দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক হারে অবৈধ অস্ত্রের মজুদ বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠায় জনগণ। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখেই এই অবৈধ অস্ত্রের মজুদ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সাধারণভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন পুলিশের চরম নিষ্ক্রিয়তা আর দায়িত্বে অবহেলার কারণেই যে অস্ত্রের এই মজুদ বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দমনের কাজে। আর এই সুযোগে দেশে বাড়ছে অবৈধ অস্ত্রের মজুদ। এই যখন দেশের অবস্থা তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে মনে ‘পুলিশ যদি ব্যস্ত থাকেন বিরোধী দল দমনে, তাহলে জনগণের নিরাপত্তা দেবে কে’?
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ সেন্টারের জরিপের ওপর ভিত্তি করে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন প্রায় চার লাখ অবৈধ অস্ত্রের মজুদ রয়েছে। আর মজুদকৃত এই অবৈধ অস্ত্রের প্রায় ৫০ ভাগই রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে। ৩০ ভাগ চোরাকারবারি ও সীমান্ত সন্ত্রাসীদের হাতে। বাকি ২০ ভাগ চরমপন্থী, উপকূলীয় সন্ত্রাসী ও জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বর্তমানে সন্ত্রাসীদের হাতে এমন অত্যাধুনিক অস্ত্রও রয়েছে, যা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও নেই।
দেশে বিরাজমান গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে পুঁজি করে সীমান্তপথে অবৈধ অস্ত্রের চালান ঢুকছে বাংলাদেশে। আর রাজনৈতিক অস্থিরতাকে এই চোরাকারবারিরা মূলত একটি মোক্ষম সময় হিসেবেই বেছে নিয়েছে। কেননা রাষ্ট্রের তাবত নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সবাই এখন ব্যস্ত বিরোধী দল দমনের মিশনে। তারা এখন এতটাই ব্যস্ত যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অনেকটা নীরবে প্রতিযোগিতা হচ্ছে বিরোধী জোটের কর্মীদের গ্রেফতার আর হয়রানি করার ক্ষেত্রে এখন কে কার চেয়ে এগিয়ে। কেউই কম যাচ্ছে না। পুলিশ বা র্যাব কিংবা বিজিবি। সকলেই এখন ব্যস্ত বিরোধী দলের সভা, সমাবেশ কিংবা গণতান্ত্রিক অধিকার হরতাল মোকাবিলায় নিজেদের শক্তির জানান দিতেই। আর এই সুযোগে অপরাধীরা বেশ আয়েশ করেই তাদের কর্মকা- পরিচালনা করতে পারছেন।
শুরু থেকেই একটি কথা প্রায় সব মহল থেকেই সমস্বরে উচ্চারিত হচ্ছিল, পুলিশকে যেন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার সরকার না করেন। কিন্তু হয়েছে ঠিক তার উল্টো। জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন না করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন উল্টো কাজটিই করছেন। পান থেকে চুন খসলেই তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরতে। অফিসে, বাড়িতে এমনকি রাস্তা থেকেও তারা বিরোধী দলের অনেককেই গ্রেফতার করছেন। কোনো একটি ঘটনারও সুষ্ঠু তদন্ত না করে চোখ বন্ধ করে সরকারের নির্দেশে বিরোধী পক্ষকে তারা হেনস্তা করছেন। আসল অপরাধীদের পেছনে সময় ব্যয় না করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ওপর মহলের অঙ্গুলির নির্দেশে কাজ করছেন।
আর এই সুযোগেই মূলত দেশে এখন অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানির শব্দ শুনতে পাচ্ছেন সাধারণ জনগণ। ফলে অনেকটা অসহায়ের মতো চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিনাতিপাত করতে হচ্ছে দেশের ১৬ কোটি মানুষকে।
একটি বিষয় খুবই পরিষ্কার যে আসন্ন সিটি কর্পোরেশন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশে অবৈধ অস্ত্রের প্রবেশ বেড়েছে। বিভিন্ন সীমান্তপথ দিয়ে আসছে অস্ত্র। অথচ তা প্রতিরোধে সরকারের কোনো উদ্যোগই নেই। বিষয়টি শুধু জনগণ নয়, সরকারের জন্যও উদ্বেগজনক। গত সপ্তাহে রাজধানীর মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র ও বেশকিছু গুলীসহ সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কেউ কেউ স্বীকারও করেছে, এসব অস্ত্র আনা হয়েছিল নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য। এটাতো গেল রাজধানীর একটি মাত্র ঘটনা। এ রকম আরো অসংখ্য ঘটনা হয়তো সবার অলক্ষ্যে রাতের আঁধারেই মিলিয়ে যাচ্ছে। শুধু এখন না। দেশের অভ্যন্তরে এই ধরনের অবৈধ অস্ত্রের প্রবেশ ঘটছে বছর জুড়েই। দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে এসব অস্ত্র বড় ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে রাজপথের রাজনৈতিক সহিংসতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে ডাকাতি, ছিনতাই ও হত্যাকা-ে ব্যবহৃত হচ্ছে অবৈধ অস্ত্র।
সম্প্রতি এর চেয়েও উদ্বেগজনক তথ্য হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের অবৈধ অস্ত্রের কারবারে জড়িয়ে পড়া। এর ফলে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের একটি অংশ কোনো না কোনোভাবে সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যাচ্ছে। জানা যায়, ২০০২ সালে ক্লিনহার্ট অপারেশনে প্রায় ১০ হাজার অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল। কিন্তু সেই অস্ত্রের এক-চতুর্থাংশও সরকারি মালখানায় জমা পড়েনি। একই ঘটনা ঘটেছে ২০০৭ সালে যৌথ বাহিনীর অভিযানের ক্ষেত্রেও। এখন প্রশ্ন হলো, অপরাধ দমনের দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত, তারা নিজেরাই যদি অপরাধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে তাহলে অপরাধ দমন করবে কে? কারা দেবে দেশের জনগণের নিরাপত্তা? অস্ত্র ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের যোগসাজশের অভিযোগ নতুন নয়। পুলিশ নাকি সন্ত্রাসীদের দিয়েই অস্ত্রের কারবার করে। তাদের কেউ ধরা পড়লে তদন্তের আগেই লেনদেন হয়ে যায়। এরপর উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ডামি অস্ত্র হিসেবে দেখানো হয়। ফলে ওই মামলা থেকে বেকসুর খালাস পেয়ে যায় সন্ত্রাসী। এই যদি হয় আইন প্রয়োগের নমুনা, তাহলে দেশে অস্ত্র প্রবেশ আদৌ বন্ধ হবে কি?
দেশের জনগণকে নিরাপত্তা দিতে হলে এবং দেশের অভ্যন্তরে অবৈধ অস্ত্রের প্রবেশ ও ব্যবসা বন্ধ করতে হলে বেশকিছু সুপারিশও করেছে বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরষের ভূত আগে তাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা থাকাটা একান্তই জরুরি। দ্বিতীয়ত সীমান্তজুড়ে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে জনবলও আরো বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত দেশের ভেতরে যেসব জায়গায় অবৈধ অস্ত্রের কারখানা গড়ে ওঠার খবর রয়েছে, সেখানে কারখানা চিহ্নিত করে সেগুলোতে অভিযান চালাতে হবে। চতুর্থত নিশ্চিত করতে হবে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী অস্ত্রধারীদের শাস্তি। বস্তুত উপযুক্ত শাস্তিই যে কোনো অপরাধ দমনের প্রধান উপায়। অথচ দেশে অস্ত্র মামলায় সাজা হওয়ার রেকর্ড খুবই কম। এক্ষেত্রেও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ ব্যাপারে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হলে অপরাধীরা সহজে পার পেয়ে যেতে পারবে না। জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে অবৈধ অস্ত্রের প্রবেশ প্রতিরোধ করতে হবে কঠোরভাবে।
আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশের প্রায় প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের হাতে বিপুল পরিমাণে অস্ত্রের মজুদ বাড়তে থাকে। বিরোধী পক্ষের কোনো ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে অবস্থানেরই সুযোগ পায়নি। অনেক মেধাবী ছাত্রদের তাদের ছাত্রত্ব শেষ করতেও হয়েছে। অনেকে পরীক্ষা দিতে পারেনি। পরিস্থিতি এতটাই মারাত্মক আকার ধারণ করে যে, সরকারি দলের সমর্থক না হলে পরীক্ষার হল থেকেও শিক্ষার্থীদের পুলিশ দিয়ে ধরে নিয়ে থানায় নির্যাতনের মতো ঘটনাও ঘটেছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যেই অন্তর্কলহের জের ধরে প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এত কিছুর পরও পুলিশ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারেনি। উপরন্তু বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন।
অন্যদিকে দেশে ব্যাপকহারে হত্যা আর গুমের ঘটনা ঘটলেও এক্ষেত্রেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না প্রশাসন। বিশেষ করে গত তিন বছরে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর গুমের ঘটনার পরও পুলিশের পক্ষ থেকে তেমন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। এছাড়া সবচেয়ে আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি তাদের নিজ বেডরুমে নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পরও অপরাধীরা কেউই আজো ধরা পড়েনি। প্রধানমন্ত্রী নিজে এই খুনের ঘটনার পরে খুনিদের ধরার বিষয়ে নির্দেশ দেয়ার পরেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি বরং নানা কল্পকাহিনী সাজিয়ে এখন মূল ঘটনাটিকেই ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে।
এই ঘটনার পরে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে, দেশে এখন কোনো মানুষই নিরাপদ নয়। বেডরুম, অফিস কিংবা রাজপথ কোথাও আজ কেউ জীবনের নিরাপত্তা বোধ করছে না। জনগণের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব যে পুলিশ প্রশাসনের তারাই যদি বিরোধী দল দমনে প্রতিক্ষণ ব্যয় করতে হয়, তাহলে সাধারণ জনগণের জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন