সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

কাদের মোল্লার রায় কি আসলে ন্যায়ভ্রষ্ট?


বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল জনাব আব্দুল কাদের মোল্লা আপিলেট ডিভিশনের রায়ে মৃত্যুদ- পেয়েছেন। এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছিলেন। তার যাবজ্জীবন রায়কে কেন্দ্র করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগ চত্বরে গণজাগরণমঞ্চ তৈরি হয়েছিল এবং ঐ মঞ্চ থেকে তাকে ফাঁসি দেয়ার দাবি উঠেছিল। মঞ্চের নেতারা আইনমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপিও দিয়েছিলেন এবং তারা উভয়ে তাদের দাবির যৌক্তিকতার কথা স্বীকার করে এই দাবিা পূরণের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। আইসিটি আইনে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করার কোন বিধান ছিল না এবং এ প্রেক্ষিতে জাগরণ মঞ্চের দাবি পূরণের জন্যে সরকার ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারছিলেন না। এই অবস্থায় সরকার একটি অভূতপূর্ব ঘটনার জন্ম দেন এবং জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার বিচারের রায় ঘোষণার পর আইন সংশোধন করে সরকার পক্ষের আপিলের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কাদের মোল্লার শাস্তি বৃদ্ধি করে যাবজ্জীবনের পরিবর্তে ফাঁসির দাবি করে আপিল করেন এবং কাদের মোল্লার তরফ থেকে যাবজ্জীবন শাস্তি মওকুফের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয়। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশন সরকারের আপিল গ্রহণ এবং আব্দুল কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসির আদেশ দেন। জনাব কাদের মোল্লার এই ফাঁসির আদেশ নিয়ে দেশ-বিদেশের আইন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও সংস্থা এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। অনেকে এই রায়কে ন্যায়ভ্রষ্ট বলেছেন এবং তাদের দৃষ্টিতে ফৌজদারী অপরাধজনিত যে কোন মামলায় বিচারের মানদ- হিসাবে ৩টি বিষয় অবশ্যই দেখতে হয় এবং এই বিষয়গুলো হচ্ছে- প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য এবং দালিলিক প্রমাণ, জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার মামলায় তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের অনুকূলে কোন প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিল না। যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের প্রায় সকলেই শোনা কথার ভিত্তিতে, প্রসিকিউশনের শেখানো ভাষায় অথবা ভয়-ভীতি, প্রলোভনের ভিত্তিতে ২য়, ৩য়, ৪র্থ এমনকি ৫ম ব্যক্তির কাছে শোনা কথার ভিত্তিতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এই মামলায় দালিলিক প্রমাণাদি গ্রহণ ও বিশ্লেষণ করা হয়নি এবং পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের যে চাহিদা তাও পূরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার এই ফাঁসির রায়কে ইনসাফ না বলে কেউ কেউ জুডিশিয়াল কিলিং বলে অভিহিত করেছেন। বিচারিক আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। আপিল আদালত সাক্ষীদের তলব করেননি। অভিযোগের সমর্থনে গৃহীত দলিল-দস্তাবেজও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন বলে জানা যায়নি। তারা পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণ পার্যালোচনা করেছেন বলেও পত্র-পত্রিকায় রিপোর্ট আসেনি। বিচারিক আদালতের রায় সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে তারা তাকে ফাঁসির রায় দিয়েছেন। এটি সম্পূর্ণ একটি নতুন রায় এবং এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কোন সুযোগ নেই। আসামীপক্ষ থেকে রায় পর্যালোচনার কথা উঠেছিল। কিন্তু এটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী এর সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন, বলেছেন আইনে এর কোন সুযোগ নেই। আবার এটর্নী জেনারেল এও বলেছেন যে, আপিল আদালতের সংক্ষিপ্ত রায়ের ভিত্তিতে ফাঁসির আদেশ তারা কার্যকর করতে পারবেন। এজন্য পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষা করতে হবে না। একট্ িকথা তারা ঠিকই বলেছেন যে, বিদ্যমান আইনে আপিলের সুযোগ নেই। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের আপিলের সুযোগ ছিল না। কেননা আইন তাদের এই অধিকার দেয়নি। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চের দাবি প্রধানমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে তারা আইনসংশোধন করে সরকারের আপিলের বিধান সংযোজন করেছেন। যদি তখন সেটা করতে পারেন এখন আইনসংশোধন করে আসামীপক্ষের জন্য আপিলের বিধান করতে পারবেন না কেন? এই প্রশ্নে অনেকে এই বিষয়টিকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও সরকারের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেন।
আব্দুল কাদের মোল্লা প্রচলিত অর্থে কোন মোল্লা নন। আমাদের দেশে একশ্রেণীর লোক আছেন যারা ধার্মিক ব্যক্তিকে মোল্লা বলে গালি দেন। তাদের দৃষ্টিতে মোল্লারা অপদার্থ, অযোগ্য এবং সভ্য দুনিয়ার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। তারা মাদরাসা শিক্ষিতদের মোল্লা বলেন। এই আব্দুল কাদের মোল্লা ঐ ধরনের ব্যক্তি নন। তিনি আগাগোড়া একজন আধুনিক শিক্ষিত ব্যক্তি, কুরআন-হদীসের ব্যুৎপত্তি তার স্বপণোদিত। তিনি পদার্থবিদ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে এমএসসি ডিগ্রি নিয়েছেন এবং পরে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে প্রথমে ডিপ্লোমা ও পরে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এমএড ডিগ্রি গ্রহণ করেন। কুরআন-হাদীস, ফিকাহ উসূলসহ ইসলামী সাহিত্যে তার অগাধ পা-িত্য ও বিচরণ ছিল। রাজনীতিতেও তিনি ছিলেন এক অনন্য প্রতিভার অধিকারী। সাংগঠনিক যোগ্যতা ছিল তার অসাধারণ। তিনি ছিলেন সদা হাস্যময় একজন দায়ী।
তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে এ নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি রয়েছে। আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষক কয়েকদিন আগে আমাকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে একটি প্রশ্ন করেছেন। তার মতে যাহা রটে কিছু বটে। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন একজন নিরপেক্ষ সাংবাদিক হিসেবে এই অভিযোগগুলোকে আমি কিভাবে দেখি? ১৯৭১ সালে আমি পূর্ণাঙ্গ একজন সাংবাদিক এবং শিক্ষক হিসেবে ঢাকায় কর্মরত ছিলাম। ঐ সময়ে আমি অবজারভার গ্রুপের বাংলা দৈনিক পূর্বদেশের সহকারী সম্পাদক এবং ঢাকাস্থ তৎকালীন কায়েদে আজম কলেজে (বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) অধ্যাপনা করতাম। মুক্তিযুদ্ধকালীন বহু ঘটনা-দুর্ঘটনা দেখার আমার সুযোগ হয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি করার পর ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে যে হরতাল, অবরোধ ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছিল তা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। ঐ সময়ে সারা প্রদেশে আওয়ামী লীগের তা-ব ও অবাঙ্গালী বিহারীদের ওপর তাদের অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ তথা উঅঈ আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগও এই সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইয়াহিয়া খান এবং ভুট্টো গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন এবং গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয়। এর আগে তেসরা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সারা প্রদেশ আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে ছিল। শেখ মুজিবের কথায় সরকারি প্রশাসন তখন উঠ-বস করত। ঐ সময়ে সেনাবাহিনীর রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। মার্চ মাসের ১৫ তারিখে উচ্ছৃঙ্খল জনতা কর্তৃক শাহজাহানপুর বাজারে গোশত ও তরিতরকারি কিনতে আসা সেনাবাহিনীর পাঁচ জওয়ানের একটি করে কান কেটে দিতে আমি দেখেছি। তারা বিনা প্রতিক্রিয়ায় কান রেখে চলে গিয়েছিল। ২৩ মার্চ নারায়ণগঞ্জ থেকে অবাঙ্গালী মহিলা ও শিশুদের নিয়ে একটি ট্রেন ঢাকা অভিমুখে আসার পথে চাষাড়াতে তার ওপর হামলা হয় এবং মেয়েদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চলে। যুবতী মেয়েদের কারুর কারুর ব্রেস্ট কেটে দেয়া হয়। ঢাকা মেডিকেলে তা আমরা দেখেছি। বিহারীরাও বাংগালীদের ওপর তাদের সুবিধামত এর প্রতিশোধ নিয়েছে। আমারই সহকর্মী কায়েদে আজম কলেজের বাংলার অধ্যাপক রফিকউদ্দিন আহমদকে তারা টুকুরো টুকরো করে কেটে কুয়াতে ফেলে দিয়েছিল। ২৫ মার্চ কালো রাতের পর এই অবাঙ্গালীরা পাকিস্তান আর্মির সাথে একত্রিত হয়ে তাদের ওপর অত্যাচারের প্রতিশোধের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। তখনকার এই হিংসা প্রতিহিংসার রাজনীতিতে আমরা জামায়াতের বা তৎকালীন ছাত্রসংঘের কোন নেতাকে অংশগ্রহণ করতে দেখিনি। আমি ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রথমত ছাত্র হিসেবে পরে শিক্ষক সাংবাদিক হিসেবে ঢাকার রাজনৈতিক অঙ্গনের সাথে জড়িত ছিলাম। কিন্তু কাদের মোল্লা নামের কোনও ব্যক্তিকে আমি জামায়াত বা ছাত্রসংঘের হয়ে কাজ করতে দেখিনি। মিরপুরে কসাই কাদের নামে একজন কাদের মোল্লা ছিলেন তার নাম আমরা শুনেছি। তিনি পেশায় কসাই ছিলেন এবং মানুষ হত্যায়ও পারদর্শী ছিলেন। তার একভাই বহুদিন পর্যন্ত কাওরান বাজারে গোশত বিক্রি করতো। তার কাছে শুনেছি কসাই কাদের তথা মিরপুরের কাদের মোল্লাকে স্বাধীনতার পর হত্যা করা হয়েছে। আগেই বলেছি জামায়াতের কাদের মোল্লাকে ৭১ সালে আমি কখনো দেখিনি। তার বাড়ি ফরিদপুর; তিনি কখনো মিরপুরের বাসিন্দা ছিলেন না। এই অবস্থায় আমি নিশ্চিত যে কাদের মোল্লা সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং সম্ভবত কসাই কাদেরের সকল অপরাধের দায় সরকার জামায়াতের কাদের মোল্লার ওপর চাপিয়ে তাকে হত্যা করতে চান। এতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং ইসলামী আন্দোলনকে দুর্বল করার উভয় লক্ষ্যই হাসিল হবে। যেহেতু জামায়াতের কাদের মোল্লা কখনো মিরপুরে ছিলেন না, কোনও অপরাধ করেননি সেহেতু স্বাধীনতার পর থেকে ৪০ বছরের মধ্যে তার বিরুদ্ধে কোথাও কোনও জিডি হয়নি, দালাল আইনে তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়নি।
এখন তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে সেগুলোও অত্যন্ত হাস্যকর। অভিযোগের সংক্ষিপ্ত বিবরণী নি¤œরূপ ঃ
এক নং অভিযোগ : ঘটনার দিন ৫ এপ্রিল ১৯৭১- ঘটনার সময় যে কোন সময়। ঘটনার স্থান-মিরপুর ১২নং সেকশনের ঈদগাহ ময়দান থেকে শাহ আলীর মাজার পর্যন্ত। আসামী আব্দুল কাদের মোল্লা মিরপুরের সাধারণ মানুষের কাছে কসাই নামে পরিচিত। তিনি শিয়ালবাড়ি রূপনগর এবং সমগ্র মিরপুর এলাকায় হাজার হাজার বাঙ্গালী হত্যার জন্য দায়ী। ১৯৭১ সালের বিহারীদের সহযোগিতায় তিনি এ হত্যাযজ্ঞ চালান। স্বাধীনতার পর শিয়ালবাড়িতে সর্ববৃহৎ গণকবর আবিষ্কৃত হয়। ১১নং এর বাসিন্দা বাংলা কলেজের ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা পল্লবকে আব্দুল কাদের মোল্লার নির্দেশে রাজাকার আল বদররা দড়ি দিয়ে বেঁধে মিরপুর ১২নং সেকশন থেকে এক নম্বরের মাজার পর্যন্ত টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যান। তারা পল্লবের শরীর বেঁধে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখে। তার আঙ্গুল কেটে নেয়া হয়। দুইদিন পর অর্থাৎ ৫ এপ্রিল আব্দুল কাদের মোল্লার ডানহাত বলে কথিত আলবদর আক্তার তাকে গুলী করে হত্যা করে। তার দুইদিন পর তার মৃতদেহ কালাপানির ঝিলের পাশে অন্যান্য ৭ জনের পাশে দাফন করা হয়।
দুই নং অভিযোগ : ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের যে কোন দিন। সময়- যে কোন সময়। ঘটনাস্থল : মিরপুরের ৬নং সেকশন। আব্দুল কাদের মোল্লা এবং তার সহযোগীরা মিরপুর ৬ নম্বরের বাসিন্দা মহিলা কবি মেহেরুননিসাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। এই নিষ্ঠুরতা দেখে মিরাজ নামে এক ব্যক্তি তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তিনি এখনো জীবিত আছেন।
তিন নং অভিযোগ : ঘটনার দিন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত। ঘটনার সময় : যে কোন সময়। ঘটনাস্থলÑমনিপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়াসহ মিরপুর ১২নং সেকশনের বিভিন্ন ব্লক ও বাড়ি। কাদের মোল্লা মুক্তিযুদ্ধকালে মিরপুর ১২ নং সেকশনের মনিপুর কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়ার নিরীহ হাজার হাজার বাঙ্গালীকে তার সহযোগী রাজাকার, আলবদর ও স্থানীয় বিহারীদের সহায়তায় বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে অপহরণ ও হত্যা করে এবং তাদের মৃতদেহ শিয়ালবাড়ি, রূপনগর এবং বালুর মাঠে কবর দেন।
চার নং অভিযোগ : ঘটনার তারিখ ২ এপ্রিল ১৯৭১ সাল। ঘটনার সময় ঐদিনের যেকোন সময়। ঘটনার স্থান মিরপুর, কল্যাণপুর ও মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকা। আব্দুল কাদের মোল্লা তার সহযোগী রাজাকার, আলবদর এবং বিহারীদের সাথে নিয়ে মিরপুর, কল্যাণপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, নিরপরাধ বাঙ্গালিদের হত্যা এবং মহিলাদের ধর্ষণ, নির্যাতনের মাধ্যমে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেন এবং এ জন্যে তাকে স্থানীয় বাসিন্দারা কসাই নামে অভিহিত করত।
৫নং অভিযোগ : ঘটনার তারিখ ২৯ মার্চ ১৯৭১ সাল। ঘটনার সময় বিকাল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। ঘটনার স্থান মিপুর ১০নং বাসস্ট্যান্ড ও মিরপুর জল্লাদ খানা। মিরপুর ১০নং সেকশনের বি-ব্লকের ২নং সড়কের ১৩নং প্লটের মরহুম খন্দকার আব্দুর রউফের পুত্র খন্দকার আবু তালেব ঢাকার আরামবাগ থেকে ২৯.০৩.১৯৭১ ইংরেজি তারিখে তার ঘর-দুয়ারের সর্বশেষ অবস্থা দেখার জন্যে মিরপুরে আসেন। তিনি দেখতে পান যে, তার ঘরদুয়ার সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পরে তিনি আরামবাগ ফিরে যাওয়ার জন্যে ১০নং সেকশনের বাসস্ট্যান্ডে আসেন। সেখান থেকে আব্দুল কাদের মোল্লা এবং তার সহযোগীরা অপহরণ করে দড়ি দিয়ে বেঁধে জল্লাদ খানা পাম্প হাউজে নিয়ে যায়। সেখানে তারা তাকে গলা কেটে হত্যা করে।
৬নং অভিযোগ : ঘটনার তারিখ ২৫.১১.১৯৭১। ঘটনার সময় সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ১১টা। ঘটনার স্থান কেরানীগঞ্জ থানার শহীদনগর। পাকিস্তানী সৈন্যরা ঐদিন ও ঐ সময়ে রাজাকার, আল বদর ও আল শামসদের সাথে নিয়ে ভাওয়াল খান বাড়ি, ভাটারার চর (শহীদনগর) এবং পার্শ্ববর্তী দুইটি গ্রামের নিরপরাধ, নিরস্ত্র লোকের ওপর ব্রাশ ফায়ার করে।
তারা আব্দুল কাদের মোল্লা, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও কামারুজ্জামানের নির্দেশে এই হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং মোজাফফর আহমদ খানের বাড়িসহ দুটি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, তারা শহীদনগর ও ভাওয়াল বাড়ির ১০ জন লোকসহ বহুলোককে হত্যা করে। তিনি পাকিস্তানী সৈন্যদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন।
৭ নং অভিযোগ : ঘটনার তারিখ : ২৪-৪-১৯৭১ সাল। ঘটনার সময় : ভোর প্রায় সাড়ে ৪টা। স্থান-আলমদী, মিরপুর (পল্লবী)। ঘটনার দিন-ফজরের নামাযের পর তুরাগ নদীর পাড়ে আলমদী গ্রামে পাকিস্তানী সৈন্যরা হেলিকপ্টার যোগে অবতরণ করে। পুর্বদিক থেকে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে ৫০ জন রাজাকার ও বিহারীরা এসে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে যোগ দেয় এবং গ্রামকে ঘিরে ফেলে। এরপর তারা বেপরোয়াভাবে গুলী চালায় এবং ৩৪৪ জন লোক এতে নিহত হয়। অভিযোগপত্রে ২৩ জনের একটি তালিকা দেয়া হয়। এই ২৩ জনের মধ্যে তিনজনের বাপের নাম আছে আর কারোর বাপের নাম বা ঠিকানা নেই। জনাব আব্দুল কাদের মোল্লাকে এই হত্যাকা-ের জন্য দায়ী করা হয়েছে।
উপরোক্ত অভিযোগগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এর মধ্যে কোনটিই সুনির্দিষ্ট নয়। কাদের মোল্লা কাউকে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন করেছেন অথবা বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছেন সরাসরি এমন কোন অভিযোগ নেই। বলা হয়েছে যে, তার নির্দেশনায় ও পরামর্শে রাজাকার আল-বদররা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই অপরাধগুলো করেছে। এই অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে, যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেয়া যায় যে, তিনি মিরপুরে ছিলেন তাহলেও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং রাজাকার আলবদরদের কমান্ড করার অথরিটি তিনি পেলেন কোথায়? সেনাবাহিনী কেন তার কথা শুনল? তিনি কি সেনাবাহিনীর জেনারেল বা ফিল্ড মার্শাল ছিলেন? ৫ এপ্রিল (চার্জ নং-১); ২ এপ্রিল (৪ নং চার্জ); ২৯শে  মার্চ এবং ২৪ এপ্রিলের যে অভিযোগগুলো তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, তিনি তার সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আল শামস এবং সেনাবাহিনীকে বর্ণিত অপরাধসমূহ সংঘটনে নির্দেশদাতা হিসেবে কাজ করেছেন এর বাস্তবতা খুঁজে পাওা যায় না। কেননা ঐ সময়ে রাজাকার, আলবদর, আলশামস গঠিতই হয়নি। রাজাকার বাহিনী প্রথম গঠিত হয়েছিল ময়মনসিংহ জোনের সামরিক প্রশাসক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ারের নির্দেশনায় নেত্রকোনা মহকুমায় এবং এর বহু দালিলিক প্রমাণ রয়েছে। এই ব্যাপারে প্রথম সিদ্ধান্ত হয় কর্নেল সারোয়ারের নেতৃত্বে নেত্রকোনায় মহকুমা প্রশাসকের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ২৫ শে মে তারিখের একটি সভায়। কেউ কেউ জামায়াত নেতা মাওলানা ইউসুফকে রাজাকার বাহিনীর প্রথম সংগঠক হিসেবে অপপ্রচার করে থাকেন এটি ডাহা মিথ্যা। যে তারিখে যেই বাহিনীর অস্তিত্বই ছিল না সেই তারিখে যে বাহিনীকে হত্যা, অগ্নিসংযোগের নির্দেশ দেয়ার বিষয়টি হাস্যাস্পদ। আবার ২৯ মার্চ, ২রা এবং ৫ এপ্রিল (চার্জশিট অনুযায়ী আসলে অপরাধটি হয়েছিল ৩ এপ্রিল) জনাব কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যে অপরাধ করার কথা বলা হয়েছে সেগুলোও অবাস্তব। কেননা ২৯ শে মার্চ অপরাধের যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে ঐ সময়ে মিরপুরসহ সারা ঢাকায় কারফিউ বলবৎ ছিল। একই অবস্থা ছিল এপ্রিলের ২ ও ৩ তারিখে। এই অবস্থায় কাদের মোল্লার বিচারকে যারা ন্যায়ভ্রষ্ট বলেন তারা অন্যায় কিছু বলেন বলে আমার মনে হয় না। কাদের মোল্লাসহ যে সমস্ত জামায়াত নেতাকে মানবতা বিরোধী তথাকথিত অপরাধের দায়ে সরকার যে বিচারের উদ্যোগ নিয়েছেন তা আসলে বিচারের জন্যে নয়, ফাঁসি দেয়ার জন্যই। এটা তাদের গ্রেফতার প্রক্রিয়া ও বিচার প্রক্রিয়াতেই বোঝা গেছে। কাদের মোল্লাকে যেদিন গ্রেফতার করা হয়েছে সেদিন তার ছেলে এবং মেয়ের জামাইকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে তার স্ত্রীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে তার বিচারের রায় সম্পর্কে সরকার যখন আগেভাগেই বুঝতে পারলেন যে, বিচারকরা ফাঁসির রায় দেবেন না তখনই তারা গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি করে যেখানে দুগ্ধপোষ্য শিশুর মুখেও ফাঁসির শ্লোগান দেয়ালেন। আপীলেট ডিভিশনের একজন বিচারক আপীল রায়ের পাঁচদিন আগে লন্ডন গিয়ে বলে আসলেন কাদের মোল্লার ফাঁসি হবে এবং রিভিউর সুযোগ থাকবে না। সাথে সাথে ফেসবুকে আমরা খবর পেলাম এবং পাঁচদিন পর দেখা গেল যে, তার কথাই সত্য। এই অবস্থায় কেউ কি বলবেন যে এই রায় ন্যায়ভ্রষ্ট নয়?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads