পাকিস্তানে কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল পঞ্চদশ পার্লামেন্ট
নির্বাচন। এতে সর্বাধিক আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে অতীতে দু’বার ক্ষমতাসীন পাকিস্তান
মুসলিম লিগ (নওয়াজ) অনেক ব্যবধানে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সদ্য বিগত সরকারে
নেতৃত্ব দেয়া পিপলস পার্টি। ‘জাতীয় পরিষদ’ নামের পার্লামেন্ট নির্বাচনে
কোনো দল এবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারেনি। তবে বৃহত্তম দল হিসেবে মুসলিম লিগ
স্বতন্ত্র ১৮ সদস্যের সমর্থন নিয়ে সহজেই সরকার গঠন করছে। গতকাল শনিবার ছিল
নবনির্বাচিত পার্লামেন্টের উদ্বোধন অধিবেশন শুরু হওয়ার দিন। আগামীকাল সোমবার
স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন হবে। পরদিনই অনুমোদিত হবে প্রধানমন্ত্রী পদের
মনোনয়ন। নওয়াজ শরিফ যে সমস্যাসঙ্কুল দেশটির সরকারপ্রধান হতে যাচ্ছেন, তা নিশ্চিত।
অবশ্য ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তেহরিক-ই ইনসাফ দল এ পদে প্রার্থী মনোনীত করেছে মখদুম
জাবেদ হাশমিকে। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হাজার
খান খোসো বিদায় নেবেন। পিপলস পার্টি আর ক্ষমতায় না থাকলেও দলটির সাবেক সভাপতি (এখনো
কার্যত মূল নেতা) ও বেনজিরের স্বামী আসিফ আলী জারদারি সংবিধানমাফিক আরো বেশ
কিছুদিন প্রেসিডেন্ট পদে থাকবেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন, পাকিস্তানের
রাষ্ট্রপ্রধানের কাজ ও দায়িত্ব বাংলাদেশের মতো শুধু রাষ্ট্রদূতের পরিচয়পত্র
গ্রহণ এবং ‘মিলাদ মাহফিল ও কবর জিয়ারতে’ সীমাবদ্ধ নয়।
পাকিস্তানের এবারের নির্বাচন সবিশেষ স্মরণীয় কয়েকটি বড় কারণেÑ (১) একটি নির্বাচিত সরকার সংবিধান নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ করতে
পেরেছে। এর আগে পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনো দল বা সরকার এই সুযোগ (আসলে, অধিকার) পায়নি
উর্দিধারী ও ‘হোয়াইট কলার’ আমলাদের চক্রান্তে। (২) অতীতে
পার্লামেন্টের সব নির্বাচন বিদ্যমান দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছিল। এবার সর্বপ্রথম
কেয়ারটেকারের পরিচালনায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিছু দিন আগে পাক
সরকার কেয়ারটেকার সিস্টেম প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রশংসা করেছিল। (৩) নির্বাচনে ৬০ শতাংশ
ভোটদাতা অংশ নিয়েছেন, যা পাকিস্তানের মতো সহিংসতাপূর্ণ এবং গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ
দেশে প্রত্যাশার অধিক। এমনকি জঙ্গি ও ড্রোন হামলায় বিপর্যস্ত ফেডারেল সরকার শাসিত
এলাকার (ফাটা) উপজাতীয় বাসিন্দারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ভোট দিতে গেছেন। সেখানে
পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রথমবারের মতো একাধিক নারী করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা। (৪) পাকিস্তানেও
বাংলাদেশ, ভারত, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো মূলত দু’টি বড় দলের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে থাকে এবং এগুলোর বড়
নেতানেত্রী নির্বাচনী অঙ্গনে প্রাধান্য বজায় রেখে আসছেন। এবার পাকিস্তানে দুই
দলের মধ্যে বিগত ক্ষমতাসীন পিপিপি ভূমিসাৎ হওয়ার পাশাপাশি তৃতীয় একটি দল জাতীয়
রাজনীতিতে পিপিপির প্রায় সমপর্যায়ে উঠে এসেছে। এটি হলো সাবেক বিশ্বক্রিকেট তারকা
ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ বা পিটিআই। রাজনৈতিক সমীকরণে শেষ পর্যন্ত
পিপিপির এক নেতা ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ হয়েছেন
পার্লামেন্টে। তবে নির্বাচনী ফলাফল, আন্দোলনের প্রকৃতি, নেতৃত্বের
বক্তব্যÑ এসব বিবেচনায় মানুষের ধারণা, ইমরানের দলটিই
ময়দানে প্রধান বিরোধী দলের অবস্থানে থাকার সম্ভাবনাময়। (৫) পাকিস্তানে আগে কোনো
ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করেনি, যা ঘটেছে এবার
পিপলস পার্টির ক্ষেত্রে। দু’বার সরকারে নেতৃত্বদানকারী এই দল গ্রাম ও শহর, শিক্ষিত-অশিক্ষিত
নির্বিশেষে সমর্থনপুষ্ট শক্তিশালী একটি জাতীয়ভিত্তিক সংগঠন। তবুও দুর্নীতি, দলীয়করণ, ক্ষমতার
অপব্যবহার, সুশাসনে ব্যর্থতা আর মার্কিন বহিঃশক্তির তাঁবেদারির দরুন জনগণের
ব্যালট অস্ত্রের দ্বারা পিপিপি ঘায়েল হয়েছে। (৬) এবার জিতে নওয়াজ শরিফ
তৃতীয়বারের মতো কেন্দ্রীয় সরকার গঠন, তথা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার
সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। পাকিস্তানের ৬৬ বছরের ইতিহাসে এটা প্রথম ঘটতে যাচ্ছে।
বেনজির ভুট্টো দু’বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
২০০৮ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভুট্টোর পিপলস পার্টি (পিপিপি) সর্বাধিক
আসন পায় এবং মুহাজির অধ্যুষিত মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) দলকে সাথে
নিয়ে সরকার গঠন করে। এর আগে ২০০৭ সালের শেষলগ্নে রাওয়ালপিন্ডিতে নির্বাচনী
জনসভায় ভয়াবহ হামলায় পিপিপি নেত্রী বেনজির ভুট্টো নিহত হন। দলের নেতৃত্বে আসেন
তার স্বামী এবং দুর্নীতিবাজ হিসেবে সমালোচিত আসিফ আলী জারদারি। নির্বাচনে বিজয়ের
পর প্রধানমন্ত্রী হলেন পিপিপির ইউসুফ রাজা গিলানি। সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের
মেয়াদ শেষে প্রেসিডেন্ট হলেন জারদারি। বিগত সরকারের শেষ দিকে সুপ্রিম কোর্টের
রায়ে গিলানি বিদায় নিলে একই দলের পারভেজ আশরাফ হন প্রধানমন্ত্রী। সরকারের মেয়াদ
পূর্ণ হওয়ার মুহূর্তে গঠিত হলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক বা কেয়ারটেকার
সরকার। এর প্রধান হিসেবে প্রবীণ আইনজীবী মির হাজার খান খোসোর ওপর দায়িত্ব অর্পিত
হয়। তিনি কয়েকজনকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে জাতীয় নির্বাচন
সম্পন্ন হয়েছে জঙ্গিদের হুমকি ও হামলা সত্ত্বেও। নির্বাচনের প্রচারণাকালে এবং ভোট
গ্রহণের দিনও বহু লোক তাদের নাশকতায় প্রাণ দিয়েছে। তবুও জনগণ দলে দলে গেছেন
ভোটকেন্দ্রে। ব্যালট অস্ত্র প্রয়োগ করে বুলেট বা সহিংসতার প্রতি অনাস্থা
জানিয়েছেন পাকিস্তানের নাগরিকেরা। তারা চান জনগণের আস্থাভাজন ব্যক্তিরা নির্বাচনী
রায়ে বলীয়ান হয়ে সরকার গঠন করবেন। কোনো গোষ্ঠী, বিশেষ কোনো মহল আর বহিঃশক্তির
মদদে দেশের ঘাড়ে ‘সরকার’ হিসেবে চেপে বসবেÑ এটা তারা আর মেনে নেবেন না। গত কয়েক বছরে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও
সাহসী ভূমিকা, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির দুর্নীতি ও ব্যর্থতা এবং সামরিক বাহিনীর
অন্যায় কর্তৃত্ব হ্রাসÑ এসব কিছুর পাশাপাশি মানুষের
গণতান্ত্রিক সচেতনতা বৃদ্ধির পরিচয় মিলেছে এই নির্বাচনে।
নির্বাচনে বিজয়ী নওয়াজ শরিফ ক্ষমতা হাতে নেয়ার আগেই উদযাপন করলেন
দেশটির পরমাণু বোমা অর্জনের পঞ্চদশ বার্ষিকী। গত ২৮ মের সেই অনুষ্ঠানে তিনি এমন
একটি তিক্ত সত্য উচ্চারণ করলেন, যা শুধু পাকিস্তান নয়, তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতসহ
অনেক দেশের বেলায়ই প্রযোজ্য। নওয়াজ সেদিন রাখঢাক না রেখেই স্বীকার করলেন, পাকিস্তানের
পারমাণবিক শক্তি রয়েছে। অথচ আজো তীব্র বিদ্যুৎ ঘাটতি এ দেশের এক বিরাট ট্র্যাজেডি।
নওয়াজ শরিফ যে কথা বলেননি তা হলো, নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ
না করে সমরসজ্জা আর অস্ত্রসম্ভারের পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা জাতির
জন্য গ্রেট ট্র্যাজেডি। ভারত ও পাকিস্তান কেউই এই ট্র্যাজেডি থেকে মুক্তি পাচ্ছে
না। ভয় ও শক্তির ভারসাম্য রাখার প্রতিযোগিতা দুই দেশের কোটি কোটি মানুষকে বঞ্চিত
রাখছে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসার মৌলিক অধিকার থেকে।
পাকিস্তানের সর্বশেষ নির্বাচন কেমন ছিল? তার প্রধান ‘শত্রু’ ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক, কলামিস্ট কুলদীপ নায়ার
লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের কথা মনে হলেই ভেসে ওঠে নৈরাজ্য, সহিংসতা, একই সাথে তামাশার
কথা। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির ছেলেকে অপহরণের বিষয়টিকেও
আকস্মিক বা অপ্রত্যাশিত বলা যাবে না। এবারের নির্বাচনের একটি লক্ষযোগ্য দিক হলো, রাজনৈতিক দলগুলো
সম্ভাব্য বিজয়ী প্রার্থীদেরই মনোনয়ন দানে সচেষ্ট ছিল। নির্বাচনের আগেই উপলব্ধি
করা গিয়েছিল যে, নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লিগ পাঞ্জাবে শক্তিশালী। আসিফ আলী
জারদারির পিপলস পার্টি সিন্ধুতে শক্তিশালী। আবার ইমরান খানের তেহরিক-ই ইনসাফ
পার্টি খাইবার পাখতুনখাওয়ায় শক্তিশালী। নির্বাচনী ফলাফল হয়েছে সে মোতাবেক।
নওয়াজ শরিফের বিজয়ের একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শহর ও
গ্রামাঞ্চলের আসনগুলোতে তার দল বিজয়ী হয়েছে সমানভাবে।’
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং পরদিন
ভারত স্বাধীন দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। আজ ভারত রাজনীতির
ক্ষেত্রে বিশ্বের ‘সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ এবং অর্থনীতির
দিক দিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎশক্তি হয়ে উঠছে জাপানকে ছাড়িয়ে। এর বিপরীতে
পাকিস্তানে গণতন্ত্র বরাবরই বিপন্ন। আর ভূরাজনৈতিক সঙ্ঘাত-সঙ্কটে দেশটির অর্থনৈতিক
সম্ভাবনা বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে। অবশ্য সামরিক ক্ষেত্রে বৃহৎ ভারত এবং
অপেক্ষাকৃত অনেক ুদ্র হলেও পাকিস্তান জনবল ও অস্ত্রবলে বিরাট শক্তি হিসেবে গণ্য।
এমনকি দুই দেশই বহু আগে থেকে পারমাণবিক মারণাস্ত্রের অধিকারী। কিন্তু অস্ত্র
শান্তি আনে না, দারিদ্র্য দূর করে না; নিশ্চিত করে না সার্বিক
উন্নয়ন।
পাকিস্তান ও ভারত দুই রাষ্ট্রেরই ‘জাতির পিতা’ (যথাক্রমে জিন্নাহ ও গান্ধী) সূচনা
পর্বেই মারা গেলেন। তবুও ভারতের সৌভাগ্য, দ্বিতীয় প্রধান নেতা নেহরু
প্রথম থেকে ১৭ বছর একাধারে দেশের নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন। অপর দিকে জিন্নাহর
উত্তরসূরি লিয়াকত আলী খান চার বছর না যেতেই নিহত হলেন। পাকিস্তানে তখনই হত্যার
রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সঙ্কটের সূচনা। আর সেই সাথে শুরু হয় ভবিষ্যতের সামরিক
শাসনের প্রস্তুতি। ভারতের জাতির পিতা চরম সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে নিহত হওয়ার
পরও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকায় গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা ছিল অুণœ। এই প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার আড়াই বছর পরই ভারত নিজস্ব সংবিধানের
অধিকারী হয়। অথচ ক্ষমতার মসনদে অবাঞ্ছিত উত্থানপতনের মধ্যে জন্ম নেয় যে
অস্থিতিশীল পরিবেশ, তাতে পাকিস্তানের সংবিধান রচনায় কেটে যায় সাড়ে আট বছর। এর পরও
রাজনৈতিক টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে কোনোমতে দু’টি বছর পার হয়েছিল। তখন ঘটল সেনা অভ্যুত্থান; জারি হলো সামরিক
শাসন। ১৯৫৮-এর সেই ঘটনার পর ’৬৯, ’৭৭ ও ’৯৯ সালে আরো তিনবার সৈনিকের রণদণ্ড ‘দেখা দিলো রাজদণ্ড রূপে’। এর মধ্যে ’৭১ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ যুদ্ধের পথে আলাদা
হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম করেছে। তবুও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বোধোদয় ঘটেনি।
এই গোষ্ঠীর মধ্যে শামিল হয়েছিল দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতালোভী রাজনীতিক এবং সামরিক-বেসামরিক
আমলা চক্র। তাদের নীতিহীন ও স্বার্থদুষ্ট অবিমৃষ্যকারিতায় বারবার অভ্যুত্থানের
মাধ্যমে ‘ডাণ্ডাতন্ত্র’ কায়েম করেও দেশটা ঠাণ্ডা করা
যায়নি, অর্থাৎ শান্তি আসেনি। বরং জাতির সঙ্কট আরো বেড়েছে। নির্বাচনের নামে
হয়েছে প্রহসন। অথবা নির্বাচিত সরকারকে মেয়াদপূর্তির আগেই নিতে হয়েছে অবমাননাকর
বিদায়। ২০১৩ সালেই প্রথম এর ব্যতিক্রম ঘটেছে।
পাকিস্তান বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনায় এসেছে সামরিক
অভ্যুত্থান কিংবা সশস্ত্রবাহিনীর ব্যাপক প্রভাব ও কর্তৃত্বের প্রসঙ্গে। এখন এই
সমস্যাসঙ্কুল দেশটি ‘টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ গণতন্ত্রের পথে
অভিযাত্রার কারণে। যে পাকিস্তানে এমন ইতিবাচক বিরাট পরিবর্তন দৃশ্যমান, তাকে কিছু দিন
আগেও ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে অভিহিত
করা হয়েছে, যাকে ইংরেজিতে বলে Banana Republic. অথচ পাকিস্তান এবার তার জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করে একাধিক কারণে
বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ ও প্রশংসা অর্জন করেছে।
পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশেও আলোচনা ও বিতর্কের তোড়জোড়
দেখা গেছে। এখনো তা চলছে। বাংলাদেশের মানুষ ২৪ বছর তাদের সাথে একত্রে ছিল বলেই
শুধু নয়, আসলে পাকিস্তান বলতে সামরিক অভ্যুত্থানের শঙ্কা জেগে থাকে বলেই সে
দেশের নির্বাচন নিয়ে এত কৌতূহল। আমাদের দেশের কলামিস্টদের মধ্যে যারা বিশেষ কোনো
দেশের প্রতি আসক্তি বা বিদ্বেষ কোনোটাই পোষণ করেন না; তাদের অভিমত, পাকিস্তানের
এবারের নির্বাচন থেকে আমাদের শেখার আছে। আর যারা ‘ভারতঘেঁষা’ হিসেবে পরিচিত, তাদের সাফ কথাÑ পাকিস্তান নামের গোল্লায় যাওয়া দেশটা থেকে বাংলাদেশের শেখার কিছুই
নেই।
কারো কাছ থেকে কিছু শেখার দরকার না থাকার মতো অবস্থা হলে, তা আমাদের জন্য
গর্বের বিষয় হতো। দুর্ভাগ্যবশত বাস্তবতা এমন যে, আমাদের অনেক কিছুই শেখার বাকি।
কোত্থেকে শিখছি, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমরা কী শিখছি। বাংলাদেশ যে
অনেক কিছুই শেখেনি, তা তো আজকের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক হ-য-র-ব-ল
পরিস্থিতিই সাক্ষ্য দিচ্ছে। কেউ দেখে শেখে, কেউ বা ঠেকে শেখে। আমরা এতই
অপরিণামদর্শী যে, ঠেকায় পড়েও শিখছি না। নিজে শিখতে না চাইলে দুনিয়ার সেরা শিক্ষিত
ব্যক্তিও কাউকে শেখাতে পারবেন না।
কেয়ারটেকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা বাংলাদেশে প্রথম
দিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। সেটা ১৯৮৩ সালের কথা। তখনো অন্য কোনো দলের মাথায় এই
আইডিয়া আসেনি। জামায়াত বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছে এবং
উল্লেখ করেছে যে, অধ্যাপক গোলাম আযম কেয়ারটেকার ফর্মুলার মূল উদ্গাতা। এখন অবশ্য কেউ
কেউ বক্রোক্তি করে থাকেন যে, বহুলালোচিত গোলাম আযমের ‘আবিষ্কৃত’ বলেই কেয়ারটেকার সরকার এখন
আওয়ামী মহলের বিষম না-পছন্দ। প্রশ্ন হলোÑ যে অমৃতের স্বাদ
নিতে তারা এতই উন্মুখ ছিলেন, যে অমৃত সুধা সেবনে সুফলও পেয়েছেন; তাতে এত দিন পর কেন আকস্মিক
অরুচি? ‘এক-এগারো’র মইন ইউ সরকার তো কেয়ারটেকার নয়, বাস্তবে এই সিস্টেমের চরম
বিকৃতি। তবুও এর রেফারেন্স দিয়ে কেয়ারটেকার নামের অমৃতসেবী আওয়ামী লীগ গরলরূপে
তুলে ধরছে এই পরীক্ষিত পদ্ধতিকে। অথচ এক সময়ে একই দলের শীর্ষ নেতানেত্রীদের মুখে
খৈ ফুটেছে কেয়ারটেকারের প্রশংসায়। এ জন্য গর্ব করে বলা হতো, ‘আমরা এভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে বিশ্বকে দেখিয়ে
দিয়েছি। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এত দিন অন্যদের আমরা অনুসরণ করেছি। এখন অন্যরা
আমাদের থেকে শিখবে।’
কেয়ারটেকার প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এখন ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব। কিন্তু যেকোনো বিবেচনা ও মূল্যায়নে দেশের ৮০ শতাংশেরও বেশি
মানুষ চান নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন হোক। আওয়ামী
লীগের সাধারণ সমর্থক ও কর্মীদের অভিমতও অভিন্ন। এই সরকার সংবিধানের সংশোধনী আনার
আগে যখন বিভিন্ন মহলের মতামত নিচ্ছিল, সে সময় প্রায় সবাই
কেয়ারটেকার বা তত্ত্বাবধায়কের পক্ষেই অভিমত দিয়েছেন। অথচ সুপ্রিম কোর্টের
রায়ের দোহাই দিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত সিদ্ধান্ত নিয়ে কেয়ারটেকারকে বিদায় করে
দেয়া হলো। তখনো সুপ্রিম কোর্টের সম্পূর্ণ রায় দেয়া হয়নি। রায়ে আরো দুই
মেয়াদে কেয়ারটেকারের আওতায় নির্বাচনের সুযোগ থাকলেও সরকার তার ইচ্ছামতো রায়টির
ব্যাখ্যা দিয়েছে।
সাম্প্রতিক এসব অভিজ্ঞতা থেকে সচেতন মানুষমাত্রেরই উপলব্ধি হচ্ছে, আওয়ামী লীগ
পরিকল্পিতভাবেই কেয়ারটেকারের বিধানকে বধ করেছে। মতামত আহ্বান করাটা ছিল মূল
নাটকের প্রথম দৃশ্যমাত্র। কেয়ারটেকার ব্যবস্থার জোরালো সমর্থকেরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ
নিজের ক্ষমতার স্বার্থেই কেয়ারটেকার ব্যবস্থা চেয়েছিল এবং এজন্য দুই বছর ধরে
প্রচণ্ড আন্দোলন করেছিল। দেশ ও জাতির স্বার্থে তারা সেই আন্দোলন করলে নিজ
সন্তানতুল্য কেয়ারটেকার বিধানকে অবলীলায় বলি দিত না। কেয়ারটেকারের বিধান
সংযোজনের কারণ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য সংসদ নির্বাচন; যাতে সরকার
সত্যিকারভাবেই হয় জনপ্রতিনিধিত্বশীল। গণতন্ত্রে প্রকৃতই আস্থাবান হলে কারো এ
ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ নেই। এক-এগারোর সরকারকে অজুহাত বানিয়ে যারা আজ
কেয়ারটেকারকে ‘গজব’ হিসেবে দেখাচ্ছেন, তারাই এক দিন
জাতিকে বুঝিয়েছেন, এটা ‘আল্লাহর রহমত’। যারা এক-এগারোর খচ্চরমার্কা (সামরিক ও বেসামরিক কোনোটাই পুরোপুরি
নয়) সরকার নিজেদের ‘আন্দোলনের ফসল’ বলে গর্ব করেছেন, মইন-ফখরের
বিরুদ্ধে একটা মামলাও করেননি এবং মইনের দক্ষিণহস্ত মাসুদ উদ্দিনকে আজ পর্যন্ত
রাষ্ট্রদূতের পদে আরামে রেখেছেন, তাদের মুখে কেয়ারটেকারের সমালোচনা শোভা পায় না।
বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ হলো, আমাদের জন্ম দেয়া সিস্টেমকে
আমরাই মেরে ফেলেছি। আর সেটা ব্যবহার করছে পাকিস্তান। তারা আমাদের থেকে শিখেছে। আর
আমরা নিজেদের সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকেও শিখিনি। দুর্যোগ আর দুর্নীতির জন্য পরিচিত
বাংলাদেশ কেয়ারটেকার সিস্টেমের সুবাদে বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিল। পারস্পরিক
অবিশ্বাসের নেতিবাচক কারণ থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের ইতিবাচক অর্জন সম্ভব করেছে এই
সিস্টেম।
পাদটীকা : নওয়াজ শরিফের দল মুসলিম লিগ এবার নির্বাচনে দু’টি স্লোগানের বহুল ব্যবহার
করেছে। এগুলো হচ্ছে, শাইনিং পাকিস্তান (আলোকিত পাকিস্তান) এবং এন্ড দ্য ডার্কনেস (অন্ধকার
বিদায় করুন)। আর নওয়াজের নির্বাচনী প্রতীক ছিল সিংহ। দেশ চালনার দায়িত্ব নিলে
শুধু সিংহের গর্জনে কাজ হবে না; যে পর্যন্ত না সহিংসতা, দারিদ্র্য ও দুর্নীতির অন্ধকার
দূর করে শান্তি, সংহতি ও সুশাসনের আলোয় দেশকে আলোকিত করা যাবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন