সুরঞ্জিত বাবুর মুখে ‘সুবহানাল্লাহ!’ আলোচনা বা মাথাব্যথা ঠিক তা নিয়ে নয়; সাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, স্বাধীনতার চেতনা ইত্যাদি ধরনের শব্দ বাংলাদেশে বহুমুখে বহুভাবে আলোচিত হওয়া সত্ত্বেও এর স্বরূপ যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে, সেটাই আজকের আলোচ্য।
সুরঞ্জিত বাবু ১৯৭২ সালে আওয়ামী নৌকায় ছিলেন না। প্রথমে ন্যাপ মুজাফফর, তারপর গণতন্ত্রী পার্টি নামে ওয়ানম্যান পার্টির সংসদ সদস্য এবং তৎকালে গণপরিষদে একমাত্র প্রতিবাদী কণ্ঠরূপেই বাংলদেশের রঙ্গমঞ্চে তার আবির্ভাব। আওয়ামী বিরোধী জাঁদরেল রাজনৈতিক নেতারা তখন অন্তরীণে বা অন্তরালে। তাদের জোগানো মালমসলাই বাগ্মিতার সাথে সংসদে উপস্থাপিত করে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছিলেন। পরে তার ঝিগাতলার বাড়িতে আওয়ামী বোমাও পড়েছিল। অনেক লেখালেখিও হয়েছিল। সংসদ চালু থাকলে সংসদে এটাই ছিল তার কাজ। ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জের দিরাই এলাকায় প্রচুর হিন্দু নাগরিকের বাস। মুসলিম কৃষক সন্তানদের মধ্যেও তেমন যোগ্য ও অর্থব্যয়ে সক্ষম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে তিনি বেশ ভাগ্যবানই বলতে হবে। যেখানে গাছপালা নেই, ঢেঁড়সগাছই সেখানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ‘বৃক্ষ’। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি আওয়ামী নৌকায় উঠে পড়লেন। কিন্তু সেখানেও দাঁড় বাওয়া বা গুণ টানা ছাড়া তেমন কিছুই করার ছিল না। আবদুস সামাদ আজাদের মতো নেতা ওই এলাকারই লোক হওয়ায় তার ভাগ্যের শিকে খোলার সম্ভাবনা ছিল না। ওয়ান-ইলেভেনের পর মাইনাস টু ফর্মুলায় কাজ করতে গিয়ে দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি কুখ্যাত র্যাটসের ‘এস’ হয়ে যাওয়ায় দলের কেন্দ্র থেকে তিনি আরো দূরে ছিটকে পড়লেন।
ওয়ান-ইলেভেনের সরকার আওয়ামী লগি-বৈঠার প্রকাশ্যে রাজপথে অর্ধডজন লোক হত্যার ফসল। তাই তাদের হাতেই এরা ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা করবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু কৌশলী নতুন মন্ত্রিসভায় নিজের নাম নেই দেখে আওয়ামী নৌকার পালের নিচ থেকেই চিৎকার করে বলে উঠলেনÑ ‘এ যে একেবারে কচিকাঁচার মেলা!’ র্যাটসের অন্য তিনজনও একই ভাগ্য বরণ করেছেন, কিন্তু তাদের কেউই এরূপ বিরূপ মন্তব্য করার প্রয়োজন বোধ করেননি। যা হোক, সুরঞ্জিত যখন দেখলেন এতেও কোনো কাজ হলো না, তখন তিনি নতুন বুলি আওড়ালেনÑ ‘হিন্দুদেরকে আর আওয়ামী লীগের রিজার্ভ ভোটবাক্স রূপে পাওয়া যাবে না।’ এ তীরটি লক্ষ্য ভেদ করল। নেত্রী নড়েচড়ে বসলেন এবং এক সন্ধ্যায় মন্ত্রিসভায় জীবনে প্রথমবারের মতো তার অন্তর্ভুক্তি ঘটল। র্যাটসের তৃতীয় মহাজনও আহ্বান পেলেন, কিন্তু এই অবেলায় মন্ত্রী হয়ে দুর্নামের ভাগী হতে অনীহা প্রকাশ করে তিনি ঠকে গেলেন! কিন্তু সুরঞ্জিত মন্ত্রী হয়ে কী করলেন? রেলমন্ত্রী হয়ে কালো বিড়াল খুঁজতে গিয়ে তিনি সেখানে নিজেকেই আবিষ্কার করলেন! গোটা জাতি ৭০ লাখ টাকার পূঁতিগন্ধময় আবর্জনার নিচে চাপা পড়া কালো বিড়ালের আর্তচিৎকার শোনার আগেই তিনি মন্ত্রিত্ব ছাড়লেন বা হারালেন! আবার কোনো অদৃশ্য জাদুর বলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তিনি দফতরবিহীন মন্ত্রী বা ‘উজিরে খামোখা’রূপে পুনর্বহালও হয়ে গেলেন! রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি মেনে পুনরায় শপথ নেয়ারও প্রয়োজন হয়নি! এটাই বুঝি খাঁটি গণতান্ত্রিক কায়দা! কচিকাঁচার মেলায় এতগুলো আনাড়ি আনকোরা অর্বাচীন থাকতে পারলে একজন প্রবীণ থাকলে আর কী-ই বা ক্ষতি। কাজ যা করার তা করবেন অনির্বাচিত উঁচু বেতনভাতাধারী উপদেষ্টারা! তাদের উপদেশ বা মন্ত্রণা যে কী মাজেজাপূর্ণ, এর যন্ত্রণা জাতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে! সুরঞ্জিত বাবুকে নিয়ে ভাটি এলাকায় নানা কথা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে প্রায় সবাই তাকে মুসলমানদের ওয়াকফ থেকে হিন্দুর দেবোত্তর সম্পত্তি পর্যন্ত সর্বত্র ‘শুঁটকির গুদামে বিড়াল প্রহরী’র মতোই দেখে। ইদানীং একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য তারই সুপারিশে বরাদ্দ করা ১০ কোটি টাকার মধ্য থেকে তিন কোটি টাকা তাকে দিতে রাজি না হওয়ায় বরাদ্দ বাতিলের চেষ্টার অভিযোগের সংবাদও দেশবাসীর নজরে এসেছে। পত্রপত্রিকায় অনেকবারই তিনি শিরোনাম হয়েছেন।
কালো বিড়াল পরিচিতির স্বল্পকালের মধ্যেই পিতৃবিয়োগের পর যত দিন একটি হিন্দু অনাথ বালককে অশুচি থাকতে হয়, একটি ঝাড়– বগলদাবা করে দুয়ারে দুয়ারে সাহায্য চেয়ে ঘুরতে হয়,তত দিনও না যেতেই তিনি আবার তার স্বভাবজাত রঙ্গরসের ভাষা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন এবং সে খেদমতটা দলের পক্ষে অকান্তভাবে আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
আইনের লোক (আইনবিষয়ক সংসদীয় কমিটির তিনিই সভাপতি) হয়ে ইদানীং বেআইনি, অগণতান্ত্রিক, চরম সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিয়ে গোটা জাতি তথা বিশ্ব মুসলিমের চেতনার তন্ত্রীতে আঘাত করলেন সুরঞ্জিত। যেকোনো মূল্যে আলোচনায় থাকার উদ্দেশ্যে বিচিত্র মুখভঙ্গি ও ভাঁড়ামি যার একমাত্র অবলম্বন, তার জন্য এটা স্বাভাবিক হতেও পারে। ইংরেজিতে এমন ক্ষেত্রেই বোধ হয় ‘ডেভিল নেসেসিটি’ শব্দযুগল ব্যবহার হয়ে থাকে। কুরআন তিলাওয়াতকালে আমরা মুসলমানেরা ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলে পরম করুণাময় আল্লাহর নাম নেয়ার আগেই আউজুবিল্লাহ পড়ে শায়তানির রাজিম বা বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর শরণ মেগে আল্লাহর পবিত্র বাণী অনুধাবনের জন্য মনকে প্রস্তুত করে নিই।
ইসলাম, মুসলমান, কুরআন, নবী করিম সা:কে নিয়ে পৃথিবীর যেকোনো এলাকায় কুমন্তব্য বিদ্বেষী সমালোচনা হলে এ দেশের মুসলমানেরাও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থাকেন। এ দেশকে ইসলামি চেতনাশূন্য করার একটা সুপরিকল্পিত কর্মসূচি নিয়েই যেন মহলবিশেষ অগ্রসর হচ্ছে। আর এ জন্য আওয়ামী শাসনের এ আমলটাকেই যেন তারা স্বর্ণযুগ বলে বেছে নিয়েছেন। কয়েক বছরে আমরা বেশ কয়েকটি এমন দুঃসংবাদ পত্রপত্রিকায় পড়েছি যে হিন্দু বা খ্রিষ্টান শিক্ষক তার মুসলমান ছাত্রীকে কেবল উত্ত্যক্তই নয় ধর্ষণও করেছে, দিনের পর দিন তা করে গেছে! পরিমল এবং এরূপ আরো ক’টি নাম আলোচনায় এসেছে। মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে অমুসলিম শিক্ষক কাসে ইসলাম ও নবী সা:-এ বিরুদ্ধে বিশ্রী ভাষায় কুৎসা রটাচ্ছেন! এরূপ ঘটনা এ আমলে বিস্তর। এগুলো কি নেহায়েত কাকতালীয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা, নাকি সুপরিকল্পিত; সে কথা গুরুত্বের সাথে ভাবার সময় এসেছে। এগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিরোধ না করার ফলেই সুরঞ্জিত বাবুর মতো একজন বয়স্ক পার্লামেন্টারিয়ান জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী, সর্বোপরি আইন ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিকেও এরূপ দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি করতে দেখা যাচ্ছে! চুপ করে থাকতে পারে না ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ।
১৮৩১ সালের ৬ মে পাঞ্জাবের বালাকোটের অজগাঁয়ে মওলানা সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও মওলানা ইসমাঈল শহীদসহ কয়েকশ’ আজাদি সংগ্রামী মুজাহিদ কাফেরদের হাতে আক্রান্ত ও শহীদ হয়ে শাহাদতের যে ইতিহাস রচনা করেছিলেন তার ঠিক ১৮২ বছর পর ২০১৩ সালের ৬ মে ভোরে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত দ্বিতীয় প্রধান মুসলিম রাষ্টের (এখন তা তৃতীয়) রাজধানী নগরীতে সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল! বালাকোটে হামলাকারীরা ছিল মূলত শিখ। সাথে ছিল কিছু ভাড়াটে খ্রিষ্টান সৈন্য। এখানে হামলাকারীরা ছিল মুসলিম পরিচয়ধারীÑ ঢাকা নগরীর থানাগুলোতে নিযুক্ত এক বিশেষ জেলাবাসী কিছু অমুসলিম ওসি-এসি সাথে বা পরিচালনায় থাকলেও সেনারা তো প্রায় সবাই মুসলিম! বালাকোটের হামলা হয়েছিল দিনদুপুরে। আক্রান্তরা ছিলেন ধর্মযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধসংক্রান্ত কম-বেশি প্রশিক্ষণ তাদের ছিলÑ যদিও যুদ্ধের প্রস্তুতি তখন তাদের ছিল না। তবে বাংলা-বিহার- আসাম-মধ্যভারত থেকে ওই মুক্তিযুদ্ধে শামিল সবাই ছিলেন যুবক ও প্রাপ্তবয়স্ক। এখানে যারা আক্রান্ত হলেন এদের কেউই যোদ্ধা বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন না। এদের বেশির ভাগই ছিলেন গ্রামগঞ্জ থেকে আসা সারা দিনের শ্রান্ত-কান্ত-অভুক্ত মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক। ঈমানের বলে বলীয়ান প্রতিবাদমুখর সাধারণ গণমানুষ এবং বয়সের ভারে ন্যুব্জ বৃদ্ধরাও ছিলেন। সারা বাংলাদেশ থেকে তারা সোনার বাংলার রাজধানীতে ছুটে এসেছিলেন আল্লাহ-রাসূল, কুরআন-কিতাব, ধর্ম ও প্রাণপ্রিয় নবীকে নিয়ে উপহাসকারী ও তাদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় প্রদানকারীদের প্রতিবাদ জানাতে। বালাকোটের শহীদেরা ছিলেন পরাধীন ভারতের বিদ্রোহী মুক্তিযোদ্ধা, ধর্মযোদ্ধা। প্রতিপক্ষ অমুসলিম-কাফের।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো পার্লামেন্টারিয়ানের উচিত ছিল অন্তত চক্ষুলজ্জার খাতিরে হলেও শাপলা চত্বরে সাধারণ নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর সশস্ত্র সরকারি বাহিনীর নৈশ বেপরোয়া হামলার নিন্দা করা এবং এর বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করা। তা না করে তিনি বললেনÑ ‘হেফাজতিরা মারের চোটে সুবহানাল্লাহ বলে পালালেন!’ এর মাসখানেক আগে তাদের দ্বিতীয় প্রধান কর্তা ‘সৈয়দ’ আশরাফ বলেছিলেনÑ ‘হেফাজতিরা লেঙ্গুড় গুটিয়ে চলে গেছেন।’ দু’জনের বক্তব্যে কী অপূর্ব মিল। দলনেত্রী ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা সুবহানাল্লাহ পাঠের তসবিহ ও হেজাব নিয়ে ভোট ও ক্ষমা ভিক্ষা করে ক্ষমতায় এলেন, অথচ তিনি দুর্গাপূজার বেদিতে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিলেনÑ ‘মা-দুর্গার কল্যাণে দেশে বিস্তর ফসল হয়েছে।’ তারই পার্শ্বচর ‘উজিরে খামোখা’ তাসবিহ তথা ‘সুবহানাল্লাহ’ নিয়ে এভাবে উপহাস করলেন। তিনি কি মনে করেন এ উপহাস করলে নেত্রী মোটেই ব্যথিত হবেন না? কাদের খুশি করার জন্য আমাদেরকে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও ঈমান-আকিদাকে বিসর্জন দিতে হবে? বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র্রে নেতা বলে গর্বকারী বঙ্গবন্ধু কি আমাদের এ ভূমিকা দেখলে খুশি হতেন?
সুরঞ্জিত বাবু ১৯৭২ সালে আওয়ামী নৌকায় ছিলেন না। প্রথমে ন্যাপ মুজাফফর, তারপর গণতন্ত্রী পার্টি নামে ওয়ানম্যান পার্টির সংসদ সদস্য এবং তৎকালে গণপরিষদে একমাত্র প্রতিবাদী কণ্ঠরূপেই বাংলদেশের রঙ্গমঞ্চে তার আবির্ভাব। আওয়ামী বিরোধী জাঁদরেল রাজনৈতিক নেতারা তখন অন্তরীণে বা অন্তরালে। তাদের জোগানো মালমসলাই বাগ্মিতার সাথে সংসদে উপস্থাপিত করে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছিলেন। পরে তার ঝিগাতলার বাড়িতে আওয়ামী বোমাও পড়েছিল। অনেক লেখালেখিও হয়েছিল। সংসদ চালু থাকলে সংসদে এটাই ছিল তার কাজ। ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জের দিরাই এলাকায় প্রচুর হিন্দু নাগরিকের বাস। মুসলিম কৃষক সন্তানদের মধ্যেও তেমন যোগ্য ও অর্থব্যয়ে সক্ষম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে তিনি বেশ ভাগ্যবানই বলতে হবে। যেখানে গাছপালা নেই, ঢেঁড়সগাছই সেখানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ‘বৃক্ষ’। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি আওয়ামী নৌকায় উঠে পড়লেন। কিন্তু সেখানেও দাঁড় বাওয়া বা গুণ টানা ছাড়া তেমন কিছুই করার ছিল না। আবদুস সামাদ আজাদের মতো নেতা ওই এলাকারই লোক হওয়ায় তার ভাগ্যের শিকে খোলার সম্ভাবনা ছিল না। ওয়ান-ইলেভেনের পর মাইনাস টু ফর্মুলায় কাজ করতে গিয়ে দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি কুখ্যাত র্যাটসের ‘এস’ হয়ে যাওয়ায় দলের কেন্দ্র থেকে তিনি আরো দূরে ছিটকে পড়লেন।
ওয়ান-ইলেভেনের সরকার আওয়ামী লগি-বৈঠার প্রকাশ্যে রাজপথে অর্ধডজন লোক হত্যার ফসল। তাই তাদের হাতেই এরা ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা করবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু কৌশলী নতুন মন্ত্রিসভায় নিজের নাম নেই দেখে আওয়ামী নৌকার পালের নিচ থেকেই চিৎকার করে বলে উঠলেনÑ ‘এ যে একেবারে কচিকাঁচার মেলা!’ র্যাটসের অন্য তিনজনও একই ভাগ্য বরণ করেছেন, কিন্তু তাদের কেউই এরূপ বিরূপ মন্তব্য করার প্রয়োজন বোধ করেননি। যা হোক, সুরঞ্জিত যখন দেখলেন এতেও কোনো কাজ হলো না, তখন তিনি নতুন বুলি আওড়ালেনÑ ‘হিন্দুদেরকে আর আওয়ামী লীগের রিজার্ভ ভোটবাক্স রূপে পাওয়া যাবে না।’ এ তীরটি লক্ষ্য ভেদ করল। নেত্রী নড়েচড়ে বসলেন এবং এক সন্ধ্যায় মন্ত্রিসভায় জীবনে প্রথমবারের মতো তার অন্তর্ভুক্তি ঘটল। র্যাটসের তৃতীয় মহাজনও আহ্বান পেলেন, কিন্তু এই অবেলায় মন্ত্রী হয়ে দুর্নামের ভাগী হতে অনীহা প্রকাশ করে তিনি ঠকে গেলেন! কিন্তু সুরঞ্জিত মন্ত্রী হয়ে কী করলেন? রেলমন্ত্রী হয়ে কালো বিড়াল খুঁজতে গিয়ে তিনি সেখানে নিজেকেই আবিষ্কার করলেন! গোটা জাতি ৭০ লাখ টাকার পূঁতিগন্ধময় আবর্জনার নিচে চাপা পড়া কালো বিড়ালের আর্তচিৎকার শোনার আগেই তিনি মন্ত্রিত্ব ছাড়লেন বা হারালেন! আবার কোনো অদৃশ্য জাদুর বলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তিনি দফতরবিহীন মন্ত্রী বা ‘উজিরে খামোখা’রূপে পুনর্বহালও হয়ে গেলেন! রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি মেনে পুনরায় শপথ নেয়ারও প্রয়োজন হয়নি! এটাই বুঝি খাঁটি গণতান্ত্রিক কায়দা! কচিকাঁচার মেলায় এতগুলো আনাড়ি আনকোরা অর্বাচীন থাকতে পারলে একজন প্রবীণ থাকলে আর কী-ই বা ক্ষতি। কাজ যা করার তা করবেন অনির্বাচিত উঁচু বেতনভাতাধারী উপদেষ্টারা! তাদের উপদেশ বা মন্ত্রণা যে কী মাজেজাপূর্ণ, এর যন্ত্রণা জাতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে! সুরঞ্জিত বাবুকে নিয়ে ভাটি এলাকায় নানা কথা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে প্রায় সবাই তাকে মুসলমানদের ওয়াকফ থেকে হিন্দুর দেবোত্তর সম্পত্তি পর্যন্ত সর্বত্র ‘শুঁটকির গুদামে বিড়াল প্রহরী’র মতোই দেখে। ইদানীং একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য তারই সুপারিশে বরাদ্দ করা ১০ কোটি টাকার মধ্য থেকে তিন কোটি টাকা তাকে দিতে রাজি না হওয়ায় বরাদ্দ বাতিলের চেষ্টার অভিযোগের সংবাদও দেশবাসীর নজরে এসেছে। পত্রপত্রিকায় অনেকবারই তিনি শিরোনাম হয়েছেন।
কালো বিড়াল পরিচিতির স্বল্পকালের মধ্যেই পিতৃবিয়োগের পর যত দিন একটি হিন্দু অনাথ বালককে অশুচি থাকতে হয়, একটি ঝাড়– বগলদাবা করে দুয়ারে দুয়ারে সাহায্য চেয়ে ঘুরতে হয়,তত দিনও না যেতেই তিনি আবার তার স্বভাবজাত রঙ্গরসের ভাষা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন এবং সে খেদমতটা দলের পক্ষে অকান্তভাবে আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
আইনের লোক (আইনবিষয়ক সংসদীয় কমিটির তিনিই সভাপতি) হয়ে ইদানীং বেআইনি, অগণতান্ত্রিক, চরম সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিয়ে গোটা জাতি তথা বিশ্ব মুসলিমের চেতনার তন্ত্রীতে আঘাত করলেন সুরঞ্জিত। যেকোনো মূল্যে আলোচনায় থাকার উদ্দেশ্যে বিচিত্র মুখভঙ্গি ও ভাঁড়ামি যার একমাত্র অবলম্বন, তার জন্য এটা স্বাভাবিক হতেও পারে। ইংরেজিতে এমন ক্ষেত্রেই বোধ হয় ‘ডেভিল নেসেসিটি’ শব্দযুগল ব্যবহার হয়ে থাকে। কুরআন তিলাওয়াতকালে আমরা মুসলমানেরা ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলে পরম করুণাময় আল্লাহর নাম নেয়ার আগেই আউজুবিল্লাহ পড়ে শায়তানির রাজিম বা বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর শরণ মেগে আল্লাহর পবিত্র বাণী অনুধাবনের জন্য মনকে প্রস্তুত করে নিই।
ইসলাম, মুসলমান, কুরআন, নবী করিম সা:কে নিয়ে পৃথিবীর যেকোনো এলাকায় কুমন্তব্য বিদ্বেষী সমালোচনা হলে এ দেশের মুসলমানেরাও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থাকেন। এ দেশকে ইসলামি চেতনাশূন্য করার একটা সুপরিকল্পিত কর্মসূচি নিয়েই যেন মহলবিশেষ অগ্রসর হচ্ছে। আর এ জন্য আওয়ামী শাসনের এ আমলটাকেই যেন তারা স্বর্ণযুগ বলে বেছে নিয়েছেন। কয়েক বছরে আমরা বেশ কয়েকটি এমন দুঃসংবাদ পত্রপত্রিকায় পড়েছি যে হিন্দু বা খ্রিষ্টান শিক্ষক তার মুসলমান ছাত্রীকে কেবল উত্ত্যক্তই নয় ধর্ষণও করেছে, দিনের পর দিন তা করে গেছে! পরিমল এবং এরূপ আরো ক’টি নাম আলোচনায় এসেছে। মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে অমুসলিম শিক্ষক কাসে ইসলাম ও নবী সা:-এ বিরুদ্ধে বিশ্রী ভাষায় কুৎসা রটাচ্ছেন! এরূপ ঘটনা এ আমলে বিস্তর। এগুলো কি নেহায়েত কাকতালীয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা, নাকি সুপরিকল্পিত; সে কথা গুরুত্বের সাথে ভাবার সময় এসেছে। এগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিরোধ না করার ফলেই সুরঞ্জিত বাবুর মতো একজন বয়স্ক পার্লামেন্টারিয়ান জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী, সর্বোপরি আইন ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিকেও এরূপ দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি করতে দেখা যাচ্ছে! চুপ করে থাকতে পারে না ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ।
১৮৩১ সালের ৬ মে পাঞ্জাবের বালাকোটের অজগাঁয়ে মওলানা সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও মওলানা ইসমাঈল শহীদসহ কয়েকশ’ আজাদি সংগ্রামী মুজাহিদ কাফেরদের হাতে আক্রান্ত ও শহীদ হয়ে শাহাদতের যে ইতিহাস রচনা করেছিলেন তার ঠিক ১৮২ বছর পর ২০১৩ সালের ৬ মে ভোরে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত দ্বিতীয় প্রধান মুসলিম রাষ্টের (এখন তা তৃতীয়) রাজধানী নগরীতে সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল! বালাকোটে হামলাকারীরা ছিল মূলত শিখ। সাথে ছিল কিছু ভাড়াটে খ্রিষ্টান সৈন্য। এখানে হামলাকারীরা ছিল মুসলিম পরিচয়ধারীÑ ঢাকা নগরীর থানাগুলোতে নিযুক্ত এক বিশেষ জেলাবাসী কিছু অমুসলিম ওসি-এসি সাথে বা পরিচালনায় থাকলেও সেনারা তো প্রায় সবাই মুসলিম! বালাকোটের হামলা হয়েছিল দিনদুপুরে। আক্রান্তরা ছিলেন ধর্মযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধসংক্রান্ত কম-বেশি প্রশিক্ষণ তাদের ছিলÑ যদিও যুদ্ধের প্রস্তুতি তখন তাদের ছিল না। তবে বাংলা-বিহার- আসাম-মধ্যভারত থেকে ওই মুক্তিযুদ্ধে শামিল সবাই ছিলেন যুবক ও প্রাপ্তবয়স্ক। এখানে যারা আক্রান্ত হলেন এদের কেউই যোদ্ধা বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন না। এদের বেশির ভাগই ছিলেন গ্রামগঞ্জ থেকে আসা সারা দিনের শ্রান্ত-কান্ত-অভুক্ত মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক। ঈমানের বলে বলীয়ান প্রতিবাদমুখর সাধারণ গণমানুষ এবং বয়সের ভারে ন্যুব্জ বৃদ্ধরাও ছিলেন। সারা বাংলাদেশ থেকে তারা সোনার বাংলার রাজধানীতে ছুটে এসেছিলেন আল্লাহ-রাসূল, কুরআন-কিতাব, ধর্ম ও প্রাণপ্রিয় নবীকে নিয়ে উপহাসকারী ও তাদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় প্রদানকারীদের প্রতিবাদ জানাতে। বালাকোটের শহীদেরা ছিলেন পরাধীন ভারতের বিদ্রোহী মুক্তিযোদ্ধা, ধর্মযোদ্ধা। প্রতিপক্ষ অমুসলিম-কাফের।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো পার্লামেন্টারিয়ানের উচিত ছিল অন্তত চক্ষুলজ্জার খাতিরে হলেও শাপলা চত্বরে সাধারণ নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর সশস্ত্র সরকারি বাহিনীর নৈশ বেপরোয়া হামলার নিন্দা করা এবং এর বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করা। তা না করে তিনি বললেনÑ ‘হেফাজতিরা মারের চোটে সুবহানাল্লাহ বলে পালালেন!’ এর মাসখানেক আগে তাদের দ্বিতীয় প্রধান কর্তা ‘সৈয়দ’ আশরাফ বলেছিলেনÑ ‘হেফাজতিরা লেঙ্গুড় গুটিয়ে চলে গেছেন।’ দু’জনের বক্তব্যে কী অপূর্ব মিল। দলনেত্রী ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা সুবহানাল্লাহ পাঠের তসবিহ ও হেজাব নিয়ে ভোট ও ক্ষমা ভিক্ষা করে ক্ষমতায় এলেন, অথচ তিনি দুর্গাপূজার বেদিতে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিলেনÑ ‘মা-দুর্গার কল্যাণে দেশে বিস্তর ফসল হয়েছে।’ তারই পার্শ্বচর ‘উজিরে খামোখা’ তাসবিহ তথা ‘সুবহানাল্লাহ’ নিয়ে এভাবে উপহাস করলেন। তিনি কি মনে করেন এ উপহাস করলে নেত্রী মোটেই ব্যথিত হবেন না? কাদের খুশি করার জন্য আমাদেরকে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও ঈমান-আকিদাকে বিসর্জন দিতে হবে? বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র্রে নেতা বলে গর্বকারী বঙ্গবন্ধু কি আমাদের এ ভূমিকা দেখলে খুশি হতেন?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন