বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে এবং নির্বাচন কমিশনের অধীনে ১৫ জুন রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেল, এতে সব কয়টা মেয়র ও অধিকাংশ কাউন্সিলর পদে বিএনপি তথা ১৮ দলের সমর্থিত প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে। সরকার তথা মহাজোট সমর্থিত প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। এ ফলাফলের পর বিরোধী দল বলছে সরকারের বিভিন্ন অপকর্ম, দুঃশাসন, দেশ চালাতে ব্যর্থতার পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবির প্রতিই ভোটের মাধ্যমে জনগণ তাদের সুস্পষ্ট রায় দিয়েছে। অপরদিকে সরকারি দল বলছে এ নির্বাচনই প্রমাণ করেছে বর্তমান সরকারের আমলে এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে দেশে সব নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব, কাজেই আগামী সংসদ নির্বাচনও বর্তমান দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু বিরোধী দল আশংকা প্রকাশ করছে এ নির্বাচনের ফলাফল দেখে সরকার আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেতার জন্য সর্বাত্মক কারচুপি’র আশ্রয় নিবে, কাজেই এ সরকারকে ক্ষমতায় রেখে বা এ সরকারের নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা গঠিত কোন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দল অংশগ্রহণ করবে না। বিরোধী দল বলছে ৪ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সরকার টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে যাতে বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিরোধী দল অংশগ্রহণ করে। উল্লেখ্য, দেশে আর কয়েক মাস পরেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ৫ বছরের মেয়াদ শেষ হবে, নিয়ম অনুযায়ী বা সংবিধান মোতাবেক ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন করতে হবে। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করতে হলে নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতেই হবে। পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক দেশেই নির্বাচনের এ ধারা অনুসরণ করা হয় এবং অন্য সব গণতান্ত্রিক দেশেই একটা স্থায়ী সাংবিধানিক ব্যবস্থার অধীনে নির্দিষ্ট সময়ে নির্বিঘেœ এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে কোন রকম সংঘাত বা সহিংসতা বর্জিত (উল্লেখ করার মত নয় এমন নেহায়েত ছোট-খাটো ঘটনা ছাড়া) শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে যে দল হেরে যায় তারা প্রকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিধায় এবং জনগণের মতামতের প্রতি আস্থা/শ্রদ্ধাশীল বলে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে বিজিত দলকে স্বাগত জানিয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে গঠনমূলক সমালোচনা করা ছাড়া নির্বাচন পরবর্তী সরকারকে তার পূর্ণ মেয়াদ পর্যন্ত সর্বাত্মক সহায়তা করে থাকে, যে কারণে সেসব দেশে সরকারি দল পরাজিত বা বিরোধী দল থেকেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে মন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে থাকে। গণতন্ত্রের এমন নজীর কি আমাদের দেশে আছে?
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে কথিত (আজকের বাস্তবতায়) স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারকে অপসারণের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর (মূলত: আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) মধ্যে কোন সহিংসতা হয়নি। বলা যায় শান্তিপূর্ণভাবেই ঐ নির্বাচনটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু তবুও ঐ নির্বাচনে যে দল (আওয়ামী লীগ) হেরে গিয়েছিল তারা তাৎক্ষণিকভাবে ও সহজেই নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নেয়নি, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি এবং নির্বাচনে সূক্ষ কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিল। পরবর্তিতে আওয়ামী লীগ বিরোধী দল হিসেবে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের বিরোধী দলের মত প্রকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির আলোকে ১৯৯১-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারকে গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সহায়তা বা সহযোগিতার পরিবর্তে হরতালসহ বিভিন্ন আন্দোলনে অস্থির রেখেছিল।
এরশাদকে সরানোর পর কথিত গণতান্ত্রিক যুগের প্রথম ৫ বছর পর যখন ১৯৯৬ সালে পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা তার আগেই আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলাম ও অন্যান্য দল বিএনপি সরকারের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ, নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসন দলীয়করণ ও কারচুপির উপ-নির্বাচনের কারণে পরবর্তী (১৯৯৬ সালের) নির্বাচন বিএনপি সরকারের অধীনে না করে একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের দাবিতে দেশব্যাপী রাজপথে হরতালসহ ভয়াবহ ও সহিংস আন্দোলন শুরু করে। ফলে বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মানতে বাধ্য হয় এবং সংশ্লিষ্ট দলগুলোর মধ্যে এ ব্যাপারে একটা সমঝোতা চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। অর্থাৎ বিগত ৫ বছরে ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের কথিত গণতান্ত্রিক আচরণ ও কার্যকলাপ বিরোধী দলকে একটা দলীয় (বিএনপি) সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে কোনভাবেই আশ্বস্ত করতে পারেনি, তাই তখন নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার রূপরেখা চূড়ান্ত করে তাকে সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনেই ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, উক্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট জয়লাভ করে সরকার গঠন করে, এ নির্বাচনকে বিএনপি মেনে নিলেও ফলাফল ঘোষণার পর নির্বাচন স্বচ্ছ হয়নি এবং নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিল। ১৯৯১-এর নির্বাচনের পর বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের বিরোধী দলের মত সরকারকে গঠনমূলক সমালোচনা ও সহযোগিতার পরিবর্তে দুর্নীতি, দলীয়করণ, বিরোধীদল নির্যাতন ও বিভিন্ন অভিযোগে সংসদ বর্জনসহ হরতাল ও সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি সরকারকে যেভাবে অস্থির রেখেছিল বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিও ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত (৫ বছর) আওয়ামী লীগ সরকারকে একই অভিযোগে একইভাবে অসহযোগিতা করেছিল ও বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে অস্থির রেখেছিল। তথাকথিত গণতন্ত্রের এমনি ধারাবাহিকতায় এবং ক্ষমতার পালাবদলের প্রক্রিয়ায় ২০০১ সালে আবারও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যায়, বিএনপি আবারও ক্ষমতায় আসে। এ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরেও বরাবরের মত আওয়ামী লীগ তাৎক্ষণিকভাবে ফলাফল মেনে নেয়নি এবং নির্বাচনে স্থূল কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিল। আমাদের দেশে নির্বাচনে পরাজিত দলের এটাই হলো গণতান্ত্রিক মানসিকতা। বিএনপি সরকার ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে বিরোধী দল দমনসহ দুর্নীতি ও দুঃশাসনের অভিযোগের কথা বাদ দিলেও প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে যেভাবে দলীয়করণ এবং পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করার নীলনক্সা ও কৌশল প্রণয়ন করেছিল তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটাকেই বিতর্কিত করে তুলেছিল। বিএনপি সরকার তার স্বীয় স্বার্থে গঠিত ঐ সময়ের নির্বাচন কমিশন, সাজিয়ে রাখা প্রশাসন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (যার প্রধান উপদেষ্টা হয়েছিল বিএনপি সরকারের প্রেসিডেন্ট ইয়াজ উদ্দীন আহমেদ) অধীনেই নির্বাচন করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন কথিত মহাজোট (এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ) নির্বাচন বয়কট করে এবং ইয়াজ উদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। স্বৈরাচারমুক্ত কথিত গণতান্ত্রিক যুগের ঐ আন্দোলন এমন পর্যায় ও মাত্রায় উঠেছিল যা স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ও সহিংস ঘটনায় রূপ নিয়েছিল, সহিংসতা ও আন্দোলনের যাঁতাকলে পড়ে সারা দেশের জনগণ দুই দল বা জোটের কাছে জিম্মি হয়ে গিয়েছিল, ঢাকা শহর বলতে গেলে প্রায় ১ মাস অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল। দুই জোটের পাল্টা-পাল্টি ও সহিংসতার ফলে সৃষ্ট শাসরুদ্ধকর ঐ পরিস্থিতির অবসান হওয়ার কোন লক্ষণ যখন একবারেই দেখা যাচ্ছিল না তখন সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান জে: মইন ইউ. আহমেদ এহেন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য জনগণের সেন্টিম্যান্টকে সঠিক ও বিচক্ষণভাবে বুঝতে পেরে প্রেসিডেন্ট ইয়াজ উদ্দীনকে দিয়ে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং ইয়াজ উদ্দীনকে সরিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান ফখরুদ্দীনকে প্রধান উপদেষ্টা করে সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠিত করে। দৃশ্যত তখন দেশে তত্ত্বাবধায়ক নামক সরকার বহাল থাকলেও মূলত: বা পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনীর আনুগত্যকে কাজে লাগিয়ে জে: মইনই দেশ শাসন করতে শুরু করে। বিএনপির নীলনক্সা অনুযায়ী নির্বাচন না হওয়ায় খুশি হয়ে আওয়ামী জোট জে: মইন-এর উদ্যোগকে স্বাগত জানায় এবং মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তাদের আন্দোলনের ফসল বলে দাবি করে এবং আত্মতৃপ্তি প্রকাশ করে।
কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পরেই দুই জোট বিশেষ করে আওয়ামী জোট মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আসল রূপ টের পেতে শুরু করে। ১৯৯৬ সালের সমঝোতা বা রূপরেখা অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল দায়িত্ব বা কাজ হলো ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া। বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজনে পূর্ববর্তি নির্বাচিত সরকারের ফেলে যাওয়া (সাজিয়ে যাওয়া) প্রশাসন ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্তরে রদবদল করতে পারে। কিন্তু জে: মইনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে মনোযোগ দেয়ার পরিবর্তে ক্ষমতায় বসেই রাজনীতিবিদদের চরিত্র হনন তথা জনগণের কাছে তাদেরকে অবাঞ্ছিত বা অগ্রহণযোগ্য করে তোলার উদ্দেশ্যে দুই দলের শীর্ষ নেত্রীসহ শত শত নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দিয়ে জে: মাসুদ-এর তত্ত্বাবধানে গঠিত দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তাদেরকে একে একে জেলে পাঠাতে শুরু করে দিল এবং মার্শাল-ল’ কোর্টের পরিবর্তে (যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের লেবেল লাগানো ছিল) বিশেষ আদালতের (ক্যাঙ্গারু কোর্টের) মাধ্যমে বিচার করে তাদেরকে সাজাও দেয়া শুরু করে দিল। এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকেও সংসদ ভবনের পাশে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত জেলে আটকে রাখা হলো। চেষ্টা শুরু করে দিল দুই নেত্রীকে মাইনাস করার এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেয়ার পরিকল্পনা। সাথে সাথে জে: মইনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে ও বিদেশে তাঁবেদার ও বর্নচোরা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা কিংস পার্টি গঠনের উদ্যোগও নিয়েছিল। জে: মইন ও জে: মাসুদের এ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তো ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে বিদায় নিতে হয়। জে: মইনের জরুরি অবস্থার সরকার যদিও মূলত: তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, কিন্তু দেশবাসী ও বিদেশের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবেই পরিচিত। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মোড়কে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কৌশল হিসেবে জে: মইনের জরুরি অবস্থার সরকার তাদেরই তল্পিবাহক/ ক্রীড়নক নির্বাচন কমিশনকে সুকৌশলে কাজে লাগালো। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ দাবি করেছিল ছবিযুক্ত ভোটার লিস্ট তৈরি করতে হবে। নির্বাচন কমিশন এটাকে আর একটু সংস্কার করে ৪০০ কোটি টাকা খরচ করে ছবিযুক্ত ভোটার লিস্ট তথা জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির পরিকল্পনা নেয় এবং এ দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেয়। নির্বাচন কমিশন এ কাজ শেষ করতে কমপক্ষে ১৮ মাস লাগবে বলে জে: মইনকে ও দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে। এই সুবাদে (আওয়ামী লীগের দাবিকে কাজে লাগিয়ে) জে: মইনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২ বছর ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেয়ে গেল। এই সময়ের মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে মামলা সাজিয়ে রাজনীতিবিদদের একে একে জেলে পাঠাতে শুরু করে দিল এবং ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে বিচার করে তাদেরকে সাজা দেয়ার কাজও জোরালো করল। আরো ১৮ মাস ক্ষমতায় থাকার সময় পেয়ে দুই নেত্রীকে মাইনাস করার এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিয়ে কিংস পার্টি গঠনের কাজও এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়। কিন্তু কোন ষড়যন্ত্র বা দুরভিসন্ধিই সফল বা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। জে: মইনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরও দুই নেত্রীকে মাইনাস করতে, দুই দলকে টুকরো টুকরো করতে (যদিও প্রচষ্টা শুরু করেছিল) এবং নিজস্ব কিংস পার্টি গঠন করে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত সবকিছুতে তাল-গোল পাকিয়ে অর্থাৎ লেজে-গোবরে অবস্থা সৃষ্টি করে ব্যর্থতা ও ষড়যন্ত্রের দায়ভার থেকে বাঁচার জন্য জে: মইনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। ঐ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ২০০৯-এর জানুয়ারিতে সরকার গঠন করে। জেনারেল মইনের জরুরি অবস্থার সরকার যে প্রকৃত অর্থে সংবিধান অনুযায়ী এবং ১৯৯৬ সালে সর্বদলীয় সমঝোতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিলনা এটা তাদের কার্যকলাপ ও দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার মধ্য দিয়েই প্রমাণ করে গেছে। এর আগে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন হয়েছিল প্রকৃত অর্থে ১৯৯৬ সালে সর্বদলীয় সমঝোতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সে সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক রদবদল ছাড়া জেনারেল মইনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মত অন্য কোন দিকে অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করেনি। কাজেই জেনারেল মইনের ১/১১ এর সরকার আর প্রকৃত অর্থে ১৯৯৬ সালে সর্বদলীয় সমঝোতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনভাবেই এক হতে পারে না।
কিন্তু আওয়ামী জোট তথা মহাজোট ১/১১-এর সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভ করার পর ৩ বছর না যেতেই উচ্চ আদালতের এক রায়ের দোহাই দিয়ে বিরোধী দল বা অন্য কোন পক্ষের সাথে আলাপ-আালোচনা না করে সংসদে তাদের সংখ্যা গরিষ্ঠতার জোরে বিল পাস করে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এর আগে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ও লোকজনের মতামত গ্রহণ করেছিল, তাদের মধ্যে প্রায় ৯৫%ই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছিল, এমনকি দল হিসেবে আওয়ামী লীগও এই ব্যবস্থার পক্ষেই মত দিয়েছিল। কিন্তু একমাত্র অওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, তারই ব্যক্তিগত অবস্থানের আলোকে উচ্চ আদালত (মূলত: প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক) কিছুদিনের মধ্যেই উদ্দেশ্যমূলক এক রীটের পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে তা বাতিল করার পক্ষে রায় দেয়। অথচ এ ব্যাপারে বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত এমিকাস কিউরীর অধিকাংশ (৯০%) সদস্যই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। উচ্চ আদালতের প্রাথমিক বা খ-িত রায়ে অবশ্য এও উল্লেখ ছিল সংসদ মনে করলে জাতীয় প্রয়োজনে (Doctrine of necessity) পরবর্তি আরো ২টা নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে, তবে বিচারপতি বা বিচার বিভাগের কাউকে এ সরকারের প্রধান হিসেবে মনোনয়ন বা নিয়োগ দেয়া যাবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের সংসদ রায়ের এ অংশটাকে উপেক্ষা করে উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় বের হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে এ ব্যাপারে সংবিধান সংশোধন করে নেয়। স্বভাবতই প্রধান বিরোধী দল বা জোট নির্বাচনের ২ বছর আগে আদালতকে ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বতিল করে কথিত গণতান্ত্রিক পন্থায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাদের অভিযোগ সরকার আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করা তথা আবারো ক্ষমতায় থাকার উদ্দেশ্যেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে তাদের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বন্দোবস্ত করেছে। বিরোধী জোট সরকারের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এবং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুর্নবহালের দাবিতে বিগত এক বছর যাবত রাজপথে আন্দোলন করে আসছে। হরতালসহ সহিংস আন্দোলনে ইতোমধ্যে বহু জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, জনগণের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। সরকারের মনোভাবও এ ব্যাপরে অনড়, তারা শেখ হাসিনাকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান রেখে বর্তমান সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর, অপরদিকে বিরোধী জোটও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দলীয় সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে যাবে না এবং দেশে এমন নির্বাচন হতে দিবে না বলেও হুমকি দিচ্ছে। অর্থাৎ এ ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী জোটের মধ্যে কোন সংলাপ বা কোন সমঝোতা না হলে নির্বাচনের আগে আগামী দিনগুলোতে দেশে আরো অরাজক ও সহিংস ঘটনা বৃদ্ধি পাবে বলে সবাই আশংকা করছে।
সরকার বলছে আদালতের রায়ের ভিত্তিতেই তারা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করেছে, সুতরাং সংবিধানের বাইরে তারা কোন কাজ করবে না। প্রশ্ন হচ্ছে: একটা দেশের জনগণ বড় নাকি সংবিধান বড়? সংবিধান দেশের জনগণই তথা মানুষেই তৈরি করেছে, এটা ৪র্থ আসমান থেকে অহি হিসেবে নাজিল হওয়া কোন গায়েবী (আল্লাহর) কিতাব (পবিত্র কুরআন) নয় যে এটাকে পরিবর্তন করা যাবে না। এ দেশের শাসক ও জনপ্রতিনিধিরাই বর্তমান সংবিধানকে জনগণের তথা নিজেদের প্রয়োজনে ১৪/১৫ বার কাটছাঁট করে সংশোধন করেছে। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, দেশকে সহিংসতা ও নৈরাজ্য থেকে রক্ষা করার স্বার্থে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন করার স্বার্থে প্রয়োজনে আবারও সংবিধান সংশোধন করা কোন পাপ বা কবিরা গুনা হবে না। ১৯৯৬ সালের নির্বানের আগে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের তীব্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিয়ে তাকে সংবিধানে সংযোজন করেছিল।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে এখন বলা হচ্ছে গণতন্ত্রের পরিপšী’ ও সংবিধানের সাথে সঙ্গতিহীন বা সাংঘর্ষিক। ১৯৯৬ সালের আগে যখন এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন করা হয়েছিল তখন কি এ কথা মনে ছিল না? প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন, বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি লতিফুর রহমান সাহেবরা যখন ইতোপূর্বে তিনটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তখন তারা কি বুঝতে অক্ষম ছিলেন যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা গণতন্ত্রের পরিপন্থী ও সংবিধানের সাথে সঙ্গতিহীন বা সাংঘর্ষিক? তাহলে বিজ্ঞ আইনজীবী ও বিচারক হয়ে তারা কি তখন কথিত গণতন্ত্র পরিপন্থী এ দায়িত্ব পালন করে সংবিধান লংঘনের মত অপরাধ করেছিলেন? শেখ হাসিনার আওয়ামী জোট সরকারের আমলে প্রধান বিচারপতি হয়ে খায়রুল হক সাহেব ২০১২ সালে বুঝতে পারলেন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা গণতন্ত্রের পরিপন্থী ও সংবিধানের সাথে সঙ্গতিহীন বা সাংঘর্ষিক। তাহলে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন, বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি লতিফুর রহমান সাহেবরা কি প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের মত জ্ঞানী-গুণি ছিলেন না ?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন