সোমবার, ২৪ জুন, ২০১৩

কোন ঘাটে ভিড়াবে নাও


আমাদের এক পাড়াতো কাকা। আমাদের বাড়ির দু’টো বাড়ি পরেই কুনু কাকার বাড়ি। কুনু কাকা পরলোকে পাড়ি দিয়েছেন প্রায় দুই দশক গত হতে চলল। কুনু কাকা ছিলেন বেশ মজার মানুষ। একবার আমার দাদীর ছোট ভাই হারুন দাদা অর্থাৎ হারুন অর রশিদ তালুকদার-এর শ্বশুর বাড়ির গ্রামে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে এসেছেন- হারুন তালুকদার মারা গেছেন, বাদ আসর তার জানাজা হবে। হারুন দাদা দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে বিশ্রাম নিয়ে কাচারী ঘরের সামনে বসেছেন আর অমনি দলে দলে লোক এসে দাদাকে দেখে ভুত দেখার মত দাঁড়িয়ে রইলো। হারুন দাদা এর কারণ জানতে চাইলে তারা বলল, কুনু মোল্লা তাদেরকে বলেছেন, হারুন তালুকদার মারা গেছেন তাই তারা জানাজা পড়তে এসেছে।
কুনু কাকা প্রায়ই এমন কিছু কিছু কা- করতো যা বলে শেষ করা যাবে না। কুনু কাকার আরেকটি বিশেষ গুণ ছিল, তিনি ভালো গল্প বলতে পারতেন। প্রায়ই তিনি আমাদের মজার মজার গল্প শুনাতেন। প্রিয় পাঠক, এখন কুনু কাকার কাছে শোনা একটি গল্পই আপনাদের বলছি- গল্পটির পটভূমি রূপকথার কল্পলোকে। এই রূপকথার কল্পভূমে ‘হীরাভূম’ নামে একটি রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের রাজা ছিলেন হারাধন। তার ছিল, তিন কন্যা- হেরাবতী, নেরাবতী ও ছেড়াবতী। রাজার মনে ছিল প্রচ- কষ্ট। তাছাড়া বয়সও হয়েছে, শরীর আর আগের মত চলে না। এখন অনেক কিছুই মনে রাখা সম্ভব হয় না। তিনি প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তার মধ্যে দিনাতিপাত করতেন। এই হীরাভূম রাজ্যের ভার তিনি কার হাতে তুলে দিয়ে যাবেন। তারতো কোনো পুত্র সন্তান নেই। কন্যাদের দিয়ে আর যা-ই হোক রাজ্য পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই রাজা, বড়কন্যা হেরাবতীকে উজির পুত্র  তোরাজীনের সাথে বিয়ে দিয়ে জামাতার হাতে হীরাভূমের শাসনভার তুলে দিলেন।
তোরাজীনের হাতে রাজ্যভার তুলে দেয়াতে রাজার কন্যাত্রয় নাখোশ হল। তাদের মতে- তোরাজীনের হাতে রাজ্যভার তুলে দিয়ে রাজা তাদের প্রতি যে শুধু অবিচার করেছেন তা নয়, রাজা সমগ্র নারী সমাজকে সমধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তাদের রাজ্য পরিচালনার সবগুণ থাকা স্বত্বেও রাজা জামাতার হাতে রাজ্যের শাসনভার তুলে দিয়ে চরম অন্যায় করেছেন। রাজা পুরুষ তাই তিনি পুরুষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছেন। রাজার কন্যাত্রয়ের মাঝে ক্ষমতার লোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তিনকন্যা ষড়যন্ত্র করে রাজা ও জামাতাকে বন্দি করে শাসনভার নিজেদের হাতে তুলে নিল। হেরাবতী নিজেকে রাজা বলে ঘোষণা দিল। নেরাবতীকে  প্রধানমন্ত্রী ও ছেড়াবতীকে সেনাপতি বানালো। সেই সাথে হীরাভূম রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে রাখল- ত্রিবতীরাজ্য।
কথায় বলে, লোভী মানুষ লোভ বেশীদিন সংবরন করতে পারে না। আর সেই লোভ যদি হয় ক্ষমতার লোভ; তবে তো কথাই নেই। হেরাবতী রাজা হওয়ার পর বছর দু’ গত হতে না হতেই নেরাবতী ও ছেড়াবতীর ভিতরের স্ব-রূপটি ছাইচাপা আগুনের মত জ্বলতে শুরু করল। নেরাবতী এবং ছেড়াবতীর প্রধান মন্ত্রী ও সেনাপতির আসনটি তাদের মনপ্লুত হল না। তাদের চাই- রাজার সিংহাসন। অপর দিকে হেরাবতী দেহত্যাগে রাজি আছে; কিন্তু গদিত্যাগে নয়! যার ফলশ্রুতিতে তারা তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াল। ত্রিবতীরাজ্য থেকে শান্তি ক্রমেই উধাও হতে শুরু করল। সেই সাথে শুরু হল- অরাজকতা। সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হল নিরপেক্ষ শ্রেণী। যারা ত্রিগোত্রীয় রাজনীতির বাইরে। তারা সু-বিচার থেকে বঞ্চিত হল। কারো কাছে বিচার চাইতে গেলে বলে, তোমাদের দায় আমার না। তোমরা ভালো হলে কখনো নির্যাতিত হতে না। তোমরা খারাপ। আর খারাপের স্থান আমাদের ভূ-খ-ে নেই। তোমরা কাল থেকে বেদেদের সাথে নদীতে থাকবে; নদীই হবে তোমাদের ঠিকানা। এভাবেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে পর্যায়ক্রমে ধসে পড়ে নিরপেক্ষ মধ্যবিত্ত শ্রেণী।
ধুঁকে ধুঁকে নিঃস্ব হতেই যেন বিধাতা এদেরকে পাঠিয়েছে। এদের ভোটেই ত্রিবতীরা পর্যায়ক্রমে নির্বাচিত হয়ে গদিতে বসে আখের গোছায়। ত্রিবতীরাজ্যে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি ও চাঁদাবাজির মত ঘৃণিত কাজগুলো নিত্যকার কর্ম হয়ে দাঁড়ায়। আশ্চর্যের বিষয় হল, নারী শাসিত ত্রিবতীরাজ্যে প্রাপ্ত বয়স্কা নারীদের চেয়ে শিশুরা বেশি ধর্ষিত হতে থাকল। অথচ ত্রিবতীরাজ্যের রাজা হতে  শুরু করে মন্ত্রি পরিষদের  প্রতিটি সদস্য নারী। তবুও বিচার চাইতে এসে অধিকাংশ ভিকটীম সু-বিচারের পরিবর্তে ভিটা থেকে বিতাড়িত হয়ে ভেলাতে বেঁধেছে আবাস।
প্রিয় পাঠক, আপনারা হয়তো ভাবছেন- আমি এই গল্পটি কেনো বললাম? হ্যাঁ, গল্পটি বলার পেছনে কারণ তো একটা আছেই। আর তা হল- আমাদের দেশ বাংলাদেশ। গত পাঁচ বছরে যত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় ৬০ শতাংশের শিকার হয়েছে শিশুরা। এবং গত ১০ বছরে ধর্ষণসহ যত নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তার ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মামলা হয়নি। বিচারের হার এক শতাংশেরও কম। নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, রাজশাহীতে ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের চার হাজার ১৬৯টি ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪১৪টি, শাস্তি হয়েছে ২৫ জনের। চট্টগ্রামে দুই হাজার ৩৭টি ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪৯৯টি, শাস্তি হয়েছে পাঁচজনের। সিলেটে দুই হাজার ২১৯টি ঘটনায় মামলা ৩৮৬টি, শাস্তি হয়েছে দু’টিতে। খুলনায় দুই হাজার ৩১টি ঘটনার মধ্যে ২৯৩টি মামলা হয়েছে, শাস্তি হয়েছে দু’টিতে। বরিশালে এক হাজার ২০০টি ঘটনায় মামলা হয় ৩৫৩টি, শাস্তি হয়েছে চারটিতে।
শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনা বাড়ছে। জাতীয় সংসদের স্পিকার ও সাবেক নারী ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শিরীন শারমিন চৌধুরী গত ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনায় শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার হার উদ্বেগজনক। সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ সংশোধনের চেষ্টা করছে।’
মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রামের তথ্য মতে, গত ১০ বছরে ঢাকায় ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তিন হাজার ৯৮০টি। মামলা হয়েছে এক হাজার ৫৫৬টি। শাস্তি হয়েছে ৪০টি ঘটনায়।
শিশুদের জন্য পরিবেশ এখন আগের চেয়েও বেশি অনিরাপদ। শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সমাজের। কিন্তু সমাজ এগিয়ে আসছে না। বিচার হয় না বলেই ধর্ষণের ঘটনা কমে না।
নারায়ণগঞ্জে চার বছরের এক শিশু ও অষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্রী বন্ধুর বাসায় খেলতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল এ বছরের জানুয়ারিতে। একই মাসে বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে প্রতিবেশীর ধর্ষণের শিকার হয় গোপালগঞ্জ সদরের তৃতীয় শ্রেণীর এক শিশু। পাঁচ দিন নিখোঁজ থাকার পর রাজধানীর ট্রপিকানা টাওয়ারে কর্মজীবী শিশু ঋতুর লাশ উদ্ধার হয় ওই ভবনের বাথরুম থেকে। পুলিশ বলছে, ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করা হয়েছিল।
পুলিশের অসহযোগিতার অভিযোগও পাওয়া গেছে ভুক্তভোগী বেশ কিছু পরিবার থেকে। রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় ধর্ষণের শিকার হয়ে শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করে স্কুলছাত্রী আফরোজা আক্তার (১৪)। গত ২০ জানুয়ারি একই গ্রামের লেবু মিয়া মেয়েটিকে ধর্ষণ করে বলে পরিবারের অভিযোগ। পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তারে গড়িমসি করেছে।
৩০ জানুয়ারি লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় স্কুলছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় আসামি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্যের ছেলেকে পুলিশ দীর্ঘ ছয় মাসেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি। অথচ, ধর্ষণের শিকার মেয়েটির মা মিডিয়াকে বলেছেন, মামলা তুলে নিতে তাকে হুমকি দেয়া হচ্ছে।
রাজধানীর ট্রপিকানা টাওয়ারে সংঘটিত ধর্ষণ ও হত্যাকা-ের ক্ষেত্রেও পুলিশ যথাসময়ে অভিযোগপত্র দায়ের করতে পারেনি। ৫৪ ধারায় কয়েকজনকে আটক করে হাজতে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এরা প্রকৃত আসামি কি না, বোঝা যায়নি। ভবনের মালিক ও নিরাপত্তারক্ষীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন শিশুটির মা। তাদেরও গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিউম্যান রাইটস মনিটরিং রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৮ সালে ৪৫৪ জন ধর্ষণের শিকার হয়। এদের মধ্যে ২০২ জন নারী ও ২৫২ জন শিশু। ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার ৪৫৬ জনের মধ্যে ২১৩ জন ছিল নারী ও ২৪৩ জন শিশু। ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা ছিল ২৯৯ জন ও শিশু ৪৭৩ জন।
আবার অনেকাংশে দেখা যায় ধর্ষণের সাজা ক্ষতিপূরণ অথবা বিয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। সাধারণভাবে ১০ বছরের নিচে শিশুরা ধর্ষণের শিকার হলে বাবা-মা টাকার বিনিময়ে মীমাংসা করে ফেলেন। ১০ বছরের ওপরে মেয়েদের সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ের ঘটনা ঘটে অহরহ। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট কেরানীগঞ্জে এক কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়। পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করে এবং যথাসময়ে অভিযোগপত্রও দেয়। কিন্তু কিছুদিন পরই আক্রান্ত পরিবারটি মামলা তুলে নেয়। পরে জানা যায় ধর্ষকের সঙ্গে ওই কিশোরীর বিয়ে হয়েছে।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, শুধু ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে নয়জন নারী ও ২৭ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে আটটি শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীই নারী। আমাদের সংসদের স্পিকারও নারী। বিরোধী দলীয় নেতাও নারী। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতিও নারীই হবেন। অথচ এই নারী শাসিত দেশেই নারীরা  প্রতিনিয়ত যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে; হচ্ছে ধর্ষিত। উদ্বেগের বিষয় হল- রূপকথার কল্পলোকে ত্রিবতীরাজ্যের ন্যায় আমাদের দেশে প্রাপ্ত বয়স্কা নারীদের চেয়ে শিশুরাই বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। শিশু ধর্ষণের বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বছরের পর বছর মামলা ঝুলতে থাকে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশের তদন্ত শেষে মামলা যখন আদালতে গড়ায়, তখন প্রভাবশালীদের চাপে পড়ে অনেকে মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়। এভাবেই অযাচিত স্রোতে ভাসতে ভাসতে ধংস হয়ে যায় একটি উদিয়মান নক্ষত্রের আলোকিত আগামি! তাইতো জানতে ইচ্ছে করে- সু-বিচারের জন্য ভিকটিমরা কোন পাড়ে যাবে; কোন ঘাটে ভিড়াবে নাও!

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads