নেপালের প্রথম সাহিত্য সম্মেলনে কাঠমান্ডু যাওয়ার কথা ছিল বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরীনের; কিন্তু তখন নয়া দিল্লি নিবাসী তসলিমা তার সুইডেনের পাসপোর্ট সাথে নেননি। স্বাভাবিক কারণেই তাই তিনি কাঠমান্ডুগামী বিমানে উঠতেই পারলেন না। এ ব্যাপারে টুইটারে তসলিমার বক্তব্য, ‘আমি নেপালকে বিদেশী রাষ্ট্র বলে ভাবিনি, ভারতের অঙ্গরাজ্য ভেবেছিলাম। তাই পাসপোর্ট সাথে নেয়ার কথা মাথায়ই আসেনি।’ আলোচিত লেখিকা তসলিমার ভূগোল জ্ঞান সম্পর্কে এমন মন্তব্যের পর স্বভাবতই নেপালে প্রচণ্ড তোলপাড়, ক্ষোভে-ধিক্কারে নেপালজুড়ে মানুষ উত্তেজিত। ফলে ওই সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজক কমিটির পরিচালক অজিত বড়াল বলেন, তসলিমার মন্তব্যে বিতর্ক মাথাচাড়া দিচ্ছে। নেপাল গেলে বিক্ষোভকারীরা তাকে কালো পতাকা দেখাতে পারে, বিক্ষোভ হতে পারে। আমরা তার নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারব না। সব জেনে তসলিমার মন্তব্যÑ আমি অত্যন্ত দুঃখিত, নেপালে আমাকে নিয়ে কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা হোক, আমি চাই না।
সূচনায় ঘটনাটির উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, ভূগোল সম্পর্কে ভ্রান্ত বিশ্বাসে তসলিমার মতো চরম বিতর্কিত লেখিকা যদি অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করতে পারেন তাহলে বিপুল জনরায়ে নির্বাচিত বর্তমান মহাজোট সরকার সব জনস্বার্থবিরোধী কলঙ্কিত কর্মকাণ্ডে দুঃখ প্রকাশ না করে উল্টো প্রলাপ বকছেন কোন যুক্তিতে? বাংলাদেশের জন্মের এবং বর্তমান বিকাশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের ইতিহাস এবং আঞ্চলিক ভূগোল জ্ঞানে সবচেয়ে অভিজ্ঞ বিদ্বানদের একঝাঁক তারকা তো বর্তমান সরকারে আছেন। তার পরও পদ্মা সেতুর বিতর্কিত এবং নিন্দিত নায়ক আবুল হোসেনকে ‘দেশপ্রেমিক’ বলেন কী করে? হলমার্ক কেলেঙ্কারির লোপাট হওয়া সাড়ে চার হাজার কোটি টাকাকে ‘এটা কোনো টাকা হলো’র মতো তাচ্ছিল্য কথা আসে কী করে? টেলিভিশন টকশোতে অংশগ্রহণকারীদের সিঁদকাটা কিংবা নিশিকুটুম্ব বলেন কেমনে? দায়িত্বের অবশ্য কর্তব্য হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়ে সমালোচকদের উদ্দেশে তীব্র বাক্যবান ছুড়ে কিভাবে বলেন যে, সাত দিন বিদ্যুৎ না দিলে তখন বুঝবে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির দায় না নিয়ে বরং অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ জগতের ক্ষতিগ্রস্তদের ফটকা কারবারি বলেন কেমনে? আরো কত বচনÑ গরু-ছাগলের চিহ্ন চিনতে পারলেই তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে হবে, মুই কার খালুরে, জিয়াউর রহমানের লাশ কবর থেকে তুলে ডিএনএ টেস্ট করতে হবে, বিশ্বব্যাংক নিজেই একটা দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠান, নোবেল পাওয়া উচিত শেখ হাসিনা এবং সšুÍ লারমার, পুলিশ কি বসে বসে আঙুল চুষবে, কুইক রেন্টাল নিয়ে সমালোচনাকারীরা দেশদ্রোহী, নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব নাকি রক্তচোষা, সুদখোর, অধ্যাপক আবদুল্লাহ্ আবু সায়িদকে সংসদে এসে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে, টিপাই মুখে বাঁধ দিলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না, বাজারে কম কম যান, আপনারা কম খানÑ তা হলেই দেখবেন দ্রব্যমূল্য কমছে, ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সময় সবাই ঘরে ভালো করে তালা লাগিয়ে যাবেন, রাবিশ-অল-বোগাস ইত্যাদি... ইত্যাদি... চলছে। এ প্রসঙ্গে গল্পটা বেমানান হবে না ধারণা করে বলছিÑ স্বামীকে সাথে করে স্ত্রী সিনেমা হলের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই এক ভিক্ষুক হাত পাতল। ভিক্ষুক : আপা, আপনি খুব সুন্দর। দুইটা টাকা দেন না। পুলকিত স্ত্রী মুচকি হেসে ভ্যানিটি ব্যাগে হাত দিতেইÑ স্বামী : এই, দুই টাকা না ওকে তুমি ১০ টাকাই দাও। ও তোমাকে সুন্দর বলছে (মনে মনে : ব্যাটা আসলেই বোধহয় অন্ধ)। দেখা গেল কিছু প্রাপ্তির লোভে অসুন্দরকে সুন্দর বলা নীতিহীন কাজ হলেও ভিক্ষুক তা করছে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশংসার দ্বারা। আর স্বামী বেচারা তার কথার যে অংশটুকু জোরে বলেছে, তার মধ্যে শ্লেষ থাকলেও মনে মনে কিন্তু প্রচণ্ড বিরক্তির অনুভূতিই প্রকাশ করেছেন। এ দেশের সাধারণ মানুষ বর্তমান সরকারের সাথে এমনই ঘর করছেন বলে মনে হয়। কারণ এ সরকার তো মুক্তিযুদ্ধের তথা স্বাধীনতার চেতনার ফেরিওয়ালা হয়েছেন দাবি করে সার্বক্ষণিক চেঁচামেচি করছেন। সেটা কীÑ কোন অর্থে, কোন মহাকল্যাণকর জাতি সেবার মাধ্যমে? জেমস্ ওটিস এর সংজ্ঞায়, ‘স্বাধীনতা হচ্ছে উন্নতির শ্বাস-প্রশ্বাসস্বরূপ।’ এ আঙ্গিকে অর্থনীতিকে, গণতন্ত্রকে, বাকস্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, পরমত সহিষ্ণুতাকে, জাতিকে বিভক্ত না করে জাতীয় স্বার্থের ব্যাপারে অন্তত ঐক্যবদ্ধ রাখাকে কি সংক্ষেপে উন্নতির শ্বাস-প্রশ্বাসের দৃশ্যমান উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করা যায়? যদি যায় তা হলে এই ফেরিওয়ালাদের কাছে তো সেসব সওদা নেই, আগ্রহী হয়ে এগুলোর নিষ্ঠাবান সরবরাহকারী হতেও তাদের কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। এটাও বাংলাদেশে সামঝোতার রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির একটি বড় বাধা। সে বাধা দূর করার জন্য বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ভাষায় ‘প্রয়োজন আইনের তোয়াক্কা করে না’- অনুসরণ করে গণদাবির ক্রমাগত উপেক্ষা এবং নির্যাতন ও খামখেয়ালিপনার শিকার জনগণ বিক্ষোভ করেÑ দ্রোহের আগুন জ্বালায়Ñ অনেক কিছুই তখন জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়। প্রথাগত ইতিহাসে পৃথিবীর বহু স্থানে এরকমই ঘটেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইলিনয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রিয়াজ প্রিয় স্বদেশ ভূমিতে এসেছিলেন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের আলোচনায় প্রচণ্ড ক্ষোভের সাথে তিনি বলেছেন, বর্তমানে রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থায় একটি প্রতিষ্ঠানও নেই, যার প্রতি মানুষ আস্থা রাখতে পারে। আমরা একটা মানবাধিকার কমিশন নামক সাইন বোর্ড ও তার একজন চেয়ারম্যান পেয়েছি, গোটা কমিশনের কোনো নড়াচড়া না দেখলেও চেয়ারম্যানের নড়াচড়া আমরা প্রতিনিয়ত দেখি। বিশাল গোঁফসহ শরীরের বেশির ভাগ অঙ্গ-প্রতঙ্গ নাড়িয়ে তিনি নিয়মিত সমবেদনা এবং উপদেশ খয়রাত দেন জাতিকে, কখনো কাঁদেন, কখনো উচ্চকণ্ঠে মানবতার পতাকা তুলে ধরার দায়িত্ব দেন আমাদের সবাইকে। কখনো কারা গেটে গিয়ে ডিআইজির বাধায় ভেতরে ঢুকতে না পেরে গোটা কমিশনকে হাস্যকর বানান, আবার পঙ্গু লিমনের অভিভাবকত্বের ফাঁকাবুলির দায়িত্বও নেন। তাইতো বুঝতে বেশ সমস্যা হয়Ñ এটা কোন জেন্ডারের পর্যায়ে পড়ে। অথচ প্রতিবেশী দেশের একটি রাজ্যের মানবাধিকার কমিশন হয়েও পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশন কিছু দিন আগে বিরোধীদলীয় এক নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেছে এই মর্মে যে, অভিযুক্ত বিরোধী নেতা মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ধর্ষিতার মূল্য তো বিশ হাজার টাকাÑ তাহলে আপনার কত? মামলার প্রতিপাদ্য হচ্ছে এ দ্বারা নারী জাতির অমূল্য সম্ভ্রমকে ব্যঙ্গ করে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন অভিযুক্ত। একই সাথে পাশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের ক্রমাগত তাগিদে সেখানকার সরকার ‘নারী থানা’র সংখ্যা ১০ থেকে বাড়িয়ে প্রতিটি নারী নির্যাতন, ধর্ষণ সংক্রমিত এলাকায় একটি করে নারী থানা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। আমাদের চেয়ারম্যান একবার ওই রাজ্যে সফর করে এলে ভালো হয়। কারণ একেবারে নতুন অনুষঙ্গ হিসেবে বাংলাদেশে এখন চলন্ত পরিবহনে যেভাবে নারী ধর্ষণ হচ্ছে সে প্রসঙ্গে তিনি নতুন উপদেশ বিতরণ করার কোনো উপাদান হয়তো পেয়ে যাবেন। কী বলব, কোন ভাষায় যে অনুভূতি প্রকাশ করব বুঝতে পারছি না। শুধু চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে লজ্জা লজ্জা। আর জোকস্ ফর্মুলায় যদি অনুভূতি প্রকাশ করি তাহলে বলতে হয়Ñ এক ব্যক্তির বাড়ির গেটে সাইনবোর্ডে লাগানো আছে ‘তোতা পাখি হতে সাবধান’। কৌতূহলী এক ব্যক্তির জিজ্ঞাসার জবাবে ওই বাড়ির দারোয়ান বলল- সন্দেহভাজন কোনো আগন্তুককে দেখলেই তোতা পাখি শিস দেয়Ñ অমনি স্যারের অ্যালসেশিয়ানটি এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানে অ্যালসেশিয়ান কিন্তু প্রহরী নয় বরং সতর্ক প্রহরী সাজানো হয়েছে তোতাপাখিকে। মূল প্রতিকারকারী নিশ্চিন্ত আরামে আছেন সাজানো প্রহরীর ভরসায়। তা না হলে শাসক দল আওয়ামী লীগ যেভাবে ক্রমেই অতিমাত্রায় অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেÑ তার রাশ টেনে ধরার কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ আমরা দেখতে পারছি না কেন? এর উত্তরে নির্বাচন ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবেÑ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করে। প্রকৃত জনমতকে কখনোই গুরুত্ব দেয় নাÑ বরং দলিত-মথিত করে দেয়।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। সেই নির্বাচনে দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এবং আওয়ামী লীগের অপ্রতিহত প্রভাবে ও সাংগঠনিক প্রতিপত্তি বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও মধ্যযুগীয় রাজদরবারের শাসনের মতো করে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে নির্লজ্জ আনুগত্য প্রদর্শনে উলঙ্গভাবে ব্যবহার করা হয়, যা ওই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ ও ফলাফলে প্রমাণিত হয়। অথচ সে নির্বাচনে বিরোধী দলের বড় ধরনের বিজয়ের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আবুল মনসুর আহমেদের পর্যবেক্ষণে সেই নির্বাচনে আওয়ামী নেতৃত্বের উদার হতেও কোনো রিস্ক বা অসুবিধা ছিল না; কিন্তু নির্বাচনকালীন অপজিশনের প্রতি তারা যে মনোভাব অবলম্বন করেছিলেন, সেটা সাময়িক অবিবেচনাপ্রসূত ভুল ছিল না বরং আওয়ামী লীগ নীতি হিসেবেই এই পন্থা গ্রহণ করেছিল। দেশের দুর্ভাগ্য যে, শেখ মুজিব উদারতার পথে না গিয়ে উল্টো পথ ধরলেন এবং বিরোধীপক্ষের প্রধান ও দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ানদের পার্লামেন্টে ঢুকতে না দেয়ার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন। শ্রদ্ধেয় প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেন তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনায় বললেনÑ আমি নিজে সাক্ষী যে রাজনৈতিক দলের অধীনে সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয় না। আরো বহু খ্যাতিমান ব্যক্তির পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান যে, ’৭৩-এর জাতীয় নির্বাচনে কোনো কারচুপি ব্যতিরেকেই আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করত। তথাপি নির্বাচনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপক কারচুপি প্রমাণ করে যে, সুদিনেও জনমত ও জনসমর্থন সম্পর্কে আওয়ামী লীগ সন্দিহান থাকে। এতে স্পষ্ট হয় যে, বিরুদ্ধের কিংবা পক্ষের জনমত-জনসমর্থন যতই থাকÑ আওয়ামী লীগের অধীনে কিংবা তাদের অনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগের কোনো নির্বাচনে এ দলটিকে পরাজিত করা যাবে না।
১৯৯৬-এর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পাবনা- ২, মেহেরপুর-১ এবং টাঙ্গাইল এর উপনির্বাচনও মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে প্রভাব বিস্তার ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে ২৬ জন মন্ত্রী ওই এলাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে নিয়মিত প্রচার কাজ চালিয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী নিজেই অভিযোগ করে বলেছেন, ‘আমি নিজের ভোটটিও দিতে পারিনি’। সরকারি দল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন হীন প্রক্রিয়া ও কর্মকাণ্ডের বর্ণনার সারাংশে কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, ‘শুধু প্রশাসন নয়, আওয়ামী লীগারেরাও কম যায় কিসে? কুকর্মে তারা জগদি¦খ্যাত।’ ওই উপনির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস এবং ব্রিটিশ কূটনীতিকেরা প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু হেনার সাথে সাক্ষাৎ করে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ১৯৯৯-এর ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঔদ্ধত্য এবং প্রভাবের মুখে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী প্রার্থী। ওয়ার্ড কমিশনার পদে একশ্রেণীর সন্ত্রাসী কেন্দ্র দখল এবং ব্যালট পেপারে সিল মারার প্রতিযোগিতা করে নির্বাচনটিকে প্রহসনে পরিণত করে। এ ক্ষেত্রেও তৎকালীন প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে নিরাপদ থাকে। ২০০০-এর ৩১ আগস্ট ঝালকাঠি-২ আসনে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে দাগি আসামি ও সন্ত্রাসীদের ব্যাপক তাণ্ডব-হাঙ্গামার কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী ইলেন ভুট্টোর এজেন্টরা ভোটকেন্দ্রে পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারেননি। এমনকি সন্ত্রাসীরা ইলেন ভুট্টোর কর্মী-সমর্থকদের বাড়িঘরের সামনে, পাড়া ও গ্রামের আশপাশে অবস্থান করে ভোটারদের বাড়ি থেকে বেরুতেও বাধা দেয়। এ বিষয়ে সাপ্তাহিক যায়যায়দিনসহ বহু পত্রপত্রিকার ঘটনাপ্রবাহের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
বর্তমান আওয়ামী সরকারের আমলেও ভোলা উপনির্বাচনে শাসক দল এবং ভীত-অনুগত প্রশাসনের অবিশ্বাস্য তাণ্ডবলীলা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। মেজর হাফিজের সমর্থক মহিলাকে তারা ধর্ষণ পর্যন্ত করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপনির্বাচনে প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা মানুষ দেখেছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ফলাফল ঘোষণা নিয়ে প্রশাসনের অহেতুক জটিলতা সৃষ্টি এবং আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থীর মারমুখী অসভ্য আচরণ জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে।
বিএনপি সরকারের আমলে এক মাগুরা উপনির্বাচন নিয়ে যদি লঙ্কাকাণ্ড হয়ে যেতে পারেÑ তাহলে প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সময়ের আওয়ামী লীগের আমলের নির্বাচনগুলো মানদণ্ডের কোন পর্যায়ে পড়ে? শুধু তাই নয়, বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি; যার ফর্মুলা জামায়াতের ল্যাবরেটরিতে আবিষ্কৃত এবং আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত কর্তৃক বাজারজাতকৃত। এই ফর্মুলা প্রয়োগের জন্য আইন প্রণয়নে জবরদস্তি দাবির আন্দোলনে ১৯৯৪-এর জুলাই থেকে ১৯৯৬ এর ২৫ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের সংঘর্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ নিহত ৬৫ জন, আহতের সংখ্যা কয়েক হাজার। একটানা এক সপ্তাহসহ ১৭৩ দিন হরতাল করা হয়। যার ফলে জীবননাশ, সম্পত্তি ধ্বংস, বিশৃঙ্খলাসহ চট্টগ্রাম বন্দর ও শিল্প-কলকারখানাসহ রাষ্ট্রীয় উৎপাদনব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ষষ্ঠ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হওয়ার পরও আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী জামায়াত-জাতীয় পার্টি তাদের পরোক্ষ ভায়োলেন্স বন্ধ করেনি। আজকের আওয়ামী সরকারের গুণধর মন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, সফিউর রহমানসহ কিছু আমলা এবং এরশাদ আমলের সুবিধাভোগী কর্মচারী নেতা সৈয়দ মহিউদ্দিনসহ কর্মচারীদের একটি গ্রুপ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে রাজপথে আন্দোলনকারীদের সাথে যোগ দেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ চেইন অব কমান্ড ভেঙে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশাসনিক বিভাজন সৃষ্টির জঘন্য উদাহরণও সৃষ্টি করা হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। আর বর্তমান সরকারের আমলে তো জনপ্রশাসন চেহারা পাল্টে দলীয় প্রশাসনে রূপ নিয়ে নিরপেক্ষতা এবং নৈতিকতা হারিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইন প্রয়োগে জনগণের জন্য অনির্ভরযোগ্য সিন্ডিকেটে পরিণত করেছে, যার সবচেয়ে বড় কলঙ্কিত অধ্যায় হচ্ছে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে বিশ্বাসযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা। যে রায় নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে, সবচেয়ে বড় বিতর্ক হচ্ছে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হওয়ায় তা সংবিধানের মৌলিক চেতনা গণতান্ত্রিক কাঠামোবিরোধী।’ কথাটি রায়ের নির্দেশনায় থাকার কারণে। অথচ জাতির ঘাড়ে আওয়ামী সরকার যে অনির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের চাপিয়ে দিলো, যে পৌর প্রশাসকদের নিয়োগ দিলো, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের শপথবিহীন মন্ত্রীর পদমর্যাদা দিলো কিংবা ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করে অনির্বাচিত প্রশাসকদের চড়িয়ে দিলো, সে ব্যাপারে আদালতের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত বরফশীতল। এ ক্ষেত্রে ১৯৯৫-৯৬ সালে সহিংস আন্দোলনকারীদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে যে বহুল কথিত বক্তব্যটি ‘সংবিধান জনগণের জন্য, জনগণের প্রয়োজনে সংবিধান, সংবিধানের জন্য জনগণ নয়’- এর যৌক্তিকতা তারা কোন কম্বলের নিচে চাপা দিলেন?
আমাদের মনে রাখতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা শুধু একটি আইনি বিষয়ই নয়, এটি একটি সামাজিক-রাজনৈতিক চুক্তিও বটে। শুধু আইন দিয়েই এটা ভাঙ্গা বা পরিবর্তন করা যাবে না। সামাজিক এবং রাজনৈতিক শান্তি বজায় রাখতে বাংলাদেশে এখন যে নির্বাচন প্রয়োজন তা শুধু নির্বাচন কমিশন দিয়ে সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন শতভাগ আন্তরিক হলে বর্তমান সরকারপ্রধানের এক সময়ের বহুল আলোচিত উক্তি সূক্ষ¥ কারচুপি হয়তো ঠেকানো সম্ভব; কিন্তু তার স্থূল কারচুপি ঠেকানো সম্ভব নয়। তাই অনিবার্য বাস্তবতা হচ্ছে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আওয়ামী লীগ প্রধানকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের কোনো বক্তব্য ছিল না। আরো একটি বিষয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, বাংলাদেশে বাকশাল প্রবর্তনের কুখ্যাত চতুর্থ সংশোধনীটি পাস হয়েছিলো ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫-এ। আবার পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা বর্তমান সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ২৫ জানুয়ারি ২০০৯-এ। বাকশাল পাস করে গণতন্ত্র হত্যার চতুর্থ সংশোধনীতে পক্ষে ভোট পড়েছিল ২৯২টিÑ আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পঞ্চদশ সংশোধনীতেও পক্ষে ভোট পড়েছে ২৯২টি। এখানে আবারো স্মরণ করতে হয় আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আবুল মনসুর আহমেদকে। তিনি বলেছেন, নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী নেতৃত্ব তাদের ক্ষমতাকালীন বৃত্তে অপজিশনের প্রতি যে মনোভাব অবলম্বন করে সেটা সাময়িক অবিবেচনাপ্রসূত ভুল নয়, বরং তারা নীতি হিসেবেই এই পন্থা গ্রহণ করে। অতএব সাধু সাবধান। সতর্ক জনগণ। কোনো অবস্থাতেই আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কিংবা তাদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থাকবে এমন প্রশাসনের অধীনে বিশ্বাসযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন হবেÑ এটা এ দেশের সাধারণ মানুষ মনেই করে না।
তাই বলতে চাইÑ আওয়ামী লীগের দাবি এবং আন্দোলনকালীন প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে জনমত জরিপের ফলাফল ছিল ৬৭ শতাংশ, বর্তমানে সেটা ৯০ শতাংশের বেশি। সুতরাং বৃহত্তর গণমানুষের দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। নির্লজ্জ ভাষায় ধারাবাহিক অশ্লীলতার উপাদান দিয়ে লিখিত ‘লজ্জা’ উপন্যাস! এর বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরীন যদি অজান্তে কৃত ছোট একটি ভুলের জন্য নেপালের মতো পরদেশের কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে পারেÑ সংশোধন করতে পারে নিজের কৃতকর্মÑ তাহলে স্বদেশবাসীর কাছে ভুল স্বীকার করে জাতীয় নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনে আওয়ামী লীগ কেন লজ্জা পাবে। তারা তো বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। আর প্রকৃতির নিয়মে তো বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথেই বাড়ে শুভবুদ্ধির পরিধি। দেশবাসীর সাথে আমিও অপেক্ষায় থাকলাম সেই শুভ বুদ্ধি উদয়ের। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন কিন্তু বলেছেন ‘প্রয়োজন আইনের তোয়াক্কা করে না’।
সাম্প্রতিক সময়ে ইলিনয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রিয়াজ প্রিয় স্বদেশ ভূমিতে এসেছিলেন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের আলোচনায় প্রচণ্ড ক্ষোভের সাথে তিনি বলেছেন, বর্তমানে রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থায় একটি প্রতিষ্ঠানও নেই, যার প্রতি মানুষ আস্থা রাখতে পারে। আমরা একটা মানবাধিকার কমিশন নামক সাইন বোর্ড ও তার একজন চেয়ারম্যান পেয়েছি, গোটা কমিশনের কোনো নড়াচড়া না দেখলেও চেয়ারম্যানের নড়াচড়া আমরা প্রতিনিয়ত দেখি। বিশাল গোঁফসহ শরীরের বেশির ভাগ অঙ্গ-প্রতঙ্গ নাড়িয়ে তিনি নিয়মিত সমবেদনা এবং উপদেশ খয়রাত দেন জাতিকে, কখনো কাঁদেন, কখনো উচ্চকণ্ঠে মানবতার পতাকা তুলে ধরার দায়িত্ব দেন আমাদের সবাইকে। কখনো কারা গেটে গিয়ে ডিআইজির বাধায় ভেতরে ঢুকতে না পেরে গোটা কমিশনকে হাস্যকর বানান, আবার পঙ্গু লিমনের অভিভাবকত্বের ফাঁকাবুলির দায়িত্বও নেন। তাইতো বুঝতে বেশ সমস্যা হয়Ñ এটা কোন জেন্ডারের পর্যায়ে পড়ে। অথচ প্রতিবেশী দেশের একটি রাজ্যের মানবাধিকার কমিশন হয়েও পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশন কিছু দিন আগে বিরোধীদলীয় এক নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেছে এই মর্মে যে, অভিযুক্ত বিরোধী নেতা মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ধর্ষিতার মূল্য তো বিশ হাজার টাকাÑ তাহলে আপনার কত? মামলার প্রতিপাদ্য হচ্ছে এ দ্বারা নারী জাতির অমূল্য সম্ভ্রমকে ব্যঙ্গ করে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন অভিযুক্ত। একই সাথে পাশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের ক্রমাগত তাগিদে সেখানকার সরকার ‘নারী থানা’র সংখ্যা ১০ থেকে বাড়িয়ে প্রতিটি নারী নির্যাতন, ধর্ষণ সংক্রমিত এলাকায় একটি করে নারী থানা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। আমাদের চেয়ারম্যান একবার ওই রাজ্যে সফর করে এলে ভালো হয়। কারণ একেবারে নতুন অনুষঙ্গ হিসেবে বাংলাদেশে এখন চলন্ত পরিবহনে যেভাবে নারী ধর্ষণ হচ্ছে সে প্রসঙ্গে তিনি নতুন উপদেশ বিতরণ করার কোনো উপাদান হয়তো পেয়ে যাবেন। কী বলব, কোন ভাষায় যে অনুভূতি প্রকাশ করব বুঝতে পারছি না। শুধু চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে লজ্জা লজ্জা। আর জোকস্ ফর্মুলায় যদি অনুভূতি প্রকাশ করি তাহলে বলতে হয়Ñ এক ব্যক্তির বাড়ির গেটে সাইনবোর্ডে লাগানো আছে ‘তোতা পাখি হতে সাবধান’। কৌতূহলী এক ব্যক্তির জিজ্ঞাসার জবাবে ওই বাড়ির দারোয়ান বলল- সন্দেহভাজন কোনো আগন্তুককে দেখলেই তোতা পাখি শিস দেয়Ñ অমনি স্যারের অ্যালসেশিয়ানটি এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানে অ্যালসেশিয়ান কিন্তু প্রহরী নয় বরং সতর্ক প্রহরী সাজানো হয়েছে তোতাপাখিকে। মূল প্রতিকারকারী নিশ্চিন্ত আরামে আছেন সাজানো প্রহরীর ভরসায়। তা না হলে শাসক দল আওয়ামী লীগ যেভাবে ক্রমেই অতিমাত্রায় অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেÑ তার রাশ টেনে ধরার কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ আমরা দেখতে পারছি না কেন? এর উত্তরে নির্বাচন ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবেÑ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করে। প্রকৃত জনমতকে কখনোই গুরুত্ব দেয় নাÑ বরং দলিত-মথিত করে দেয়।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। সেই নির্বাচনে দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এবং আওয়ামী লীগের অপ্রতিহত প্রভাবে ও সাংগঠনিক প্রতিপত্তি বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও মধ্যযুগীয় রাজদরবারের শাসনের মতো করে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে নির্লজ্জ আনুগত্য প্রদর্শনে উলঙ্গভাবে ব্যবহার করা হয়, যা ওই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ ও ফলাফলে প্রমাণিত হয়। অথচ সে নির্বাচনে বিরোধী দলের বড় ধরনের বিজয়ের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আবুল মনসুর আহমেদের পর্যবেক্ষণে সেই নির্বাচনে আওয়ামী নেতৃত্বের উদার হতেও কোনো রিস্ক বা অসুবিধা ছিল না; কিন্তু নির্বাচনকালীন অপজিশনের প্রতি তারা যে মনোভাব অবলম্বন করেছিলেন, সেটা সাময়িক অবিবেচনাপ্রসূত ভুল ছিল না বরং আওয়ামী লীগ নীতি হিসেবেই এই পন্থা গ্রহণ করেছিল। দেশের দুর্ভাগ্য যে, শেখ মুজিব উদারতার পথে না গিয়ে উল্টো পথ ধরলেন এবং বিরোধীপক্ষের প্রধান ও দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ানদের পার্লামেন্টে ঢুকতে না দেয়ার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন। শ্রদ্ধেয় প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেন তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনায় বললেনÑ আমি নিজে সাক্ষী যে রাজনৈতিক দলের অধীনে সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয় না। আরো বহু খ্যাতিমান ব্যক্তির পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান যে, ’৭৩-এর জাতীয় নির্বাচনে কোনো কারচুপি ব্যতিরেকেই আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করত। তথাপি নির্বাচনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপক কারচুপি প্রমাণ করে যে, সুদিনেও জনমত ও জনসমর্থন সম্পর্কে আওয়ামী লীগ সন্দিহান থাকে। এতে স্পষ্ট হয় যে, বিরুদ্ধের কিংবা পক্ষের জনমত-জনসমর্থন যতই থাকÑ আওয়ামী লীগের অধীনে কিংবা তাদের অনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগের কোনো নির্বাচনে এ দলটিকে পরাজিত করা যাবে না।
১৯৯৬-এর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পাবনা- ২, মেহেরপুর-১ এবং টাঙ্গাইল এর উপনির্বাচনও মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে প্রভাব বিস্তার ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে ২৬ জন মন্ত্রী ওই এলাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে নিয়মিত প্রচার কাজ চালিয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী নিজেই অভিযোগ করে বলেছেন, ‘আমি নিজের ভোটটিও দিতে পারিনি’। সরকারি দল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন হীন প্রক্রিয়া ও কর্মকাণ্ডের বর্ণনার সারাংশে কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, ‘শুধু প্রশাসন নয়, আওয়ামী লীগারেরাও কম যায় কিসে? কুকর্মে তারা জগদি¦খ্যাত।’ ওই উপনির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস এবং ব্রিটিশ কূটনীতিকেরা প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু হেনার সাথে সাক্ষাৎ করে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ১৯৯৯-এর ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঔদ্ধত্য এবং প্রভাবের মুখে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী প্রার্থী। ওয়ার্ড কমিশনার পদে একশ্রেণীর সন্ত্রাসী কেন্দ্র দখল এবং ব্যালট পেপারে সিল মারার প্রতিযোগিতা করে নির্বাচনটিকে প্রহসনে পরিণত করে। এ ক্ষেত্রেও তৎকালীন প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে নিরাপদ থাকে। ২০০০-এর ৩১ আগস্ট ঝালকাঠি-২ আসনে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে দাগি আসামি ও সন্ত্রাসীদের ব্যাপক তাণ্ডব-হাঙ্গামার কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী ইলেন ভুট্টোর এজেন্টরা ভোটকেন্দ্রে পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারেননি। এমনকি সন্ত্রাসীরা ইলেন ভুট্টোর কর্মী-সমর্থকদের বাড়িঘরের সামনে, পাড়া ও গ্রামের আশপাশে অবস্থান করে ভোটারদের বাড়ি থেকে বেরুতেও বাধা দেয়। এ বিষয়ে সাপ্তাহিক যায়যায়দিনসহ বহু পত্রপত্রিকার ঘটনাপ্রবাহের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
বর্তমান আওয়ামী সরকারের আমলেও ভোলা উপনির্বাচনে শাসক দল এবং ভীত-অনুগত প্রশাসনের অবিশ্বাস্য তাণ্ডবলীলা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। মেজর হাফিজের সমর্থক মহিলাকে তারা ধর্ষণ পর্যন্ত করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপনির্বাচনে প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা মানুষ দেখেছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ফলাফল ঘোষণা নিয়ে প্রশাসনের অহেতুক জটিলতা সৃষ্টি এবং আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থীর মারমুখী অসভ্য আচরণ জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে।
বিএনপি সরকারের আমলে এক মাগুরা উপনির্বাচন নিয়ে যদি লঙ্কাকাণ্ড হয়ে যেতে পারেÑ তাহলে প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সময়ের আওয়ামী লীগের আমলের নির্বাচনগুলো মানদণ্ডের কোন পর্যায়ে পড়ে? শুধু তাই নয়, বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি; যার ফর্মুলা জামায়াতের ল্যাবরেটরিতে আবিষ্কৃত এবং আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত কর্তৃক বাজারজাতকৃত। এই ফর্মুলা প্রয়োগের জন্য আইন প্রণয়নে জবরদস্তি দাবির আন্দোলনে ১৯৯৪-এর জুলাই থেকে ১৯৯৬ এর ২৫ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের সংঘর্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ নিহত ৬৫ জন, আহতের সংখ্যা কয়েক হাজার। একটানা এক সপ্তাহসহ ১৭৩ দিন হরতাল করা হয়। যার ফলে জীবননাশ, সম্পত্তি ধ্বংস, বিশৃঙ্খলাসহ চট্টগ্রাম বন্দর ও শিল্প-কলকারখানাসহ রাষ্ট্রীয় উৎপাদনব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ষষ্ঠ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হওয়ার পরও আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী জামায়াত-জাতীয় পার্টি তাদের পরোক্ষ ভায়োলেন্স বন্ধ করেনি। আজকের আওয়ামী সরকারের গুণধর মন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, সফিউর রহমানসহ কিছু আমলা এবং এরশাদ আমলের সুবিধাভোগী কর্মচারী নেতা সৈয়দ মহিউদ্দিনসহ কর্মচারীদের একটি গ্রুপ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে রাজপথে আন্দোলনকারীদের সাথে যোগ দেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ চেইন অব কমান্ড ভেঙে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশাসনিক বিভাজন সৃষ্টির জঘন্য উদাহরণও সৃষ্টি করা হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। আর বর্তমান সরকারের আমলে তো জনপ্রশাসন চেহারা পাল্টে দলীয় প্রশাসনে রূপ নিয়ে নিরপেক্ষতা এবং নৈতিকতা হারিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইন প্রয়োগে জনগণের জন্য অনির্ভরযোগ্য সিন্ডিকেটে পরিণত করেছে, যার সবচেয়ে বড় কলঙ্কিত অধ্যায় হচ্ছে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে বিশ্বাসযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা। যে রায় নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে, সবচেয়ে বড় বিতর্ক হচ্ছে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হওয়ায় তা সংবিধানের মৌলিক চেতনা গণতান্ত্রিক কাঠামোবিরোধী।’ কথাটি রায়ের নির্দেশনায় থাকার কারণে। অথচ জাতির ঘাড়ে আওয়ামী সরকার যে অনির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের চাপিয়ে দিলো, যে পৌর প্রশাসকদের নিয়োগ দিলো, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের শপথবিহীন মন্ত্রীর পদমর্যাদা দিলো কিংবা ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করে অনির্বাচিত প্রশাসকদের চড়িয়ে দিলো, সে ব্যাপারে আদালতের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত বরফশীতল। এ ক্ষেত্রে ১৯৯৫-৯৬ সালে সহিংস আন্দোলনকারীদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে যে বহুল কথিত বক্তব্যটি ‘সংবিধান জনগণের জন্য, জনগণের প্রয়োজনে সংবিধান, সংবিধানের জন্য জনগণ নয়’- এর যৌক্তিকতা তারা কোন কম্বলের নিচে চাপা দিলেন?
আমাদের মনে রাখতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা শুধু একটি আইনি বিষয়ই নয়, এটি একটি সামাজিক-রাজনৈতিক চুক্তিও বটে। শুধু আইন দিয়েই এটা ভাঙ্গা বা পরিবর্তন করা যাবে না। সামাজিক এবং রাজনৈতিক শান্তি বজায় রাখতে বাংলাদেশে এখন যে নির্বাচন প্রয়োজন তা শুধু নির্বাচন কমিশন দিয়ে সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন শতভাগ আন্তরিক হলে বর্তমান সরকারপ্রধানের এক সময়ের বহুল আলোচিত উক্তি সূক্ষ¥ কারচুপি হয়তো ঠেকানো সম্ভব; কিন্তু তার স্থূল কারচুপি ঠেকানো সম্ভব নয়। তাই অনিবার্য বাস্তবতা হচ্ছে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আওয়ামী লীগ প্রধানকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের কোনো বক্তব্য ছিল না। আরো একটি বিষয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, বাংলাদেশে বাকশাল প্রবর্তনের কুখ্যাত চতুর্থ সংশোধনীটি পাস হয়েছিলো ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫-এ। আবার পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা বর্তমান সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ২৫ জানুয়ারি ২০০৯-এ। বাকশাল পাস করে গণতন্ত্র হত্যার চতুর্থ সংশোধনীতে পক্ষে ভোট পড়েছিল ২৯২টিÑ আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পঞ্চদশ সংশোধনীতেও পক্ষে ভোট পড়েছে ২৯২টি। এখানে আবারো স্মরণ করতে হয় আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আবুল মনসুর আহমেদকে। তিনি বলেছেন, নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী নেতৃত্ব তাদের ক্ষমতাকালীন বৃত্তে অপজিশনের প্রতি যে মনোভাব অবলম্বন করে সেটা সাময়িক অবিবেচনাপ্রসূত ভুল নয়, বরং তারা নীতি হিসেবেই এই পন্থা গ্রহণ করে। অতএব সাধু সাবধান। সতর্ক জনগণ। কোনো অবস্থাতেই আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কিংবা তাদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থাকবে এমন প্রশাসনের অধীনে বিশ্বাসযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন হবেÑ এটা এ দেশের সাধারণ মানুষ মনেই করে না।
তাই বলতে চাইÑ আওয়ামী লীগের দাবি এবং আন্দোলনকালীন প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে জনমত জরিপের ফলাফল ছিল ৬৭ শতাংশ, বর্তমানে সেটা ৯০ শতাংশের বেশি। সুতরাং বৃহত্তর গণমানুষের দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। নির্লজ্জ ভাষায় ধারাবাহিক অশ্লীলতার উপাদান দিয়ে লিখিত ‘লজ্জা’ উপন্যাস! এর বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরীন যদি অজান্তে কৃত ছোট একটি ভুলের জন্য নেপালের মতো পরদেশের কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে পারেÑ সংশোধন করতে পারে নিজের কৃতকর্মÑ তাহলে স্বদেশবাসীর কাছে ভুল স্বীকার করে জাতীয় নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনে আওয়ামী লীগ কেন লজ্জা পাবে। তারা তো বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। আর প্রকৃতির নিয়মে তো বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথেই বাড়ে শুভবুদ্ধির পরিধি। দেশবাসীর সাথে আমিও অপেক্ষায় থাকলাম সেই শুভ বুদ্ধি উদয়ের। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন কিন্তু বলেছেন ‘প্রয়োজন আইনের তোয়াক্কা করে না’।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন