মে ২০১৩ জাতিসঙ্ঘের সহকারী মহাসচিব ফার্নান্দেজ তারাকো সরকারপ্রধান ও
বিরোধী নেত্রীকে জানিয়ে গেলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন জাতিসঙ্ঘ। সব দলগুলোর
মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে সমঝোতার মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার
কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এমনটিই প্রত্যাশা করে
জাতিসঙ্ঘ। দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণে
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন সুষ্ঠু ও নিরপে হয় জাতিসঙ্ঘ তাই কামনা করে।
জাতিসঙ্ঘের এ আকাক্সার সাথে দেশের সাধারণ জনগণের ‘সাধারণ ইচ্ছা’র কোনো ফারাক থাকার প্রশ্নই
ওঠে না। আদালতের এক সংপ্তি রায়ের দোহাই দিয়ে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরা তড়িঘড়ি
করে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ‘কাত্যায়নী বধ’-এর মতো চলমান
নির্বাচনকালীন নিরপে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বলি দিয়ে দেশের
রাজনীতিতে অহেতুক, অনাকাক্সিত ও অবাঞ্ছিত সঙ্কট সৃষ্টি করে। দেশজুড়ে দৃশ্যমান চলমান এ
সঙ্কটের এটা তো শুরু মাত্র! আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য যখন দৃঢ়কণ্ঠে
বলে ওঠেনÑ ‘কেয়ামত হয়ে যাবে, তবুও তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর কখনো ফিরে আসবে না’ তখন জনগণ ভাবতেই পারে নাগরিকদের অকুণ্ঠ সমর্থনপ্রাপ্ত বিরোধী দলের
ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে না নিলে দেশে দুনিয়াবি রাজনৈতিক গজব অনিবার্য।
প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়ত বলে চলেছেন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে
যেভাবে নির্বাচন হয়, আগামী নির্বাচনও সেভাবেই হবে। এটা তার মাইন্ড সেট।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে বিরোধী দল বহুবার সংবাদ
সম্মেলন, জনসভা, মানববন্ধন, হরতাল, বিবৃতির মাধ্যমে এর যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে। দাবি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল
নন এমন ভঙ্গিতে প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেত্রীকে বলেছেন, ‘আপনারা কী চান সংসদে এসে বলুন।’ ১৪ দলীয় কিছু
বাম নেতা যাদের প্রধানমন্ত্রী নৌকা থেকে ঠেলে ফেলে দিলে তাদের রাস্তার টোকাই ছাড়া
জনগণ অন্য কিছু ভাববে না, তারাই এখন বিরোধীদলীয় জোটনেত্রীর প্রতি অবিরাম অশ্রাব্য
বাকচাতুর্যপূর্ণ বিদ্বেষের তীর নিপে করে চলেছে। অথচ এদের দিগম্বর করে নিরীণ করলে
এখনো তাদের শরীরে রীবাহিনীর নির্মম অত্যাচারের আলামত পাওয়া যাবে বলে অনেকের
ধারণা। এদের মুখে এখন আর শ্রেণিসংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র
কায়েমের কথা একবারও শোনা যায় না। মার্কস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সে তুং, চে গুয়েভারাÑ এসব নাম এরা ঘুণারেও প্রকাশ্যে উচ্চারণ করে না। যেমনÑ আওয়ামী লীগও ‘মুজিববাদ’ শব্দটি আর উচ্চারণ করে না ।
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র আর মুজিববাদের রক্তাক্ত লড়াইয়ে অন্তত ৪০ হাজার
‘বাঙালি’ লাশ হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর আমলে। জন্ম নিয়েছিল, দু’টি দানবÑ ‘বাকশাল’ ও ‘গণবাহিনী’। বাকশাল ধ্বংস করেছিল
বহুদলীয় গণতন্ত্রকে আর গণবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের গৌরব সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড
ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিল। এ বাহিনীর অভ্যন্তরে এক প্রলম্বিত রক্তয়ী সাংঘর্ষিক
অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সিপাহি জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে
রাষ্ট্রীয় মতার পাদপিঠে চলে আসেন মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দানকারী শহীদ রাষ্ট্রপতি
জিয়াউর রহমান। সফল এ রাষ্ট্রনায়কই দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তক।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। তার ৩২তম শাহাদতবার্ষিকীতে
জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
১০ মে ২০১১ প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত রায়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী, ১৯৯৬ ভাবী সাপেে
অর্থাৎ প্রসপেকটিভলি বাতিল ও মতাবহির্ভূত ঘোষণা করে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি
বলেছিলেন, ‘জাতীয় সংসদের দশম ও একাদশ নির্বাচন অনাদিকাল থেকে চলে আসা নীতির
ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিধানগুলোতে অনুষ্ঠিত হতে পারে, যা অন্যবিধভাবে
বৈধ নয়Ñ প্রয়োজনের কারণে বৈধ; জনগণের
নিরাপত্তার জন্যÑ যা সর্বোচ্চ আইন এবং রাষ্ট্রের
নিরাপত্তার জন্যÑ যা সর্বোচ্চ আইন।’ (“That which otherwise is not lawful, necessity makes
lawful,” safety of the people is the supreme law & safety of the state
is the supreme law) সে সময়ের নবনিযুক্ত প্রধান
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক হঠাৎ করে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের বিষয়ে বহু আগের
এক রিট মামলা থেকে উদ্ভূত আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে
অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিধায় আদালতের বন্ধু হিসেবে যে আটজন সিনিয়র আইনজীবীকে মতামত
দিতে ডাকা হয়েছিল তাদের সাতজনই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখা
এবং এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় সংবিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে মত দেন।
এতদসত্ত্বেও খায়রুল হক গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১১ অবসরে যাওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে ১০
মে ২০১১ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে এক সংপ্তি রায় ঘোষণা করেন। এটি ছিল একটি
বিভক্ত রায়। সংপ্তি রায় যখন ঘোষণা করা হয় তখন জাতীয় সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ
পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান ছিল। ২ জুন ২০১৩ প্রকাশিত ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ : নবম
জাতীয় সংসদের অষ্টম-পঞ্চদশ অধিবেশন’ শীর্ষক টিআইবি
গবেষণা প্রতিবেদন দাবি করছে, সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি গঠনে প্রধান বিরোধী দলের
প্রতিনিধিত্ব ছিল না। ১১ মাসে বিভিন্ন পেশার মানুষের বক্তব্য নেয়ার দাবি করে
বিশেষ কমিটি। এই বিশেষ কমিটির ৫১টি সুপারিশসহ প্রতিবেদন উপস্থাপন করে, যার কোনোটিই
বিলের চূড়ান্ত খসরায় গৃহীত হয়নি। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই ৩০ জুন ২০১১ মতাসীন
সরকার পার্লামেন্টে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে
দেয়। সর্বশেষ এ সংশোধনীটির পে ভোট পড়ে ২৯১টি এবং বিপে পড়ে মাত্র একটি ভোট।
এ সংশোধনী অনুযায়ী আগামী দশম সংসদ নির্বাচন আওয়ামী নেতৃত্বাধীন জোট
মতায় থেকেই নির্বাচন পরিচালনা করবে। মেয়াদ শেষে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার
বিধান থাকায় নির্বাচন ২০১৩-এর শেষ দিকে অথবা ২০১৪-এর প্রথম দিকেই অনুষ্ঠিত হওয়ার
কথা। বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ১৪ জানুয়ারি ২০১৪।
বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর গত ১৬ সেপ্টেম্বর আপিল
বিভাগের সাতজন বিচারপতি পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বার করেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি
এম খায়রুল হক, প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা ও
বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনÑ এ চারজন
তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক ঘোষণা দেন। বিচারপতি এম এ ওয়াহাব ও বিচারপতি
নাজমুন আরা সুলতানাÑ এ দু’জন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল
রাখার পে মত দেন। বিচারপতি ঈমান আলী বিষয়টি পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের পে রায়
দেন।
পূর্ণাঙ্গ এ রায় প্রকাশের আগেই পঞ্চদশ সংশোধনী পার্লামেন্টে পাস
হলেও এ রায়ে বলা হয়Ñ ‘সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবার েেত্র, জাতীয় সংসদের বিবেচনা অনুসারে, যুক্তিসঙ্গত কাল
পূর্বে যথা ৪২ (বিয়াল্লিশ) দিন পূর্বে সংসদ ভাঙ্গিয়া দেয়া বাঞ্ছনীয় হইবে, তবে নির্বাচনপরবর্তী
নতুন মন্ত্রিসভা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা সংপ্তি আকার
গ্রহণকরত উক্ত সময়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা
করিবেন।’ অন্যত্র বলা
হয়েছে, ‘সংবিধান ত্রয়োদশ আইন ১৯৯৬, অসাংবিধানিক ও অবৈধ হইলেও
জাতীয় সংসদ ইহার বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত অনুসারে উপরে বর্ণিত নির্দেশাবলী সাপেে দশম
ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনকালীন সময়ে প্রয়োজন মতো নতুন ভাবে ও আঙ্গিকে
তত্ত্বাবধায় সরকার গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।’
পূর্ণাঙ্গ রায়ের উপরোল্লিখিত অংশটিকে সরকার এবং বিরোধীদলীয় আমলে
নিয়ে একটি নতুন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ব্যবস্থা সমঝোতার মাধ্যমে বেছে নিলে
সমস্যার সমাধানের রাস্তা হয়তো বেরিয়েও আসতে পারে। নতুবা সরকারের একগুঁয়েমির
খেসারত শুধু রাজনীতিকদেরই দিতে হবে না, দেশের সমগ্র জনগণকেই এর চরম
মূল্য দিতে হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন