রাজনৈতিক ইতিহাসের ব্যাপারে আমার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। উপলক্ষ পেলে তাই ইতিহাসের উল্লেখ করি। ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়ার পাশাপাশি উদ্দেশ্য থাকে ইতিহাসের শিক্ষার দিকটিকে প্রাধান্যে আনা। যাতে অন্তত এমন ভুলের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, যার ফলে পুরো জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। এভাবে নিবন্ধ শুরু করার কারণ তৈরি করেছেন সুদূর কানাডায় বসবাসরত একজন বাংলাদেশী নাগরিক। চাকরি, ব্যবসা, লেখাপড়া কিংবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, প্রবাসে যারা বসবাস করেন তাদের মধ্যে দেশপ্রেম প্রবলভাবে জাগ্রত ও সক্রিয় থাকে। প্রতি মুহূর্তে বাংলাদেশ তাদের উতলা করে রাখে। দেশের কল্যাণ চিন্তায় তারা অস্থির হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে এমন দিনগুলোতে দেশের ভেতরে যখন রাজনৈতিক সংকট মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে যায়- যেমন অবস্থার মধ্যে এই সময়ে পড়েছে বাংলাদেশ।
কানাডা থেকে যিনি ই-মেইলে তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছেন তিনিও বর্তমানে মোটেই সুখে বা নিশ্চিন্তে থাকতে পারছেন না। চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবি তাকে যেমন আনন্দিত করেছে, তেমনি তিনি ভীত হয়ে পড়েছেন আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়েও। নির্ধারিত সে নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হতে পারবে কি না সে ব্যাপারে গভীর সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি। আর এর কারণ, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের প্রত্যেকে একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি বাতিল করে দিচ্ছেন, অন্যদিকে ‘সংবিধান অনুযায়ী’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা এমনভাবে দিয়ে চলেছেন যা শুনে মনে হচ্ছে, ওই সংবিধান অক্ষত রয়েছে এবং এর ওপর তারা ইচ্ছামতো কাঁচি চালাননি। অথচ বাস্তবে উচ্চ আদালতের বিতর্কিত একটি রায়কে অবলম্বন করে সংবিধানের খোলনলচেই তারা পাল্টে ফেলেছেন। শুধু তা-ই নয়, রায়টিতে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে বলেও অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা বিষয়টিকে সম্পূর্ণরূপে পাশ কাটিয়ে গেছেন। এখন তারা বলতে শুরু করেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে নাকি আবারও সেই এক-এগারোর মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে এবং ওই সরকার নাকি ‘কেয়ামত পর্যন্ত’ ক্ষমতায় থাকবে! কথাটা বেশিবার বলছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী সেই সাথে এই বলে ভয়ও দেখাচ্ছেন যে, আবারও যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে তাহলে নাকি তাকে শুধু নয়, বেগম খালেদা জিয়াকেও ‘জেলের ভাত’ খাইয়ে ছাড়বে!
প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের কথা এবং ভয়ভীতির কথা শুনেই কানাডা প্রবাসী ওই বাংলাদেশী ই-মেইলে আমাকে একটি নিবন্ধের কপি পাঠিয়েছেন। ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ শিরোনামের নিবন্ধটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা। এটি ২০১০ সালের ৭ ডিসেম্বর দেশের অধিকাংশ দৈনিকে একযোগে প্রকাশিত হয়েছিল (‘সংগ্রাম’, ‘আমার দেশ’ ও ‘নয়া দিগন্ত’সহ সরকার সমর্থক নয় এমন দৈনিকগুলো অবশ্য নিবন্ধটি পাওয়ার এবং প্রকাশ করার সুযোগ পায়নি)। প্রধানমন্ত্রী এতে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের ‘আন্দোলনের ফসল’ হিসেবে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ নামের যে সরকার ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ক্ষমতা দখল করেছিল, যে সরকারের প্রধান উপদেষ্টার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে শেখ হাসিনা ‘সমর্থন’ জানিয়েছিলেন, সে সরকারই তাকে সংসদ ভবন এলাকার একটি বাড়িতে দীর্ঘ ১১ মাস বন্দি করে রেখেছিল। ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ নিবন্ধে নিঃসঙ্গ ওই দিনগুলোর কথাই লিখেছিলেন শেখ হাসিনা। পড়লে প্রধানমন্ত্রীর জন্য মায়া লাগবে। ‘সাবজেল’ হিসেবে ঘোষিত বাড়িটির উত্তর দিকের জানালা দিয়ে তিনি ‘পাখির কলকাকলিতে মুখরিত’ গণভবন দেখতেন। দক্ষিণের জানালা দিয়ে দেখা যেতো প্রিয় নারিকেল গাছটিও। ‘গণভবনের মাঠ, তারপর রাস্তা, পাশে লেক, তারপরই বিশাল খেলার মাঠ। ওই মাঠের পাশেই বাড়িটায় বন্দি ছিলাম’। শেখ হাসিনা আরো লিখেছেন, ‘আর এখন সেই সবুজ মাঠ পেরিয়ে যে গণভবন, সেখানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উঠেছি।’
গণভবনকে ঘিরে অনেক স্মৃতি প্রধানমন্ত্রীর। পিতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনও গণভবনে যাতায়াত করেছেন তিনি। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সেখানে বসবাস করেছেন। ‘সুধা সদনে’ মেরামতের কাজ চলছিল বলে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর মাসখানেক গণভবনে থেকে যেতে চেয়েছিলেন। তাছাড়া ‘জাতির পিতার কন্যা হিসেবে’ তাকে গণভবনে থাকতে দেয়ার ব্যাপারে ‘সরকারি আইন’ করে ‘সিদ্ধান্ত’ও নাকি হয়েছিল। কিন্তু বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাকে ‘অপমান’ করেছিল, গণভবনের সব টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের মনোনীত বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৯৬ সালের ১৬ আগস্ট গণভবন ছেড়ে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি লিখেছেন, ‘অনেকে তো রাষ্ট্রপতি যে বাড়িতে থাকত সে বাড়ি এক টাকার বিনিময়ে লিখে নিয়েছে। আমার বাবাও তো রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় শাহাদাতবরণ করেছিলেন। তারপরও তো আমি এক টাকার বিনিময়ে কোনো সরকারি বাড়ি লিখে নেইনি।’
নিবন্ধে এভাবেই ধীরে ধীরে রাজনীতির দিকে পা বাড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। মূলত একজন রাজনৈতিক নেত্রী, সুতরাং ‘অনেককে’ তিনি টেনে আনতেই পারেনÑ যদিও মাত্র ৪০ বছরের বাংলাদেশে ‘অনেকে’ রাষ্ট্রপতি যেমন হননি, তেমনি ‘অনেকে’ আবার রাষ্ট্রপতির বাড়ি ‘এক টাকার বিনিময়ে লিখে’ও নেননি। এ ধরনের আরো কিছু কথাও রয়েছে নিবন্ধে। এসবের মধ্যে বিচার বিভাগ সম্পর্কিত কথাগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের মামলা চাপিয়েছিলেন উদ্দিন সাহেবরা। সঙ্গত কারণেই বিচারকে ‘প্রহসন’ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেননি শেখ হাসিনা। তিনি দেখেছেন, ‘কোর্টে টাস্কফোর্স ও গোয়েন্দার লোকজন গিজগিজ করছে।’ আদালতের ওপর ‘সব সময় চাপ’ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ‘হাই কোর্টের একজন বিচারপতি তো প্রকাশ্যে বলেই দিলেন, শপথ মোতাবেক কাজ করতে পারছেন না।’ তিনি আরো জানিয়েছেন, ওই দিনগুলোতে সুপ্রিম কোর্টকেও ‘নির্দেশ’ শুনতে হতো এবং মামলার রায় নির্ভর করতো কি ‘ওহি’ নাজিল হয় তার ওপর। সব মিলিয়েই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সেদিনের বন্দি নেত্রী শেখ হাসিনা।
সন্দেহ নেই, তিনি সঠিক অবস্থাই তুলে ধরেছেন। নিবন্ধটি পড়লে বাংলাদেশী নন এমন যে কারো মনে হবে, শেখ হাসিনা নিজে ক্ষমতায় গেলে নিশ্চয়ই বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। অন্যদিকে বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত। এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সারাদেশে হত্যা-সন্ত্রাস আর হামলা-মামলার রাজত্ব শুরু হয়েছে। নিয়মিতভাবে চলছে গুপ্তহত্যা ও ক্রসফায়ারে হত্যা। রাজনীতিক ও সাংবাদিকসহ নিরীহ মানুষও রিমান্ডে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ‘ওহি’র ধমকে রিমান্ড পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিরা পর্যন্ত নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ না করে পারছেন না। এরকম এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাটর্নি জেনারেল ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলকে ২০০৯ সালের ২৮ অক্টোবর মাননীয় আদালত বলেছেন, ‘আপনাদের ক্ষমতা আছে। আমাদেরকেও পেটান। এভাবে চালাতে চাইলে হাইকোর্ট উঠিয়ে দিন।’ এমন অসহায় মন্তব্যের কারণ সম্ভবত উল্লে¬খের অপেক্ষা রাখে না। সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী রিমান্ডে নেয়া ও নির্যাতন চালানো মানবাধিকার ও ফৌজদারি আইনের চরম লংঘন। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এবং পুলিশ কিছুই মানছে না। এখানে তুলনার জন্য ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ নিবন্ধে উল্লে¬খিত বিচারপতিদের কথা বলা য়ায়। দেখা যাবে, শেখ হাসিনার সরকারও ঠিক সেভাবেই চালাচ্ছেÑ যেভাবে তার বিরুদ্ধে চালানো হয়েছিল। ‘ওহি’ও নাজিল হচ্ছে তখনকার মতোই!
নিবন্ধে বেশ কিছু আলোচিত বিষয়ের উল্লেখ থেকে বিরত থেকেছেন প্রধানমন্ত্রী। জেনারেল মইন উ’দের সঙ্গে যোগাযোগ এরকম একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, অন্যরা তো বটেই, শেখ হাসিনা নিজেও এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে জানান দিয়েছেন। যেমন ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জেনেভায় অল ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ১/১১-এর পরবর্তী সরকারের আমলে তাকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সে প্রস্তাবে রাজি হননি। তাকে নাকি তখন হত্যার হুমকিও দেয়া হয়েছিল। তথ্য হিসেবে শেখ হাসিনা অবশ্য নতুন কিছু শোনাননি। কারণ, এ ধরনের প্রস্তাব ও সমঝোতা প্রচেষ্টার কথা উদ্দিন সাহেবদের দিনগুলোতে সব সময় বাতাসে ভেসে বেড়িয়েছে। সদিচ্ছার প্রমাণ দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল ঘটনাপ্রবাহের ‘অগ্রগতি’ সম্পর্কে আরো বিস্তারিতভাবে জানানো, সম্পূর্ণ ‘কেচ্ছা’ শোনানো। কিন্তু তিনি নীরব থেকেছেন। প্রস্তাবটি বেছে বেছে কেবল তাকেই কেন দেয়া হয়েছিল সে প্রশ্নের উত্তরও জানাননি প্রধানমন্ত্রী।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, এত বড় একটি বিষয়কেও ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ নিবন্ধে পাশ কাটিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু তিনি পাশ কাটালে কি হবে, ওই দিনগুলোতে যেমন, পরবর্তীকালেও তেমনি এ সম্পর্কে অনেক তথ্যই প্রকাশিত হয়েছে। যেমন কিছু তথ্য জানা গেছে ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে’র একটি রিপোর্টে (৩.৭.০৯)। জড়িত কয়েকজনের উদ্ধৃতি দিয়ে রচিত রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার প্রতি জেনারেল মইন উ’র মনোভাবে পরিবর্তন ঘটেছিল ২০০৮ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে। খালেদা জিয়া দেশ ছেড়ে যেতে অস্বীকার করায় রাষ্ট্রক্ষমতাকেন্দ্রিক ‘খায়েশ’ পূরণ করতে গিয়ে প্রচন্ড ধাক্কা খেয়েছিলেন মইন উ। তখনই তাকে শেখ হাসিনার দিকে ‘মৈত্রীর হাত’ বাড়ানোর কৌশল নিতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠিত নেতাদের এড়িয়ে তিনি একদল সাবেক আমলা ও অরাজনীতিক ব্যক্তির সাহায্য নিয়েছিলেন। কারণ, নেতারা তখনও শেখ হাসিনাকে ‘মাইনাস’ করে দলের ভেতরে ‘সংস্কার’ করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন! সাবেক ওই আমলা ও অরাজনীতিক ব্যক্তিদের মাধ্যমেই একটি ‘ডিল’ বা সমঝোতা হয়েছিল। মইন উ’র নির্দেশে ডিজিএফআই-এর দুই ডিজি মেজর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ও মেজর জেনারেল এটিএম আমিন ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার প্রতিটি বিষয়ে দেখাশোনা করেছেন। এটিএম আমিন নেত্রীর জন্য নিজেই বিশেষ কারাগারে খাবার নিয়ে গেছেন। তাকে টাঙ্গাইলের শাড়ি উপহার দিয়েছেন। ডিজিএফআই-এর একজন সাবেক সিনিয়র অফিসার জানিয়েছেন, হঠাৎ করেই শেখ হাসিনার ‘কদর’ অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
ঘটনাপ্রবাহের সে পর্যায়েই ডিজিএফআই-এর ডিজি মেজর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদকে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় ‘নীতি নির্ধারক’ হিসেবে বর্ণিত সাবেক আমলা এইচ টি ইমামের সঙ্গে দিনের পর দিন গোপন বৈঠকে অংশ নিতে এবং গভীরভাবে মেলামেশা করতে দেখা গেছে। শেখ হাসিনা ও জেনারেল মইন উ’র মধ্যে ‘দূতিয়ালিতে’ এইচ টি ইমামের প্রত্যক্ষ অবদান সম্পর্কে ইতিমধ্যে অনেক তথ্য প্রকাশিতও হয়েছে। এসব তথ্যে জানা গেছে, তার চেষ্টাতেই শেখ হাসিনা ‘মাইনাস’ হওয়ার পরিণতি এড়াতে পেরেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ‘ডিজিটাল’ নির্বাচনের সমগ্র আয়োজনেও এইচ টি ইমাম প্রধান ‘নটরাজের’ ভূমিকা পালন করেছেন। এখানে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনের চারদিন আগে, ২৪ ডিসেম্বর কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সমঝোতা বৈঠকের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। সে বৈঠকে মইন উ এবং ফখরুদ্দিন আহমদের সঙ্গে শেখ হাসিনার পক্ষে প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এইচ টি ইমাম। ছিলেন আরেক উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন অহমেদও। সেদিনের সমঝোতার ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগ অবিশ্বাস্য ‘বিজয়’ অর্জন করে ক্ষমতায় এসেছে বলে প্রচারণা রয়েছে। একই কারণে এইচ টি ইমামরাও ‘যথোচিত’ পুরস্কার পেয়েছেনÑ তারা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু নিবন্ধে ‘ডিল’ সংক্রান্ত কোনো বিষয়ের ধারেকাছেও যাননি শেখ হাসিনা।
‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ নিবন্ধে শেখ হাসিনার কিছু কথা যে কারো হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। যেমন পবিত্র কোরআনের সুরা আলে ইমরানের ২৬ নম্বর আয়াতের উচ্চারণ ও অর্থ উল্লে¬খ করে তিনি বলেছেন, ‘আল্ল¬াহ সবই পারেন।’ এরপর লিখেছেন, ‘আমি গণভবনে ছিলাম, এখন কারাভবনে আছি। যারা আজ ক্ষমতায় তাদেরও ভবিষ্যতে কারাগারে থাকতে হবে নাÑ এই গ্যারান্টি কি পেয়েছে? ক্ষমতার মসনদ ও কারাগার খুব কাছাকাছি।’ কথাটা তিনি সত্যিই ‘মিন’ করে থাকলে গণতন্ত্রকামী জনগণ নিশ্চয়ই খুশি হতো। অন্যদিকে মইন উ’কে তো বটেই, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাম নিয়ে ক্ষমতা দখলকারীদের প্রত্যেককেই চমৎকার কৌশলে ছাড় দেয়া হয়েছে। কাউকেই জবাবদিহি করতে বা বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি। ফখরুদ্দিন আহমদ তার স্ত্রী এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা শ্যালক ইফতেখার আহমদ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম দিকেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। মইন উ’কে প্রথমে মিলিটারি পুলিশের প্রহরায় ‘সোশ্যাল ওয়ার্ক’ করার জন্য বিদেশে যেতে দেয়া হয়েছে। সেই থেকে নিয়মিত যাওয়া-আসার মধ্যে রয়েছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, একথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, মইন উ’কে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর বা ‘সেনা সমর্থিত’ সরকারের কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার পরিকল্পনা সরকারের নেই। অক্ষরে অক্ষরেই কথা রেখেছেন শেখ হাসিনা। এর কারণ সম্পর্কে নিশ্চয়ই কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না।
‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ নিবন্ধে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লে¬খ পাওয়া যায়নি। যেমন ঠিক কোন আইন বলে ২০০৮ সালের ১১ জুন ‘নির্বাহী আদেশে’ শেখ হাসিনাকে ‘সাবজেল’ থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল এবং কিভাবে তিনি ১৩টি মামলায় হাজিরা দেয়া থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেনÑ এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই নিবন্ধে। অথচ রাতারাতি মুক্তি পেয়ে শেখ হাসিনা শুধু আমেরিকার উদ্দেশে উড়ালই দেননি, তারও আগে সবাইকে হতভম্ব করে ‘সুধা সদনে’ উদ্দিন সাহেবদের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সভাপতিত্বও করেছিলেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার দীর্ঘ টেলি সংলাপ নিয়েও বাজারে তখন গুঞ্জন উঠেছিল। কারণ, একটির বেশি পাসপোর্ট রাখা আইনসম্মত না হলেও আদালত তার তিনটি পাসপোর্টই ফেরৎ দিয়েছিল। মামলার আলামত হিসেবে থানায় আটকে রাখা গাড়িটিও ‘সুধা সদনে’ পৌঁছে গিয়েছিল। সে গাড়িতে চড়েই ১২ জুন সকালে পুলিশ ও র্যাবের প্রহরায় বিমান বন্দরে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ‘ডিজিটাল’ নির্বাচনের প্রাক্কালে তার ঢিলেঢালা গতিবিধির ব্যাপারেও নিবন্ধে কিছু বলেননি তিনি। কারণ, আজ জ্বর তো কাল মাথা ব্যথা করে কোনোভাবে দিন পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। অথচ সত্যি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রয়োজন বোধ করলে এবং বিজয়ের ব্যাপারে গ্যারান্টি না থাকলে তিনি খালেদা জিয়ার মতো কিংবা তার চাইতেও বেশি সফর করতেন, ভাষণ দিয়ে বেড়াতেন। উদ্দিন সাহেবদের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানের একটি মন্তব্যও স্মরণ করা দরকার। দুই নেত্রী ও প্রধান দুই দলের মধ্যে সমঝোতা বৈঠক ও ‘জাতীয় সনদ’ স্বাক্ষর করা নিয়ে আগে থেকে প্রচারণা চালানো হলেও নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে এসে এই উপদেষ্টা হঠাৎ একদিন বলেছিলেন, এসবের আর ‘দরকার’ নেই। অর্থাৎ এর মধ্যেই সকল ‘আয়োজন’ সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল! এখানে ২৯ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনের চারদিন আগে, ২৪ ডিসেম্বর কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সমঝোতা বৈঠকের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে, যে বৈঠকে মইন উ এবং ফখরুদ্দিন আহমদের সঙ্গে শেখ হাসিনার পক্ষে প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এইচ টি ইমাম। সেদিনের সমঝোতার ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগ অবিশ্বাস্য ‘বিজয়’ অর্জন করে ক্ষমতায় এসেছে বলে প্রচারণা রয়েছে। কিন্তু এসব বিষয়ের কোনো উল্লে¬খই করেননি শেখ হাসিনা।
এসব কারণেই কানাডা প্রবাসী ওই বাংলাদেশী তার চিঠিতে লিখেছেন, এক-এগারোর তথা তত্ত্বাবধায়ক নামের অবৈধ ও অসাংবিধানিক সরকারের যে সরকারের ব্যাপারে শেখ হাসিনা এখন মারমুখী হয়ে উঠেছেন সে সরকার শুধু তার নিজের আন্দোলনের ‘ফসল’ই ছিল না, মইন-ফখরুদ্দিনদের মাধ্যমে সব সুযোগ-সুবিধাও তিনি একাই ভোগ করেছিলেন। তাকে ক্ষমতায়ও তো তারাই বসিয়ে গেছেন। কিন্তু এত কিছু পাওয়া সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নাম শুনলেই তিনি এত বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন কেন? তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিজেও তো বারবার শুনিয়ে চলেছেন, সংবিধানে তারা এমন ব্যবস্থা করেছেন যার ফলে কোনো গোষ্ঠীই আর কখনো অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখল করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রীর এই কথাটা সত্য হলে ‘জেলের ভাত’ খাওয়ার বা খাওয়ানোরও তো প্রশ্ন উঠতে পারে না। তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী নিজে কেন ভয় পাচ্ছেন এবং খালেদা জিয়াকেই বা কেন ভয় দেখাচ্ছেন? তার তো বরং সানন্দেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে সম্মত হওয়া উচিত। পাঠকরাও কানাডা প্রবাসীর বক্তব্য এবং প্রশ্নগুলো নিয়ে ভেবে দেখতে পারেন। দেখবেন, কথার মারপ্যাঁচ খাটালেও প্রধানমন্ত্রী আসলে নিজের জালেই আটকে পড়েছেন। তার কাছে প্রশ্নটির কোনো উত্তর নেই।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন