বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন, ২০১৩

কালাকানুনে সমাধান নেই


পুলিশের বিরুদ্ধে যখন ঘুষ-দুর্নীতি-চাঁদাবাজিসহ এন্তার অভিযোগ, তখন পুলিশকে অবাধ ক্ষমতা দিয়ে পাস করা হলো সন্ত্রাস বিরোধী বিল। এর প্রতিবাদে সংসদ থেকে ওয়াক আউট করে বিরোধী দল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, গত মঙ্গলবার পুলিশকে অবাধ ক্ষমতা দিয়ে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত ও পরিধি বৃদ্ধি করে ‘সন্ত্রাস বিরোধী (সংশোধন) বিল-২০১৩’ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। বিলটিকে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের চেয়েও মারাত্মক কালো আইন বলে আখ্যায়িত করেছে বিরোধী দল। বিরোধী দলকে দমন করার জন্যই আইনটি পাস করা হচ্ছে- অভিযোগ করে বিলটি পাসের আগেই সংসদ অধিবেশন থেকে ওয়াক আউট করে বিরোধী দল। এদিকে বিলটি পাসের আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, কোনো ভদ্রলোক ও ভদ্র মহিলার বিরুদ্ধে আইনটি অপপ্রয়োগ করা হবে না। অগণতান্ত্রিক কাজ ও সন্ত্রাসের প্রতিকূলে, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের দমন কাজে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য এ বিলটি আনা হয়েছে। বিরোধী দল যে কারণে বিলটিকে কালো আইন বলে উল্লেখ করছে, তার ব্যাখ্যায় বলা হয়, বিলটির বিধান অনুযায়ী আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ অপরাধীর বিরুদ্ধে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়াই মামলা রুজু করতে পারবে এবং তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। এছাড়া ফেসবুকসহ যে কোনো ইন্টারনেট মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা, কথা-বার্তা, স্থির বা ভিডিও চিত্র, পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবেন। এ আইনের অধীনে অপরাধ জামিন অযোগ্য হিসেবে আগে থেকেই বিধান রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে নিবন্ধিত জাহাজ বা বিমানে অবস্থানকারীর ক্ষেত্রে আইনটি প্রযোজ্য হওয়ার কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম আইনটি কার্যকর হয়। এরপর ২০১২ সালে এটি প্রথমবার সংশোধন করা হয়। আর সরকারের শেষ বছরে দ্বিতীয় দফায় আইনটিতে অনেকগুলো মৌলিক সংশোধনী আনা হলো। বিশেষ করে রাজপথে মিটিং-মিছিলসহ রাজনৈতিক কর্মকা-ের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘটনাকেও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের আওতাভুক্ত করা হয়েছে এবার সংশোধনী বিলের মাধ্যমে। এছাড়া এ ধরনের কাজে সহযোগিতা, প্ররোচনা ইত্যাদিও সমান অপরাধ হিসেবে গণ্য করে শাস্তির বিধান করা হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন যখন একটি কালো আইন হিসেবে নিন্দিত হচ্ছে, তখন এর চাইতেও আরো মারাত্মক কালো আইন পাস করার উদ্যোগ সরকার কেন নিল? বিরোধী দল মনে করছে, আসল লক্ষ্য সন্ত্রাস দমন নয় বরং বিরোধী দল দমন। এবারের বিলে যেভাবে সংশোধনী আনা হয়েছে তাতে বিরোধী দলের মন্তব্যের উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়।
সরকার তো নিজেকে গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবেই দাবি করে থাকে। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে সরকারের আচরণে তেমন উদাহরণ লক্ষ্য করা যায় না। বরং সরকারের দমন-পীড়ন ও পুলিশের বিরোধী দল ঠ্যাঙানোর তৎপরতায় অনেকেই মনে করছেন, গণতন্ত্রের নামে আসলে দেশে চলছে এক ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসন। এই শাসনকে আরো পোক্ত করতেই যেন নতুন নতুন কালো আইন পাসের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। জনমনে প্রশ্ন জেগেছে, বিরোধী দল দমনে এত তৎপর হলেও সন্ত্রাস দমনে বিশেষ করে নিজ দলের সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকার এত অক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে কেন? বুধবারের পত্রিকায় এমন কিছু খবর মুদ্রিত হয়েছে যাতে উপলব্ধি করা যায়, সন্ত্রাস দমন ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। নইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. তুহিন মালিকের গাড়িতে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা হামলা চালায় কেমন করে? গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে কেমন করে সন্ত্রাসীরা হুমকি দিয়ে বলে, টক-শোতে অংশ নিলে হত্যা করা হবে তাকে। উল্লেখ্য যে, গত সোমবার রাতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভি’র টক-শোতে অংশগ্রহণ করার কারণে ড. তুহিন মালিককে এমন হুমকি দেয়া হয়। এ ঘটনায় তিনি রাজধানীর তেজগাঁও থানায় একটি জিডি করেছেন। এদিকে গাড়ির পার্কিং করা নিয়ে রাজধানীর গুলশানে ডিসিসি মার্কেটে গত মঙ্গলবার তা-ব চালিয়েছে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। তারা ভাংচুর করেছে ফার্মেসীসহ ১৫টি দোকান। হামলাকারীরা এ সময় ফাঁকা গুলীও ছোঁড়ে। ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত থাকলেও পালন করে নীরব ভূমিকা। ছাত্রলীগের ভাংচুরের সময় প্রাণভয়ে দৌড়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময় বিদেশীসহ বেশ কয়েকজন ক্রেতা আহত হয়েছেন। হামলাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বুধবার প্রতিবাদ সভা ডেকেছেন। তবে দুঃখের বিষয় হলো, ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারের দাবি কিংবা ড. তুহিন মালিকের জিডি বর্তমান সরকারের সময় তেমন ফলপ্রসূ হয় না। কারণ দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন পুলিশের দায়িত্ব হলেও পুলিশকে আজ-কাল লক্ষ্য করা যায় ভিন্ন ভূমিকায়। পুলিশ এখন যেন বিরোধী দল দমন ও সরকারি দল পালনে অবতীর্ণ হয়েছে। সরকারি দলের লোকজন এখন প্রকাশ্যে ভাঙচুর ও গোলাগুলীতে তৎপর হলেও পুলিশ সেখানে কর্তব্যের কথা ভুলে যায়। আর বিরোধী দল মানববন্ধনের মত নিরীহ কর্মসূচি পালন করতে গেলেও অতি তৎপর হয়ে নিষ্ঠুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় পুলিশ। এমন চিত্রকে গণতান্ত্রিক সমাজের চিত্র বলে বিবেচনা করা যায় না। এ কারণেই সরকারের নীতি এবং প্রশাসন ও পুলিশের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করে পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হলেই সরকার গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চা করতে হলে যে আদর্শবোধ, নিষ্ঠা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সহিষ্ণুতা প্রয়োজন তা বর্তমান সময়ে তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এই বিষয়গুলো ছাড়া যে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণ সম্ভব নয়, তা আমাদের সরকার কিংবা রাজনৈতিক মহল আদৌ উপলব্ধি করেন কিনা সে বিষয়ে জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমান সরকার সুশাসনের কথা বলেছিলেন, দিন বদলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আমরা জানি, দিন বদল অনেক বড় ব্যাপার। দিন বদলের জন্য জীবন দর্শন প্রয়োজন, ত্যাগী ও যোগ্য কর্মীবাহিনী প্রয়োজন, প্রয়োজন উদার ও জ্ঞানদীপ্ত সাহসী নেতৃত্ব। এসব বিষয়ের উপস্থিতি তো এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আর সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তো পুলিশের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গুরুত্বপূর্ণ এ ভূমিকা পালনে প্রয়োজন নীতিনিষ্ঠ, নির্লোভ ও যোগ্যতাসম্পন্ন সাহসী পুলিশ বাহিনী। কিন্তু বর্তমানে পুলিশ বাহিনী কি স্বাধীনভাবে নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে সক্ষম হচ্ছে? জনগণ তো মনে করে, পুলিশ স্বাধীনভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারলে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হতো এবং জনগণকে জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা-আতঙ্কে ভুগতে হতো না। পুলিশকে বিধিবদ্ধ কর্তব্য পালনের বদলে এখন যেভাবে বিরোধী দল ও বিক্ষুব্ধ জনগণকে দমনে ঠ্যাঙারে বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ করা হয়েছে, তাতে প্রতিনিয়ত পুলিশের ইমেজ ক্ষুণœ হচ্ছে। ফলে রাজপথে এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেভাবে পুলিশ ও জনতা মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে তা গণতান্ত্রিক দেশের চিত্র হতে পারে না। দেশের মানুষ পুলিশ বাহিনীর গুরুত্বকে স্বীকার করে এবং তাদের সম্মানও করতে চায়। কিন্তু পুলিশকে সেই সম্মানের আসনে অবস্থানের জন্য তো তাদের কর্মকা-ও সম্মানজনক হতে হবে। গুণগত এ পরিবর্তনে সরকারের ভূমিকাটাই আসল কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, পুলিশকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ যেন তাদের আসল কাজটাই ভুলে গেছে। সরকারের ভ্রষ্টনীতির কারণে পুলিশও পলে পলে ভুলের পাঁকে জড়িয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের খবর মুদ্রিত হচ্ছে পত্রিকার পাতায়। পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছেন, ব্যক্তির দায় সংস্থা নেবে না। কেউ অপরাধ করলে ছাড় নয়, বিধি ও আইন মোতাবেকই ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু পুলিশ প্রধানের বক্তব্যের প্রতিফলন কতটা ঘটছে? একশ্রেণীর পুলিশ সদস্যের ঘুষ, দুর্নীতি আর অপরাধের দায় গিয়ে পড়ছে পুলিশ বাহিনীর কাঁধে। এতে বিব্রত হচ্ছে পুলিশ প্রশাসন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগও বাড়ছে। পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, রাজনীতির বলয় থেকে বের হয়ে পেশাগত বলয়ে ফিরে আসতে না পারলে পুলিশ বাহিনীর কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়েই পুলিশের সামনে অপরাধের দিগন্ত খুলে যায়। গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের নামে তারা জড়িয়ে পড়ে গ্রেফতার বাণিজ্যে। এছাড়া বিরোধী দলের উপর দমন-পীড়ন ও নির্যাতন চালাতে গিয়ে তারা গণবিক্ষোভের মুখে পড়ে। অথচ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে গণবিরাগ নয় বরং পুলিশের প্রয়োজন ছিল গণসমর্থন। পুলিশ কেন আজ এমন অবস্থার মুখোমুখি, তা সরকারের বিশ্লেষণ করে দেখা প্রয়োজন। সরকার আসলেই যদি দেশ ও জনগণের কল্যাণ চায়, তাহলে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের কাজকেই সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এর পরিবর্তে  সরকার যদি ক্ষমতাকে আঁকড়ে থাকার লক্ষ্যে দমন-পীড়ন ও কালাকানুনের কৌশল গ্রহণ করে, তাহলে শুধু যে দেশ ও জনগণের ক্ষতি হবে তা নয়, পরিণামে গ্লানির পথে পরাজয় বরণ করতে হবে শাসকদেরও। তাই ইতিহাসের বার্তাকে গুরুত্ব দিয়ে এখন সরকারের উচিত হবে নতুন নতুন কালো আইন পাসের বদলে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে এসে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার অনুকূলে কাজ করে যাওয়া। সময়ের এই আহ্বান শুনতে সরকার সমর্থ হয় কি না- সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads