বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ
কারা প্রথমে এনেছিল, এত দিনে আমরা হয়তো ভুলে গেছি। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, বারবার জোর
প্রচারণা চালিয়ে জনগণের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল করতে কাজ করেছে মিডিয়া। এ উচ্চ
প্রচারণা এখনো থেমে যায়নি। তারেক প্রসঙ্গ এলেই বাংলাদেশের লিডিং পত্রিকাগুলো তার
বীভৎস কার্টুন ছাপে। খুনি ও মাফিয়াদের ঘৃণিত চরিত্র হিসেবে প্রকাশ করতে সাধারণত
যে ধরনের তুলির আঁচড় ব্যবহার করে, তারেকের ক্ষেত্রে সে ধরনেরই
আঁচড় পড়ে। এই নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এখনো ধারণার মধ্যে রয়ে গেছে। তার
বিরুদ্ধে একটি দুর্নীতির অভিযোগও প্রমাণ করা যায়নি। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ
সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দ্রব্যমূল্যের মতো বিষয় নিয়ে
বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেন সাংবাদিকেরা।
ক’দিন আগে এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির তথ্যপ্রমাণ ফাঁস
হয়। এক ব্যবসায়ীকে আটক করে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে ভয় দেখিয়ে এক কোটি টাকা চাঁদা
আদায় করেন ওই কর্মকর্তা। একজন এসআইসহ অন্য এক সহযোগীকেও ওই ঘটনায় চিহ্নিত করা
হয়েছে। সুনির্দিষ্ট প্রমাণের পরও পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। ওই পুলিশ
কর্মকর্তা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। এ ঘটনাটি ফাঁস হতো না, যদি ভুক্তভোগী
ব্যবসায়ীর এলাকার ক্ষমতাসীন সংসদ সদস্য তার পক্ষে অবস্থান না নিতেন। সেই সংসদ
সদস্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সাথে দেখা করে অভিযোগটি সরাসরি
দাখিল করেন। লিখিত অভিযোগের সাথে চাঁদা নেয়ার প্রমাণস্বরূপ ভিডিও ফুটেজ, অডিও রেকর্ড ও
ব্যাংক স্টেটমেন্ট জমা দেন তিনি। প্রামাণ্য দলিলদস্তাবেজ একইসাথে প্রধানমন্ত্রীর
দফতর ও পুলিশ সদর দফতরেও পাঠানো হয়। একজন ক্ষমতাসীন সংসদ সদস্যের সরাসরি সাহায্য
পাওয়ার সৌভাগ্য ক’জন ব্যবসায়ীর রয়েছে।
তারকা ক্রিকেটার আশরাফুলের অপ্রমাণিত একটি অপরাধকে বড় করে কাভারেজ
দেয়া হয়। যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ না থাকার পরও গণমাধ্যম আরো কয়েকজন নেতৃস্থানীয়
ক্রিকেটারকে জড়িয়ে বিশাল করে খবর প্রচার করে। একজন আশরাফুলের বলি হওয়া এবং
কয়েকজন দায়িত্বশীল ক্রিকেটারের গায়ে কলঙ্ক লেপে আমাদের কী অর্জন থাকতে পারে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটকে দুর্নীতিমুক্ত রেখে ভাবমর্যাদা অটুট রাখার ক্ষেত্রে সহায়তা
করা দায়িত্ববোধের মধ্যে আসে। মূল অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির আওতায়
আনার প্রক্রিয়ায় অবদান রাখতে পারা মিডিয়ার কৃতিত্ব। তাদের চিহ্নিত করার কতটুকু
চেষ্টা মিডিয়া করেছে, সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সপ্রমাণিত অভিযোগ নিয়ে মিডিয়ার
মাথাব্যথা নেই। শপথ নিয়ে পুলিশ সদস্যরা জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব নেন। রক্ষক
নিজে ভক্ষক হলে সেটি অপরাধ হিসেবে যেমন বড়, খবর হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।
একটি পত্রিকায় খবর বের হওয়ার পর এই খবরের এখন ফলোআপ নেই। রেলওয়ে নিয়োগ
দুর্নীতি নিয়ে কতটুকু গিয়েছে আমাদের মিডিয়া? দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর
বাসার দিকে গভীর রাতে ৭৪ লাখ টাকা পৌঁছে যাচ্ছিল। সেই ড্রাইভার এখন কোথায়? অন্য একটি ঘটনায়
এতিমদের জন্য বরাদ্দ করা সেই তিন কোটি টাকার কী হলো? এই খবর কে দেবে? এই দুর্নীতি ফাঁস
করে দেয়া সম্পাদক এখন রিমান্ডে। তার পত্রিকা এখন বন্ধ। ডেসটিনি ১৪ কর্মকর্তার
আত্মসাৎ করা এক হাজার ৪৪৮ কোটি কিংবা হলমার্কের নেতৃত্বে দেশের ইতিহাসে সংঘটিত
সর্ববৃহৎ আর্থিক কেলেঙ্কারির হাজার হাজার কোটি টাকার সর্বশেষ কী অবস্থা? পদ্মা সেতু
কেলেঙ্কারির নাম প্রকাশ না হওয়া সেই ব্যক্তিটি কে? বেচারা আশরাফুল না বুঝেই
পত্রিকায় পর পর ব্যানার হেডিং। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কান্নাজড়িত অধোবদনে ক্ষমা
চাওয়ার ঘটনা আর একটিও আমরা দেখলাম না। শেয়ারবাজার লুটপাটকারী, ডেসটিনির
ডাকাতেরা, রেলওয়ের কালো বিড়ালেরা ও পদ্মার বোয়ালেরা কি তার চেয়ে ছোট অপরাধী?
মারধর করে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এক কোটি টাকা আদায়কে চাঁদাবাজি বললে
অপরাধের সঠিক মাত্রা প্রকাশ হবে না। ডেসটিনির রফিকুল আমিন কিংবা সাবেক জেনারেল
হারুনদের নেতৃত্বে অর্থ লোপাট চুরি ও ডাকাতি দুই ক্যাটাগরিতে অপরাধ হিসেবে গণ্য
হয়। হলমার্কের তানভীর তাফসিরকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীনদের বড় কর্তারা ইতিহাসের
সবচেয়ে বড় অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটিয়েছেন। সরকারের ওইসব রাঘব বোয়ালকে নিয়ে
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন কেউ আগ্রহ দেখায়নি। পুলিশের ওই
কর্মকর্তার বীভৎস কার্টুনটি কাউকে আঁকতে দেখা গেল না। সুরঞ্জিতের খবরটি ততটুকুই
করা হলো যাতে ‘মিনিস্টারস উইদাউট পোর্টফোলিও’ থাকতে তার কোনো
অসুবিধা না হয়। রফিকুল ও হারুন এদের কোনো বিকৃত কার্টুন আমরা দেখিনি।
সাক্ষাৎ চোর-ডাকাত মাফ পেয়ে যাচ্ছে। অপছন্দ হচ্ছে বলে তথ্যপ্রমাণ
ছাড়া ঘৃণিত চরিত্র হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা হচ্ছে অন্যদের। পদ্মা সেতু দুর্নীতি
এই ফাঁক গলিয়ে বের হয়ে গেছে। স্রেফ ধারণার বশবর্তী হয়ে তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে
চালানো প্রচারণা এখন বোগাস বলতে শুরু করেছে জনগণ। পদ্মা নিয়ে একটি বোগাস প্রচারণা
চালালেও শাপে বর হিসেবে দেখা দিত। অগ্রিম প্রচারণা সম্ভাব্য দুর্নীতিবাজদের পেছনের
দিকে টেনে ধরতে পারত। এতে করে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বেঁচে যেত। দুর্নীতিপরায়ণ
হিসেবে বাংলাদেশে চিহ্নিত হতো না। ধারণা নিয়ে আশরাফুলের ওপর চড়াও হওয়া গেলেও
জাতির বৃহত্তর স্বার্থে পদ্মা নিয়ে সজাগ হওয়া গেল না।
তারকা সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন সাংবাদিক নেতাদের এক কাতারে
নিয়ে এলো। নেতাদের রাজনৈতিক মনোবৃত্তি তাদের আবার বিভক্তির দিকে ঠেলে দিতেও বেশি
সময় লাগল না। সহকর্মী সাংবাদিকদের বিচারও যেন সে ক্ষেত্রে গৌণ হয়ে গেল। মিডিয়া
নিজের স্পেস ব্যবহারেও কার্পণ্য শুরু করল।
একটি মানুষের হত্যা মানে পুরো বিশ্বমানবতার মৃত্যু। আমরা নিজ
হাতেই হত্যা করেছি হত্যার খবর। নৈতিক শক্তি তাই আমরা অনেকটাই হারিয়েছি। ২০১২ সালের
১১ ফেব্রুয়ারি নৃশংসভাবে এই সাংবাদিক দম্পতি খুন হন। নিজ ফ্যাটেই তাদের হত্যা করা
হয়। নিরাপদ একটি বাসায় দু’জন মানুষকে হত্যার পর কিভাবে খুনিরা নিজেদের আড়াল করে নিলো? কিভাবে সম্ভব? এই তারকা
সাংবাদিকেরা ক’দিন ব্যানার হেডিং হতে পেরেছেন? আমাদের মিডিয়া অনুসন্ধানী
সাংবাদিকতায় বেশ পারদর্শিতা দেখালেও এ ক্ষেত্রে যেমন ব্যর্থ হলো; একইভাবে খুব বেশি
আগ্রহও দেখাতে পারল না।
২০০৯ সালের মে থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত খুন হয়েছেন ১৮ হাজার ২৮৯
জন। রাজনৈতিক হত্যা ৬৫২টি। ১৭ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। সরকারের বিরুদ্ধে দু’টি গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। গত
২৮ ফেব্র“য়ারি থেকে মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহে শতাধিক মানুষকে হত্যা করা
হয়েছে বাংলাদেশে। বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, শ্রমিক নেতা
আমিনুল ইসলামসহ গুমের তালিকাটি দীর্ঘ। গরিব দর্জি বিশ্বজিৎ, নাটোরের
বিএনপিপন্থী চেয়ারম্যান বাবুকে প্রকাশ্যে রাস্তায় খুন করা হয়েছে। এসব অবৈধ
কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশি গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেনি মিডিয়া। প্রকাশ্যে সংঘটিত
হত্যাকাণ্ডকে লো প্রোফাইলে নিয়ে গেছে মিডিয়া। অপ্রকাশ্য খুন-গুম সে জন্য একটি
বিষয় হিসেবে ধর্তব্যের মধ্যে আসছে না।
বেআইনি কর্মকাণ্ড নিয়ে মিডিয়ার অনাগ্রহ কোনপর্যায়ে তা দেখা যাক।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি দেলাওয়ার হোসেনের টানা ৫৩ দিনের রিমান্ড
শেষে আরো ১৭ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করে পুলিশ। রিমান্ড কোনপর্যায়ে গিয়ে
ঠেকেছে চিন্তা করা যায় না। রিমান্ডের অপব্যবহার নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই।
দেলাওয়ারকে পাঁজাকোলা করে আদালতে হাজির করা হয়। বসার মতো শারীরিক সক্ষমতা তার
ছিল না। টানা প্রায় দুই মাস রিমান্ডে নির্যাতনের পর একজন যুবক শত বছরের অক্ষম
বৃদ্ধের মতো শারীরিক অবস্থায় পতিত হওয়ার পরও বাংলাদেশের মিডিয়ায় খবরের মর্যাদা
পায়নি। মিডিয়া জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে মৌলিক, মানবিক ও নাগরিক
অধিকারের বিপক্ষের শক্তিতে পরিণত হচ্ছে।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দিকে চোখ ফেরানো যাক। শঙ্কার বিষয় ছিল
উদ্ধার অভিযানে দীর্ঘসূত্রতায় এক হাজারের বেশি শ্রমিকের প্রাণহানি। প্রয়োজনীয়
উদ্ধারসামগ্রী জোগানে ব্যর্থতা এবং ভুল অপারেশন কৌশল। রেশমা অবশ্যই একটি অলৌকিক
চ্যাপ্টার। একজন রেশমাকে জীবিত উদ্ধার বিশাল একটি ঘটনা নিঃসন্দেহে। তাকে নিয়ে প্রচারণার
জোয়ার তুলে রানা প্লাজা প্রলয়কে সরকারের সাফল্যের কাহিনীতে রূপান্তর সঠিক হতে
পারে না। এখন এর তলায় পড়ে গেল অপরাধী রানার বিচার। কিংবা ভবিষ্যতের রানাদের
বেড়ে ওঠা ও মুরাদ জংদের মুফতে মাফ পাওয়া। রানা প্লাজা সঙ্কটের সমাধান এটা নয়।
সরকারকে এভাবে উতরে দেয়ার মধ্যে জাতির কী লাভ?
একই কায়দায় ‘তাণ্ডব’ ও ‘নাশকতার’ আড়ালে শাপলা চত্বরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডকে সরকারের নগদ লাভে পরিণত করা
গেছে। এর মাধ্যমে একটি জঘন্য সংস্কৃতি প্রচলন হয়ে গেল। এ সুযোগটি শাসক শ্রেণী
উদাহরণ হিসেবে অন্য কোনো গোত্রের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাতে ব্যবহার করতে পারে।
১৩ দফা দাবি উপস্থাপন হেফাজতের গণতান্ত্রিক অধিকার। গণমাধ্যমও এর
বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করতে পারে; কিন্তু খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে
তার প্রভাব পড়তে পারে না। গণমাধ্যম সাংবাদিকতার নীতি এ ক্ষেত্রে অনুসরণ করেনি। যা
করেছে বা ঘটেছে তার বিবরণ না দিয়ে বরং হেফাজত যা করেনি বাড়িয়ে রঙ চঙ লাগিয়ে তা
প্রকাশ করেছে। ৭ মে একটি পত্রিকার ১১-এর পাতা পুরোটাতে ছবি দিয়েছে। প্রথমে বড়
করে দু’টি ছবির মাঝখানে ক্যাপশনে পত্রিকাটি লিখেছে, ‘১৩ দফা দাবিতে পূর্বঘোষিত ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির পর রাজধানীর মতিঝিলে আয়োজিত
সমাবেশের আগেই রোববার পল্টন এলাকায় তাণ্ডব শুরু করে হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকেরা।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই তাণ্ডব ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত মতিঝিল এলাকায়। মধ্যরাতে
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হেফাজত কর্মীদের সরিয়ে দিলে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির অবসান ঘটে।
গতকাল সকাল হলে দেখা যায়, হেফাজতের তাণ্ডবের ভয়াবহতা। হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের
ভেতরে আগুন দিলে পুড়ে যায় অসংখ্য গাড়ি।’
পুরো পাতায় একটা ছবিও এমন নেই যেখানে হেফাজত চলে যাচ্ছে বা
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব ছবি দেখলে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে
আগের দিনের লাখ লাখ হেফাজত কর্মী যাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সহিংসতার অভিযোগ আনা
হয়েছে তারা কিভাবে চলে গেল। প্রায় সব পত্রিকা খবর প্রকাশে একই ধরনের বর্ণনা
স্টাইল অবলম্বন করেছে এবং একই ধরনের ছবি প্রকাশ করেছে।
১৩ দফার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে মানুষ হত্যার খবরকে মিডিয়া
গায়েব করে দিয়েছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল তারা যেন হেফাজতের নেতাকর্মী সমর্থকদের
ওপর পরিচালিত হত্যাকাণ্ডের সমর্থক হয়ে গেল। শুধু সমর্থন দান নয়, জঘন্য
হত্যাকাণ্ডকে আড়াল করতে ধান ভানতে শিবের গীত গাইল। মানুষ হত্যার খবরের চেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ খবর হয়ে গেল গাছ কাটা, বই পোড়া, আগুন দেয়া।
শাপলা চত্বরে সংঘটিত ঘটনার পর ইনকিলাব ‘সব চ্যানেলই বিটিভি’! শিরোনামে একটি খবর ছাপে। বিস্তারিত বিবরণ পড়লে বিষয়টা পরিষ্কার
হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল কেমন আচরণ করছে তা বুঝতে সহজ
হবে। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘দেশের সব বেসরকারি স্যাটেলাইট
টিভি চ্যানেলগুলো এখন কার্যত বিটিভিকরণ হয়ে গেছে। সরকারের মালিকানাধীন বিটিভি
যেমন সরকারের তোয়াজ এবং সরকারের পছন্দের খবর প্রচার করে থাকে; বর্তমান প্রায়
সব স্যাটেলাইট টেলিভিশন সেটাই করছে।
এক সময়ের ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘বিবি গোলাম’ এবং ‘বাপ বেটির’ বক্সের দুর্নাম এখন বেসরকারি চ্যানেলগুলো নিয়ে করা হচ্ছে। সরকারকে
খুশি করতে অতি তোষামোদিকরণ নীতি গ্রহণ করেছে বেসরকারি চ্যানেলগুলো। সরকারকে খুশি
করতে অনেক সময় বিটিভিকে হার মানাচ্ছে এসব চ্যানেলের খবর। বাঁশের চেয়ে যেন কঞ্চি
বড়।
খবরের কারণে গত কয়েক বছরে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো যে জনপ্রিয় হয়ে
ওঠে তাতে এখন ভাটার টান ধরেছে। বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা অনেকেই
বাংলাদেশের বেসরকারি চ্যানেলগুলোর খবর দেখা কমিয়ে দিয়েছেন। বরং প্রকৃত তথ্য পেতে
আলজাজিরা, সিএনএন, বিবিসির খবর বেশি দেখছেন।
সংবাদ নিজগুণে জায়গা করে নিয়েছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। মানুষ
হত্যার পরিসংখ্যান মোটা হলে সেটা আপনাআপনি সংবাদ হয়ে যায়। স্থানীয় মিডিয়ায় না
এলেও আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে বিশ্বসম্প্রদায়ের জন্য সংবাদটি কাভার করতে হয়। তারা
এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে কিছু দুর্লভ ভিডিও প্রকাশ করেছে। গাছ কাটা, বই পোড়ানো তাদের
সংবাদের বিষয় ছিল না।
আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেফতার করা
হয়েছে। তার কী অপরাধ তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও রিমান্ডে নিয়ে নির্দয়
অত্যাচার করা হচ্ছে। পত্রিকাটির ছাপাখানাও দ্বিতীয়বারের মতো বন্ধ করে দেয়া
হয়েছে। তথ্যমন্ত্রী এর ছাপা বন্ধের বিষয়ে বলছেন, আমার দেশ ছাপতে কোনো বাধা নেই।
বাস্তবে আমরা দেখছি এর স¤পূর্ণ বিপরীত চিত্র। ভিন্ন একটি প্রেসে ছাপাতে গিয়ে হয়রানির শিকার
হয়েছেন ওই প্রেস-সংশ্লিষ্ট অন্য এক সম্পাদক। মাহমুদুর রহমানের বৃদ্ধ মায়ের
বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। সরকারের কথা আর কাজ বিপরীতমুখী। সহযোগী দৈনিকে এখনো তার
নানা দোষত্রুটি নিয়ে লেখা হচ্ছে। একজন সম্পাদকের মার খাওয়ার চেয়ে ওইসব
দোষত্রুটিকে তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে।
দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। চ্যানেল দু’টির বিরুদ্ধে উসকানির অভিযোগ
আনা হলেও কোন রিপোর্ট ভিত্তিহীন অথবা তাদের কোন প্রতিবেদন দেশের আইন ভঙ্গ করেছে তা
সুনির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। এর আগে আরো কয়েকটি মিডিয়া বন্ধ করা হয়েছে। শত শত
সংবাদকর্মী এখন বেকার। বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের ১৫ ধাপ অবনতি
হয়েছে। ফ্রান্স-ভিত্তিক রিপোর্টার্স উইদাউট বডার্স বার্ষিক প্রতিবেদনে এটি
প্রকাশিত হয়েছে।
শাপলা চত্বরে ক্র্যাকডাউনের পর ব্রিটিশ পত্রিকা ইকোনমিস্ট বাংলাদেশের
মিডিয়াকে ‘নতজানু’ বলে মন্তব্য করেছে। এর কিছু
দিন পর আলজাজিরা রিপোর্ট করেছে ‘দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মিডিয়া’।
ক’দিন আগে এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির তথ্যপ্রমাণ ফাঁস
হয়। এক ব্যবসায়ীকে আটক করে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে ভয় দেখিয়ে এক কোটি টাকা চাঁদা
আদায় করেন ওই কর্মকর্তা। একজন এসআইসহ অন্য এক সহযোগীকেও ওই ঘটনায় চিহ্নিত করা
হয়েছে। সুনির্দিষ্ট প্রমাণের পরও পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। ওই পুলিশ
কর্মকর্তা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। এ ঘটনাটি ফাঁস হতো না, যদি ভুক্তভোগী
ব্যবসায়ীর এলাকার ক্ষমতাসীন সংসদ সদস্য তার পক্ষে অবস্থান না নিতেন। সেই সংসদ
সদস্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সাথে দেখা করে অভিযোগটি সরাসরি
দাখিল করেন। লিখিত অভিযোগের সাথে চাঁদা নেয়ার প্রমাণস্বরূপ ভিডিও ফুটেজ, অডিও রেকর্ড ও
ব্যাংক স্টেটমেন্ট জমা দেন তিনি। প্রামাণ্য দলিলদস্তাবেজ একইসাথে প্রধানমন্ত্রীর
দফতর ও পুলিশ সদর দফতরেও পাঠানো হয়। একজন ক্ষমতাসীন সংসদ সদস্যের সরাসরি সাহায্য
পাওয়ার সৌভাগ্য ক’জন ব্যবসায়ীর রয়েছে।
তারকা ক্রিকেটার আশরাফুলের অপ্রমাণিত একটি অপরাধকে বড় করে কাভারেজ
দেয়া হয়। যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ না থাকার পরও গণমাধ্যম আরো কয়েকজন নেতৃস্থানীয়
ক্রিকেটারকে জড়িয়ে বিশাল করে খবর প্রচার করে। একজন আশরাফুলের বলি হওয়া এবং
কয়েকজন দায়িত্বশীল ক্রিকেটারের গায়ে কলঙ্ক লেপে আমাদের কী অর্জন থাকতে পারে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটকে দুর্নীতিমুক্ত রেখে ভাবমর্যাদা অটুট রাখার ক্ষেত্রে সহায়তা
করা দায়িত্ববোধের মধ্যে আসে। মূল অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির আওতায়
আনার প্রক্রিয়ায় অবদান রাখতে পারা মিডিয়ার কৃতিত্ব। তাদের চিহ্নিত করার কতটুকু
চেষ্টা মিডিয়া করেছে, সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সপ্রমাণিত অভিযোগ নিয়ে মিডিয়ার
মাথাব্যথা নেই। শপথ নিয়ে পুলিশ সদস্যরা জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব নেন। রক্ষক
নিজে ভক্ষক হলে সেটি অপরাধ হিসেবে যেমন বড়, খবর হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।
একটি পত্রিকায় খবর বের হওয়ার পর এই খবরের এখন ফলোআপ নেই। রেলওয়ে নিয়োগ
দুর্নীতি নিয়ে কতটুকু গিয়েছে আমাদের মিডিয়া? দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর
বাসার দিকে গভীর রাতে ৭৪ লাখ টাকা পৌঁছে যাচ্ছিল। সেই ড্রাইভার এখন কোথায়? অন্য একটি ঘটনায়
এতিমদের জন্য বরাদ্দ করা সেই তিন কোটি টাকার কী হলো? এই খবর কে দেবে? এই দুর্নীতি ফাঁস
করে দেয়া সম্পাদক এখন রিমান্ডে। তার পত্রিকা এখন বন্ধ। ডেসটিনি ১৪ কর্মকর্তার
আত্মসাৎ করা এক হাজার ৪৪৮ কোটি কিংবা হলমার্কের নেতৃত্বে দেশের ইতিহাসে সংঘটিত
সর্ববৃহৎ আর্থিক কেলেঙ্কারির হাজার হাজার কোটি টাকার সর্বশেষ কী অবস্থা? পদ্মা সেতু
কেলেঙ্কারির নাম প্রকাশ না হওয়া সেই ব্যক্তিটি কে? বেচারা আশরাফুল না বুঝেই
পত্রিকায় পর পর ব্যানার হেডিং। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কান্নাজড়িত অধোবদনে ক্ষমা
চাওয়ার ঘটনা আর একটিও আমরা দেখলাম না। শেয়ারবাজার লুটপাটকারী, ডেসটিনির
ডাকাতেরা, রেলওয়ের কালো বিড়ালেরা ও পদ্মার বোয়ালেরা কি তার চেয়ে ছোট অপরাধী?
মারধর করে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এক কোটি টাকা আদায়কে চাঁদাবাজি বললে
অপরাধের সঠিক মাত্রা প্রকাশ হবে না। ডেসটিনির রফিকুল আমিন কিংবা সাবেক জেনারেল
হারুনদের নেতৃত্বে অর্থ লোপাট চুরি ও ডাকাতি দুই ক্যাটাগরিতে অপরাধ হিসেবে গণ্য
হয়। হলমার্কের তানভীর তাফসিরকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীনদের বড় কর্তারা ইতিহাসের
সবচেয়ে বড় অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটিয়েছেন। সরকারের ওইসব রাঘব বোয়ালকে নিয়ে
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন কেউ আগ্রহ দেখায়নি। পুলিশের ওই
কর্মকর্তার বীভৎস কার্টুনটি কাউকে আঁকতে দেখা গেল না। সুরঞ্জিতের খবরটি ততটুকুই
করা হলো যাতে ‘মিনিস্টারস উইদাউট পোর্টফোলিও’ থাকতে তার কোনো
অসুবিধা না হয়। রফিকুল ও হারুন এদের কোনো বিকৃত কার্টুন আমরা দেখিনি।
সাক্ষাৎ চোর-ডাকাত মাফ পেয়ে যাচ্ছে। অপছন্দ হচ্ছে বলে তথ্যপ্রমাণ
ছাড়া ঘৃণিত চরিত্র হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা হচ্ছে অন্যদের। পদ্মা সেতু দুর্নীতি
এই ফাঁক গলিয়ে বের হয়ে গেছে। স্রেফ ধারণার বশবর্তী হয়ে তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে
চালানো প্রচারণা এখন বোগাস বলতে শুরু করেছে জনগণ। পদ্মা নিয়ে একটি বোগাস প্রচারণা
চালালেও শাপে বর হিসেবে দেখা দিত। অগ্রিম প্রচারণা সম্ভাব্য দুর্নীতিবাজদের পেছনের
দিকে টেনে ধরতে পারত। এতে করে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বেঁচে যেত। দুর্নীতিপরায়ণ
হিসেবে বাংলাদেশে চিহ্নিত হতো না। ধারণা নিয়ে আশরাফুলের ওপর চড়াও হওয়া গেলেও
জাতির বৃহত্তর স্বার্থে পদ্মা নিয়ে সজাগ হওয়া গেল না।
তারকা সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন সাংবাদিক নেতাদের এক কাতারে
নিয়ে এলো। নেতাদের রাজনৈতিক মনোবৃত্তি তাদের আবার বিভক্তির দিকে ঠেলে দিতেও বেশি
সময় লাগল না। সহকর্মী সাংবাদিকদের বিচারও যেন সে ক্ষেত্রে গৌণ হয়ে গেল। মিডিয়া
নিজের স্পেস ব্যবহারেও কার্পণ্য শুরু করল।
একটি মানুষের হত্যা মানে পুরো বিশ্বমানবতার মৃত্যু। আমরা নিজ
হাতেই হত্যা করেছি হত্যার খবর। নৈতিক শক্তি তাই আমরা অনেকটাই হারিয়েছি। ২০১২ সালের
১১ ফেব্রুয়ারি নৃশংসভাবে এই সাংবাদিক দম্পতি খুন হন। নিজ ফ্যাটেই তাদের হত্যা করা
হয়। নিরাপদ একটি বাসায় দু’জন মানুষকে হত্যার পর কিভাবে খুনিরা নিজেদের আড়াল করে নিলো? কিভাবে সম্ভব? এই তারকা
সাংবাদিকেরা ক’দিন ব্যানার হেডিং হতে পেরেছেন? আমাদের মিডিয়া অনুসন্ধানী
সাংবাদিকতায় বেশ পারদর্শিতা দেখালেও এ ক্ষেত্রে যেমন ব্যর্থ হলো; একইভাবে খুব বেশি
আগ্রহও দেখাতে পারল না।
২০০৯ সালের মে থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত খুন হয়েছেন ১৮ হাজার ২৮৯
জন। রাজনৈতিক হত্যা ৬৫২টি। ১৭ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। সরকারের বিরুদ্ধে দু’টি গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। গত
২৮ ফেব্র“য়ারি থেকে মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহে শতাধিক মানুষকে হত্যা করা
হয়েছে বাংলাদেশে। বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, শ্রমিক নেতা
আমিনুল ইসলামসহ গুমের তালিকাটি দীর্ঘ। গরিব দর্জি বিশ্বজিৎ, নাটোরের
বিএনপিপন্থী চেয়ারম্যান বাবুকে প্রকাশ্যে রাস্তায় খুন করা হয়েছে। এসব অবৈধ
কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশি গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেনি মিডিয়া। প্রকাশ্যে সংঘটিত
হত্যাকাণ্ডকে লো প্রোফাইলে নিয়ে গেছে মিডিয়া। অপ্রকাশ্য খুন-গুম সে জন্য একটি
বিষয় হিসেবে ধর্তব্যের মধ্যে আসছে না।
বেআইনি কর্মকাণ্ড নিয়ে মিডিয়ার অনাগ্রহ কোনপর্যায়ে তা দেখা যাক।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি দেলাওয়ার হোসেনের টানা ৫৩ দিনের রিমান্ড
শেষে আরো ১৭ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করে পুলিশ। রিমান্ড কোনপর্যায়ে গিয়ে
ঠেকেছে চিন্তা করা যায় না। রিমান্ডের অপব্যবহার নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই।
দেলাওয়ারকে পাঁজাকোলা করে আদালতে হাজির করা হয়। বসার মতো শারীরিক সক্ষমতা তার
ছিল না। টানা প্রায় দুই মাস রিমান্ডে নির্যাতনের পর একজন যুবক শত বছরের অক্ষম
বৃদ্ধের মতো শারীরিক অবস্থায় পতিত হওয়ার পরও বাংলাদেশের মিডিয়ায় খবরের মর্যাদা
পায়নি। মিডিয়া জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে মৌলিক, মানবিক ও নাগরিক
অধিকারের বিপক্ষের শক্তিতে পরিণত হচ্ছে।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দিকে চোখ ফেরানো যাক। শঙ্কার বিষয় ছিল
উদ্ধার অভিযানে দীর্ঘসূত্রতায় এক হাজারের বেশি শ্রমিকের প্রাণহানি। প্রয়োজনীয়
উদ্ধারসামগ্রী জোগানে ব্যর্থতা এবং ভুল অপারেশন কৌশল। রেশমা অবশ্যই একটি অলৌকিক
চ্যাপ্টার। একজন রেশমাকে জীবিত উদ্ধার বিশাল একটি ঘটনা নিঃসন্দেহে। তাকে নিয়ে প্রচারণার
জোয়ার তুলে রানা প্লাজা প্রলয়কে সরকারের সাফল্যের কাহিনীতে রূপান্তর সঠিক হতে
পারে না। এখন এর তলায় পড়ে গেল অপরাধী রানার বিচার। কিংবা ভবিষ্যতের রানাদের
বেড়ে ওঠা ও মুরাদ জংদের মুফতে মাফ পাওয়া। রানা প্লাজা সঙ্কটের সমাধান এটা নয়।
সরকারকে এভাবে উতরে দেয়ার মধ্যে জাতির কী লাভ?
একই কায়দায় ‘তাণ্ডব’ ও ‘নাশকতার’ আড়ালে শাপলা চত্বরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডকে সরকারের নগদ লাভে পরিণত করা
গেছে। এর মাধ্যমে একটি জঘন্য সংস্কৃতি প্রচলন হয়ে গেল। এ সুযোগটি শাসক শ্রেণী
উদাহরণ হিসেবে অন্য কোনো গোত্রের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাতে ব্যবহার করতে পারে।
১৩ দফা দাবি উপস্থাপন হেফাজতের গণতান্ত্রিক অধিকার। গণমাধ্যমও এর
বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করতে পারে; কিন্তু খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে
তার প্রভাব পড়তে পারে না। গণমাধ্যম সাংবাদিকতার নীতি এ ক্ষেত্রে অনুসরণ করেনি। যা
করেছে বা ঘটেছে তার বিবরণ না দিয়ে বরং হেফাজত যা করেনি বাড়িয়ে রঙ চঙ লাগিয়ে তা
প্রকাশ করেছে। ৭ মে একটি পত্রিকার ১১-এর পাতা পুরোটাতে ছবি দিয়েছে। প্রথমে বড়
করে দু’টি ছবির মাঝখানে ক্যাপশনে পত্রিকাটি লিখেছে, ‘১৩ দফা দাবিতে পূর্বঘোষিত ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির পর রাজধানীর মতিঝিলে আয়োজিত
সমাবেশের আগেই রোববার পল্টন এলাকায় তাণ্ডব শুরু করে হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকেরা।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই তাণ্ডব ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত মতিঝিল এলাকায়। মধ্যরাতে
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হেফাজত কর্মীদের সরিয়ে দিলে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির অবসান ঘটে।
গতকাল সকাল হলে দেখা যায়, হেফাজতের তাণ্ডবের ভয়াবহতা। হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের
ভেতরে আগুন দিলে পুড়ে যায় অসংখ্য গাড়ি।’
পুরো পাতায় একটা ছবিও এমন নেই যেখানে হেফাজত চলে যাচ্ছে বা
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব ছবি দেখলে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে
আগের দিনের লাখ লাখ হেফাজত কর্মী যাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সহিংসতার অভিযোগ আনা
হয়েছে তারা কিভাবে চলে গেল। প্রায় সব পত্রিকা খবর প্রকাশে একই ধরনের বর্ণনা
স্টাইল অবলম্বন করেছে এবং একই ধরনের ছবি প্রকাশ করেছে।
১৩ দফার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে মানুষ হত্যার খবরকে মিডিয়া
গায়েব করে দিয়েছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল তারা যেন হেফাজতের নেতাকর্মী সমর্থকদের
ওপর পরিচালিত হত্যাকাণ্ডের সমর্থক হয়ে গেল। শুধু সমর্থন দান নয়, জঘন্য
হত্যাকাণ্ডকে আড়াল করতে ধান ভানতে শিবের গীত গাইল। মানুষ হত্যার খবরের চেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ খবর হয়ে গেল গাছ কাটা, বই পোড়া, আগুন দেয়া।
শাপলা চত্বরে সংঘটিত ঘটনার পর ইনকিলাব ‘সব চ্যানেলই বিটিভি’! শিরোনামে একটি খবর ছাপে। বিস্তারিত বিবরণ পড়লে বিষয়টা পরিষ্কার
হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল কেমন আচরণ করছে তা বুঝতে সহজ
হবে। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘দেশের সব বেসরকারি স্যাটেলাইট
টিভি চ্যানেলগুলো এখন কার্যত বিটিভিকরণ হয়ে গেছে। সরকারের মালিকানাধীন বিটিভি
যেমন সরকারের তোয়াজ এবং সরকারের পছন্দের খবর প্রচার করে থাকে; বর্তমান প্রায়
সব স্যাটেলাইট টেলিভিশন সেটাই করছে।
এক সময়ের ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘বিবি গোলাম’ এবং ‘বাপ বেটির’ বক্সের দুর্নাম এখন বেসরকারি চ্যানেলগুলো নিয়ে করা হচ্ছে। সরকারকে
খুশি করতে অতি তোষামোদিকরণ নীতি গ্রহণ করেছে বেসরকারি চ্যানেলগুলো। সরকারকে খুশি
করতে অনেক সময় বিটিভিকে হার মানাচ্ছে এসব চ্যানেলের খবর। বাঁশের চেয়ে যেন কঞ্চি
বড়।
খবরের কারণে গত কয়েক বছরে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো যে জনপ্রিয় হয়ে
ওঠে তাতে এখন ভাটার টান ধরেছে। বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা অনেকেই
বাংলাদেশের বেসরকারি চ্যানেলগুলোর খবর দেখা কমিয়ে দিয়েছেন। বরং প্রকৃত তথ্য পেতে
আলজাজিরা, সিএনএন, বিবিসির খবর বেশি দেখছেন।
সংবাদ নিজগুণে জায়গা করে নিয়েছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। মানুষ
হত্যার পরিসংখ্যান মোটা হলে সেটা আপনাআপনি সংবাদ হয়ে যায়। স্থানীয় মিডিয়ায় না
এলেও আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে বিশ্বসম্প্রদায়ের জন্য সংবাদটি কাভার করতে হয়। তারা
এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে কিছু দুর্লভ ভিডিও প্রকাশ করেছে। গাছ কাটা, বই পোড়ানো তাদের
সংবাদের বিষয় ছিল না।
আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেফতার করা
হয়েছে। তার কী অপরাধ তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও রিমান্ডে নিয়ে নির্দয়
অত্যাচার করা হচ্ছে। পত্রিকাটির ছাপাখানাও দ্বিতীয়বারের মতো বন্ধ করে দেয়া
হয়েছে। তথ্যমন্ত্রী এর ছাপা বন্ধের বিষয়ে বলছেন, আমার দেশ ছাপতে কোনো বাধা নেই।
বাস্তবে আমরা দেখছি এর স¤পূর্ণ বিপরীত চিত্র। ভিন্ন একটি প্রেসে ছাপাতে গিয়ে হয়রানির শিকার
হয়েছেন ওই প্রেস-সংশ্লিষ্ট অন্য এক সম্পাদক। মাহমুদুর রহমানের বৃদ্ধ মায়ের
বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। সরকারের কথা আর কাজ বিপরীতমুখী। সহযোগী দৈনিকে এখনো তার
নানা দোষত্রুটি নিয়ে লেখা হচ্ছে। একজন সম্পাদকের মার খাওয়ার চেয়ে ওইসব
দোষত্রুটিকে তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে।
দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। চ্যানেল দু’টির বিরুদ্ধে উসকানির অভিযোগ
আনা হলেও কোন রিপোর্ট ভিত্তিহীন অথবা তাদের কোন প্রতিবেদন দেশের আইন ভঙ্গ করেছে তা
সুনির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। এর আগে আরো কয়েকটি মিডিয়া বন্ধ করা হয়েছে। শত শত
সংবাদকর্মী এখন বেকার। বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের ১৫ ধাপ অবনতি
হয়েছে। ফ্রান্স-ভিত্তিক রিপোর্টার্স উইদাউট বডার্স বার্ষিক প্রতিবেদনে এটি
প্রকাশিত হয়েছে।
শাপলা চত্বরে ক্র্যাকডাউনের পর ব্রিটিশ পত্রিকা ইকোনমিস্ট বাংলাদেশের
মিডিয়াকে ‘নতজানু’ বলে মন্তব্য করেছে। এর কিছু
দিন পর আলজাজিরা রিপোর্ট করেছে ‘দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মিডিয়া’।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন