বৃহস্পতিবার, ২০ জুন, ২০১৩

সিটি নির্বাচনে পরিবর্তিত রাজনীতির দৃশ্যপট


চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির পর দেশের রাজনীতি যেমন বদলে গেছে, তেমনি বদলে গেছে সরকার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মনোভাব। বিশেষ করে, সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের বরাতে জানা যায়, নয়াদিল্লির বাংলাদেশ নীতিতে নাটকীয় পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেছে। তিস্তা বা স্থলসীমান্ত চুক্তি রূপায়ণে ভারতের অপারগতাকেও জনরোষের কারণ বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়। বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির একটি মহল নিজেদের অপারগতার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের আচরণকেও দোষারোপ করছেন নির্বাচনী পরাজয়ের জন্য। নয়াদিল্লি এ অভিযোগ নাকচ করে বলেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির খাত কোন দিকে বইবে, তা ভারতের বিদেশনীতির ওপর নির্ভর করে না। ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক কেন্দ্র সাউথ ব্লকের পরামর্শ, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর নামমাত্র বা বিনা সুদে যে বিপুল ঋণ এবং অনুদান বাংলাদেশ সরকারকে দেয়া হয়েছিল তার সদ্ব্যবহার করা হোক। সে দেশের পরিকাঠামো ক্ষেত্রের হাল তা হলে অনেকটাই বদলে যাবে। অর্থাৎ ভারত বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতির ফায়দাই বেশি লুটতে চায়।
ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিটি নির্বাচনে ভরাডুবির পর বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়ে গেছে। চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর বাংলাদেশে ক্ষমতায় পরিবর্তন আসছে কি না এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে পত্রিকাটি। পত্রিকাটি বলছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি সে দেশের রাজনীতিতে একটি বড় প্রশ্নœ তুলে দিল। এ বার কি তা হলে বাংলাদেশেও পরিবর্তন? এতে বলা হয়েছে, পরিকাঠামো উন্নয়ন দুরবস্থা, গোটা বাংলাদেশ জুড়ে চলছে প্রবল বিদ্যুৎ সমস্যা। বিএনপি’র পক্ষ থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সরাসরি হাসিনার পরিবার এবং তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের দিকে। শুধু বিরোধীরাই নন, খোদ বিশ্বব্যাঙ্ক এই দুর্নীতি নিয়ে  তাদের  ওয়েবসাইটে একটি রিপোর্ট পেশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০১১ এবং ২০১২ পরপর দু’বছর দু’বার বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিয়ে এই দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করার অনুরোধ জানানো হয়। চুক্তি বাতিল না করে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হাসিনা সরকারকে অনুরোধও করা হয়। কিন্তু সরকার কিছুই করেনি। আনন্দবাজার লিখেছে, সাম্প্রতিক ভোট ফলাফলের পর  আওয়ামী লীগের দাবি, বিরোধীদের সাম্প্রদায়িক প্রচারের মোকাবিলা ঐক্যবদ্ধভাবে করা যায়নি বলেই এই হার।
অন্যদিকে বিএনপি শিবিরের বক্তব্য, সরকারের ‘অপশাসনের’ বিরুদ্ধে এটি জনতার রায়। এই অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ বা চাপানউতোরের মধ্যেই মনে করা হচ্ছে, সাড়ে চার বছর ক্ষমতায় থাকার পর হাসিনা সরকারের জনপ্রিয়তা ক্রমশ তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। দুর্নীতি থেকে অপশাসন, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি থেকে মূল্য বৃদ্ধি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে  শুধু বিরোধীরাই যে স্বর চড়িয়েছেন তা নয়, দেশের মধ্যে সার্বিক জনরোষও তৈরি হয়েছে। পত্রিকাটি লিখেছে, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশাল এই চারটি শহরেই মুখ থুবড়ে পড়ার পর হাসিনা সরকারের সামনে অগ্নিপরীক্ষা, ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণভাবে ভোটের নির্ধারিত সময় এসে যাওয়া সত্ত্বেও এই দু’টি নির্বাচন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। নীরব বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনও।
প্রধান বিরোধী পক্ষ বিএনপি -জামায়াতে ইসলামী জোটের অভিযোগ, এই অবস্থায় ঢাকা সিটি করপোরেশনে ভোট করতে ভয় পাচ্ছে আওয়ামী লীগ। কারণ রাজধানীর করপোরেশন হাতছাড়া হলে, তার প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়তে পারে। এতে বলা হয়েছে, চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে হারার পর গতকাল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বক্তব্য, ‘কট্টরপন্থীদের’ বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করা যায়নি। বিরোধীরা যে সাম্প্রদায়িক প্রচার করেছে, তার মোকাবিলাও ঠিক মতো করা যায়নি। তাদের আশা, যে দুর্বলতাগুলো সামনে চলে এসেছে সেগুলো সাধারণ নির্বাচনে মুছে ফেলা সম্ভব হবে। অন্য দিকে বিএনপি’র বক্তব্য, ওই ফল আওয়ামী লীগের দুর্নীতি, দলবাজি এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের রায়। তাদের বিশ্বাস, নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন হলে বিএনপি জোটই ক্ষমতায় আসবে। আনন্দবাজার লিখেছে, সরকারের সমালোচকদের কথায় পায়ের তলা থেকে মাটি আলগা হয়ে আসছে বুঝেই মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদের আবেগকে সামনে নিয়ে এসে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন আওয়ামী নেতারা। একাত্তরের ঘাতকদের ফাঁসির দাবিকে কেন্দ্র করে শাহবাগের উত্তাল আন্দোলনও যে দেশের মূল সমস্যাগুলো থেকে মানুষের মনকে সরিয়ে রাখতে পারেনি, চার শহরের নির্বাচনের ফলই প্রমাণ।
এই অবস্থায় ভোটের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে রাজি নন শেখ হাসিনা। তার কথায়, ২০০১-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ক্ষমতা দখল করে গেড়ে বসেছিল, তার পরে আর কোনও অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় বসানো যায় না। আমেরিকা বা ভারতের মতো ধারাবাহিক গণতন্ত্রের দেশেও শাসক দলকে ক্ষমতায় রেখেই নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও তাই হবে। অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় নির্বাচন হবে। এ দিনও সংসদে হাসিনা বলেন, “এ বার বসলে ওরা আর নামবে না।”
অন্য দিকে বিএনপি’র অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে ক্ষমতায় থাকতে চাইছে। বিএনপি তা হতে দেবে না। নির্বাচনের জন্য তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবিতে অনড়। এই পরিস্থিতিতে দেশবাসীর একটাই প্রার্থনা, বরফ গলাতে দু’পক্ষ আলোচনায় বসুক। কিন্তু বাংলাদেশে সরকার ও বিরোধী পক্ষের আলোচনায় বসা এতটাই দুর্লভ ঘটনা, যে সহসা তা হওয়ার আশা কেউই করছেন না।
ভারতীয় পত্রিকার উপরোক্ত বিশ্লেষণের পর দেশটির মনোভাব বুঝতে অসুবিধা হয় না। নয়াদিল্লী বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলকে যে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, সেটা স্পষ্ট। এমন কি, সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হওয়ায় হারের মধ্যেও হাতে অস্ত্র পেয়েছে আওয়ামী লীগ, সেটাও কেউ বিশ্বাস করছে না। আওয়ামী লীগ বলেছে, নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে সুষ্ঠু এবং পক্ষপাতহীন ভোট যে সম্ভব, এটাই তার প্রমাণ। কিন্তু বিরোধী দল বলেছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক বিষয় নয়। পর্যবেক্ষক মহল ও রাজনীতির বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সিটি নির্বাচনের সবগুলোতেই ব্যাপক ভরাডুবির পর দেশে-বিদেশে আওয়ামী লীগ ইমেজ ও বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কটে পতিত হবে। তাদের সহযোগী ও মিত্ররাও আস্থা হারাবে। এই অবস্থায় গণরায় মেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়া এবং বিরোধীদের দমন-পীড়ন, নির্যাতন, হামলা-মামলার বদলে কাছে টেনে নেয়াই হবে আওয়ামী লীগের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ। নইলে সিটি নির্বাচন যে সঙ্কেত দিয়ে গেলো, সেটার পথ ধরে বাংলাদেশের সামনের  রাজনীতি আরও পরিবর্তিত হয়ে যাবে, যা আওয়ামী লীগের জন্য একই রকম ভরাডুবি ডেকে আনবে।
প্রসঙ্গত বলা ভালো, সিটি নির্বাচনে বিজয় বিএনপি-জামায়াত জোটকে প্রবলভাবে চাঙ্গা করেছে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে বিজয়ের জন্য বিরোধীরা মুখিয়ে আছে। প্রেসিডেন্টের আসনে (কিশোরগঞ্জ-৪) উপ-নির্বাচনও হবে ৩ জুলাই। সেখানে প্রেসিডেন্টপুত্র বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েই গিয়েছিলেন। কিন্তু বিদ্রোহী প্রার্থী প্রবল বেগে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় সেখানেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছে। নির্বাচনের প্রাথমিক হাওয়াও ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতি বড়ই চমকপ্রদ হয়। এখানে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় থেকে নানা খেলা দেখায়। কারচুপির ও ক্যুও এই খেলা বাংলাদেশে নতুন নয়। বাংলাদেশের মানুষ এই খেলা আর দেখতে চায় না। আর এজন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য দাবি করছে। এই দাবি গণদাবি এবং যৌক্তিক দাবি। এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে পুরো জাতি। সরকারের সাহস ও সদিচ্ছা থাকলে এই দাবি মানতে আপত্তি কেন? এটাই সন্দেহের সৃষ্টি করছে। তা হলে সরকার কি চায়Ñএমন প্রশ্নও উঠছে। সরকারকে গণদাবির প্রতি এবং সিটি নির্বাচনের গণরায়ের প্রতি আরও মনোযোগী হতে হবে। জনগণের দাবি ও আকাক্সক্ষাকে বুঝতে ও মূল্য দিতে হবে। তুচ্ছ ব্যক্তিদের কথার ফাঁদে আটকে গেলে সরকারের আরও ভরাডুবি হবে। শাহবাগ নামক ‘ফেতনা’ সরকারের জন্য ক্ষতির মাত্রাই যে বাড়াবে, আশা করি সেটা বুঝার মতো সময় এসে গেছে। ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন ও আলেম সমাজকে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, জঙ্গি, যুদ্ধাপরাধী বলার ফলও যে বুমেরাং হয়েছে, ক্ষমতার রাজনীতিকে বদলে দিচ্ছে, সেটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। মানুষ সবই দেখতে পারবে। বিশ্বও দেখছে। শুধু দেখতে পারছে না ক্ষমতার রঙিন চশমা পরা চোখ। সামনে তাদের চশমার কাঁচ খান খান হয়ে গেলে বাস্তব চিত্র তারাও ঠিকই দেখতে পারবে। কিন্তু তখন করার মতো সময়, শক্তি ও সামর্থ্য তাদের থাকবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads