ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে লিখতে লিখতে হাত পচে গেছে। কলমের নিব ভোঁতা হয়ে গেছে, কলমের কালি শুকিয়ে গেছে। আর হাল আমলে কম্পিউটারে ফোলডারের পর ফোলডার এবং ফাইলের পর ফাইল ভরে গেছে। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর সমাধান হয়নি। সমস্যাগুলো একদিন দুই দিনের নয়। সময়ের পরিসরে পাকিস্তান পিরিয়ডকে যদি অন্তর্ভুক্ত করি তাহলে ৬৫ বছর। আর যদি বাংলাদেশ পিরিয়ডকে বিবেচনায় আনি তাহলে ৪২ বছর। পাকিস্তান পিরিয়ড না হয় বাদই দিলাম, যদিও ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন সমস্যা সেই পাকিস্তান আমল থেকেই। ফারাক্কা বাঁধ এবং গঙ্গাবাঁধও সেই পাকিস্তান আমল থেকেই। তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার উৎপত্তিও সেই পাকিস্তান আমলেই। তবুও আমরা বিভিন্ন বোধগম্য কারণে পাকিস্তান আমলটি ছেড়েই দিলাম।
বাংলাদেশ আমল থেকে যে সব সমস্যার শুরু, আজ ২০১৩ সালেও সেইসব সমস্যার সমাধানের কোনো আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে না। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো এই ২০১৩ সালের মে মাসে এসে যুক্ত হলো আরো একটি সমস্যা। সেটি হলো নারায়ণগঞ্জে ভারতের প্রস্তাবিত কনটেইনার টারমিনাল পোর্ট নির্মাণের সমস্যা। আগের চারটি সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি। এই চারটি সমস্যা হলো (১) ছিটমহল সমস্যার সমাধান (২) ভারতকে ট্রানজিট বা করিডোর প্রদান (৩) তিস্তাসহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান এবং (৪) টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা বা না করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এছাড়া অন্যান্য সমস্যাতো রয়েছেই। বাণিজ্য ক্ষেত্রে ভারতের অনুকূলে এবং বাংলাদেশের প্রতিকূলে আসমান জমিন ফারাক। ভারতীয় পণ্যে বাংলাদেশী বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের পণ্য ভারতে অবাধে প্রবেশ করতে পারছে না। বাংলাদেশের পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে গেলে অনেক উঁচু শুল্ক প্রাচীর পার হয়ে যেতে হয়। দুই দেশের মধ্যে কথা হয়েছিল যে উভয় দেশই তাদের শুল্ক প্রাচীর অপসারণ করবে অথবা একটি যুক্তিযুক্ত পর্যায়ে নামিয়ে আনবে। বিষয়টি আরেকটু খুলে বলছি।
॥ দুই ॥
বাংলাদেশী পণ্য যখন ভারতে প্রবেশ করে তখন অনেক উচ্চহারে ভারত আমদানি শুল্ক বসায়। ফলে যখন বাংলাদেশী পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য ভারতের বাজারে ঢোকে তখন তার দাম অনেক বেড়ে যায়। অতবেশী দামে বাংলাদেশী পণ্য কেনার আগ্রহ ভারতীয় ক্রেতারা হারিয়ে ফেলে। তাই কথাছিল যে উভয় দেশই তাদের আমদানি শুল্ক হয় বিলোপ করবে, না হলে যুক্তিযুক্ত পর্যায়ে হ্রাস করবে। বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্যের বেলায় শুল্ক প্রাচীর যুক্তিযুক্ত পর্যায়ে নামিয়েছে। অর্থাৎ অনেক হ্রাস করেছে। কিন্তু ভারত এ ব্যপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে ভারতে বাংলাদেশী পণ্যের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও উচ্চ মূল্যের কারণে সেগুলো বাজার পাচ্ছে না।
এসব জ্বলন্ত সমস্যাতো রয়েছেই। কোথায় এগুলোর সমাধান হবে, তা না হয়ে বরং নিত্যনতুন সমস্যা পয়দা হচ্ছে। সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফের গুলীবর্ষণের হার বেড়ে গেছে। এখন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ বলা হচ্ছে। ভারতীয় আধা-সামরিক বাহিনীর গুলীতে বাংলাদেশীরা বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে। এই নিয়ে কত দেন দরবার হলো। দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা মিটিং করলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রীরাও বৈঠক করলেন। সমস্যা সমাধানের জন্য কত রকম আশ্বাস আর ওয়াদা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্যা যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।
এরই মধ্যে এসে গেছে নারায়ণগঞ্জে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ সমস্যা। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের একটি বাংলা দৈনিকে খবরটি সর্বপ্রথম ছাপা হয়। ছাপা হওয়ার পর উভয় দেশের কর্তৃপক্ষ কিছুটা নড়েচড়ে বসেন। প্রথম কয়েক দিনতো ভারতের কর্তৃপক্ষ এটিকে কোনো পাত্তাই দিতে চায়নি। কিন্তু বাংলাদেশে যখন এটিকে নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হলো তখনই ভারতীয়রা বিষয়টিতে নজর দেয়। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে বাংলাদেশের কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্টের ৪৬ বিঘা জমি আছে। নারায়ণগঞ্জের কনটেইনার টার্মিনাল পোর্ট ঐ জমির ওপর নির্মাণ করার ব্যাপারে ভারতের একটি বেসরকারি কোম্পানি একটি জরিপ পরিচালনা করতে চায়। এই জরিপ কাজ পরিচালনার জন্য ভারতের ত্রিপুরার এক বা একাধিক দৈনিক পত্রিকায় তারা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। বিজ্ঞাপনের ফটোকপি বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর হৈ চৈ পড়ে যায়। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো এই যে জরিপ করার ব্যাপার এবং পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে কিছুই জানানো হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে এই ব্যাপারে কথা ওঠে। এদেশে একটি টার্মিনাল নির্মাণ হবে, সেই ব্যাপারে জরিপ হবে এবং সেই জরিপের ব্যাপারে বিজ্ঞাপনও ছাপা হবে অথচ বাংলাদেশকে সে ব্যাপারে কিছুই জানানো হচ্ছে না, এটি কোনো সার্বভৌমত্ব দেশ মেনে নিতে পারে না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের যতখানি তৎপর হওয়া উচিত ছিল ততখানি তৎপরতা পরিলক্ষিত হয় না। যাই হোক, জনমতের চাপে পড়ে ভারতের নিকট থেকে বিষয়টির ব্যাখ্যা চাইতে আওয়ামী লীগ সরকার বাধ্য হয়। গত বৃহস্পতিবার ভারত একটি দায়সারা গোছের উত্তর দেয়। উত্তরে বলা হয়েছে যে, যেহেতু এই বিষয়টি দুইটি দেশের সরকারের মধ্যকার বিষয় নয় তাই এটিকে দুইটি দেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসাবে গণ্য করা ঠিক হবে না। আমরা বিষয়টিকে নারায়ণগঞ্জের একটি কনটেইনার টার্মিনাল পোর্ট নির্মাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। আমরা বিষয়টিকে বাংলা-ভারত সম্পর্কের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে চাই।
॥ তিন॥
দেখা যাচ্ছে যে, বিগত সাড়ে চার বছরে ভারত এবং বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা হলো গ্রহীতা আর বাংলাদেশের ভূমিকা হলো দাতা। এই সাড়ে চার বছরে বাংলাদেশ শুধু দিয়েই চলেছে আর ভারত শুধু নিয়েই চলেছে। এইভাবে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের সম্পর্ক চলতে পারে না। সার্বভৌম সমতা হলো বর্তমান বিশ্বে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সম্পর্কের ভিত্তি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই নীতিমালা অনুসৃত হচ্ছে না।
এই জন্য কাকে দায়ী করা যায়? শুধু ভারত নয়, প্রতিটি রাষ্ট্রই চায় দ্বিপাক্ষিক বা বহু পাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধা আদায় করা। ভারত বাংলাদেশের নিকট থেকে সেই সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধা আদায় করছে। বিনিময়ে বাংলাদেশ কোনো প্রতিদান আদায় করতে পারেনি। ভারত একতরফা সুবিধা ভোগ করছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পর থেকেই এসব কথা প্রায় সকলেই জানেন। এসব কথার পুনরাবৃত্তির কোনো অবকাশ নেই। ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়নি। অথচ তারা বেরুবাড়ি ঠিকই পেয়ে গেছে। দহগ্রাম-আংগুর পোতায় যাতায়াতের জন্য ৩ বিঘা করিডোর ব্যবহারের সুযোগ এবার দেয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ৩ বিঘার ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবারও স্বীকার করে নেয়া হয়নি। শেখ হাসিনার দিল্লী সফর এবং মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবকিছু উজাড় করে দিতে যাচ্ছিলেন। শুনতে বেখাপ্পা ঠেকলেও কঠিন বাস্তব হলো এই যে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি মাঝখানে বাধা হয়ে না দাঁড়ালে বাংলাদেশ সরকারের নিকট থেকে ভারত কড়ায় গন্ডায় ট্র্যানজিটের নামে করিডোর আদায় করে ছাড়তো। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দিতে রাজি না হওয়ায় সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। অথচ এর মাঝে তিতাস নদীকে ভারতীয়রা দুইভাগে ভাগ করে সেটিকে একটি মরা নদী বানিয়েছে। ভারতের ত্রিপুরার পালাটোনায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবে বলে ভারত আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত ভারি যানবাহন দিয়ে এমন ভারি যন্ত্রপাতি পরিবহন করেছে যে, সেই কারণে ঐ এলাকায় বাংলাদেশের রাস্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য শুল্কপ্রাচীর আজও দাঁড়িয়েই আছে। ঐ প্রাচীর হয় সম্পূর্ণ নামিয়ে ফেলার কথাছিল, না হয় প্রাচীরের উচ্চতা হ্রাস করার কথা ছিল। কিন্তু সেগুলোর কিছুই করা হয়নি। আর কি আশ্চর্য, কিছুদিন আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এ ব্যাপারে খুব হৈ চৈ করলেও এখন অকস্মাৎ তারা খামোশ হয়ে গেছেন।
ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে অব্যাহতভাবে বঞ্চিত করার পটভূমিতে গত বৃহস্পতিবার এক শ্রেণীর পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে, আগামী ৬ মাসে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আসাম ও ত্রিপুরায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন পণ্য যাবে। এজন্য বাংলাদেশ কোনো চাজর্, মাশুল বা শুল্ক নেবে না। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এই পণ্য পরিবহনের ফলে ভারতের সাশ্রয় হবে অন্তত ৫০ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে এর পরিণতিতে বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ ৩৬ কিলোমিটার সড়ক এবং ব্রিজ ও কালভার্ট ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভেঙ্গে পড়া ব্রিজ এবং কালভার্ট মেরামত করতে খরচ হবে কয়েক শত কোটি টাকা। ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, অবকাঠামো মেরামত বাবদ কম করে হলেও ২৫০ কোটি টাকা খরচ হবে। ভারত এরমধ্যে ২৪৫ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আজও সেই টাকা পাওয়া যায়নি। ঐ টাকার ভাগ্য অনেকটা সেই ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে কিন্তু গোয়ালে নেই’-এর মতো। ট্র্যানজিট সংক্রান্ত শুল্ক আদায়ে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমানের পদাঙ্কই অনুসরণ করছে বলে মনে হচ্ছে। উল্লেখ্য, মশিউর রহমানকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, ট্র্যানজিটের বিনিময়ে বাংলাদেশ কি রকম চার্জ আদায় করবে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে, ভারতের নিকট থেকে ট্র্যানজিটের বিনিময়ে মাশুল অথবা টোল আদায় করাটা অভদ্রতার শামিল। তার কথায় সে দিন বাংলাদেশে তীব্র সমলোচনার ঝড় উঠেছিল।
এই সরকারের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৭ মাস। তারপর তারা ক্ষমতায় ফিরে আসবে, নাকি ক্ষমতার হাত বদল হবে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সেটি কেউ জানে না। সুতরাং বিনা শুল্কে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতকে পণ্য ও যন্ত্রপাতি পরিবহনের সুবিধা দেয়ার অধিকার পড়ন্ত বেলায় এই সরকারের আর নাই। এই সরকার যদি ভারতের চরণতলে সবকিছু বিনাশর্তে সমর্পণ করতে চায় তাহলে তাদের অপেক্ষা করতে হবে। আগামী নির্বাচনের সময় নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ জনগণকে বলুক যে আগামী নির্বাচনে জনগণ যদি তাদেরকে ভোট দেয় তাহলে তারা ভারতের পদতলে বাংলাদেশের সবকিছু লুটিয়ে দেবে। বিনিময়ে তারা ভারতের নিকট থেকে কোনো কিছুই দাবি করবে না। জনগণ যদি তাদের এই নির্বাচনী ইশতেহার সমর্থন করে তাদেরকে ভোট দেয় তাহলে তারা ভারতের বেদীমূলে বাংলাদেশের স্বার্থ বির্সজন দিতে পারবে তার আগে নয়। তার আগে তারা এই ব্যাপারে এক কদমও হাঁটতে পারবে না। হাঁটলে পরবর্তী সরকার এসে সেগুলো সব বাতিল করে দিবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন