্তু অশ্লীলতা মানতে হবে কেন? শালীনতা পরিহার করতে হবে কার স্বার্থে? সংসদে অসংসদীয় বক্তব্য দিয়ে পরিস্থিতি এভাবে উত্তপ্ত করা হবে কেন? আমরা ভালো করে জানি, গানের লোক আইনপ্রণেতা হয়ে গেছেন। যিনি আইনের ভাষা বুঝবেন না, তিনি সংসদীয় আচরণ করবেন কিভাবে। নাটকের লোক তো সংলাপ বোঝবেন, আইনের মারপ্যাঁচ জানবেন কিভাবে। সিনেমার লোক তো সংসদীয় আঙিনায় ঠাঁই পাওয়ারই কথা ছিল না। কলেজের সীমা অতিক্রম করেননি, এমন মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী বডিতে ঠাঁই পেয়েছেন। অর্থনীতি বোঝেন না, শুধু দলীয় ক্যাডার হওয়ার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালক বানিয়ে দিলে ব্যাংক লুণ্ঠন ঠেকাবে কে? তারা তো ঠগবাজের মতো চাণক্য আর কৌটিল্য শাস্ত্রের পাণ্ডিত্য দেখিয়ে পার পেতে চাইবেনই। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে অযোগ্য লোক বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা জনগণের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। তাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে দুর্নীতি, অনিয়ম হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে। সুশাসনের পরিবর্তে দুঃশাসন, নিয়মের পরিবর্তে অনিয়ম, বিচারের নামে অবিচার দেশ-জাতিকে গ্রাস করে বসে আছে।
যেদিন মধ্যরাতের টিভি টকশোকে সিঁধেল চুরির সাথে তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করলেন, সেদিন বুঝেছিলাম এ জাতির কপালে অনেক দুঃখ আছে। স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। সরকার সমালোচনা ও ভিন্নমত মোটেও সহ্য করবে না। গণতন্ত্রের কথা বলবে, মানবে না। ভিন্নমত দমন করতে দ্বিধা করবে না। আইনের শাসন শিকায় উঠবে। বাস্তবে ঘটল তাই। এখন পাণ্ডব দল টকশোর উপস্থাপক ও অথিতিদের দাবড়ানোর দিকেও নজর দিয়েছে। যদিও শেষ বেলায় বিরোধী দলকে সীমিত আকারে সহ্য করতে হচ্ছে। এটাও করা হচ্ছে শুধুই আতঙ্কিত হওয়ার মতো ভবিষ্যতের কথা ভেবেই। সবারই স্বীকার করা বোধ করি জরুরি হয়ে পড়েছে যে, সাধারণ মানুষের মন বোঝার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। বেশ ক’টি জরিপ আগাম সতর্ক বার্তা দিয়েছে। কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফলও পরিস্থিতি বোঝার মতো প্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছে। এখনো বোধোদয় না ঘটলে পরিস্থিতি কার নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে সেটা বলা হয়তো কঠিন, কিন্তু ক্ষমতার তখত যে উল্টে যাবে তা তো নিশ্চিত করে বলা সম্ভব।
এক-এগারো যেন মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের বাঘের গল্পের মতো। যেদিন সত্যি সত্যি বাঘ আসবে সেদিন পালানোর মতো অবস্থা থাকবে কি না জানি না, তবে আমরা আর কোনো এক-এগারো চাই না। অনেক দুর্বল ও নিপীড়ক নির্বাচিত সরকারও অসাংবিধানিক সরকারের চেয়ে ভালো। তাই সংসদকে নোংরা কথামালা দিয়ে উত্তপ্ত করে নয়, যুক্তি ও তথ্যের সাথে সত্যের প্রাণপ্রাচুর্য দিয়ে প্রাণবন্ত করে তুলুন। পরের দিকে থু থু ছিটিয়ে লাভ নেই, নিজের গায়ে মাখতে হয়। ডুব দিয়ে পায়খানা করলেও নিজের মাথায় নিতে হবে। তাই সোজাসাপটা নির্বাচনের পথে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ তৈরি করুন। জনগণ যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় ভরসা পায়, তা নিয়ে আর কোনো নোকতা নয়Ñ সমঝোতার পথ ধরে অগ্রসর হোন। এখন রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ে তুললে সবার লাভ। সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি করলে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের বিষাক্ত ছোবল থেকে সবাই রেহাই পাবেন। নয়তো ক্ষোভের আগুনে সবাইকে দগ্ধ হতে হবে। আওয়ামী লীগ জিয়াকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে যে বিতর্কের সূচনা করেছে, তারই ফলোআপ ভক্তরা কুরুক্ষেত্রের উপজীব্য বানিয়েছে বঙ্গবন্ধু ও জিয়াকে। অথচ কাউকে ছোট করে কাউকে বড় করা যায় না। অপরকে সম্মান না করলে সম্মান পাওয়া যায় না। জিয়াকে ছোট করা কোনো দলের মিশন হলে, সেই দলের নেতারা ধোয়া তুলসী থাকবেন কিভাবে। জিয়াকে অবজ্ঞা, অস্বীকার কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে বঙ্গবন্ধুকে মহান করা যাবেÑ এ ভাবনা ভুল। বঙ্গবন্ধু ও জিয়া কেউ কারো প্রতিপক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী নন। যার যার আসনে তারা স্ব স্ব অবদানের জন্যই নন্দিত। তাদেরকে তাদের জায়গায় রেখে নিজেদের পথচলা নিরাপদ করুন। বঙ্গবন্ধু ও জিয়া কবর থেকে উঠে এসে আমাদেরকে উদ্ধার করবেন না। তারা ত্রাণকর্তা সেজেও আর আসবেন না। তাদের আত্মাকে শান্তিতে থাকতে দিন। আমাদের শান্তির পথ আমাদেরই রচনা করতে হবে। সেই পথ রচনা করার শক্তি, সাহস ও নৈতিক বল না থাকলে পথ আগলে না থেকে সরে দাঁড়ান। নতুন প্রজন্ম তাদের তারুণ্যনির্ভর স্বপ্নকে বাস্তব করতে সাহসী ও কাক্সিত ভূমিকা পালন করবে ইনশাআল্লাহ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন