বাংলাদেশের মতো গরীব একটি দেশেও প্রথম থেকেই লক্ষ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করে রীতিমতো চমক সৃষ্টি করেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার বিশাল এক বাজেট পেশ করেছেন তিনি। সংসদে শুধু নয়, পরদিন অন্য দুই সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনেও যথেষ্টই শুনিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সেখানে নিজের পেশ করা বাজেট প্রস্তাবের পক্ষে সাফাই-ই কেবল গাননি, এমন আরো কিছু কথাও বলেছেন যেগুলো সমালোচনার ঝড় তুলেছে। এর বাস্তবায়ন করা অন্তত বর্তমান সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেক কারণের মধ্যে তারা বিশেষভাবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও ঠিকাদার নামধারীদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। উদাহরণ দিতে গিয়ে একটি প্রধান বিষয় হিসেবে এডিপি বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির কথা বলেছেন। এই খাতে ৭২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা এবং এডিপি বহির্ভূত প্রকল্পের জন্য তিন হাজার ১৫ কোটি ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য খাতে এক হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। বলা হচ্ছে, এসব বরাদ্দের প্রধান উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগের নির্বাচনী তহবিল স্ফীত করা। বিগত অর্থবছরগুলোতে দেখা গেছে, অবকাঠামো ও পল্লী উন্নয়নের জন্য নানা নামে নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পের হাজার হাজার কোটি টাকার বেশিরভাগই নানাভাবে দলীয় লোকজনের পকেটে ঢুকেছে। সারা বছর বসে থাকার পর সংসদে বাজেট পেশ হওয়ার প্রাক্কালে এসে হঠাৎ তারা তৎপর হয়ে ওঠে এবং প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে দেখিয়ে মে মাসেই চাল, গমসহ বরাদ্দকৃত অর্থ তুলে নেয়। বলা বাহুল্য, সব কাজেরই ঠিকাদারি পেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন।
খাত ধরে ধরে আলোচনা করলে সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য প্রকাশিত হয়ে পড়বে। উদাহরণ হিসেবে আয়করের দিকে লক্ষ্য করা যেতে পারে। বাজেটে রাজস্ব খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লক্ষ ৬৭ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। চাকরি ও ব্যবসাসহ আয় না থাকলেও অর্থমন্ত্রী সধারণ মানুষের জন্য ন্যূনতম আয়কর ধরেছেন তিন হাজার টাকা। তিনি এমনকি নারী ও প্রতিবন্ধীদেরও রেহাই দেননি। বছরে দুই লাখ ২০ হাজার টাকার বেশি আয় করলেই একজন মানুষকে আয়কর দিতে হবে। শুনলে মনে হতে পারে যেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্যের পথ ধরে মানুষের আয় এত বেশি বেড়ে গেছে যে, তারা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আয়কর হিসেবে দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে! ওদিকে যে শেয়ার বাজার থেকে এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি লুণ্ঠন করা হয়েছে সে শেয়ার বাজারের জন্য প্রণোদনার নামে অর্থমন্ত্রী বরাদ্দ রেখেছেন মাত্র নয়শ কোটি টাকা। অথচ এরই মধ্যে বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রণোদনার যেসব পদক্ষেপ তারা নিয়েছেন সেগুলোর কোনোটিই কিন্তু সুফলপ্রসূ হতে পারেনি। একই কারণে এক লাখ কোটি টাকার স্থলে নয়শ কোটি টাকার বরাদ্দকে মাত্রই বলা হচ্ছে। কারণ, শেয়ারবাজারের ধসে দেশে নগদ অর্থের তীব্র সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল। পাশাপাশি সরকার বিপুল ঋণ নেয়ায় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ পাননি বললেই চলে। ফলে নতুন বিনিয়োগ হয়নি, অনেকের পুরনো ব্যবসাও লাটে ওঠার অবস্থা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের রফতানি খাত। মাত্র সেদিনের এই ধ্বংসাত্মক অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এবারও কোনো সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারেননি অর্থমন্ত্রী। ব্যাংকিং খাত থেকে ২৫ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার ঘোষণা দিয়ে অর্থমন্ত্রী বরং শিল্পায়ন ও নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনাকে শুরুতেই নস্যাৎ করেছেন। এর সঙ্গে যদি ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকার ঘাটতির কথা উল্লেখ করা যায় তাহলে দেখা যাবে, এই বাজেট কোনোদিক থেকেই সফল্যের মুখ দেখবে না। এই না পারার প্রকৃত কারণ হলো, বাজেটের উদ্দেশ্য সমৃদ্ধি বা জনতুষ্টি অর্জন নয়, জনগণের স্বার্থ দেখাও নয়, নানা চটকদার কথার আড়ালে নিজেদের পকেট এবং দলের নির্বাচনী তহবিল স্ফীত করার লক্ষ্য নিয়েই এবারের বাজেট তৈরি করেছেন অর্থমন্ত্রী।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন