সংবাদপত্রে একটি জরিপ প্রকাশের পর বাংলাদেশের মিডিয়া ও শাসকদের
সম্পর্ক কোন পর্যায়ে রয়েছে তা আরো স্পষ্ট হলো। প্রধানমন্ত্রী ওই জরিপ নিয়ে
মন্তব্য করতে গিয়ে বলছেন, একটি পত্রিকা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। পত্রিকাটি সম্প্রতি পরিচালিত এক
জরিপে জানিয়েছে ৯০ শতাংশ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। এর আগে একই ধরনের জরিপ
চালিয়ে পত্রিকাটি জানিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি জনসমর্থন বাড়ছে। আগের জরিপে দেখা গিয়েছিল
সরকারের প্রতি জনসমর্থন কমে যাচ্ছিল। ব্যাপারটি ছিল অত্যন্ত বিস্ময়কর।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কাজের প্রতি মানুষ আস্থা হারাচ্ছিল কিন্তু ব্যক্তি
প্রধানমন্ত্রীর ওপর মানুষের সমর্থনের হার উল্টো বেড়ে যাচ্ছিল। বিশ্বের কোনো
শাসকের বেলায় এর আগে এমন ঘটেছিল কি না জানা যায় না। ওই জরিপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী
কোনো মন্তব্য না করলেও পরবর্তী জরিপে যখন ৯০ শতাংশ মানুষের তত্ত্বাবধায়কের প্রতি
সমর্থন দেখানো হলো, এবার তিনি কড়া মন্তব্য করলেন। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কখনো হুমকির
মুখে পড়বে না, এমন বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। এখন যেন সে বিশ্বাস একটু নড়ে গেল। এই
বিষয়টিও বোঝা গেল কয়েকটি মিডিয়ার ওপর উসকানি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির
দায় চাপানো ছিল স্রেফ অজুহাত। প্রকৃতপক্ষে সরকারের টার্গেট ভিন্ন মত।
মাহমুদুর রহমানকে আটক করার ৪০ দিন পর ১৫ সম্পাদক বিবৃতি নিয়ে এলেন।
বিবৃতিতে তারা ৬ মে বন্ধ করে দেয়া দু’টি চ্যানেলও খুলে দেয়ার দাবি না জানিয়ে পারলেন না। এখন প্রজ্ঞাবান
প্রবীণ সম্পাদকদের বিরুদ্ধে ‘না জেনে’, ‘না বুঝে’ বিবৃতি দিয়েছেন বলে অভিমত
দিচ্ছেন তথ্যমন্ত্রী। একজন সম্পাদককে মুক্তির আহ্বানে দেয়া বিবৃতি গণমাধ্যমের
জন্য মঙ্গলজনক হবে না বলে হুমকি দিলেন তিনি। ১৫ সম্পাদকের সবার দীর্ঘ সাংবাদিকতার
অভিজ্ঞতা রয়েছে। সংবাদমাধ্যম যদি সত্যিকার অর্থে জাতির বিবেক হয়ে থাকে, তাহলে তারা
নিঃসন্দেহে জাতির বিবেকের চালিকাশক্তি। তথ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন, বাংলাদেশের টোটাল
মিডিয়ার অবস্থান এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিলম্ব বিবৃতির পর সম্পাদক আত্মপক্ষ সমর্থন করে ‘কৈফিয়ত নয়’ বলে সাফাই ছাপছেন বড় করে নিজ পত্রিকায়। এতে এটা মনে হওয়া
অস্বাভাবিক হবে না যে, হুমকিতে কাজ হয়েছে। একজন সম্পাদকের নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেয়া বিবৃতি
যেন ওই কৈফিয়তের মাধ্যমে আবার প্রত্যাহার করে নিলেন প্রবীণ সম্পাদকেরা। কৈফিয়তে
এমন ভাষা ও যুক্তি প্রয়োগ করা হলো যাতে পরস্পর বিরোধিতা রয়েছে। এর গূঢ়ার্থ
দাঁড়াল, ওই সম্পাদক গোষ্ঠীগতভাবে অন্যায়ের সমর্থক; কিন্তু
ব্যক্তিগতভাবে এর বিপক্ষে। শাপলা চত্বরে জমায়েত হওয়া হেফাজতের লাখ লাখ সদস্যকে ‘দুর্বৃত্ত’ আখ্যা দিলেন তিনি। অথচ যেখান থেকে সাম্প্রদায়িক স্লোগান দেয়া
হয়েছে। সঙ্কীর্ণ ওইসব ম্লোগানের ফলে দাঙ্গা বাধার উপক্রম হয়েছিল। সম্পাদক সেই ‘গণজাগরণ’ মঞ্চকে উচ্চ প্রশংসা করেছেন। আমার দেশের সাংবাদিকতাকে ‘অসাংবাদিকতা’ ও ‘অপপ্রচার’ বলে অভিহিত করেছেন।
বন্ধ হয়ে যাওয়া টিভি চ্যানেলের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উসকানির
অভিযোগ এনে তিনি নিজ থেকেই সরকারের কর্তাব্যক্তিদের চ্যানেল দু’টির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে
বলেন। ওই রাতেই দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয়া হয়। আমার দেশের মতোই দু’টি টেলিভিশনের ব্যাপারেও ওই
সম্পাদকের ঢালাও অভিযোগ সীমাবদ্ধ রয়েছে কিছু শব্দ চয়নের মধ্যে। এ ধরনের ধারণাগত
শব্দ প্রয়োগ না করে নিজ পত্রিকায় ‘সাম্প্রদায়িক উসকানি’ ‘অসাংবাদিকতা’ ও ‘অপপ্রচারের’ মুখোশ কেন তিনি উন্মোচন করে দেননি? সংবাদ প্রচারে এসব মিডিয়া কোন
আইন ভঙ্গ করেছে, সেটা তিনি সুনির্দিষ্ট করে বলছেন না।
অন্য এক শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক সবার বিরুদ্ধে শাণিত কলম চালালেন।
বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্রিকাকে তিনি প্রচারপত্র বলে উপস্থাপন করলেন। মিথ্যা ও হলুদ
সাংবাদিকতা করেই পত্রিকাটি হট কেক হয়েছিল বলে গল্প উপস্থাপন করে জানালেন। ভাষা
ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক মার্জিত ছিলেন এমনকি তিনি পত্রিকাটির নামও ধরেননি। ২৫টি
টিভি চ্যানেল, জাতীয় দৈনিকসহ আরো অসংখ্য প্রকাশনা থাকতে কিভাবে মিথ্যা প্রচারণা
চালানো হলো সে প্রমাণ উপস্থাপন করলেন না ‘কৈফিয়ত নয়’ এর লেখক সম্পাদকের মতো।
তাদের বক্তব্যে প্রভাবিত না হলে দৈনিক আমার দেশের ক্ষেত্রে আমরা ব্যতিক্রমী
ঘটনাই দেখব। পত্রিকাটির দাম ও প্রচার সংখ্যা অর্থনীতির সব তত্ত্বকে ব্যর্থ করে
একসাথে বেড়ে গিয়েছিল। পত্রিকাটির কাগজের মান ছিল গড় মানের চেয়ে খারাপ, অন্য পত্রিকা
যেখানে ২৪ পৃষ্ঠা সেখানে তারা দিচ্ছিল ১৬ পৃষ্ঠা, ভাষার মাধুর্য এবং
পৃষ্ঠাসজ্জার মানদণ্ডে এটি অন্যদের ছাড়িয়ে গিয়েছিল বিষয়টি এমন ছিল না। তাহলে
কোন জিনিস পত্রিকাটিকে হট কেক করেছিল। কেন পাঠকেরা উঁচু দাম বিবেচনায় নিচ্ছিল না।
বাংলাদেশের মিডিয়ার বিরুদ্ধে উচ্চারিত হওয়া শব্দ ‘নতজানু’ ‘স্বাধীনতা’ কি এর কারণ?
বাংলাদেশের মিডিয়া কি সত্য জানাতে ব্যর্থ হচ্ছে? পাঠক বেপরোয়া
হয়ে কি সেই আসল ঘটনা জানতে চেয়েছে? সেজন্যই কি তারা কাগজের মান, পৃষ্ঠা সংখ্যা, পৃষ্ঠাসজ্জা
ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি? একটি সত্য ঘটনা জানার জন্যই কি ১২ টাকা ব্যয় তাদের কাছে
গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি? সম্ভবত পাঠকের এ চাহিদা মেটাতে গিয়ে পত্রিকাটি ও এর সম্পাদককে এক
অসম লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল। তার পরিণাম ভোগ করছেন সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও
আমার দেশ পরিবার। এই সম্পাদকের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এখনো প্রমাণ হয়নি। কিন্তু
রিমান্ডে নিয়ে তাকে নির্যাতন চালানো হয়েছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য তিনি আটক
রয়েছেন।
প্রচারণা ও মিথ্য তথ্য পরিবেশনের যে ইঙ্গিত দিচ্ছেন শীর্ষস্থানীয়
সাংবাদিক তা কিভাবে সম্ভব যেখানে বাকি ২৫ টিভি চ্যানেল ও অসংখ্য পত্রপত্রিকা সবার
জন্য উন্মুক্ত ছিল। এখন এভাবে অভিযোগ উত্থাপন না করে যখন যে মিথ্যাচার আমার দেশ
করেছিল সেটা কেন সময় মতো জাতিকে জানিয়ে দেননি। ফলে পত্রিকাটির ভেল্কিবাজি কয়েক
দিনের মধ্যে মিথ্যা বলে প্রমাণ হয়ে যেত। পত্রিকাটি অকার্যকর হয়ে গেলে সম্পাদককেও
গ্রেফতার করার প্রয়োজন পড়ত না। তাকে নিয়ে সম্পাদকদেরও বিবৃতি দেয়ার প্রয়োজন
পড়ত না। তবে এটা ঠিক, আমার দেশের প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি।
তিনি লিখেছেন,“সংবাদপত্রের ডিকারেশন বা
টেলিভিশনের লাইসেন্স নেয়ার আবেদনে এক একজন মালিক সরকারের কাছে ‘আপনার বিশ্বস্ত’ বলে সব শর্ত মেনে নেয়ার মুচলেকা দেবেন আর লাইসেন্সটি পাওয়ার পরপরই
মাথায় স্বাধীনতার শিং গজাবে? যে পণ্য বিক্রির জন্য লাইসেন্স নেয়া হলো দোকান খুলেÑ সেখানে লাইসেন্সের শর্ত ভেঙে ভিন্ন পণ্য বিক্রি করলে এবং এর পরিণতিতে
দোকান বন্ধ হয়ে গেলে তার দায় কে নেবে।” সরকারের বেআইনি
কর্মকাণ্ড প্রকাশ করাকে কেউ ‘স্বাধীনতার শিং’ বলতে চানÑ এটা আমাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মিডিয়াকে দোকানের সাথে
তুলনা করাটা হয়তো তিনি নিজেও পছন্দ করবেন না। ঢালাওভাবে তো সম্মানিত সম্পাদক ‘কৈফিয়ত নয়’ কলামে লিখেছেন। প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন পণ্য কি বিক্রি করেছেন
সুনির্দিষ্টভাবে না উল্লেখ করে একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তোলা কতটা
যৌক্তিক। সরকার কিন্তু আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে মিডিয়া বন্ধ করেনি। তাহলে
লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গের যে কথা তারা বলছেন তা কিভাবে প্রমাণ হলো।
আলোচিত ইস্যু যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা আমরা
করেছি কি, সেই প্রশ্ন উঠেছে। পাঠক চেয়েছে ইস্যুটি নিয়ে নিরপেক্ষ ও বিস্তারিত
বিবরণ তুলে ধরুক মিডিয়া। কিন্তু মিডিয়া নিজেই এ ইস্যুর সাথে ওতপ্রোত জড়িয়েছে।
বিশেষণের বহুল ব্যবহার ও আবেগের আতিশয্যে হারিয়ে গেল সংবাদ। আবার অনেক সংবাদ হয়ে
গেল একেবারে গায়েব। সুখরঞ্জন এমনি একটি ইস্যু। তৈরি করা হলো অদ্ভুত উদ্ভট সংবাদ। ৪০
বছর আগের হত্যা, খুন, গুম, ধর্ষণ নিয়ে সংবাদের প্লাবন বইয়ে দিলাম আমরা কিন্তু পিরোজপুরের
সুখরঞ্জন বালীর খোঁজখবর নিয়ে একটি সংবাদও দিতে পারলাম না, যা বাংলাদেশের
মিডিয়ার জন্য আরেকটি চপেটাঘাত হয়ে ফিরে এলো। ৪০ বছর আগে সঙ্ঘটিত গুরুতর
অপরাধগুলো একটিও খাটো নয়। এর সাথে জড়িত অপরাধীদের কোনো রকম ছাড়ের পক্ষে একজন
ব্যক্তিও বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না।
পুরনো ওই সব খবর তৈরির বেলায় আমাদের পেশাদারিত্বের ঘাটতি ছিল
আশঙ্কাজনক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগ যাচাই-বাছাই করার বালাই আমরা করিনি।
অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দেইনি। একজনের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে অসংখ্য
অভিযোগ এনেছি। অভিযুক্ত ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করার প্রয়োজন মনে করিনি আমরা। অন্য
দিকে একজন প্রধান সাক্ষী হাওয়া হয়ে গেলেও আমরা তার বেলায় কোনো আগ্রহ দেখালাম
না। পরিবারের প্রধান সুখরঞ্জন নিখোঁজ হওয়ার পর তার স্ত্রী সন্তানের কী হলো তা
নিয়ে আমাদের একেবারেই মায়া হলো না। বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের ফটক থেকে আইন-শৃঙ্খলা
বাহিনী তাকে অপহরণ করেছিল বলে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আইনজীবীরা অভিযোগ
করেন। অভিযোগের সমর্থনে তারা মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিওচিত্র আদালতে দাখিল করেছিলেন।
কিছু পত্রিকা এ খবর প্রচার করে বরং চাপের মুখে পড়ে। হারিয়ে যাওয়া সুখরঞ্জন এখন
বড় একটি বাস্তবতা। ৬ মে শেষ প্রহরে অভিযান নিয়ে বিদেশীরা ‘নতজানু’ মন্তব্য করার পর সুখরঞ্জন ইস্যুতে বাংলাদেশী মিডিয়াকে এখন ‘অন্ধ’ বলে মন্তব্য করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমার দেশ কিছু পত্রিকার
একটি যারা নিখোঁজ ব্যক্তির খবর দিয়েছিল।
আমরা কি গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম? এ প্রশ্নের উত্তর
খোঁজা যাক। শুরুটা হয়েছিল নাশকতা ও তাণ্ডব দমনের নামে। সরকারের অতিরিক্ত
বলপ্রয়োগকে আমরা দেখেছি ‘জামায়াত-শিবির’ দমন হিসেবে।
বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তাদের রাজনৈতিক অধিকারকে আমরা স্বীকৃতি দিইনি।
ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে নিষিদ্ধ না হলেও মহাজোট সরকার এ দলটির
প্রতি একটি নিষিদ্ধ দলের মতোই আচরণ করে আসছে। তাদের অফিসে আক্রমণ করে নেতাকর্মীদের
ধরে নিয়ে গেছে পাইকারি হারে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের অফিস সিলগালা করে
দিয়েছে। ধর্মীয় বইপুস্তক যার হাতে পেয়েছে ‘জিহাদি’ বই রাখার অপরাধে তাকেই
গ্রেফতার করেছে। অথচ এসব বই সরকার নিষিদ্ধ করেনি। দলটির সাথে সম্পর্ক রয়েছে এমন
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে বন্ধ করে দিয়েছে তারা। এসব করার সময় মানুষের রুটি
রুজি তথা অর্থনৈতিক দিকটি বিবেচনায় নিতে চায়নি সরকার। বাংলাদেশের বেশির ভাগ
সংবাদমাধ্যম এ খবর এড়িয়ে গেছে অন্যায়ভাবে। বা কখনো পুলিশের সাথে ‘জিহাদি’ ও ‘নাশকতার’ তত্ত্বে সুর মিলিয়েছে।
সরকারি এসব বেআইনি পদক্ষেপের প্রতিবাদে সমাবেশ করতে চাইলে দলটিকে
অনুমতি দেয়া হয়নি। সংবাদমাধ্যম তখন চুপ রইল। তারা যখন বিুব্ধ হয়ে রাস্তায়
মিছিল বের করার চেষ্টা করেছে টিয়ার শেল, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে তা
পণ্ড করেছে পুলিশ। যাকে যেখানে পেয়েছে নির্যাতন চালিয়েছে, গ্রেফতার করে
বাণিজ্য (ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে উৎকোচ গ্রহণ) করেছে। আসকারা পেয়ে পুলিশ আরো
বেপরোয়া হয়ে সরাসরি গুলি চালাল। শরীরে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করল। কিভাবে মিছিলে
আক্রমণ করা হলো; তাজা বুলেট ছোড়া হলো মিডিয়া সেসব গায়েব করে দিলো। মিডিয়ায় খবরের
মর্যাদা পেল যখন জামায়াত-শিবির ঢিল ছুড়তে শুরু করল। কখনোবা ক্ষোভের আতিশয্যে পুলিশের
গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলো তারা বা পাবলিক যানবাহনে আক্রমণ করল। ঘটনার পেছনের দিকটি
সম্পর্কে পাঠককে অন্ধকারে রেখে প্রতিক্রিয়াকে বাড়িয়ে দেখাল মিডিয়া। এটি তখন
মিডিয়ার ভাষায় ‘তাণ্ডব’।
সরকার স্পষ্টত চেয়েছে জামায়াত-শিবিরকে সব ধরনের গণতান্ত্রিক
অধিকারবঞ্চিত করে ‘জঙ্গিপনার’ দিকে ঠেলে দিতে। এ
প্রক্রিয়ায় মিডিয়া সরকারের অন্যায় আচরণ প্রকাশ না করে সরাসরি সরকারের পক্ষে
অবস্থান নিয়েছে। দলটি এখন ছাত্রলীগের মতো রাম দা, কিরিচ হাতে নিয়েছে, মিডিয়া তা
দেখাতে পারেনি। সরকারের সাথে মিডিয়ার প্যারালাল অবস্থান দলটিকে সে পথে ঠেলে
দেয়ার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করছে।
গুলি ছুড়ে বিক্ষোভ দমনকে আমরা জায়েজ করেছি। এই সুযোগকে সরকার কাজে
লাগিয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নিঃশেষ করার কাজে। তার পরিণাম এখন কোথায় গিয়ে
ঠেকেছে? প্রধান বিরোধী দল বিএনপির একটি দোয়া মাহফিল নাশকতার অভিযোগে পুলিশ
পণ্ড করে দিয়েছে। দলটি প্রকাশ্যে তাদের কেন্দ্রীয় অফিসে কর্মসূচি পালন করতে
পারেনি কয়েকবার। বাধ্য হয়ে গোপনে তাদের কার্যক্রম চালাতেও দেখা গেছে। মিডিয়া
সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়তে পারে না। তারা কেবল তথ্য-উপাত্ত
ও মন্তব্য করে সব পক্ষকে সহযোগিতা করতে পারে। কিন্তু সেই সহযোগিতা তারা আগেই
বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি দমনে সরকারকে করেছে। এখন মাঠে একতরফাভাবে সরকার ও
শাসকগোষ্ঠী। মিডিয়াকেও দেখা যাচ্ছে দুর্বল। সাংবাদিক খুন, সম্পাদক আটক, রিমান্ডে
নির্যাতন, পত্রিকা বন্ধ, সম্পাদকদের হুমকির বিরুদ্ধে বিরোধী দল শক্ত করে কোনো অবস্থান নিতে
পারেনি। প্রশ্নও আসে না; কারণ বিরোধী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা নিজেরাই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এখন এ কথা স্পষ্ট, কোনো পক্ষ জয়ী হতে পারছে না। বরং সবাই মিলে একসাথে পরাজয় ও
ব্যর্থতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশের গণতন্ত্র গভীর খাদের কিনারে। ‘নতজানু’ থেকে ‘কেবল বাঁচিয়া থাকা’ সাংবাদিকদের জীবন
হতে পারে না। অর্থনীতি ধসের একটা পর্যায়ে বিজ্ঞাপনদাতাদেরও পাওয়া যাবে না। ‘নতজানু’ থেকেও তখন আর বাঁচার পথ থাকবে না।
মার খাওয়া সম্পাদক কিংবা বন্ধ হয়ে যাওয়া চ্যানেলের বিরুদ্ধে বলার
জন্য সাহসিকতার প্রয়োজন হয় না। পক্ষে দাঁড়াতে না পারলে অজুহাত হিসেবে সমালোচনা
করাও বিষয় হতে পারে না। বরং প্রধান বিষয় হওয়া উচিত টোটাল মিডিয়া নিয়ে দেশে-বিদেশে
যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে তা। প্রৌঢ় সম্পাদক কিংবা শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক কেউ
কিন্তু বাংলাদেশের মিডিয়া ‘নতজানু’ হওয়া নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহ
দেখাননি। তথ্যমন্ত্রীর বিবৃতির পর ‘কৈফিয়ত নয়’ ‘বিনীত নিবেদনের’ করুণ সুর বেজে
উঠলেও মিডিয়া ও সম্পাদকের পক্ষ নিয়ে কেউ শক্ত করে একটি শব্দ করারও সাহস পাননি।
সত্যের পক্ষে সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্যই সাংবাদিকতা বিশ্বে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর পেশা
হিসেবে স্বীকৃত।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন