‘পুলিশি রাষ্ট্র ও পুলিশি রাজত্ব’ এখন সর্বজনবিদিত
বাক্যাংশ। এ বাক্যাংশদ্বয় একাধারে ভয়ভীতি ছড়ায়, অপর দিকে ক্ষমতা ও লোভের
অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রকাশ ঘটায়। আভিধানিক অর্থ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুসারে
পুলিশি রাষ্ট্র হলো ‘এমন একটি দেশ যেখানে উৎপীড়ক সরকার গোপন বা প্রকাশ্য পুলিশ বাহিনী
দিয়ে জনগণের সব রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামাজিক অধিকার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং প্রচলিত বিচার ও
শাসনব্যবস্থা অকেজো থাকে।’ এক কথায় এক সর্বগ্রাসী শাসন
কায়েম হয় এবং তা পরিচালনা করে এক স্বেচ্ছাচারী কর্তৃত্বব্যঞ্জক ব্যক্তি বা দল।
অবশ্য ‘পুলিশি রাষ্ট্র’ অভিধাটি
সর্বপ্রথম ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে অস্ট্রিয়া ব্যবহার করে, যখন এই ইউরোপীয়
দেশটি সর্বপ্রথম জাতীয় পর্যায়ে একটি পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি করে। তার আগে
আইনশৃঙ্খলা পরিচালিত হতো স্থানীয়পর্যায়ে। এর ১৪ বছর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
নিউ ইংল্যান্ডে পুলিশ বাহিনী তৈরি হয়। যখন বিশ্বের সব দেশেই পুলিশ বাহিনীর
অভ্যুদয় ঘটল, তখন এর অর্থ ও ব্যবহারের তারতম্য হতে থাকল। কারণ ক্ষমতাসীনেরা তাদের
ক্ষমতা, সম্পদ ও বিশেষ সুবিধা এবং অধিকার ভোগের জন্য এই পুলিশ বাহিনীর ওপর ভর
করতে শুরু করে। আর এসব বাহিনী নানা নামে এবং ক্ষমতা নিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনের
অধিকারসহ সব অধিকার ছিনিয়ে নিতে থাকে। ফলে পুলিশ অভিধাটির সাথে ভালো যা কিছু
সম্পৃক্ত ছিল তা হারিয়ে যেতে থাকে। আর এই অসহনীয় অবস্থার তীব্রতা দেশটির রাজনৈতিক, সামাজিক ও
অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে প্রকাশ ঘটতে থাকে। প্রথম দিকে পশ্চাৎপদ
দেশগুলোতে এর তীব্রতা বেশি হলেও এখন রঙ ও ঢঙে এর আগ্রাসন সর্বগ্রাসী।
তাই পুলিশি রাষ্ট্র এখন দুই ভাগে বিভক্ত। উন্নত দেশ বলে পরিচিত
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে এমন অবস্থা হলে, তাকে ‘ইলেকট্রনিক পুলিশ স্টেট’ বা বৈদ্যুতিক পুলিশি রাষ্ট্র বলা হয়। বিশ্বে পুলিশি কেমন চিত্র এর ওপর সর্বপ্রথম ২০০৮
সালে এক মার্কিন বেসরকারি সংস্থা একটি সমীক্ষা চালায়। ক্রিপ্টোহিপ্পি (Crypohippie) নামে সংস্থাটি
দেশগুলোকে শ্রেণীভুক্ত করার জন্য ১৭টি প্রশ্ন করে এবং ইলেকট্রনিক ব্যবস্থার
ব্যবহারের পরিমাণ নির্ধারণ করে এই কর্মকাণ্ডটি পরপর তিনবার (২০০৮-১০) পরিচালনা
করে। তখন তারা বিশ্বের ৫২টি দেশকে ‘ইলেকট্রনিক পুলিশ স্টেট’ হিসেবে চিহ্নিত
করেছে। এদের সবাই শিল্পোন্নত বা কমিউনিস্ট দেশ। বিশ্বের অন্য দেশগুলোকে সাধারণ
পুলিশ স্টেট বলা হয়েছে। এক কথায় পুলিশ স্টেটের আন্তর্জাতিকীকরণ এখন সম্পূর্ণ
হয়েছে। এই দুই ধরনের পুলিশি রাষ্ট্রের মাঝে পার্থক্য হলো ইলেকট্রনিক পুলিশ
স্টেটের জনগণ অত্যন্ত নিবিড় নজরদারিতে থাকলেও তারা তার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি টের
পায় না বলেই চলে। তবে এই নজরদারির তথ্যাবলি আদালতে ব্যবহৃত হয় এবং জনগণের পক্ষে
তার প্রতিবিধান পাওয়া সম্ভব হয় না। অপর পক্ষে সাধারণ পুলিশ স্টেটে এই নজরদারি
প্রকাশ্য ও প্রত্যক্ষভাবে হয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শক্তির অপব্যবহার এবং
অতিব্যবহার করার ফলে পুলিশ স্টেট বলতে সাধারণত এসব দেশগুলোকেই বোঝায়। এ দেশগুলো
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তৃতীয় বিশ্বে। এ দেশগুলোতে প্রায়ই গণতন্ত্রের ছত্রচ্ছায়ায়
স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে।
ক্রিপ্টোহিপ্পির প্রথম সার্ভে হয় ২০০৮ সালে। সে বছরের প্রথম ১০টি
ইলেকট্রনিক পুলিশ স্টেট হলোÑ (১) চীন, (২) উত্তর কোরিয়া, (৩) বেলারুশ, (৪) রাশিয়া, (৫) ব্রিটেন, (৬) মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র, (৭) সিঙ্গাপুর, (৮) ইসরাইল, (৯) ফ্রান্স ও (১০) জার্মানি। এ ছাড়া মালয়েশিয়া ছিল ১১ নম্বরে, দক্ষিণ কোরিয়া ১৫
নম্বরে, জাপান ১৯ নম্বরে এবং ভারত ২৩ নম্বরে। এই লিস্টের সর্বশেষ দেশ হলো
ফিলিপাইনস ৫২ নম্বরে। বাংলাদেশ এই লিস্টে একেবারেই নেই।
ক্রিপ্টোহিপ্পি বলেছে, ১৭টি কর্মকাণ্ড যদি রাষ্ট্র
করে তাহলে তাকে ইলেকট্রনিক পুলিশ স্টেট বলা হবে। তা হলোÑ (১) ডেইলি ডকুমেন্ট। প্রতিদিন পরিচিতিপত্রসহ কী কী দলিল জনগণকে বহন
করতে হয়, (২) বর্ডারে কী দলিল সাথে নিতে হয় এবং তা ইলেকট্রনিক ব্যবস্থায়
নথিভুক্ত কি না, (৩) জনগণের অর্থনৈতিক বিষয়গুলো এ ব্যবস্থার নজরদারিতে কি না, (৪) সরকার এমন
নজরদারি করছে তা ভেতরের কেউ প্রকাশ করলে সে শাস্তি বা পক্ষপাতিত্বের সম্মুখীন হয়
কি না, (৫) এর বিরুদ্ধে সাংবিধানিক নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা আছে কি না, (৬) রাষ্ট্র
জনগণের তথ্য কতটুকু খোঁজ করে এবং তা সংরক্ষণ করে ও কতটুকু প্রকাশ করে, (৭) কী তথ্য
রাষ্ট্র খুঁজে বেড়ায়, (৮) আইএসপির তথ্য রক্ষণের পদ্ধতি, (৯) মোবাইল ফোনের রেকর্ডের
ব্যবহার, (১০) স্বাস্থ্য রেকর্ডের সংরক্ষণ হয় কি না, (১১) রাষ্ট্র তথ্য
সংগ্রহে কী পদ্ধতি এবং শক্তির ব্যবহার করে? (১২) হেবিয়াস কর্পাসের অবস্থা, (১৩) পুলিশ ও
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রকাশ্য ও গোপন যোগাযোগ আছে কি না এবং সাংবিধানিকভাবে
প্রতিরোধের ব্যবস্থা আছে কি না, (১৪) পুলিশ চাওয়ামাত্রই কোর্ট কি ওয়ারেন্ট জারি করেন, (১৫) রাষ্ট্র কি গোপনে
জনগণের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে, (১৬) ক্রিপ্টোগ্রাফির ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে কি, (১৭) রাষ্ট্র কি
ইচ্ছেমতো যাকে ইচ্ছে তাকে অন্তরীণ করতে পারে। যেমন সরকারি সংস্থা গোপনে
প্রতিবাদীদের অপহরণ, গুম ও খুন করে কি না? ক্রিপ্টোহিপ্পি ১৭০টি
রাষ্ট্রের ওপর এ সমীক্ষা চালিয়ে দেখতে পায় ৫২টি দেশ জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য
ইলেকট্রনের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে। এর শেষ বছরের সমীক্ষায় (২০১০) দেখা যায়, মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া চার নম্বরে উঠে এসেছে এবং তৃতীয় বিশ্বের স্বৈরাচারী
গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই ইলেকট্রনিক ব্যবহার দ্রুত প্রসার ঘটছে। বাংলাদেশ অনেক
পেছনে ছিল প্রথম সমীক্ষায়। তবে তৃতীয় সমীক্ষায় বেশ এগিয়ে এসেছে। আর প্রথম
দশটির মাঝে ভীষণ প্রতিযোগিতা চলছে ওপরের সারিতে ওঠার জন্য।
পুলিশ স্টেটে পুলিশের এবং সেনাসদস্যের সংখ্যা বেশি হওয়ার কথা। এ
নিয়ে খোদ জাতিসঙ্ঘও অনুসন্ধান চালিয়েছে। এসব দেশে সরকারি হিসাবে কত কয়েদি আছে
তারও বার্ষিক সমীক্ষা জাতিসঙ্ঘ করে থাকে। এর অন্যতম কারণ হলো সরকারের জনগণের
অধিকার এবং স্বাধীনতা খর্বকরণের তদারকিতে এই পুলিশ বাহিনীর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
আর এ জন্য কয়েদখানার জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ে। জাতিসঙ্ঘসহ মানবকল্যাণে নিয়োজিত
সংস্থাগুলো এ হিসাব নিয়ে বলতে পারে দেশটির সরকার পুলিশ রাষ্ট্র হতে কত দূরে।
জাতিসঙ্ঘের হিসাব উল্লেখ করে ডগলাস কার্পেন্টার এক নিবন্ধে বিশ্বের ১৫৫
দেশের জেলে ২০১১ সালে কত কয়েদি ছিল তার হিসাব দিয়েছেন। এ লিস্টে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র সর্বাগ্রে। প্রথম ১৫টি দেশের নাম হলোÑ (১) মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র ২১৮৬২৩০, (২) চীন ১৫৪৮৪৯৮, (৩) রাশিয়া ৮৬৯৮১৪ (৪) ভারত ৩৩২১১২ (৫) মেক্সিকো ২১৪৪৫০, (৬) ইউক্রেন ১৬৫৭১৬, (৭) থাইল্যান্ড ১৬৪৪৪৩, (৮) দক্ষিণ
আফ্রিকা ১৫৭৪০২, (৯) ইরান ১৪৭৯২৬, (১০) ইন্দোনেশিয়া ৯৯৯৪৬, (১১) ফিলিপাইন ৮৯৬৩৯, (১২) পাকিস্তান ৮৯৩৭০, (১৩) ব্রিটেন ৮৮৪৫৮, (১৪) ভিয়েতনাম ৮৮৪১৪
ও (১৫) জাপান ৭৯০৫৫।
তবে মজার ব্যাপার হলো জনসংখ্যা এবং কয়েদিদের অনুপাতে প্রথম পাঁচটি
দেশ হলোÑ (১) যুক্তরাষ্ট্র, (২) রাশিয়া, (৩) সেন্ট কিটস
অ্যান্ড নেভিস, (৪) তুর্কমেনিস্তান ও (৫) কিউবা। এ হিসাব প্রতি এক লাখ জনগণের কতজন
জেলে। সেই হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ৭৩৮ জনের একজন জেলে। তেমনি রাশিয়ার ৬১১, সেন্ট কিটসের ৫৪৭
জন, তুর্কমেনিস্তানের ৪৮৯ জন ও কিউবার ৪৮৭ জন। কয়েদির সংখ্যায় চীন
দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও জনসংখ্যার অনুপাতে কয়েদিদের সংখ্যা অনুসারে এর স্থান ৮৭তম।
তেমনি ভারত ১৫১তম স্থানে। এ দিক দিয়ে বাংলাদেশের ৭১২০০ কয়েদি জেলে থাকায় সে বছর
(২০১১) এর স্থান ছিল ১৪৩তমে।
জেলখানাগুলোর কী অবস্থা? জাতিসঙ্ঘের অপরাধের ধারার ওপর ২০০২
সালে প্রকাশিত অষ্টম সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সে বছর যুক্তরাষ্ট্রের ১৫৫৮ জেলে
ছিল ২০১৯২৩৪ কয়েদি, মেক্সিকোর ৪৪৮ জেলে ছিল ১৭২৮৮৮ কয়েদি। আসলে ডগলাস বলেছেন, এ চিত্রটি
একেবারেই অসম্পূর্ণ। কারণ জাতিসঙ্ঘের হিসাবে অনেক তথ্য বিলম্বে আসে। আর পুলিশি
রাষ্ট্রে জেলে আনাগোনা এত দ্রুত যে কোনো একটি হিসাব অন্যটির সাথে মিলবে না। এ ছাড়া
তৃতীয় বিশ্বের জেলের অবস্থা ও পরিচালনা অত্যন্ত ভয়াবহ।
পুলিশ স্টেটের চিহ্ন কী? ড. ইউল পটার তার ‘গ্রিন ইজ দ্য নিউ রেড’ প্রবন্ধে (সেপ্টেম্বর ২০১২) সাতটি চিহ্নের কথা উল্লেখ করেছেন। এর
প্রকাশ পেলেই বুঝতে হবে রাষ্ট্রটি পুলিশি স্টেটে পরিণত হয়েছে। চিহ্নগুলো হলোÑ (১) প্রতিবাদী বা বিরোধীদের গৃহে বা কর্মস্থলে ইচ্ছেমতো হানা দেয়া ও
হয়রানি করা হলে, (২) পুলিশ বাহিনীকে নিত্যনতুন অস্ত্রে সজ্জিত করা হলে যেমন পুলিশদের
মিলিটারি ট্রেনিং ও অস্ত্রপাতি দেয়া হলে, (৩) বিরোধীদের রাজনৈতিক
কর্মকাণ্ডের জন্য অসঙ্গতিপূর্ণ শাস্তি দেয়া হলে, (৪) প্রতিপক্ষকে শুধু শাস্তি
দেয়ার জন্য আইন তৈরি করলে, বিশেষ করে যদি তা ধর্মীয় বা এমন বিশ্বাসীদের সম্পর্কে হয়, (৫) প্রতিপক্ষ ও
বিরোধীদের জন্য বিশেষ কয়েদখানা সৃষ্টি বা নির্ধারণ করা হলে, (৬) প্রতিপক্ষের
কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে বিশেষ বাহিনী তৈরি অথবা প্রচলিত
বাহিনীগুলোকে বিশেষভাবে ব্যবহার করলে, (৭) কোনো ধর্মীয় দল বা
মতাদর্শী বা প্রচারকদের মতো এবং কর্মকাণ্ডকে অপরাধমূলক কাজ ঘোষণা করে তাদের ব্যাপক
ধরপাকড় করলে। ড. পটার বলেছেন, এসব কর্মকাণ্ড কমবেশি সব দেশেই হচ্ছে। এর ফলে জনগণের গণতান্ত্রিক ও
মানবাধিকার ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। পশ্চিম ও কমিউনিস্ট দেশগুলো
ইলেকট্রনিক তদারকির মাঝ দিয়ে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থকেই শুধু এগিয়ে নেয়।
তবে যে পুলিশ স্টেটগুলো ইলেকট্রনিক তদারকিতে অগ্রসর নয়, সাধারণ মানুষের
কাছে সেগুলোই পুলিশি রাষ্ট্র বলে পরিচিত। এর অন্যতম কারণ এ দেশগুলো এক দিকে
পরাশক্তির লেজুড়বৃত্তি করে বলে আইনের তোয়াক্কা করে না। আবার ক্ষমতাবানেরা বেশির
ভাগ ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের ছত্রচ্ছায়ায় নাজি পদ্ধতি ও নীতির বাস্তবায়ন করে থাকে। হিটলারের নাজি
পুলিশ স্টেটের একটিই নীতি ছিল। তা হলোÑ ‘যা করতে বলা হবে তাই করো নতুবা তার জন্য মূল্য দাও। রাষ্ট্রের
পরিচালকেরা যেভাবে চালাচ্ছে সে সম্পর্কে কোনো কথা না বলো, তোমার কোনো ক্ষতি
হবে না। যদি শুধু ভাবো অথবা সন্দেহ করো, তার জন্যও হয়তো মূল্য দিতে
হতে পারে।’ ১৯৩৩ সালের ভোটে জার্মানির এক
কোটি ৭০ লাখ লোক হিটলারকে ভোট দেয়নি। সিক্রেট পুলিশ, গেস্টাপো ও
হিটলারের কর্মী দল এদের চরম হয়রানি ও অত্যাচারের মাঝে রাখে।
চার দিকের কর্মকাণ্ডের সাথে এই নাজি পদ্ধতির এখন এত মিল দেখতে পাওয়া
যায়। যেমন এ পদ্ধতিতে যে কাউকে গ্রেফতার করলে মাত্র তিন মিনিট সময় দেয়া হতো
জিনিসপত্র নেয়ার জন্য। আবার এমন আইন তৈরি করা হলো যার ভিত্তিতে কেউ বা কোনো দল বা
গোষ্ঠী কোনো ঘটনা ঘটাতে পারে এই আশঙ্কাকে কেন্দ্র করেই তাদের গ্রেফতার বা অত্যাচার
করা যাবে। এদেরকে ডি-১১ ফরমে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হতো। এখানে স্বীকারোক্তি
থাকত যে, তার নিরাপত্তার জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর যখন ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ সৃষ্টি হলো, সেখানে কোনো আইনের সহায়তা ছিল না। নিয়ম ছিল গ্রেফতার করে নিয়ে
গিয়ে প্রথমেই ২৫টি বেত মারা হতো। এর পরের অত্যাচার ছিল আরো ভয়াবহ। কখনোই কেউ
কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পায়নি। কারণ এর ভয়াবহতার চিত্র যেন কেউ না
জানে। জার্মানির পরাজয়ের পরই এ ঘটনা জানা গেছে। জার্মানির এই পদ্ধতি পরে রিমান্ড, এনকাউন্টার
ইত্যাদিতে পরিণত হয়।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক নিল এম রিচার্ডস
ইলেকট্রনিক তদারকির অত্যন্ত নিন্দা করে সিএনএনকে বলেছেন, ‘এটা খারাপ নীতি। এবং এটা কাজ করে না। হাজার হাজার ক্যামেরার মাঝেও
সন্ত্রাস হচ্ছে। সন্ত্রাসের আসল কারণ খুঁজে বের করতে হবে। বরং এসব কর্মকাণ্ড
সরকারকে অন্যায় করার সুযোগ দিয়ে থাকে।’
এক আলোচনায় ইকোনমিস্ট পত্রিকা ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্সে লিখেছে, উন্নত ১০ পশ্চিমা
দেশের গণতান্ত্রিক সূচক ভীষণভাবে পড়ে গেছে। এর মাঝে আছে ইউএস, রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি, বেলজিয়াম ইত্যাদি।
এসব দেশে প্রথমে ‘ওয়ার অন ড্রাগস’ এবং বর্তমানের ‘ওয়ার অন টেরর’ মাঝ দিয়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে নাগরিক অধিকার সীমিত করে
ক্রমেই পুলিশ স্টেটের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আসলে জেমস করবেট তার ‘বয়লিংফ্রগপোস্ট’ ব্লগে বলেছেন, ইলেকট্রনিক পুলিশ স্টেট যত বেশি সংখ্যায় বাড়বে মাল্টিন্যাশনাল
কোম্পানিগুলোর তত মুনাফা। তারা হাজার ধরনের তথ্য সংরক্ষণের (ডাটাবেজ) প্রযুক্তি
নির্মাণ করে ব্যবসায় বাড়াচ্ছে। তবে আসল নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই থাকছে। এ বিষয়ের
ওপর একজন বিশেষজ্ঞ হচ্ছেন অ্যান্ডুু গেভিন মার্শাল। তিনি বলেছেন, একমাত্র আইবিএমই ‘স্মার্ট পাবলিক সেফটি’র নামে কোটি কোটি ডলারের
তদারকি প্রযুক্তি বিক্রয় করেছে। এ জন্যই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো পুলিশি
স্টেটের প্রধান প্রবক্তা।
এ দিকে এসব প্রযুক্তি ক্ষমতাবানদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। সে জন্য
তথাকথিত ডিজিটাল ব্যবস্থার এত প্রচার, মার্শাল বলেছেন। গেভিন
মার্শালের মতে, আসলে ‘পুলিশ স্টেট ইন্টারন্যাশনালের’ জন্ম হয়েছে এবং
এটা বিশ্বকে এক কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণের দিকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
তিনি একটি উদাহরণ দিয়েছেন। ২০০৪
সালে ইউএস ভিজিট প্রোগ্রাম শুরু করে। এতে যাত্রীদের ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ছবি
সংরক্ষণের ব্যবস্থা চালু হয়। এখন এটা বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা। গত ২০১০ সালে জাতীয়
পরিচয়পত্র ব্যবস্থার সূত্রপাত করা হলেও এখন বিশ্বব্যাপী হয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশ
তারা তাদের নাগরিকদের পরিচয়পত্র আদান-প্রদান করছে। একে নাম দিয়েছে আইসিএও ৯৩০৩।
এর মাধ্যমে এসব দেশের যেকোনো নাগরিকের সমস্ত তথ্য অন্য দেশে এক কিকেই পাওয়া
যাচ্ছে। ফলে ইউএসএ’র মতো দেশগুলো বিদেশীদের সব তথ্য এক কিকেই জানতে পারছে।
মার্শাল বলেছেন, এসবের মূলে হলো শক্তিশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সব নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত
করা। স্বাধীনতা, অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলো ক্রমেই গৌণ হয়ে পড়ছে। তাই মার্শাল বলেছেনÑ স্বাধীনতা চাইলে, অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবাইকে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে।
নতুবা এই অধীনতার শৃঙ্খল ভাঙা সহজ হবে না। সর্বগ্রাসী পুলিশি রাজত্বের থাবা
প্রতিনিয়তই কঠিনতর হবে। তৃতীয় বিশ্বের জনগণকে সইতে হবে প্রথম থাবার ধাক্কা। এর
মাঝে তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই নাগরিক অধিকার, মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো
গৌণ হয়ে পড়েছে। আর তা সংরক্ষণে সংবিধান বা বিচারব্যবস্থা কোনোটাই সাহায্যে আসছে
না।
তাই পুলিশি রাষ্ট্র এখন দুই ভাগে বিভক্ত। উন্নত দেশ বলে পরিচিত
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে এমন অবস্থা হলে, তাকে ‘ইলেকট্রনিক পুলিশ স্টেট’ বা বৈদ্যুতিক পুলিশি রাষ্ট্র বলা হয়। বিশ্বে পুলিশি কেমন চিত্র এর ওপর সর্বপ্রথম ২০০৮
সালে এক মার্কিন বেসরকারি সংস্থা একটি সমীক্ষা চালায়। ক্রিপ্টোহিপ্পি (Crypohippie) নামে সংস্থাটি
দেশগুলোকে শ্রেণীভুক্ত করার জন্য ১৭টি প্রশ্ন করে এবং ইলেকট্রনিক ব্যবস্থার
ব্যবহারের পরিমাণ নির্ধারণ করে এই কর্মকাণ্ডটি পরপর তিনবার (২০০৮-১০) পরিচালনা
করে। তখন তারা বিশ্বের ৫২টি দেশকে ‘ইলেকট্রনিক পুলিশ স্টেট’ হিসেবে চিহ্নিত
করেছে। এদের সবাই শিল্পোন্নত বা কমিউনিস্ট দেশ। বিশ্বের অন্য দেশগুলোকে সাধারণ
পুলিশ স্টেট বলা হয়েছে। এক কথায় পুলিশ স্টেটের আন্তর্জাতিকীকরণ এখন সম্পূর্ণ
হয়েছে। এই দুই ধরনের পুলিশি রাষ্ট্রের মাঝে পার্থক্য হলো ইলেকট্রনিক পুলিশ
স্টেটের জনগণ অত্যন্ত নিবিড় নজরদারিতে থাকলেও তারা তার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি টের
পায় না বলেই চলে। তবে এই নজরদারির তথ্যাবলি আদালতে ব্যবহৃত হয় এবং জনগণের পক্ষে
তার প্রতিবিধান পাওয়া সম্ভব হয় না। অপর পক্ষে সাধারণ পুলিশ স্টেটে এই নজরদারি
প্রকাশ্য ও প্রত্যক্ষভাবে হয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শক্তির অপব্যবহার এবং
অতিব্যবহার করার ফলে পুলিশ স্টেট বলতে সাধারণত এসব দেশগুলোকেই বোঝায়। এ দেশগুলো
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তৃতীয় বিশ্বে। এ দেশগুলোতে প্রায়ই গণতন্ত্রের ছত্রচ্ছায়ায়
স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে।
ক্রিপ্টোহিপ্পির প্রথম সার্ভে হয় ২০০৮ সালে। সে বছরের প্রথম ১০টি
ইলেকট্রনিক পুলিশ স্টেট হলোÑ (১) চীন, (২) উত্তর কোরিয়া, (৩) বেলারুশ, (৪) রাশিয়া, (৫) ব্রিটেন, (৬) মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র, (৭) সিঙ্গাপুর, (৮) ইসরাইল, (৯) ফ্রান্স ও (১০) জার্মানি। এ ছাড়া মালয়েশিয়া ছিল ১১ নম্বরে, দক্ষিণ কোরিয়া ১৫
নম্বরে, জাপান ১৯ নম্বরে এবং ভারত ২৩ নম্বরে। এই লিস্টের সর্বশেষ দেশ হলো
ফিলিপাইনস ৫২ নম্বরে। বাংলাদেশ এই লিস্টে একেবারেই নেই।
ক্রিপ্টোহিপ্পি বলেছে, ১৭টি কর্মকাণ্ড যদি রাষ্ট্র
করে তাহলে তাকে ইলেকট্রনিক পুলিশ স্টেট বলা হবে। তা হলোÑ (১) ডেইলি ডকুমেন্ট। প্রতিদিন পরিচিতিপত্রসহ কী কী দলিল জনগণকে বহন
করতে হয়, (২) বর্ডারে কী দলিল সাথে নিতে হয় এবং তা ইলেকট্রনিক ব্যবস্থায়
নথিভুক্ত কি না, (৩) জনগণের অর্থনৈতিক বিষয়গুলো এ ব্যবস্থার নজরদারিতে কি না, (৪) সরকার এমন
নজরদারি করছে তা ভেতরের কেউ প্রকাশ করলে সে শাস্তি বা পক্ষপাতিত্বের সম্মুখীন হয়
কি না, (৫) এর বিরুদ্ধে সাংবিধানিক নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা আছে কি না, (৬) রাষ্ট্র
জনগণের তথ্য কতটুকু খোঁজ করে এবং তা সংরক্ষণ করে ও কতটুকু প্রকাশ করে, (৭) কী তথ্য
রাষ্ট্র খুঁজে বেড়ায়, (৮) আইএসপির তথ্য রক্ষণের পদ্ধতি, (৯) মোবাইল ফোনের রেকর্ডের
ব্যবহার, (১০) স্বাস্থ্য রেকর্ডের সংরক্ষণ হয় কি না, (১১) রাষ্ট্র তথ্য
সংগ্রহে কী পদ্ধতি এবং শক্তির ব্যবহার করে? (১২) হেবিয়াস কর্পাসের অবস্থা, (১৩) পুলিশ ও
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রকাশ্য ও গোপন যোগাযোগ আছে কি না এবং সাংবিধানিকভাবে
প্রতিরোধের ব্যবস্থা আছে কি না, (১৪) পুলিশ চাওয়ামাত্রই কোর্ট কি ওয়ারেন্ট জারি করেন, (১৫) রাষ্ট্র কি গোপনে
জনগণের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে, (১৬) ক্রিপ্টোগ্রাফির ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে কি, (১৭) রাষ্ট্র কি
ইচ্ছেমতো যাকে ইচ্ছে তাকে অন্তরীণ করতে পারে। যেমন সরকারি সংস্থা গোপনে
প্রতিবাদীদের অপহরণ, গুম ও খুন করে কি না? ক্রিপ্টোহিপ্পি ১৭০টি
রাষ্ট্রের ওপর এ সমীক্ষা চালিয়ে দেখতে পায় ৫২টি দেশ জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য
ইলেকট্রনের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে। এর শেষ বছরের সমীক্ষায় (২০১০) দেখা যায়, মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া চার নম্বরে উঠে এসেছে এবং তৃতীয় বিশ্বের স্বৈরাচারী
গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই ইলেকট্রনিক ব্যবহার দ্রুত প্রসার ঘটছে। বাংলাদেশ অনেক
পেছনে ছিল প্রথম সমীক্ষায়। তবে তৃতীয় সমীক্ষায় বেশ এগিয়ে এসেছে। আর প্রথম
দশটির মাঝে ভীষণ প্রতিযোগিতা চলছে ওপরের সারিতে ওঠার জন্য।
পুলিশ স্টেটে পুলিশের এবং সেনাসদস্যের সংখ্যা বেশি হওয়ার কথা। এ
নিয়ে খোদ জাতিসঙ্ঘও অনুসন্ধান চালিয়েছে। এসব দেশে সরকারি হিসাবে কত কয়েদি আছে
তারও বার্ষিক সমীক্ষা জাতিসঙ্ঘ করে থাকে। এর অন্যতম কারণ হলো সরকারের জনগণের
অধিকার এবং স্বাধীনতা খর্বকরণের তদারকিতে এই পুলিশ বাহিনীর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
আর এ জন্য কয়েদখানার জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ে। জাতিসঙ্ঘসহ মানবকল্যাণে নিয়োজিত
সংস্থাগুলো এ হিসাব নিয়ে বলতে পারে দেশটির সরকার পুলিশ রাষ্ট্র হতে কত দূরে।
জাতিসঙ্ঘের হিসাব উল্লেখ করে ডগলাস কার্পেন্টার এক নিবন্ধে বিশ্বের ১৫৫
দেশের জেলে ২০১১ সালে কত কয়েদি ছিল তার হিসাব দিয়েছেন। এ লিস্টে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র সর্বাগ্রে। প্রথম ১৫টি দেশের নাম হলোÑ (১) মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র ২১৮৬২৩০, (২) চীন ১৫৪৮৪৯৮, (৩) রাশিয়া ৮৬৯৮১৪ (৪) ভারত ৩৩২১১২ (৫) মেক্সিকো ২১৪৪৫০, (৬) ইউক্রেন ১৬৫৭১৬, (৭) থাইল্যান্ড ১৬৪৪৪৩, (৮) দক্ষিণ
আফ্রিকা ১৫৭৪০২, (৯) ইরান ১৪৭৯২৬, (১০) ইন্দোনেশিয়া ৯৯৯৪৬, (১১) ফিলিপাইন ৮৯৬৩৯, (১২) পাকিস্তান ৮৯৩৭০, (১৩) ব্রিটেন ৮৮৪৫৮, (১৪) ভিয়েতনাম ৮৮৪১৪
ও (১৫) জাপান ৭৯০৫৫।
তবে মজার ব্যাপার হলো জনসংখ্যা এবং কয়েদিদের অনুপাতে প্রথম পাঁচটি
দেশ হলোÑ (১) যুক্তরাষ্ট্র, (২) রাশিয়া, (৩) সেন্ট কিটস
অ্যান্ড নেভিস, (৪) তুর্কমেনিস্তান ও (৫) কিউবা। এ হিসাব প্রতি এক লাখ জনগণের কতজন
জেলে। সেই হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ৭৩৮ জনের একজন জেলে। তেমনি রাশিয়ার ৬১১, সেন্ট কিটসের ৫৪৭
জন, তুর্কমেনিস্তানের ৪৮৯ জন ও কিউবার ৪৮৭ জন। কয়েদির সংখ্যায় চীন
দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও জনসংখ্যার অনুপাতে কয়েদিদের সংখ্যা অনুসারে এর স্থান ৮৭তম।
তেমনি ভারত ১৫১তম স্থানে। এ দিক দিয়ে বাংলাদেশের ৭১২০০ কয়েদি জেলে থাকায় সে বছর
(২০১১) এর স্থান ছিল ১৪৩তমে।
জেলখানাগুলোর কী অবস্থা? জাতিসঙ্ঘের অপরাধের ধারার ওপর ২০০২
সালে প্রকাশিত অষ্টম সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সে বছর যুক্তরাষ্ট্রের ১৫৫৮ জেলে
ছিল ২০১৯২৩৪ কয়েদি, মেক্সিকোর ৪৪৮ জেলে ছিল ১৭২৮৮৮ কয়েদি। আসলে ডগলাস বলেছেন, এ চিত্রটি
একেবারেই অসম্পূর্ণ। কারণ জাতিসঙ্ঘের হিসাবে অনেক তথ্য বিলম্বে আসে। আর পুলিশি
রাষ্ট্রে জেলে আনাগোনা এত দ্রুত যে কোনো একটি হিসাব অন্যটির সাথে মিলবে না। এ ছাড়া
তৃতীয় বিশ্বের জেলের অবস্থা ও পরিচালনা অত্যন্ত ভয়াবহ।
পুলিশ স্টেটের চিহ্ন কী? ড. ইউল পটার তার ‘গ্রিন ইজ দ্য নিউ রেড’ প্রবন্ধে (সেপ্টেম্বর ২০১২) সাতটি চিহ্নের কথা উল্লেখ করেছেন। এর
প্রকাশ পেলেই বুঝতে হবে রাষ্ট্রটি পুলিশি স্টেটে পরিণত হয়েছে। চিহ্নগুলো হলোÑ (১) প্রতিবাদী বা বিরোধীদের গৃহে বা কর্মস্থলে ইচ্ছেমতো হানা দেয়া ও
হয়রানি করা হলে, (২) পুলিশ বাহিনীকে নিত্যনতুন অস্ত্রে সজ্জিত করা হলে যেমন পুলিশদের
মিলিটারি ট্রেনিং ও অস্ত্রপাতি দেয়া হলে, (৩) বিরোধীদের রাজনৈতিক
কর্মকাণ্ডের জন্য অসঙ্গতিপূর্ণ শাস্তি দেয়া হলে, (৪) প্রতিপক্ষকে শুধু শাস্তি
দেয়ার জন্য আইন তৈরি করলে, বিশেষ করে যদি তা ধর্মীয় বা এমন বিশ্বাসীদের সম্পর্কে হয়, (৫) প্রতিপক্ষ ও
বিরোধীদের জন্য বিশেষ কয়েদখানা সৃষ্টি বা নির্ধারণ করা হলে, (৬) প্রতিপক্ষের
কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে বিশেষ বাহিনী তৈরি অথবা প্রচলিত
বাহিনীগুলোকে বিশেষভাবে ব্যবহার করলে, (৭) কোনো ধর্মীয় দল বা
মতাদর্শী বা প্রচারকদের মতো এবং কর্মকাণ্ডকে অপরাধমূলক কাজ ঘোষণা করে তাদের ব্যাপক
ধরপাকড় করলে। ড. পটার বলেছেন, এসব কর্মকাণ্ড কমবেশি সব দেশেই হচ্ছে। এর ফলে জনগণের গণতান্ত্রিক ও
মানবাধিকার ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। পশ্চিম ও কমিউনিস্ট দেশগুলো
ইলেকট্রনিক তদারকির মাঝ দিয়ে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থকেই শুধু এগিয়ে নেয়।
তবে যে পুলিশ স্টেটগুলো ইলেকট্রনিক তদারকিতে অগ্রসর নয়, সাধারণ মানুষের
কাছে সেগুলোই পুলিশি রাষ্ট্র বলে পরিচিত। এর অন্যতম কারণ এ দেশগুলো এক দিকে
পরাশক্তির লেজুড়বৃত্তি করে বলে আইনের তোয়াক্কা করে না। আবার ক্ষমতাবানেরা বেশির
ভাগ ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের ছত্রচ্ছায়ায় নাজি পদ্ধতি ও নীতির বাস্তবায়ন করে থাকে। হিটলারের নাজি
পুলিশ স্টেটের একটিই নীতি ছিল। তা হলোÑ ‘যা করতে বলা হবে তাই করো নতুবা তার জন্য মূল্য দাও। রাষ্ট্রের
পরিচালকেরা যেভাবে চালাচ্ছে সে সম্পর্কে কোনো কথা না বলো, তোমার কোনো ক্ষতি
হবে না। যদি শুধু ভাবো অথবা সন্দেহ করো, তার জন্যও হয়তো মূল্য দিতে
হতে পারে।’ ১৯৩৩ সালের ভোটে জার্মানির এক
কোটি ৭০ লাখ লোক হিটলারকে ভোট দেয়নি। সিক্রেট পুলিশ, গেস্টাপো ও
হিটলারের কর্মী দল এদের চরম হয়রানি ও অত্যাচারের মাঝে রাখে।
চার দিকের কর্মকাণ্ডের সাথে এই নাজি পদ্ধতির এখন এত মিল দেখতে পাওয়া
যায়। যেমন এ পদ্ধতিতে যে কাউকে গ্রেফতার করলে মাত্র তিন মিনিট সময় দেয়া হতো
জিনিসপত্র নেয়ার জন্য। আবার এমন আইন তৈরি করা হলো যার ভিত্তিতে কেউ বা কোনো দল বা
গোষ্ঠী কোনো ঘটনা ঘটাতে পারে এই আশঙ্কাকে কেন্দ্র করেই তাদের গ্রেফতার বা অত্যাচার
করা যাবে। এদেরকে ডি-১১ ফরমে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হতো। এখানে স্বীকারোক্তি
থাকত যে, তার নিরাপত্তার জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর যখন ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ সৃষ্টি হলো, সেখানে কোনো আইনের সহায়তা ছিল না। নিয়ম ছিল গ্রেফতার করে নিয়ে
গিয়ে প্রথমেই ২৫টি বেত মারা হতো। এর পরের অত্যাচার ছিল আরো ভয়াবহ। কখনোই কেউ
কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পায়নি। কারণ এর ভয়াবহতার চিত্র যেন কেউ না
জানে। জার্মানির পরাজয়ের পরই এ ঘটনা জানা গেছে। জার্মানির এই পদ্ধতি পরে রিমান্ড, এনকাউন্টার
ইত্যাদিতে পরিণত হয়।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক নিল এম রিচার্ডস
ইলেকট্রনিক তদারকির অত্যন্ত নিন্দা করে সিএনএনকে বলেছেন, ‘এটা খারাপ নীতি। এবং এটা কাজ করে না। হাজার হাজার ক্যামেরার মাঝেও
সন্ত্রাস হচ্ছে। সন্ত্রাসের আসল কারণ খুঁজে বের করতে হবে। বরং এসব কর্মকাণ্ড
সরকারকে অন্যায় করার সুযোগ দিয়ে থাকে।’
এক আলোচনায় ইকোনমিস্ট পত্রিকা ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্সে লিখেছে, উন্নত ১০ পশ্চিমা
দেশের গণতান্ত্রিক সূচক ভীষণভাবে পড়ে গেছে। এর মাঝে আছে ইউএস, রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি, বেলজিয়াম ইত্যাদি।
এসব দেশে প্রথমে ‘ওয়ার অন ড্রাগস’ এবং বর্তমানের ‘ওয়ার অন টেরর’ মাঝ দিয়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে নাগরিক অধিকার সীমিত করে
ক্রমেই পুলিশ স্টেটের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আসলে জেমস করবেট তার ‘বয়লিংফ্রগপোস্ট’ ব্লগে বলেছেন, ইলেকট্রনিক পুলিশ স্টেট যত বেশি সংখ্যায় বাড়বে মাল্টিন্যাশনাল
কোম্পানিগুলোর তত মুনাফা। তারা হাজার ধরনের তথ্য সংরক্ষণের (ডাটাবেজ) প্রযুক্তি
নির্মাণ করে ব্যবসায় বাড়াচ্ছে। তবে আসল নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই থাকছে। এ বিষয়ের
ওপর একজন বিশেষজ্ঞ হচ্ছেন অ্যান্ডুু গেভিন মার্শাল। তিনি বলেছেন, একমাত্র আইবিএমই ‘স্মার্ট পাবলিক সেফটি’র নামে কোটি কোটি ডলারের
তদারকি প্রযুক্তি বিক্রয় করেছে। এ জন্যই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো পুলিশি
স্টেটের প্রধান প্রবক্তা।
এ দিকে এসব প্রযুক্তি ক্ষমতাবানদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। সে জন্য
তথাকথিত ডিজিটাল ব্যবস্থার এত প্রচার, মার্শাল বলেছেন। গেভিন
মার্শালের মতে, আসলে ‘পুলিশ স্টেট ইন্টারন্যাশনালের’ জন্ম হয়েছে এবং
এটা বিশ্বকে এক কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণের দিকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
তিনি একটি উদাহরণ দিয়েছেন। ২০০৪
সালে ইউএস ভিজিট প্রোগ্রাম শুরু করে। এতে যাত্রীদের ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ছবি
সংরক্ষণের ব্যবস্থা চালু হয়। এখন এটা বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা। গত ২০১০ সালে জাতীয়
পরিচয়পত্র ব্যবস্থার সূত্রপাত করা হলেও এখন বিশ্বব্যাপী হয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশ
তারা তাদের নাগরিকদের পরিচয়পত্র আদান-প্রদান করছে। একে নাম দিয়েছে আইসিএও ৯৩০৩।
এর মাধ্যমে এসব দেশের যেকোনো নাগরিকের সমস্ত তথ্য অন্য দেশে এক কিকেই পাওয়া
যাচ্ছে। ফলে ইউএসএ’র মতো দেশগুলো বিদেশীদের সব তথ্য এক কিকেই জানতে পারছে।
মার্শাল বলেছেন, এসবের মূলে হলো শক্তিশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সব নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত
করা। স্বাধীনতা, অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলো ক্রমেই গৌণ হয়ে পড়ছে। তাই মার্শাল বলেছেনÑ স্বাধীনতা চাইলে, অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবাইকে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে।
নতুবা এই অধীনতার শৃঙ্খল ভাঙা সহজ হবে না। সর্বগ্রাসী পুলিশি রাজত্বের থাবা
প্রতিনিয়তই কঠিনতর হবে। তৃতীয় বিশ্বের জনগণকে সইতে হবে প্রথম থাবার ধাক্কা। এর
মাঝে তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই নাগরিক অধিকার, মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো
গৌণ হয়ে পড়েছে। আর তা সংরক্ষণে সংবিধান বা বিচারব্যবস্থা কোনোটাই সাহায্যে আসছে
না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন