কটা দেশের নির্বাচন পদ্ধতি কি বা কেমন হবে এটা একটা রাজনৈতিক বিষয়, রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট সংগঠন বা ব্যক্তিরা আলাপ-আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংসদের বাইরে বা ভেতরে বসে তা নির্ধারণ বা ঠিক করবে, এটাই স্বাভাবিক। আদালত থেকে রাজনৈতিক বিষয় নির্ধারণ বা ঠিক করে দেয়াটাই হবে অস্বাভাবিক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মত একটা রাজনৈতিক বিষয়কে বাতিল করে আদালত রায় দেয়ার পর এ নিয়ে দেশে এখন যে ভয়াবহ রাজনৈতিক সহিংসতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে আদালত বা কোন বিচারপতি আর একটা রুল জারি করে বা ফরমান দিয়ে তা এখন বন্ধ করে দিতে বা এর সমাধান দিতে পারে না কেন? এখন কেন রাজনীতিবিদদেরকেই দ্বিপক্ষীয়ভাবে বা কোন দেশী-বিদেশী তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের জন্য তাগিদ দেয়া হচ্ছে? কাজেই যেটা রাজনৈতিক বিষয় এবং যেটা রাজনীতিবিদরাই সমাধান দিবেন সে বিষয় আদালতে টেনে আনা যেমন ঠিক নয় আদালতেরও এমন রাজনৈতিক (স্পর্শকাতর) বিষয় উপেক্ষা করাই দেশ ও জাতির স্বার্থে শ্রেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় রাজনৈতিক বিষয় ছাড়া আমাদের দেশে আরো অনেক বিষয় বা জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আছে যেখানে স্বতোপ্রণোদিত হয়ে আদালতের তথা বিচারকদের কঠোরভাবে হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য রাজনৈতিক বিবেচনায় বা দলীয় আনুগত্যের সুবাদে নিয়োগ পাওয়া বিচারপতিদের দ্বারা পরিচালিত বিচার বিভাগ আজ কথিত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নামে দলীয় সরকার বা দলীয় সরকারের প্রশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত/নির্দেশিত হয়েই বলতে গেলে বিচার (উল্লেখ করার মত নয় সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) কাজ পরিচালনা করছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে এমনই একটা স্পর্শকাতর ও বিতর্কিত রাজনৈতিক বিষয়ে রায় দিয়ে সারা দেশে আগুন লাগিয়ে দিয়ে চলে গেছেন, এ আগুনে এখন জ্বলছে দেশের সাধারণ মানুষ, দেশের সম্পদ, বিদেশের কাছে বাংলাদেশকে একটা সহিংস ও অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছেন।
বিরোধী জোটের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুন:বহালের দাবির জবাবে শেখ হাসিনা বারবার ১/১১-এর কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা উল্লেখ করে বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে জুজুর ভয় দেখান। অথচ শেখ হাসিনা নিজেও জানেন ও বুঝেন জেনারেল মইনের ১/১১-এর জরুরি অবস্থার কথিত তত্ত্বাধায়ক সরকার আর ১৯৯৬ ও ২০০১-এর নির্বাচন পরিচালনাকারী তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনভাবেই এক জিনিষ নয়। অথচ মজার ব্যাপার হলো ১/১১-এর কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেই শেখ হাসিনা সন্তুষ্ট চিত্তে তাদের ২০০৭-২০০৮-এর আন্দোলনের ফসল বলে বহুবার দেশের ও বিদেশের জনগণের কাছে দাবি করেছেন। শুধু তাই নয়, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরি করার দাবি জানিয়ে প্রকারান্তরে শেখ হাসিনাই জে: মইনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ২ বছর ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ভোটার তালিকায় ভুয়া ভোটার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় শুধু তাকে আবার সংশোধন বা হাল নাগাদ করলেই তা ২ মাসের মধ্যে করা যেত, ছবিযুক্ত ভোটার লিস্ট তৈরি করা একটা সময়সাপেক্ষ ব্যয়বহুল ব্যাপার, এ দাবিকে পুঁজি করেই নির্বাচন কমিশন আরো এক ধাপ এগিয়ে একই সাথে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির পরিকল্পনা করে জে: মইনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তাছাড়া যে ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদাহরণ দিয়ে শেখ হাসিনা এখন খালেদা জিয়া তথা বিরোধী জোটকে ভয় দেখাচ্ছেন ক্ষমতায় আসার আগে তিনিই বারবার দাবি করেছেন এটা তার ও তার জোটের আন্দোলনের ফসল এবং মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সকল কর্মকান্ডকে ক্ষমতায় গেলে তিনি বৈধতা দিবেন। খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠজন বা বিরোধী মহল থেকে এ কথাও শোনা যায় বা অভিযোগ করা হয় জে: মইনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বন্দি অবস্থায় থাকাকালীন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার কাছে মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সকল কর্মকান্ডকে বৈধতা দিলে এবং ক্ষমতায় গেলে তাদের কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে না - এ ব্যাপারে মুচলেকা দিলে বা অঙ্গীকার করলে তাদেরকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে বিদেশ যেতে বা রাজনীতি করতে দেয়া হবে। এ ব্যাপারে খালেদা জিয়া কোন আপোষ করেননি। শেখ হাসিনা রাজি হওয়ায় তাকে বিদেশে যেতে দেয়া হয় এবং পরবর্তীতে বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদেরকে কথিত দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করে জেলে ভরে, সাজা দিয়ে, তারেক রহমানকে শারীরিকভাবে পঙ্গু করে দিয়ে, নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে বিএনপি’কে ২ টুকরো করার চেষ্টা চালিয়ে নির্বাচনের আগে দলে বিভক্তি সৃষ্টি করে, নির্বাচনের আগে বিএনপি’র নেতাদের গায়ে সফলভাবে দুর্নীতির লেবেল লাগিয়ে জে: মইন নির্বাচনে বিএনপি’র ভরাডুবি’র ব্যবস্থা করে (নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছিল বলেও বিএনপি অভিযোগ করেছিল) শেখ হাসিনার জোটকে নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করার পথ সুগম করে দিয়েছিল। বিএনপি বা বিরোধী জোটের এ অভিযোগের (যদি সত্য নাও হয়) সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা সরকার জে: মইনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারা তার নিজের (বন্দি রাখা অবস্থায় তাকে খাদ্যে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রসহ) ও তার দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার জেল-জুলুম-অত্যাচারের জন্য জে: মইন, জে: মাসুদ বা অন্য কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বরং তার ওয়াদামত সেই সরকারের সকল কর্মকান্ডকে বৈধতা দিয়েছেন এবং জে: মইন ও ফখরুদ্দীনকে নির্বিঘেœ বিদেশে যেতে ও জে: মাসুদকে বিদেশে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে দিয়েছেন (এখনও সেখানে কর্মরত আছে)। অবস্থার পূর্বাপর বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় শেখ হাসিনা ১/১১-এর সরকারের সার্বিক আশীর্বাদ পেয়েই ক্ষমতায় এসেছেন। অথচ এখন খালেদা জিয়া ও বিরোধী জোটকে ১/১১-এর কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভয় দেখিয়ে বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসলে আবারও যে উনি (খালেদা জিয়া) জেলে যাবেন না এর কি কোন নিশ্চয়তা আছে? প্রশ্ন হচ্ছে শেখ হাসিনা আন্দোলন করে ১৯৯৬ সালে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন, হাবিবুর রহমান ও লতিফুর রহমানের তিনটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি জে: মইনের ১/১১-এর কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মত ২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন বা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে জেলে ঢুকিয়েছিলেন? ১৯৯৬ ও ২০০১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদাহরণ না দিয়ে জে: মইনের ১/১১-এর কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদাহরণ দিয়ে শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে যে জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন জনগণ এটা সহজেই বুঝতে পারে, জনগণকে এত বোকা ভাবা ঠিক নয়।
সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দিয়ে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী জোট সরকারের মন্ত্রী ও সমর্থকরা এখন বেশ জোরালোভাবে বলছে নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়াটাই গণতান্ত্রিক, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা অগণতান্ত্রিক। একটা নির্বাচিত সরকার আর একটা নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে এটাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। তাহলে আমাদের দেশের (অন্য দেশের কথা বাদ দিলেও) হাজারো সংগঠন ও সংস্থায় যেসব নির্বাচন হচ্ছে সেখানে কি নির্বাচিত ক্ষমতাসীন কমিটির দ্বারাই পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়? বর্তমানে দেশে যেসব স্থানীয় সরকার ও জেলা পরিষদ রয়েছে সেখানে কি অনির্বাচিত প্রশাসকরা দায়িত্ব পালন করছেনা? সেখানে কি একটা নির্বাচিত সরকার বা প্রশাসন আর একটা নির্বাচিত প্রশাসন বা কমিটির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করছে (ঢাকা সিটি করপোরেশনই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ)? এটা কি অগণতান্ত্রিক নয়? অথবা এমন অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কি গণতান্ত্রিক নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরকে বাধাগ্রস্ত করছে?
খেলার মাঠে খেলা পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষ রেফারি নিয়োগ করা হয়, প্রতিদ্বন্দ্বি দুই দলের মধ্য থেকে টসের মাধ্যমে কাউকে রেফারি নিয়োগ করা হয়না কেন? তাহলে এটা কি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়? দুই দলের মধ্য থেকে কাউকে রেফারি করা হলে পক্ষপাতিত্ব করা হবে অর্থাৎ এক দলের ওপর আর এক দলের বিশ্বাস বা আস্থা নাই বলেই খেলা পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষ রেফারি নিয়োগ দেয়া হয়। তেমনিভাবে নির্বাচনটাও প্রতিদ্বন্দ্বি রাজনৈতিক দলের একটা খেলা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস না থাকে তবে এখানেও একজন নিরপেক্ষ রেফারির মত যদি নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য একটা অনির্বাচিত সরকার (তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকার) নির্বাচন পরিচালনা করে তবে তা অগ্রহণযোগ্য বা অযৌক্তিক হবে কেন? একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে যদি একটা নিরপেক্ষ (তৃতীয় পক্ষ) ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন হয় তবে তার মাঝখানে গণতন্ত্র আর অগণতন্ত্রের প্রাচীর দাঁড় করানোর কি যুক্তি থাকতে পারে? এ ব্যাপারে বর্তমান সরকার পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণও দিচ্ছে। অথচ তার আগে একবারও আত্ম-পর্যালোচনা বা উপলব্ধি করা হয় না যে আমরা কি অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মত বিগত ৪২ বছরে প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক হতে পেরেছি? কথিত ’৯০-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর “গণতন্ত্র” ছিনিয়ে এনে বিগত ২৩ বছরে কি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে বা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পেরেছি? বরং গণতন্ত্রকে সহিংসতা ও সন্ত্রাসে পরিণত করেছি, কথিত গণতান্ত্রিক যুগের প্রতিটি নির্বাচনের সময়েই দেশে রাজনৈতিক হানাহানি ও সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আমরা এমন গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা করেছি যে একটা নির্বাচনও আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে পারি না। গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো পরমত সহিষ্ণুতা, উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের জনগণ বা রাজনীতিবিদদের মত আমাদের বিশেষ করে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে কি এই গণতান্ত্রিক মানসিকতা আছে? আমাদের দেশে বিরোধী বা নিরপেক্ষ মতকে যেভাবে কটাক্ষ ও সমালোচনা করে উপেক্ষা করা হয় এবং বিরোধী দলকে দমন ও পীড়ন করা হয় পৃথিবীর অন্য কোন গণতান্ত্রিক দেশে কি সেভাবে করা হয়? আমাদের দেশে বিরোধী দল যেভাবে গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে সহিংস রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালায় এবং অপরদিকে সরকারও যেভাবে বিরোধী দলীয় নেতাদের রাজপথে চোরের মত পিটায়, গুলী করে মারে, মামলার পর মামলা, রিমা-ে নিয়ে অমানুষিক অত্যাচার এমনকি রাজনৈতিক নেতাদের চোর-ডাকাতের মত ডা-াবেড়ী পরিয়ে রাখা হয় পৃথিবীর অন্য কোন গণতান্ত্রিক বা সভ্য দেশে কি তা হয়? আমাদের দেশে তথাকথিত সংসদীয় গণতন্ত্রের আবরণে যেখানে এক ব্যক্তির হাতে স্বৈরাচারের মত ক্ষমতা থাকে ও প্রয়োগ করা হয় অন্য কোন গণতান্ত্রিক দেশে কি তা আছে? আমাদের দেশে লাগাতার সংসদ বর্জনের যে সংস্কৃতির চর্চা চলছে অন্য কোন গণতান্ত্রিক দেশে কি তা আছে? অন্যান্য দেশের সংসদে যে কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে উত্তেজনা বা মারামারিও হয়, কিন্তু সেসব দেশে আমাদের দেশের সংসদের মত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য, অসভ্য ও অশ্লীল ভাষায় গালাগালি ও মারামারির উপক্রম হয় না, ঐসব দেশের রাজনীতিবিদরা দাবি আদায়ের বা সরকারের বিরোধিতার জন্য রাজপথে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়ে এমন সহিংস আন্দোলন করে না। আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন দল পরবর্তী মেয়াদে আবারও ক্ষমতায় আসার উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত প্রশাসনের সর্বস্তরে যেভাবে দলীয় আনুগত্যের লোকজনকে বসিয়ে দলীয়করণের নজীর স্থাপন করে পৃথিবীর অন্য কোন গণতান্ত্রিক দেশে শুধু পরবর্তীতে আবারও ক্ষমতায় আসার উদ্দেশ্যে কি এমন দলীয়করণ করা হয়? আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিচারালয়সহ সব কয়টা সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করে যেভাবে কলুষিত ও ধ্বংস করে পৃথিবীর অন্য কোন গণতান্ত্রিক দেশে কি তা করা হয়? আমাদের দেশে নির্বাচনের আগে কোটি কোটি টাকার মনোনয়ন বাণিজ্য (ঐড়ৎংব ঞৎধফরহম) হয়, ভোটের আগে টাকা-পয়সা দিয়ে ভোটার কেনা যায়, পৃথিবীর অন্য কোন গণতান্ত্রিক দেশে কি তা হয়? এমন আরো অনেক বিষয় ও ক্ষেত্র আছে যা অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে বিদ্যমান, কিন্তু আমাদের দেশে অনুপস্থিত। কাজেই কেবল স্বীয় রাজনৈতিক স্বার্থে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের উদাহরণ বা তুলনা দেয়া কি আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ বা ক্ষমতাসীন সরকারের বেলায় শোভা পায়? অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মত গণতন্ত্রের মূল ও প্রতিটি বিষয় যদি আমরা অনুসরণ করতাম তবে নির্বাচনের ব্যাপারেও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের ব্যবস্থা বা পদ্ধতিকে অনুসরণ করা বা তুলনা দেয়া যথার্থ ও যৌক্তিক বলে বিবেচনা করা যেত। আওয়ামী জোট সরকার সমর্থিত কিছু কিছু মহল ও ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন সময়ে টেলিভিশনের টক-শোসহ বিভিন্ন জায়গায় বেশ জোরালো গলায় বলে যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যেভাবে গণতান্ত্রিক চর্চায় এগিয়ে গেছে আমাদেরকেও এগিয়ে যেতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার অগণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে এসে আমাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, আমরা আর কত পিছিয়ে থাকব ইত্যাদি, ইত্যাদি। অর্থাৎ আমাদের মত বিতর্কিত ও বিকৃত গণতান্ত্রিক দেশে একটা সুষ্ঠু, ১০০% অবাধ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থাকে উনারা অগণতান্ত্রিক ও পিছিয়ে থাকার মানসিকতা হিসেবে বুঝাতে চাচ্ছেন, অপরদিকে সমস্ত প্রশাসন যন্ত্রকে প্রভাবিত করে ১০০% কারচুপি করার সম্ভাবনা ও সুযোগ সংবলিত ক্ষমতাসীন দলের অধীনে দেশে বিদেশে সবার কাছে অগ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন করাকে উনারা গণতান্ত্রিক ও সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চাবিকাঠি বলে মনে করছেন। আসলে তাদের ফর্মুলামত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তাদের সমর্থিত আওয়ামী জোটই আবার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশি বলে তারা তাদের চিন্তা-ভাবনা, মন-মানসিকতা ও প্রচারণাকে এভাবে সেট করে নিয়েছেন। অথচ পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মত আমাদের দেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার জন্য গণতান্ত্রিক চর্চায় ও মানসিকতায় আমাদের যে ঘাটতি রয়েছে সবার আগে সেখান থেকে বের হয়ে আসার কোন ফর্মূলা উনারা তাদের সমর্থিত সরকারকে দেননা। শুধু দলীয় সরকারের অধীনে একটা নির্বাচন করলেই কি আমরা তাদের ভাষায় সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাব? ২৩ বছর যাবত তো দেশের মানুষ নির্বাচন দেখছে, কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্র কি দেখতে পাচ্ছে?
সরকারি মহল ও তাদের সমর্থকেরা প্রায়ই বলে যাচ্ছেন নির্বাচন কমিশন একটা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, তারাই নির্বাচন করবে, সুতরাং নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনে আরো কিভাবে শক্তিশালী করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এটাও একটা হাস্যকর ও প্রহসনের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশন যে একটা ঠুঁটো জগন্নাথ এটা সবাই জানে ও দেখে, নামে সাংবিধানিক ও স্বাধীন হলেও এটা আসলে পরাধীন তথা সরকারের অধীন। যে সরকার ক্ষমতায় আসে নির্বাচন কমিশনকে তাদের পছন্দের লোক দ্বারা গঠিত করে এবং নির্বাচনের সময় তাদেরকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারের আমলের নির্বাচন কমিশনের আচরণ ও কর্মকা- জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে এবং তাদের ব্যাপারে বিরোধী দলের আপত্তি সব সময়েই ছিল, ২০০৭-২০০৮ সময়ের মধ্যে তা আরো প্রকট হয়েছিল। তাছাড়া নির্বাচন কি শুধু নির্বাচন কমিশনই করে? নির্বাচনের সাথে সরকারের আরো অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সরাসরি ও পরোক্ষভাবে জড়িত। সরকার কি নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যস্ত করবে? যদি তা করা হয় তবে বুঝা যাবে নির্বাচন কমিশন সত্যিকার অর্থে নির্বাচনের সময় স্বাধীনভাবে কাজ করছে কিনা এবং সরকার ঐ সময় নিষ্ক্রিয় ও নিরপেক্ষ থাকছে কিনা। সরকারি মহল ও তাদের সমর্থকেরা তাদের কথিত ইচ্ছানুযায়ী “গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে” সব দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠিত করে পরীক্ষামূলকভাবে অন্তত একবার সরকারকে কি এ ফর্মুলা গ্রহণ করার উপদেশ দিবেন?
সরকারি মহল ও তাদের সমর্থকরা প্রায়ই এ কথাও বলে যাচ্ছেন এ সরকারের আমলে প্রায় ৬০০০-এর মত স্থানীয় ও কয়েকটা উপ-নির্বাচন হয়েছে, কোথাও কোন কারচুপি বা সরকারি হস্তক্ষেপ হয়নি। স্থানীয় ও উপ-নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচনের গুরুত্ব এক নয়, এসব নির্বাচনে জয় পরাজয় সরকার বা বিরোধী দলের কোন মাথা ব্যথার কারণ নয়। এ কারণে এসব নির্বাচনে সরকারের তেমন হস্তক্ষেপ করা বা কারচুপি করার প্রবণতা কম থাকে। বর্তমান ৪ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনই তার প্রমাণ, এমন ফলাফলের পরেও সরকারের ক্ষমতা ছাড়ার কোন সুযোগ বা আশংকা নাই। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন বা ৩০০ আসনের সংসদ নির্বাচন সরকার ও বিরোধী দলের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ নির্বাচনে সরকার বা ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, দেশ চালানোর জন্য সরকার পরিবর্তন হয়, ক্ষমতার মসনদ দখল করার সুযোগ হয়। এ কারণে জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার ও কারচুপি করার সম্ভাবনা বা আশংকাও বেশি থাকে। এক সাথে একই দিনে সারা দেশে একই সময়ে ৩০০ আসনে নির্বাচন হয় বলে প্রতিটা আসনে, প্রতিটা ভোট কেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যেমন কঠিন, তেমনি দেশের সব কয়টা টিভি চ্যানেল, পত্রিকার সাংবাদিক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের পক্ষেও একই দিনে বা কয়টা আসনের খবর সংগ্রহ ও নজরদারি বা তদারকি করা সম্ভব নয় (পর্যাপ্ত লোকবলের ও সাজ-সরঞ্জামের অভাবে)। ক্ষুদ্র পরিসরে স্বল্পসংখ্যক আসনে কেবল সেটা সম্ভব।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থার জন্ম নিয়েছে, অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চার যে প্রসার ঘটেছে, দলীয়করণ ও দুর্বৃত্তায়নের যে ন্যক্কারজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, ছলে বলে কৌশলে (পুনরায়) ক্ষমতায় যাওয়ার যে মানসিকতার জন্ম হয়েছে এ অবস্থার মধ্যে একটা দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন কি বিরোধী দল মেনে নিবে? বিএনপি সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনও তাই আওয়ামী লীগ প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং আন্দোলন করে তখন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা কায়েম করেছিল। এমনকি ২০০৭-এর ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় বিএনপি ক্ষমতায় ছিল না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যার (বিচারপতি কে. এম. হাসান) হওয়ার কথা ছিল তার কোন এক কালে বিএনপির সাথে সংশ্লিষ্টতার কথিত অভিযোগে তাকে প্রধান উপদেষ্টা মেনে নিবে না বলে আওয়ামী জোট ব্যাপক হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু করেছিল, এরপর ইয়াজ উদ্দীন (বিতর্কিত পন্থায়) প্রধান উপদেষ্টা হওয়ায় বিএনপির লোক বলে আওয়ামী জোট তাকেও না মেনে সারা দেশে স্মরণকালের ভয়াবহ সহিংস আন্দোলন শুরু করেছিল, যার ফলশ্রুতিতে ১/১১-তে জে: মইন রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দীনকে দিয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে একটা কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েম করে ২ বছর ক্ষমতায় ছিল। আর এখন ২০১৪ সালের নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়কের পরিবর্তে শেখ হাসিনাকে সরকার প্রধান রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী জোটের একটা নিরংকুশ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে বিরোধী দল অংশগ্রহণ করবে বা নির্বাচনকে মেনে নিবে এটা প্রত্যাশা করা কি অস্বাভাবিক ও দিবাস্বপ্ন নয়?
আমাদের দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এবং নজিরবিহীন গণতান্ত্রিক পরিবেশে সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য একটা নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার বিকল্প এখনো চিন্তা করার সময় আসেনি (যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা বিশেষ করে রাজনীতিবিদরা মন-মানসিকতায়, চিন্তা-চেতনায় এবং আচার-আচরণে অন্যান্য উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের জনগণের সমতুল্য হতে না পারবো)।
তাই, মাথা ব্যথা হলে যেমন মাথা কেটে ফেলে দেয়া কোন স্থায়ী চিকিৎসা নয় তেমনি (কেবল ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনায়) তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা খারাপ (?) বলে আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে তাকে সমূলে উৎখাত করে দেয়াও উত্তম কাজ নয় (যার প্রমাণ এখন দেশে বিরাজমান)। বরং ২০০৭-এর নির্বাচনের আগে এ ব্যবস্থায় যেসব অনিয়ম ও ত্রুটি বা ফাঁক-ফোঁকর ছিল সবাই মিলে এখন আলোচনার মাধ্যমে তাকে সংশোধন ও সময়োপযোগী করাটাই ছিল উত্তম ও প্রত্যাশিত কাজ। তাই আগামী সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের চলমান সংকটকে কার্যকরভাবে সমাধান করতে হলে আলোচনা বা সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার ব্যাপারে একটা সমঝোতা বা ঐকমত্যে পৌঁছানো ছাড়া আর কোন পথ খোলা আছে বলে মনে হয় না। একগুঁয়েমী বা একতরফা সিদ্ধান্ত কখনও সবার তথা দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। বিশেষ করে ৪ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলের প্রেক্ষিতে বিরোধী দলের অবস্থান ও বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে সরকারকে একগুঁয়েমী বা স্বার্থান্বেষী মহলের কুপরামর্শকে পরিহার করতে হবে। সরকারের অন্ধ দাম্ভিকতা, উগ্রতা ও বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার ব্যর্থতাই সিটি করপোরেশনে তাদের ভরাডুবির অন্যতম প্রধান কারণ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন