ভারে বহুতল ভবন ধসে পড়ে নিহত ১১২৮ জন, নিখোঁজ ১৭৬ জন
এবং পঙ্গু বা গুরুতর আহত হাজার শ্রমিকের দুর্ভাগ্যের মর্মান্তিক ঘটনাকে ‘ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড’ আখ্যা দিয়ে বিগত ৯ মে নোবেল বিজয়ী কর্মবীর প্রফেসর ড. মুহাম্মদ
ইউনূস একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিশাল ফাটল ধরেছে :
“রানা প্লাজায় ফাটলের পর ভবনধস
দেখিয়ে দিলো আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে বিশাল ফাটল ধরেছে, সেটা আমলে না
নিলে জাতিও এরকম ধসের ভেতর হারিয়ে যাবে।
সাভারে শুধু শুধু ভবন ধসে পড়েনি। রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ধসে পড়ার
অভিলণ হিসেবে এ ভবন ধসে পড়েছে। ভবনধসের বিশ্লেষণ করলে আমাদের ধসে পড়া রাষ্ট্রীয়
প্রতিষ্ঠানগুলোর চেহারা ধরা পড়বে।”
বাস্তবিক, ভূ-রাজনৈতিক ঘোরচক্রে আর জরুরি অবস্থার সুযোগে ২০০৮-এর সালতামামি
সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে যে দ্বিতীয় শেখ হাসিনা সরকার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা
নিয়ে মতাসীন হয়েছে, তার একাংশের কাজই যেন ছিল একে একে রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক
শৃঙ্খলাগুলোর খিলান ধসিয়ে দিয়ে নয়া বাকশালী ইমারত তৈরির বন্দোবস্ত করা। বিগত ৫৫
মাসের শাসনামলে সেই কুকাজটিরই ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে মতাসীন সরকার। বাংলাদেশকে ‘ব্যর্থরাষ্ট্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তির তাঁবেতে পরিণত করার
জন্য জাতিরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অস্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক বৈকল্য দীর্ঘস্থায়ী করার
যে দেশী-বিদেশী যোগসাজশ একটা বৈরী মহল অনুসরণ করে চলেছে, সজ্ঞানে কিংবা
অপরিণামদর্শিতাবশত সেই বৈরী মহলের অশুভ এজেন্ডা অনুসরণ করার জন্য মতাসীন গোটা
মহাজোট সরকারকেই এখন দায়ী করছে ওয়াকেবহাল মহল। জনগণও তাদের ‘চাপাবাজি’তে আর ভুলছে না, তাদের দুঃশাসন-দুরাচার-অত্যাচার-মিথ্যাচার-কিষ্ট
হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফলে মেয়াদপূর্তির বছরে এসে দ্রুত নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে
মতাসীন সরকার।
রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলাগুলোর ওপর হাল আমলের বিনাশী হামলার
একটা বিশেষ নজির :
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকারের শপথগ্রহণের দেড় মাসের মাথায় (বর্তমান
পার্লামেন্টের প্রথম বৈঠকের ঠিক এক মাস পরে) ২৫-২৬ ফেব্র“য়ারি ঘটল পিলখানা
হত্যাকাণ্ডের মর্মান্তিক ঘটনা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়াধীন আধাসামরিক বাহিনী
তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের (বর্তমান বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডস) সদস্যদের সশস্ত্র
বিদ্রোহকে ‘রাজনৈতিক মীমাংসা’র প্রক্রিয়ায় দীর্ঘায়িত করে এবং তাৎণিক সামরিক দমন প্রক্রিয়াকে
নিবৃত্ত করে বিডিআর মহাপরিচালক ও তার পরিবারসহ পিলখানায় সমবেত ৫৭ জন পদস্থ সেনা
কর্মকর্তার হত্যার সুযোগ করে দিয়েছিল বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনারত রাজনৈতিক নেতারা।
সামরিক বাহিনী তাতে যেমন হারিয়েছে বিনাযুদ্ধে সুদ এতগুলো সেনা কর্মকর্তার
মূল্যবান জীবন, তেমনি হারিয়েছিল মনোবল। প্রতিবাদে সেনাদরবারে প্রধানমন্ত্রীর
উপস্থিতিতে ােভ প্রকাশ করেছিলেন আরো কিছু সেনা কর্মকর্তা। সরকার অনুমোদিত তদন্ত ও
বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও সীমাবদ্ধতা নিয়েও তারা সামরিক শৃঙ্খলা অনুসরণ করেই
কতকগুলো সঙ্গত প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। এমন স্পষ্টবাদিতার জেরে এবং অন্ধ
আনুগত্যের সন্ধানে শেখ হাসিনা সরকার সশস্ত্রবাহিনী (সেনা, নৌ ও বিমান) থেকে
গত চার বছরে ১৯৭ জন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেছে। স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়েছেন আরো ১৬১
জন। এ দুই ধরনের প্রক্রিয়ায় কর্মচ্যুত হওয়া কর্মকর্তার তালিকায় লেফটেন্যান্ট
থেকে শুরু করে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন। এ ছাড়া তিন
বাহিনী থেকে ৩৬ জন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে
সেনাবাহিনী থেকে ১২ জন, নৌবাহিনী থেকে ১১ ও বিমানবাহিনী থেকে ১৩ জন। এ তালিকায় আছেন একজন লে.
জেনারেল, তিনজন মেজর জেনারেল বা সমমানের, তিনজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, দু’জন কর্নেলসহ বিভিন্ন পদের
কর্মকর্তা। তবু নানা বাধ্যবাধকতার মধ্যেও আন্তর্জাতিক শান্তিরায় নিয়োগের উপযুক্ত
মান বজায় রেখে এ দেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশের একাংশ প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও
নৈতিকতা বজায় রেখে চলেছে। বৈদেশিক সহায়তায় ও জাতিসঙ্ঘ মিশন-লব্ধ আয়ের বদৌলতে এ
দেশের প্রতিরা অবকাঠামোরও উল্লেখযোগ্য শক্তিবৃদ্ধি ঘটেছে। এখন সরকারের মেয়াদের
শেষ বছরে এসে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরামন্ত্রী শেখ হাসিনা সামরিক বাহিনীরও একটা ‘মনস্তাত্ত্বিক দলীয়করণ’-এর আকাক্সা ব্যক্ত করেছেন। ২৬ মে ঢাকা সেনানিবাসে লেফটন্যান্ট কর্নেল
থেকে কর্নেল ও কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে পদোন্নতির জন্য আহূত পাঁচ
দিনব্যাপী ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের ‘সেনাসদর নির্বাচনী বৈঠক-২০১৩’-এর উদ্বোধন করেন
প্রধানমন্ত্রী। ইতোমধ্যে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র একটা মনোপলি ব্যাখ্যা খাড়া করে যে বাকশালী স্লোগান দিয়ে তিনি
মহাজোটভুক্ত ১৪ দলের নেতৃত্ব পাকাপোক্ত করছেন, সেই স্লোগানকেই সেনা
কর্মকর্তাদের প্রমোশনের একটা কষ্টিপাথর হিসেবে তিনি বিবেচনায় নিতে বললেন :
‘যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের
নির্বাচিত করা খুবই জটিল কাজ। তবে কাজটি অত্যন্ত আন্তরিকতা ও সততার সাথে করতে হবে।
আপনাদের প্রজ্ঞা, বিচার-বুদ্ধি এবং ন্যায়পরায়ণতার ওপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। আমার
দৃঢ়বিশ্বাস, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ঊর্ধ্বে উঠে, আপনারা উচ্চপ্রশিতি, কর্মোদ্যমী, সচেতন, প্রত্যুৎপন্ন ও
সর্বাবস্থায় গণপ্রজাতন্ত্রের মূলনীতির প্রতি অবিচল থাকার ভিত্তিতে উপযুক্ত
নেতৃত্ব নির্বাচনে সর্বতোভাবে সফল হবেন।
নেতৃত্ব ন্যস্ত করতে হবে তাদেরই হাতে, যারা সুশিতি, কর্মম, সচেতন, বুদ্ধিমান এবং
সর্বোপরি গণতন্ত্রকে সুসংহত করার জন্য দৃঢ়প্রত্যয়ের অধিকারী। আদর্শগতভাবে
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সামরিক বাহিনীর জন্য অত্যন্ত মৌলিক ও
মুখ্য বিষয়।’
বাকশালী কায়দায় উচ্চ আদালতকে কুগিত করার কাজও শুরু হয়েছে দ্বিতীয়
হাসিনা সরকারের আমলে এসে আগের আমলের প্রধান বিচারপতির অবসর গ্রহণের সময় থেকে
পরবর্তী সব প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল আদালতের বিচারক ও হাইকোর্টের বিচারকদের নিয়োগ
ও পদোন্নতির েেত্র দলীয় আনুগত্যের বিবেচনা দিয়ে। এভাবে নিযুক্ত হাইকোর্টের জজ
সাহেবদের অনেকেরই অর্থলালসা ও গুরুতর দুর্নীতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারে প্রকাশ্য
আলোচনা হয়, জজ সাহেবদের নিজ নিজ পছন্দের অ্যাডভোকেটদের কাছে ধরনা না দিলে মামলার
নিষ্পত্তি হয় না, এরকম অভিযোগের কথা একজন বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবং একজন নামজাদা
ব্যারিস্টার নিজ মুখেই বলেছেন।
উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালত উভয়েরই বিচার প্রক্রিয়ায় নেপথ্য
নির্বাহী হস্তপে, দুর্নীতি বিস্তার আর পপাতদুষ্টতা যোগ ছাড়াও অপ্রাসঙ্গিকভাবে
সাংবিধানিক ধারাবাহিকতাকে আদালতের রায় ও মন্তব্য দিয়ে কাটাছেঁড়া করিয়ে
স্ববিরোধী করে তোলা এবং গণভোট ছাড়াই আদালতের দোহাই দিয়ে ২০১১ সালে পঞ্চদশ
সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের তেত্রিশ বছর ধরে চালু মৌলিক অবকাঠামোর স্বেচ্ছাচারী
পরিবর্তনের চালাকি ছিল এই সরকারের এক চরম দুরাচার। ফলে এক দিকে যেমন নির্বাচনকালীন
সরকারব্যবস্থা নিয়ে অনতিক্রমণীয় রাজনৈতিক-সাংবিধানিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে, অন্য দিকে
নির্বাচনী প্রচারকৌশলের উপাত্ত হিসেবে সরকারের খাড়াকরা শাহবাগ মঞ্চের
ইসলামবিদ্বেষী কিছু কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় জাগ্রত হেফাজতে ইসলামের প্রতিবাদের
ভাষাতেও আইনিব্যবস্থা ও সাংবিধানিক সংশোধনের জোর দাবি এসেছে।
নির্বাচন-পূর্ব এ বছরে শেখ হাসিনা নয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে
নিয়োগ দিয়েছেন সাবেক ডাকসাঁইটে আমলা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে। তিনি কঠোর
পুলিশি ব্যবস্থা ও দমননীতি দিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার ডামাডোলকে স্তব্ধ
করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। তিনিও সংবিধানের ধার ধারছেন না। প্রথমেই হুকুম
দিয়েছেন : জামায়াত-শিবিরকে রাজপথে দাঁড়াতে দেয়া হবে না; দেখা মাত্রই
তাদের গুলি করতে পারবে পুলিশ। ফলাফল, পুলিশের হিংস্র আক্রমণে বড়
রাস্তায় দাঁড়াতে না পারলেও জামায়াত-শিবির কর্মীরা অলিগলি থেকে ঝটিকা মিছিলে
বেরিয়ে ফেব্র“য়ারি মাস ধরে পাল্টা সহিংসতা অবলম্বন করেছে, টহল পুলিশের ওপর
ককটেল আক্রমণ ও পাল্টা লাঠি চালিয়েছে। তারপর এ বছর ২৮ ফেব্র“য়ারি থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত এক
সপ্তাহে পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে মারল ১৭৭ জন নিরস্ত্র সন্দেহভাজনকে, যাদের কেউ ছিল
বিােভকারী, কেউ ছিল পথচারী। সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক অধিকারের এমন হিংসাত্মক
বরখেলাপ কোনো জরুরি অবস্থায় কিংবা সামরিক শাসনামলেও ঘটেনি।
তাতে কি অস্থিরতার অবসান ঘটেছে? না। বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক
উভয় স্তরে অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়ে মে মাসে তার একটা চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ৪ মে
রাজধানীর শাপলা চত্বরে ‘নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে সাধারণ
নির্বাচনানুষ্ঠানের’ দাবিতে ও হত্যার
লাইসেন্সপ্রাপ্ত পুলিশি জুলুমের প্রতিবাদে ১৮ দলীয় জোটের মহাসমাবেশে ছিল
শান্তিপূর্ণ বিশাল লোক সমাগম ও কঠোর আন্দোলনের চরমপত্র। ৫ মার্চ যান চলাচলে সরকার-আরোপিত
নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও হেফাজতে ইসলামের ডাকে হেঁটে আসা লাখ লাখ কর্মী ঢাকায় ছয়টি
প্রবেশপথে সমাবেশ করে স্থলপথে ঢাকা অবরোধ করেছেন, পুলিশের অনুমোদনক্রমেই ঢাকার
অভ্যন্তরে শাপলা চত্বরে সমবেত হয়েছেন তাদের নেতা আল্লামা শফীর মুখে পরবর্তী
নির্দেশের অপোয় ১০ লাধিক হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী। তাদের নেতাকে সমাবেশে আসতে
দেয়নি পুলিশ, পরদিন জোর করে প্লেনে তুলে চট্টগ্রামে ফেরত পাঠিয়েছে। আর শাপলা
চত্বরে অবস্থানরত মাদরাসা-শিক ও অন্যান্য হেফাজত নেতাদের সঙ্ঘশক্তি ‘নির্মূল’ করতে ওই দিনই মধ্যরাতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এক প্রচণ্ড অভিযানের
নীলনকশা অনুযায়ী জড়ো হয়েছে র্যাব-পুলিশ-বিজিবিÑ এই তিন বেসামরিক
সশস্ত্র বাহিনীর সম্মিলিত দল। সেই মধ্যরাতের অভিযানের নির্দয় আক্রমণের ফলে সরকারি
ভাষ্যমতে, ১০ মিনিটেই উচ্ছেদ করা গেছে অবস্থান ধর্মঘটকারীদের, কোনো হতাহতের
কারণ ঘটেনি। পত্রিকায় প্রকাশ, পুলিশেরই দাফতরিক হিসাব মোতাবেক দেড় লাধিক গোলাগুলি ব্যয় করেছে
পুলিশ ৫ মে অস্থিরতা মোকাবিলায়, যার বেশির ভাগ ব্যয় হয়েছে শাপলা চত্বরের অভিযানে ও আশপাশে। দেশী
বিদেশী মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে। ওই রাতের নির্মম
হত্যাকাণ্ড, পড়ে থাকা লাশ আর লাশগুমের সচিত্র কাহিনী ইন্টারনেটে বিশ্বজুড়ে
প্রচারিত হয়েছে। কিছু চিত্র পোস্টার আকারে সারা দেশে দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়েছেন
হেফাজত কর্মীরা; সরকারের গোয়েন্দারা বেশির ভাগ দেয়াল থেকে সেসব পোস্টার তুলে ছিঁড়ে
ফেলেছে। বাংলাদেশে সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা প্রসঙ্গে তাদের মাসিক
প্রতিবেদনে মতিঝিলে ৫ মে মধ্যরাতে হেফাজতের অবস্থান কর্মসূচিতে সরকারি বাহিনীর
অভিযান নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেসনোট প্রত্যাখ্যান করেছে মানবাধিকার
সংগঠন ‘অধিকার’: ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রথম শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থানের সময়
রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র মানুষের ওপর সরকারি বাহিনীর সহিংসতা, গুলি ও হত্যার
ঘটনা ঘটানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, তাতে বাংলাদেশে
এক ভয়াবহ অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে।’ বর্তমান সরকার
মতায় আসার পর সরকারি দলের সমর্থক দুর্বৃত্তরা প্রাণঘাতী অস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন
সময়ে পুলিশের সাথে থেকে এবং তাদের সহযোগিতায় বিরোধী দলের ওপর হামলা করেছে। (এখন)
“২০১৩-তে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’-এর ইসলাম অবমাননাকারী ব্লগারদের শাস্তির দাবিতে দু’পরে পাল্টাপাল্টি অবস্থান এবং
সরকারের নির্বিচারে গুলি চালানো ও সর্বশেষ হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকদের ওপর
সরকারের অভিযান সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অত্যন্ত জটিল করে তুলেছে।”
মে মাসজুড়ে সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন করে সরকার ও বিরোধী জোট উভয়পে
ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণু আচরণের আলামত ও সামাজিক সহিংসতার চিত্র উপস্থাপিত করা হয়েছে
‘অধিকার’-এর ওই মাসিক প্রতিবেদনে : ‘মে মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৪৬ জন নিহত ও ৯৪৮ জন আহত হয়েছেন। এর
মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৫টি এবং বিএনপির তিনটি অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতের ঘটনা। আওয়ামী
লীগের অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতে নিহত হয়েছেন দু’জন ও আহত হয়েছেন ১৬৯ জন। অন্য দিকে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতে ২৩ জন
আহত হয়েছেন।
মে মাসে ২৫ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এই
হত্যাকাণ্ডগুলো র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি কর্তৃক সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগ।
২০১৩ সালের মে মাসে ৯ ব্যক্তি গণপিটুনিতে মারা গেছেন। আইনশৃঙ্খলা
রাকারী বাহিনীগুলোর প্রতি আস্থাহীনতা এবং ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে
ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমে যাওয়ায় মানুষের নিজের হাতে আইন তুলে
নেয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
মে মাসে ১৫ জন নারী যৌতুক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯ জনকে
হত্যা করা হয়েছে। ছয়জন বিভিন্নভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ২৮ নারী ও শিশু
ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দু’জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। তিনজন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ১৮
শিশুর মধ্যে তিনজন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ১০ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
তাদের মধ্যে বখাটে কর্তৃক আহত হয়েছেন একজন। আত্মহত্যা করেছেন একজন। একজন নারী
এসিডদগ্ধ হয়েছেন।
৫ মে মধ্যরাতে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির ১০ হাজার
সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে
শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থানরত হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে ওই স্থান থেকে
উৎখাতের উদ্দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এই সময়
আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে শাপলা চত্বরে অবস্থানরত অনেক ঘুমন্ত
এবং নিরস্ত্র হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপর গুলি, রাবার বুলেট ও
সাউন্ড গ্রেনেড নিপে করে। এ আক্রমণের ফলে অনেক মানুষের হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।
অধিকার তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে সঠিক ঘটনাটি জানা এবং হতাহতদের সংখ্যা সংগ্রহের
চেষ্টা করছে। তবে বর্তমান অবস্থায় এটা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রহমতুল্লাহ অধিকারকে জানান, আইনশৃঙ্খলা
রাকারী বাহিনীর সদস্যদের আক্রমণের পর তিনি বহু লোকের লাশ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেন।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সদস্যরা মৃত ব্যক্তিদের ঘটনাস্থল থেকে
অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু এ ঘটনার পর বাংলাদেশের সরকারি টিভি
চ্যানেল বিটিভি এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রগুলো, যার অধিকাংশের
মালিকানা সরকার সমর্থকদের হাতে রয়েছে, তারা সঠিক সংবাদ প্রকাশের
েেত্র নীরব ভূমিকা পালন করে। সেই রাতে দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি নামে দু’টি বিরোধীদলীয় চ্যানেল সরাসরি
এ ঘটনা প্রচার করছিল। অভিযান শুরু হওয়ার পর রাত সাড়ে ৪টার পর থেকে সরকার টিভি
চ্যানেল দু’টি বন্ধ করে দেয়, যা এখন পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে। এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও আক্রমণের
প্রতিক্রিয়ায় গত ৬ মে দিনব্যাপী নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর, চট্টগ্রামের
হাটহাজারী ও বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা বিােভ করতে থাকলে
তাদের সাথে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। এ সঙ্ঘর্ষে একজন
বিজিবি সদস্য, দু’জন পুলিশ সদস্য ও একজন সেনাবাহিনী সদস্যসহ ২৭ জন সাধারণ মানুষ নিহত
হন।’
আর বৈদেশিক সম্পর্কের েেত্রও আধিপত্যবাদী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি
সরকারের দুর্বল আচরণের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির কথা তুলে ধরে ‘অধিকার’-এর ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে ‘মে মাসে ভারতীয় সীমান্ত রীবাহিনী বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে
বাংলাদেশীদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। বিএসএফ তিনজনকে হত্যা
করেছে, দু’জনকে নির্যাতন ও আটজনকে গুলি করে আহত করেছে। একই সময়ে বিএসএফের হাতে
অপহƒত হয়েছেন ১০ জন।
এসব ঘটনা শুধু অমানবিক নয়, এর ফলে আমাদের সীমান্ত
ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলারও অবমাননা ঘটছে, রাষ্ট্রের অমর্যাদা ঘটছে।
অধিকার বলেছে, ‘কোনো স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র কখনোই তার বেসামরিক নাগরিকদের
নির্বিচারে হত্যা-নির্যাতন-অপহরণ মেনে নিতে পারে না।’ তাই আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, বিশ্বসন্ত্রাস প্রসঙ্গে
বাংলাদেশ-সংক্রান্ত ২০১২ সালের বার্ষিক রিপোর্টে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর
মন্তব্য জুড়ে দিয়েছে যে, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও
পররাষ্ট্রনীতি আঞ্চলিক শক্তিশালী দেশ বিশেষ করে ভারত দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত।’
এ দিকে মাসজুড়েই দেখা যাচ্ছে হেফাজত দমনে সরকারের নিষ্ঠুর উচ্ছেদ ও
গ্রেফতার অভিযানের জেরে উল্টো ফল। ২৯ মে আমাদের সময়.কম-এ মতাসীন দলের এমপি গোলাম
মওলা রনি ‘বাবুনগরীকে হেফাজত করুন’ বলে একটি আবেদন
প্রচার করেন। তার উদ্বেগ থেকেই প্রকাশ পায়, সরকারের নিষ্ঠুর দমননীতির
পরিণতি কিভাবে সাকারকেই ফাঁপরে ফেলেছে : ‘দেশের সব পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে যে হেফাজতে
ইসলামের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী ভয়ানক অসুস্থ। তার পায়ে
পচন ধরেছে এবং তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। তিনি বর্তমানে রিমান্ডে পুলিশ
হেফাজতে আছেন। তার এই অসুস্থতা নিয়ে ভয়াবহ রকম গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সরকারের উচিত
কালবিলম্ব না করে তার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে দেশবাসীকে জানানো। রিমান্ডে তার
প্রতি কোনো অবিচার করা হয়নি এ ব্যাপারে দেশবাসীকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে বুঝানো এবং
অবহিত করা; অন্যথায় এটা নিয়ে মারাত্মক কিছু ঘটতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছে।
হেফাজতকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই। যাদের কথায় ঢাকা শহরে লাখ
লাখ লোক সারা দেশ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছুটে আসে তাদের মতা নিয়ে ঠাট্টা মশকারা
করার মতো নির্বোধের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সরকারী টিভিসহ সরকার সমর্থক
মিডিয়াগুলোতে বলা হচ্ছে, মাত্র ১০ মিনিটের অভিযানে তাদের হটিয়ে দেয়া হয়েছিল। এ নিয়ে
পুলিশের বড় কর্তাদের গর্বের সীমা নেই। বাস্তব অবস্থা কিন্তু মোটেও তদ্রƒপ ছিল না। রাত ১০টায় সম্মিলিত
বাহিনী তিন দিক থেকে তিন স্তরে আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। প্রথমে পুলিশ, তারপর র্যাব এবং
সবার পেছনে বিজিবি। ঘটনার রাতে প্রত্যদর্শী সাংবাদিকদের মতে, রাত ১০টা থেকে
ভোর ৫টা পর্যন্ত একনাগাড়ে অভিযান পরিচালিত হয়। হেফাজত কিংবা হেফাজতের মধ্যে
লুকিয়ে থাকা জামায়াত-শিবির-বিএনপির কর্মীরা প্রবল বেগে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
ঘটনার রাতে হেফাজতের প থেকে ইটপাটকেল, বোমা (পটকা) এবং (টিয়ার গ্যাস
প্রতিষেধক) আগুনের মাধ্যমে যে ভয়ানক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় তা ছিল নজিরবিহীন।
পুরো নটর ডেম কলেজের সামনের রোড, কমলাপুর আইসিডি সড়কসহ যাত্রাবাড়ী রোডে তারা যে প্রতিরোধ গড়ে তোলে
তাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বারবার পিছু হটতে বাধ্য হয়। এভাবে চলছিল রাত ১০টা থেকে ২টা
পর্যন্ত। রাত ২টার পর সম্মিলিত বাহিনী এগোতে থাকে। ৪টার দিকে পরিস্থিতি তাদের
অনুকূলে আসে। ৫টার সময় নিয়ন্ত্রণে আসে। কাজেই ১০ মিনিটের অভিযানে হেফাজত
ছত্রভঙ্গ হয়েছেÑ এই ছেলে-ভোলানো গল্পকারেরা
সরকারকে আরো একটা ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে।’
ওই দিনই বিকেলে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায় নিবিড়
পর্যবেণে শয্যাশায়ী হেফাজত নেতা বাবুনগরীর জামিনের ব্যবস্থা করা হয়। এ সম্পর্কে ৩০
মে সংবাদপত্রের রিপোর্ট ”
সরকারের নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ও
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ আহমেদ বাবুনগরী জীবন-মৃত্যুর সন্ধিণে
রয়েছেন। এ অবস্থায় গতকাল তাকে তিনটি মামলায় আকস্মিকভাবে জামিন দিয়েছেন আদালত।
সরকারপরে পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত ২৯ মে মামলার ধার্য তারিখ না হওয়া সত্ত্বেও
জামিনের আবেদন করেন বাবুনগরীর আইনজীবীরা। আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে গত ৬ মে
রাজধানী থেকে আটক করে পুলিশ। প্রখ্যাত ও হাদিসবিশারদের বিরুদ্ধে একই দিনে মিথ্যা ও
ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে কয়েক ডজন মামলা করা হয়। ওই দিনই তাকে মতিঝিল থানার একটি
মামলায় ৯ দিনের রিমান্ডে নেয় ডিবি পুলিশ। ৯ দিনের জায়গায় ১১ দিন রিমান্ডে রেখে
অকথ্য নির্যাতনের পর আবারো আদালতে হাজির করে তিনটি মামলায় লাগাতার ২২ দিনের
রিমান্ডে নেয়া হয় তাকে। রিমান্ডে নির্মম নির্যাতনে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে এক
দিন পরই তাকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালতের আদেশে তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা
হয়। আদালতে তিনি দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন বলে প্রচারণা
চালায় সরকার। অবস্থার আরো অবনতি হলে তাকে বারডেম হাসপাতালে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে
রাখা হয়। পুলিশের নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে মর্মে চার দিকে খবর ছড়িয়ে পড়লে ২৯
মে সকাল থেকেই সরকার তাকে জামিনে মুক্ত করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সকাল থেকেই
সরকারপরে লোকজন আল্লামা বাবুনগরীর উকিলদের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে থাকেন। তারা
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ বাবুনগরীর পরে সিনিয়র আইনজীবীদের সাথে দেখা
করে জামিনের আবেদন করতে অনুরোধ করেন। ১৮ দিনের রিমান্ড বাকি থাকতেই তাকে জামিন
দেয়ার কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায়, চিকিৎসায় বাবুনগরীর অবস্থার
উন্নতি হচ্ছে না। রিমান্ডে রেখে বর্বর নির্যাতনের কারণে তার কিডনি অকেজো হয়ে
পড়েছে। তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পচন ধরেছে। এ অবস্থায় সরকার জামিনের নামে একটি
মৃতদেহ বাবুনগরীর পরিবারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে। সারা কার্যদিবস ধরে সরকারপরে
শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী, এমনকি আদালত ও পুলিশ প্রশাসনের প থেকে আসামিপরে সিনিয়র আইজীবীদের
সাথে দফায় দফায় যোগাযোগ করতে থাকে। বাবুনগরীর অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছে যে, পুলিশ একটি
ফরোয়ার্ডিং দিয়ে তাকে ১৮ দিন রিমান্ডে নেয়ার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়ে দেয়।
তখন মানবিক তাগিদে আদালতে জামিনের আবেদন তুলে ধরে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক
সভাপতি অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী
কোনো সাধারণ মানুষ নন। তিনি শুধু বাংলাদেশেই নন, গোটা মুসলিম বিশ্বে একজন
স্বীকৃত ও শ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীন। তিনি প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ। দেশে-বিদেশে তার
হাজার হাজার ছাত্র ইসলাম ধর্মের প্রচারে নিরলস ভূমিকা রেখে চলেছেন। ইসলামবিদ্বেষী
ভয়ঙ্কর ব্লগারচক্র যখন মহান আল্লাহ ও মহানবী সা:-কে নিয়ে বিদ্রƒপ করেছে, তখন তিনি দেশের
সর্বস্তরের আলেম-ওলামাকে নিয়ে এর প্রতিবাদ করেছেন। শুধু ইসলাম ও মুসলমানের
মর্যাদা রার তাগিদেই তিনি গত ৫ মে ঢাকা অবরোধে নেতৃত্ব দেন। মতিঝিলে লাখ লাখ আলেম-ওলামার
শান্তিপূর্ণ সমাবেশে গভীর রাতে বাতি নিভিয়ে পুলিশ গুলি চালায়। এতে শত শত আলেম ও
কুরআনে হাফেজ নিহত হন; আহত হন হাজার হাজার আলেম। সরকারও বর্বর গণহত্যাকে আড়াল করতেই মিথ্যা
ও ভিত্তিহীন মামলা দিয়ে পরদিন বাবুনগরীকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়। তাকে
নির্যাতন করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় তারা। বর্তমানে বারডেম হাসপাতালে তিনি জীবন-মৃত্যুর
সন্ধিণে রয়েছেন। তার কিডনি কাজ করছে না। দুই পা ও শরীরের কয়েকটি স্থানে পচন
ধরেছে। নির্যাতনের কারণে শরীরে সৃষ্টি হওয়া ত থেকেই এ পচন ধরেছে। এ অবস্থায়
জামিন মঞ্জুর না করার এখতিয়ার আদালতের। জবাবে সরকারপরে আইজীবীরা জামিন দিতে তাদের
কোনো আপত্তি নেই বলে জানান। শুনানি শেষে ১৮ দিন রিমান্ড বাকি থাকতেই ঢাকা মহানগর
ম্যাজিস্ট্রেট ১০ হাজার টাকা মুচলেকায় জামিন মঞ্জুর করেন। এ দিকে ঢাকা সিএমএম
আদালতে জামিন মঞ্জুরের সাথে সাথেই বারডেম হাসপাতালে তাকে আটক করে রাখার দায়িত্বে
থাকা পুলিশ হাসপাতাল ত্যাগ করে। হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ইসলামি
সংগঠনের নেতারা বাবুনগরীর এ অবস্থার জন্য সরকারকে চরম মূল্য দিতে হবে বলে
হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। আদালতের আদেশের পর অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, মিথ্যা ও
ভিত্তিহীন মামলায় লাগাতার রিমান্ডে রেখে বাবুনগরীকে ভয়ানক ও বর্বর নির্যাতন করা
হয়েছে। নির্যাতনে মৃত্যুপথযাত্রী দেশের শীর্ষস্থানীয় এ আলেমকে এখন জামিন দিয়ে
দায়মুক্ত হতে চায় সরকার।
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী এখন হাসপাতালে নিবিড় চিকিৎসাধীন, কথা বলতে পারছেন; তবে জীবনসংশয়
কাটেনি।
ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৫-৬ মের পুলিশি হত্যাকাণ্ডের তীব্র
প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও আরেক দফা সংবিধান লঙ্ঘনের মাত্রা চড়িয়ে ১৪৪ ধারা জারি না
করেই ঢালাওভাবে সবরকম সভা সমাবেশ মিছিল এমনকি পথপার্শ্বের মানববন্ধন পর্যন্ত
নামঞ্জুর বলে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছেন। সেই নিষেধাজ্ঞা অবশ্য বিরোধী জোটের ঝটিকা
মিছিল বিােভ সমাবেশ রুখতে পারেনি। ওই নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের ঘোষণা দিয়েই
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে পুনর্বহাল, মিছিল-সভা-সমাবেশের ওপর আরোপিত
নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ, আটক নেতাকর্মীদের মুক্তি, সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার
এবং সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ১৮ দলীয় জোট দেশজুড়ে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন
করেছে। ২৬ মের হরতালে সরকারের নিষেধাজ্ঞা ভেঙে রাজধানীসহ সারা দেশে মিছিল-পিকেটিং
করেছে ১৮ দলীয় জোট। পুলিশের সাথে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ সময় হরতাল সমর্থকদের
ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল নিেেপর ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ গুলি ছুড়েছে। হরতাল সমর্থকেরা
যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেছে। এভাবেই ঘটে চলেছে সরকার ও বিরোধী জোটের
রাজপথে সহিংস মোকাবেলা। চারটি বড় শহরে মেয়র নির্বাচনের মোকাবেলায় ১৫ জুন
পর্যন্ত একটা নিয়মতান্ত্রিক আবহ সৃষ্টি হলেও অন্যত্র স্থানীয় কারণে হরতাল আর
সংঘর্ষ লেগেই আছে। মফঃস্বল এলাকাগুলোতে প্রশাসন অসহায়, মতাসীনেরা
গণবিচ্ছিন্ন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন