শনিবার, ২২ জুন, ২০১৩

ডিজিটাল গোয়েন্দাগিরি


বিশ্বব্যাপী সাক্ষাতের প্রথম প্রশ্ন, কেমন আছো? বা ভালো আছো? আর জবাব, ভালো আছি বা ভালো নেই। অর্থাৎ খবর জানার প্রবল ইচ্ছার প্রথম প্রকাশ। সংবাদমাধ্যমের জন্মও এই জনমানসের জানার চিকীর্ষা পূরণের মাঝ দিয়ে। এ কর্মকাণ্ড সংবাদমাধ্যম সফলভাবে করতে শুরু করলে, ক্ষমতাবানেরা ও চিন্তাবিদেরাÑ এর ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। ক্ষমতার তিন অঙ্গের সাথে একে জড়িয়ে চতুর্থ এস্টেট নাম দিয়ে এর অবস্থান নির্ণয় করে। সেই থেকে ক্ষমতা ও সংবাদমাধ্যমের সম্পর্ক সেই ‘ঘৃণা ও প্রেমের’ চিত্রেরই একাংশ। ক্ষমতা সংবাদমাধ্যমকে আদরে কোলে তুলে নেয় যখন এ মাধ্যম তার গুণগানে সরব থাকে। ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে যখনই এ মাধ্যম তার সত্য স্বরূপের চিত্রায়নে ব্যস্ত হয়। এর সবচেয়ে ভালো দৃষ্টান্ত হলো ডাকাতদলের নেতার ব্যবহার। বশংবদটির জন্য কিছু ভালো উপহার এবং আদরের লাথি-গুঁতো দিয়ে নিজের মতো করে ব্যবহার আর যারা এর ব্যত্যয় ঘটাবে তাদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ। বিশ্বের সব সংবাদমাধ্যমের বর্তমান ভাগ্যকে এই একটি বাক্যে প্রকাশ করা চলে।
সংবাদমাধ্যম সবাইকে টানে। আদর্শবাদীদের যেমন প্রধান আশ্রয়স্থল তেমনি অপরাধীদের আখড়া হতেও দেখা যায়। কারণ সবাই ‘কেমন আছো’ বলতে চায় আর ‘ভালো আছি’ শুনতে চায়। তবে যখনই সেই ডাকাতদলের সর্দারেরা প্রাধান্য লাভ করে, তখনই এই ফোর্থ এস্টেটের অবস্থা করুণ হতে থাকে। আর এই এস্টেটের অবস্থা করুণ হলে, সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ হয় সবার আগে। কারণ যা কিছু ছিটে ফোটা এই সংবাদমাধ্যমই তাদের কথা বলে।
সংবাদমাধ্যমের মূল শক্তি সত্য কথন। জনগণও তাই কামনা করে। সংবাদমাধ্যমে তাই কোনো বক্তব্য আসলে পাঠক প্রথমেই তাকে বিচারের ডকে ওঠায় না। তারা বিশ্বাস করতে চায়। তারা বিশ্বাস করে এ মাধ্যমের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্যের সাথে থাকা। তাই খবরের কাগজের বক্তব্যের এই গ্রহণযোগ্যতা। আর এই একই কারণে ক্ষমতাবানেরা সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। সরকারে অধিষ্ঠিত ক্ষমতাবানেরা যতটা ত্রিত্ত্বের (সম্পদ, ক্ষমতা ও সুবিধা) প্রতি আকৃষ্ট, ঠিক ততটাই তারা কঠোর হয় সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এটা স্বতঃসিদ্ধ যে কোনো সরকার কতখানি জনকল্যাণকামী ও গণতন্ত্রের বিশ্বাসী তার সহজ প্রমাণ হলো সে সরকার সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ কতখানি করছে। এ নিয়ন্ত্রণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ সবাই বুঝতে পারে। যেমন সংবাদমাধ্যমকে বন্ধ করে দেয়া, তার নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা আইনের প্রবর্তন, প্রকাশনাকে আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বল করে স্বাভাবিক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া, শাসকযন্ত্রকে ব্যবহার করে সব সময় ভীতি এবং অসহায় অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়া, ইত্যাদি আর এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাবানদের স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক চরিত্রকেই প্রকাশ করে। তবে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ আরো ভয়াবহ। এক দিকে এই নিয়ন্ত্রণ লোকচুর অন্তরালে, অপর দিকে সংবাদমাধ্যমের পক্ষে এই নিয়ন্ত্রণকে জনসম্মুখে তুলে ধরে কোনো সমর্থন আদায় করাও অসম্ভব। আবার এই নিয়ন্ত্রণ হয় আইনের ছত্রচ্ছায়ায়। এর জন্য এমন ক্ষমতাবানেরা একের পর এক নতুন আইন নির্মাণ করে।
আর এসব নিয়ন্ত্রণের একই উদ্দেশ্য। সংবাদমাধ্যম যেন জনগণের হয়ে সত্য না বলতে পারে। সত্য উদঘাটনে হয় অপারগ। এ কাজটি ক্রমান্বয়ে জটিল ও কঠিন হয়ে পড়ছে। এতে সাহায্যে আসছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তার চিরাচরিত ভূমিকা নিয়ে। বিজ্ঞানের এবং প্রযুক্তির সব সুবিধা আর সাহায্য অবশেষে মানবের অকল্যাণেই কেন বেশি ব্যবহার হয় এই প্রশ্নের জবাব অবশ্য এক কথায় সম্ভব নয়। ডিনামাইট আবিষ্কৃত হয়েছিল কঠিন কাজকে সহজ করার জন্য। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার ব্যবহার হচ্ছে মানুষের অকল্যাণে। তেমনি সবচেয়ে আধুনিকতম প্রযুক্তি ইন্টারনেটকে ক্রমান্বয়ে মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। একে ব্যবহার করে মানুষের একান্ত অধিকার, বক্তব্যের স্বাধীনতা, সর্বোপরি স্বাধীনতাকে নানাভাবে সীমিত করার কর্মকাণ্ড চলছে দ্রুত অথচ সঙ্গোপনে। এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিচ্ছে প্রযুক্তিতে পারঙ্গম দেশগুলোর ক্ষমতাবানেরা। সাধারণ মানুষ জানতেও পারছে না তাদের সব অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, বিশেষ করে যে অধিকারগুলো তাদের সবচেয়ে প্রিয়, তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই গোপনীয়তা ছিনতাইর ঘটনা আর একবার ফাঁস করে দিলেন আর একজন সত্য ও স্বাধীনতার ধারক, বাহক ও পূজারি। অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেন ফাঁস করে দিয়েছেন ‘ডিজিটাল গোয়েন্দাগিরির’ (ডিজিটাল স্পাইইং) অভূতপূর্ব কর্মকাণ্ডে এক ঝলক। এ তথ্য ফাঁসের মাঝ দিয়ে যে ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে এসেছে তা সব বোদ্ধা মানুষকে অভিভূত করতে এতটুকু সময় নেয়নি। স্নোডেন ব্রিটেনের গার্ডিয়ান ও আমেরিকার ওয়াশিংটন পোস্টের কাছে এই ডিজিটাল গোয়েন্দাগিরির তথ্য ফাঁস করে দেন। এক কথায় এই কর্মকাণ্ড শুধু প্রতিটি মার্কিনিকেই শুধু নয়, বিশ্বের প্রতিটি মানুষই এর নজরদারির আওতায় এসে গেছে। এ তথ্য পশ্চিমা জগতে তুমুল আলোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠিয়েছে। সেই সাথে আলোচনা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। এমনি এক তথ্য ফাঁস করে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বন্ধ করা হয়েছিল।
এলসবার্গ ছিলেন মার্কিন প্রতিরক্ষা কনসাল্টিং প্রতিষ্ঠান র‌্যান্ড করপোরেশনের একজন বিশ্লেষক। বিবেকতাড়িত হয়ে তিনি বুঝেছিলেন, ভিয়েতনামে যে অনৈতিক যুদ্ধ চলছে তাতে শুধু হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের হত্যা হচ্ছে না, সরকার জনগণের নামে জনগণের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। ‘আমার মনে কোনো দ্বিধা ছিল না যে সরকার এক অন্যায় কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। তাই জনগণকে আসল তথ্যের একাংশ জানিয়েছিলাম যাতে তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে’Ñ এলসবার্গ মন্তব্য করেন। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নিক্সন সরকার তাকে গ্রেফতার ও বিচার শুরু করে। তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় বিচার করা হচ্ছিল। ঠিক এ সময়েই ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারিও ফাঁস হয়ে পড়লে নিক্সন বিদায় হয় এবং এলসবার্গ সসম্মানে মুক্তিলাভ করেন।
তবে ক্ষমতাবানেরা তাদের ‘সম্পদ, ক্ষমতা ও সুবিধার’ (ওয়েলথ পাওয়ার অ্যান্ড প্রিভিলেজ) জন্য বারবার এমন জনবিরোধী কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যাপী করে যাচ্ছে। এর প্রথম শিকার হচ্ছে সত্যান্বেষী সংবাদমাধ্যমগুলো। ফলে বিশ্বের প্রতিটি দেশেই এমন সত্যান্বেষী সংবাদমাধ্যমের সংখ্যা সীমিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে এ অবস্থা অত্যন্ত করুণ। উল্লেখ্য, ক্ষমতাবানদের বশংবদ সংবাদমাধ্যমগুলো মাঝে মাঝে এলসবার্গের মতো বিবেকবানদের দেয়া গোপন তথ্যগুলো ফাঁস করে জনগণের বিশ্বাসের পাত্র হয়ে থাকতে চাইছে। এবারো স্নোডেনের ডিজিটাল গোয়েন্দাগিরির তথ্য ফাঁস করল এমনি সংবাদমাধ্যম। অবশ্য এমন গোপন তথ্যের কণামাত্র তৃতীয় বিশ্বের কোনো সংবাদমাধ্যম ফাঁস করার জন্য তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সম্পাদককে জেল-জুলুম-নির্যাতন সইতে হয়েছে। সর্বোপরি বশংবদ সংবাদমাধ্যমগুলো এমন সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে। ক্ষমতাবানরা যেসব অনৈতিক কথা বলেছে, তার পুনরাবৃত্তি করতে তারা পাচ্ছিল তীব্র আনন্দ। বাংলাদেশে এর দৃষ্টান্ত এখন এত প্রকট।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি সুবিধা আছে। সেখানে আদালতে জনগণ এখনো স্বস্তি পায়। কারণ প্রতিকার পায়। সেখানের আদালত তৃতীয় বিশ্বের আদালতগুলোর মতো ক্ষমতাবানদের পুরোপুরি আজ্ঞাবহ হয় না। বিবেক অনেকখানি কাজ করে। তবে ক্ষমতাবানেরা বারবার আদালত এবং জনগণের কাছে নিন্দিত হয়ে, জনমানসকে পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় রত আছে। প্রযুক্তি তাদের এ ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতা দিচ্ছে। আর প্রযুক্তির কারণে সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের সফল পদ্ধতিগুলো বিশ্বব্যাপী এক সাধারণ গুণিতকের মতো কাজ করছে। তবে উন্নত দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির অমার্জিত ব্যবহার করছে তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতাবানেরা। বিশেষ করে নির্বাচিত স্বৈরাচার শাসকেরা।
এবারের দু’টি গোপন তথ্য ফাঁসের ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঝড় তুলেছে। তবে দু’টিতেই একই পদ্ধতির ব্যবহার হয়েছে। মার্কিন প্রধান সংবাদমাধ্যম এপির সাংবাদিকদের টেলিফোন ও অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমের ওপর গোয়েন্দাগিরি ও হামলা এবং মার্কিন সরকারের বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল গোয়েন্দাগিরি এই একই সূত্রে গ্রথিত।
পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘দিসকান্টবিহ্যাপেনিং অনলাইন’ সংবাদমাধ্যমের সদস্য আলফ্রেডো লোপেজ এপির ১০০ জন সাংবাদিকের টেলিফোন, ইমেইল ও অন্যান্য যোগাযোগের ওপর সরকারি আড়িপাতার ব্যাপকতার একটি হিসাব দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, মার্কিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি প্রতিদিন ১৭০ কোটি ইমেইল, ফোন এবং অন্যান্য যোগাযোগের বক্তব্য শুধু পড়েই না, প্রয়োজনীয় অংশ সংরক্ষণ করে এদের ব্যবহারকারীদের প্রয়োজনে আইনের আওতায় আনার কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। অধুনা তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতাবানেরা এ পদ্ধতির অনুসরণে আইন তৈরি করছে এবং প্রতিবাদীদের ধড়পাকড়ে ব্যস্ত।
এপি কখনো সরকারের বিরোধিতা করে না। তবু কেন তার সাংবাদিকেরা গোয়েন্দা নজরদারিতে এলো? তারা একটি একান্ত সংবাদের পেছনে ছুটছিলেন এবং তা সরকারি কৃতিত্বকেই তুলে ধরার জন্য। তারা জানতে পারে সিআইএ একটি ইয়েমেনি সন্ত্রাসী কাণ্ড ঠেকিয়ে দিয়েছে আড়িপাতা তথ্যের ভিত্তিতে। সিআইকে জিজ্ঞেস করলে, তারা খবরটি ছাপাতে নিষেধ করে। এপি তখন নতুনভাবে অনুসন্ধান করে এর সত্যতায় নিশ্চিত হয়ে খবরটি প্রকাশ করে। ঘটনাক্রমে তা সরকারিভাবে প্রকাশের এক দিন আগে। এটাই ছিল এপির অপরাধ। তখন এনএসএ এপির দুই মাসের কর্মকাণ্ড আটক করে জানার চেষ্টা করে এপি খবরটি পেল কী করে। তবে এলসবার্গ বা স্নোডেনের ফাঁস করা ঘটনাগুলোর জন্য এমন কষ্ট করতে হয়নি এনএসকে। মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট এপির তথ্য আটকের বিষয়ে জড়িত ছিল। লোপেজ এ কর্মকাণ্ডকে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে বর্ণনা করেছেন। তবে এমন তথ্য আটক যদি সংবাদপত্রের সর্বাপেক্ষা স্বাধীনতার দেশ যুক্তরাষ্ট্রে এমনভাবে ঘটতে পারে, তাহলে অন্য দেশগুলোতে এটা কেমন হতে পারে, তা শুধু অনুমেয়। বিশেষ করে সে দেশগুলো যদি তৃতীয় বিশ্ব হয়।
বিশ্বব্যাপী সংবাদমাধ্যমের একটি ধারণা স্বতঃসিদ্ধ। সংবাদমাধ্যম আদালতের বিশেষ চাপ ছাড়া সংবাদ উৎস প্রকাশ করে না। যদি সে উৎস নিজেকে প্রকাশ না করতে চায়। এখন ডিজিটাল গোয়েন্দাগিরির বদৌলতে সংবাদমাধ্যমের অজান্তেই এই উৎসের খবর সরকার জানতে পারবে। স্নোডেন বলেছেন, এনএসএ’র (ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি) বিশাল তথ্য সংরক্ষণ ভাণ্ডার বিশ্বের যেকোনো কম্পিউটারে প্রবেশ (হ্যাক) করতে পারে। এর জন্য তাকে প্রতিটি কম্পিউটারে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এর নেটওয়ার্ক ব্যাকবোনে (যাকে রুটার বলা হয়) ঢুকে এক সাথে হাজার হাজার কম্পিউটারের তথ্য আহরণে সক্ষম। এ কর্মকাণ্ডটি প্রায় একদশক ধরে চলছে। তিনজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাউন্টার টেরোরিজমের অ্যাডভাইজার রিচার্ড এ কার্ক নিউ ইয়র্ক ডেইলি নিউজের এক নিবন্ধে এই তথ্য চোরাইকে ‘ভ্যাকুয়াম কিনার অ্যাপ্রোচ’ বলে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ এ কিনারগুলো যেমন বর্জ্য পদার্থগুলোকে শুষে নেয়, তেমনি ডিজিটাল গোয়েন্দাগিরির দ্বারা প্রার্থিত তথ্য বের করে আনা হয়। কী পরিমাণ তথ্য নেয়া হয়েছে? এনএসএ তার এই কর্মকাণ্ডকে নাম দিয়েছে ‘মুক্ত সংবাদদাতা’ (বাউন্ডলেস ইনফরম্যান্ট) যা প্রিজন নামের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তথ্য গ্রহণ করছে। গত মার্চের ৩০ দিনে এই কার্যক্রম শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত কম্পিউটার থেকে ৩০০ কোটি তথ্য সংগ্রহ করেছে। এ কার্যক্রম সারা বিশ্বের দিকে চেয়ে আছে। যেমন এই মার্চ মাসেই সারা বিশ্ব থেকে ৯৭০০ কোটি (৯৭ বিলিয়ন) তথ্য সংগ্রহ করেছে। এর মাঝে সর্বাধিক হলো ইরান থেকে। ইরান থেকে ১৪০০ কোটি (১৪ বিলিয়ন), পাকিস্তান থেকে ১৩৫০ কোটি (১৩৫ বিলিয়ন), জর্ডান থেকে ১২৭০ কোটি (১২.৭ বিলিয়ন), মিসর থেকে ৭৬০ কোটি (৭৬ বিলিয়ন), এবং ভারত থেকে ৬৩০ কোটি (৬.৩ বিলিয়ন) তথ্য সংগ্রহ করেছে। বাংলাদেশের তথ্যসংখ্যা দেখানো হয়নি। তবে যে ‘হিটম্যাপ’ প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে লাল রঙে বাংলাদেশের স্থান। এ লাল রঙ যারা প্রধান লক্ষ্য তাদের। এর মাঝে চীন, রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য অন্তর্ভুক্ত।
এ চিত্রটি একটি ভয়াবহ দিক নির্দেশ করে। তা হলো মুক্ততথ্য, সত্য বা প্রতিবাদের সব পথ বন্ধ করে দেয়ার জন্য পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখন ক্ষমতাবানদের হাতে। শুধু তাই নয়, এ অযাচিত তথ্যের ভাণ্ডারে আছে অশীলিত তথ্য যা প্রিন্ট সংবাদমাধ্যমে কখনো থাকে না। এক কথায় কারো কোনো গোপন তথ্য বলে কিছু থাকবে না এবং এ কার্যক্রমে বিশ্বের সব ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো সহায়তা দিচ্ছে। তাই মাইক্রোসফট, গুগুল, বিং ইয়াহু, স্কাইপি, ইউটিউব, ভিমিও, ফিকার, পিকাছা, ফেসবুক, টুইটার, আইফোন বা আইপ্যাডসহ সব ধরনের আধুনিক তথ্যবাহন এই কার্যক্রমের আওতায়। কোনো আইন নেই এর প্রতিবিধানের। এর প্রধান কারণ এই ইন্টারনেট সার্ভিসগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত। গার্ডিয়ানের গ্লেন গ্রিনওয়ার্ল্ড এ কে ‘হোম ফিল্ড এডভানটেজ’ বলে অভিহিত করেছেন। গ্লেন গ্রিনওয়ার্ল্ড গত সপ্তাহে গার্ডিয়ানে এই ডিজিটাল গোয়েন্দাগিরির কাহিনী প্রকাশ করেছেন। বিশ্বের অধিকাংশ ইন্টারনেট আর্কিটেকচার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হওয়ার কারণে মার্কিন গোয়েন্দারা এ সুযোগটা পাচ্ছে। এ জন্যই চীনের সার্চ ইঞ্জিন ‘বাইডু’ এখন বিশেষ জনপ্রিয়।
এই গোন্দোগিরির সপক্ষে সরকারি বক্তব্য হলো এটা সন্ত্রাস ঠেকাতে সাহায্য করেছে। এর বিরোধিতা করেছেন মার্কিন কয়েকজন স্বাধীনতাকামী সিনেটর। তারা প্রমাণ করেছেন কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম এই গোয়েন্দাগরির দিয়ে ঠেকানো সক্ষম হয়নি। কারণ সন্ত্রাসীরা জানে এমন নজরদারিতে তাদের টেলিফোন-ইত্যাদি আছে। সিনেটরেরা আরো দেখিয়েছিল, যে সফলতা এ ব্যাপারে এসেছে তা প্রচলিত পুরোনো পদ্ধতিতে।
আসলে ‘ওয়ার অন টেরর’ (সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ) গণতান্ত্রিক আকাক্সার বিরুদ্ধে ক্ষমতাবানদের যুদ্ধ। পিলজার তার বিখ্যাত ‘দি ওয়ার অন ডেমোক্রাসি’ ছবিতে এর চমৎকার চিত্র তুলে ধরেছেন। পিলজার বলেছেন, ‘এটা একটা বিশ্বজনীন ছবি, যা বিভিন্ন অতিকথনের আসল রূপ প্রকাশ করেছে। এটি একটি বিশ্বজনীন ছবি যা বিভিন্ন অতিকথনের আসল রূপ প্রকাশ করেছে। আসলে তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সত্য ও সফল উদ্দেশ্য এবং চরিত্র বর্ণনা করা হয়েছে।’ এখানে মানুষের মুখপত্র সত্যকথনের সংবাদমাধ্যমের শৃঙ্খলিত স্বরূপও উদঘাটিত হয়েছে।
সংবাদমাধ্যম বা ফোর্থ এস্টেটের জন্ম যে ‘ঘৃণা-ভালোবাসার’ আবহাওয়ায়, তার আচার-আকার পাল্টালেও এ এস্টেটের কর্মকাণ্ড ক্রমান্বয়েই দৃঢ়তর শৃঙ্খলে আবদ্ধ হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বে এ শৃঙ্খলের ব্যাপ্তি ও ব্যবহার অনুমানকেও হার মানায়। কারণ এখানে শুধু ক্ষমতাবান ও তাদের অনুসারীরাই বলতে পারেন এবং বলার অধিকার রাখেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads