রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

নির্বাচন সংস্কৃতি : বাংলাদেশ বনাম বহির্বিশ্ব

দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রোপট বিবেচনা করে এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো একটি সভ্য দেশে দীর্ঘ প্রবাস যাপনের অভিজ্ঞতার আলোকেই লেখাটি লিখছি। গত ৭ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের আগে ও পরে পুরো অস্ট্রেলিয়ায় একজন নাগরিক খুন হওয়া তো দূরের কথা, কোথাও কোনো হানাহানির ঘটনা শুনিনি। শোনা যায়নি একদলের কর্মী অন্য দলের কর্মীকে হুমকি-ধমকি দিতে। ছিল না কোনো ভোটকেন্দ্র দখল বা পুলিশি অ্যাকশানের ঘটনা। এমনকি দেখা যায়নি কোনো পাবলিক স্পটে মিছিল, মিটিং বা মাইকিং হতে। শুধু একটাই সমস্যাÑ ভোট না দিলে ৭২ ডলার জরিমানা গুনতে হবে এবং যথাযথ কারণ দর্শিয়ে চিঠি দিতে হবে। যদিও ভোট দেয় না এমন লোক পাওয়া বেশ কঠিন হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দিন থেকে নতুন সরকারের হাতে মতা হস্তান্তরের সময় পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার সর্বত্রই নির্বাচনী পরিবেশ থাকে নিজের ঘরের মতোই শান্ত ও শান্তিপ্রিয়। অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাচনের দিন অনেকটাই ঈদের ঠিক পরের দিনের ঢাকা শহরে পরিণত হয়। মানুষের কোলাহল খুব একটা চোখে পড়ে না। তা ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার সব নির্বাচন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হওয়ায় মানুষের কর্ম ব্যস্ততা চোখে পড়ে না বললেই চলে। অন্যান্য নির্বাচনের মতো এবারো ভোট চলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। যাবো যাবো করে অবশেষে কেন্দ্রে গেলাম বেলা আড়াইটার পর। থ্যাঙ্কস গড। দেশে থাকলে ওই সময় নাগাদ হয়তো শুনতাম ইতোমধ্যেই আমার ভোট দেয়া হয়ে গেছে। এবারো ভোটকেন্দ্রের সামনে হাতেগোনা চার-পাঁচজন দলীয় এজেন্ট দাঁড়িয়েছিল। এরা বেশ আন্তরিকতার সাথে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করে। এরা হাতে নিজ নিজ দলের পোস্টার বা লিফলেট বহন করলেও কোনো ভোটারকে তাদের প্রার্থীকে ভোট দিতে প্রভাব বিস্তার করে না। কিভাবে ব্যালটে ভোট দান করতে হবে সে বিষয়ে বিশেষত পরামর্শ দিয়ে থাকে। এ ছাড়া উন্নত বিশ্বের লোকজন কোনো দলের প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে কেউ নাক গলাতে আসুক মোটেও পছন্দ করে না। ভোটারেরা বেশ কিছু দিন ধরেই দুই দলের নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো পর্যবেণ করে এবং কোন বিষয়গুলো জনগণ ও দেশের উন্নয়নে যুগোপযোগী ভূমিকা রাখবে, অতীতে মতাসীনেরা সরকারে থেকে জনগণের ওয়াদার কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছে ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করেই ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। উন্নত বিশ্বে জবাবদিহিতার রাজনীতি বিদ্যমান বলেই রাজনীতিবিদদের ওপর জনগণের আস্থা আছে ও তারা নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করার উদ্দেশ্যেই রাজনীতি করেন। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যেই দেশের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বেসরকারি ফলাফল আসতে শুরু করে। প্রায় তিন ঘণ্টার মধ্যেই বেশির ভাগ আসনের ফলাফলের ভিত্তিতে নির্ধারণ হয়ে যায় কোন দল সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। দেশের প্রধান দুটি দল হচ্ছে লেবার পার্টি ও লিবারেল পার্টি। এবার লিবারেল গত এক শতাব্দীতে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে লেবারকে হারিয়ে সরকার গঠন করেছে। দেশের অনেক ভোট কেন্দ্রে যখন অবশিষ্ট ভোট গণনা চলছিল, পরাজিত দলের নেতা ও বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে বিজয়ী দলের নেতা টনি অ্যাবটকে স্বাগত জানাতে ফোন করেন। এরপর কিছুণের মধ্যেই দলীয় সমর্থকদের সামনে এসে দুই দলের নেতাই পৃথক পৃথক বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে দুই দলের প্রধানই এ ফলাফল বা বিজয়কে জনগণের বিজয় বলে উল্লেখ করেন। কোনো প্রার্থীই নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন বা কারচুপির কোনো অভিযোগ আনেননি। কেউ কারো বিরুদ্ধে সামান্য ােভ নিয়ে কথা বলেননি। বরং দুই দলই আগামী দিনের অস্ট্রেলিয়া কেমন হবে, দেশ শিা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, বৈদেশিক সম্পর্কোন্নয়ন ইত্যাদিতে কিভাবে আরো অগ্রসর হবে সে বিষয়ে কথা বলেন। অপর দিকে আমাদের বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ক্রমেই অন্ধকার যুগে পা রাখছে। গত কয়েক বছর ধরে দেশের টিভির খবর দেখতে বসলেই বুঝে উঠতে পারি না, এটা বাংলাদেশ নাকি আফগানিস্তান, ইরাক, মিসর কিংবা সিরিয়ার মতো কোনো দেশ। আমাদের প্রিয় এ জন্মভূমি তো এমনটি ছিল না। এ অবস্থার জন্য আমি দেশের মানুষের চেয়ে কিছু রাজনীতিবিদের সরাসরি দায়ী করতে চাই। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী রক্তয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে নামে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও মানুষের স্থায়ী রূপ এখনো দেখতে পায়নি। প্রতিবারই দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নির্বাচন তথা মতা হস্তান্তরকে কেন্দ্র করে দেশের ১৬ কোটি মানুষকে এক ধরনের বলির-পাঁঠায় পরিণত হতে হয়। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসে ততই মতার অপব্যবহার, একে অন্যের প্রতি বিষোদগার, ােভ, ঘৃণা, হুমকি-ধমকি, হরতাল, অবরোধ, বোমাবাজি, মামলাবাজি, মারামারি, কাটাকাটি, খুন ইত্যাদি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কয়েকশ লোক নিহত হয় ও কয়েক হাজার লোক আহত হয়। সবার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করে। একই সাথে সবাই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে দেশে কোনো পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে দেশের মানুষ কমপে দুই বছরের জন্য স্বস্তি পাবে সে আশায় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কামনা করে। অবশেষে অনেক জল্পনা-কল্পনার মধ্য দিয়ে নিরপে সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন করা হলেও সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হয় না। নির্বাচনের দিন কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতেই রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যকে বিভিন্নভাবে দোষারোপ শুরু করে। কেউ বলে নিখুঁত কারচুপি হয়েছে, কেউ বলে সূক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপি ইত্যাদি বিভিন্ন সংজ্ঞা মিডিয়ায় তুলে ধরে। বিশেষ করে যে দল হারতে বসে তারা সহজে জনতার রায়কে মেনে নিতে অপারগতা প্রকাশ করে। অবশেষে অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই রায় মানতে বাধ্য হয়। কারণ নির্বাচন কোনো দলীয় সরকারের অধীনে হয়নি। দেশের প্রায় সর্বেেত্রই অনগ্রসরতা ও স্থিতিশীলতার অভাব, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, খুন, নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি ঘটনার ফলে দেশে বিদেশের অনেক মানুষের মুখে প্রায়ই শুনা যায়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এর কোনো পরিবর্তন কেয়ামত পর্যন্ত হবে না। তাদের কথায় যুক্তি থাকলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাংলাদেশও কয়েক বছরের মধ্যে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মধ্যম আয়ের শান্তিপ্রিয় দেশ হতে পারে। এত সমস্যার পেছনে সাধারণ মানুষের দোষ। সর্বেেত্রই স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ, অদ লোকের হাতে মতায়ন, রাজনীতিবিদদের জবাবদিহিতার অভাব, আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং আইন না মানলে মানাতে বাধ্য না করানোই এর মূল কারণ। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের মতো এত জনবহুল দেশে সুস্থ নির্বাচনের পরিবেশ বাস্তবায়ন অসম্ভব। অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা কম, তাই সেখানে সমস্যা কম, ফলে নিরপে নির্বাচন সম্ভব। ইন্দোনেশিয়া, জাপান, যুক্তরাজ্যও বেশ জনবহুল দেশ। তা ছাড়া আমাদের পাশের দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বার্মা বিভিন্ন দেশেও যদি অপোকৃত সুস্থ ধারার রাজনীতি বিদ্যমান থাকে, তাহলে বাংলাদেশে সমস্যা কোথায়? দেশের অনেক লোক দেশের বাইরে থাকে ও এ সংখ্যার এক বিশাল অংশ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে অতি সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। অনেকেই বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুনাম বাড়িয়ে চলেছেন এবং কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ওই দেশের সরকার থেকে পুরস্কৃতও হয়েছেন। আবার যারা দেশের নীতিনির্ধারক, বুদ্ধিজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক, প্রবীণ সাংবাদিক এবং প্রথম সারির রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত, তাদের বেশির ভাগই উচ্চশিায় শিতি। কাজেই এদের কোনোটাই প্রমাণ করে না আমরা অসভ্য বা বর্বর জাতি। বাংলাদেশের নির্বাচনী হাওয়া বর্তমানে এমন গতিতে বইছে ইতোমধ্যেই পশ্চিমা দেশগুলোতেও এ বাতাস বইতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিরতা নিয়ে নিয়মিত আলোচনা হয় বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে। আজ জাতিসঙ্ঘের প্রধান, কাল ইউরোপীয় প্রতিনিধি দল, পরশু অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি দল আসছে বা বার্তা পাঠাচ্ছে। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশীদের নাক গলানো এক দিকে যেমন দুঃখজনক, অন্য দিকে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমর্যাদা ুণœ হতে যথেষ্ট। তবে ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, একটি দেশ যখন অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে, তখনই বিদেশীরা হস্তপে করে। এ ধরনের সমস্যার সমাধানের জন্যই জাতিসঙ্ঘের মতো সংগঠনের জন্ম হয়েছে। উন্নত দেশগুলোরও করার কি আছে। তারাও বাংলাদেশের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। ব্যবসায়িক খাতে এরা কয়েকশ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে রেখেছে। দেশের রাজনৈতিক রোষানলে পড়ে তারাও ব্যবসায়িকভাবে বেশ তিগুস্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেক দেশ বিভিন্ন খাতে নতুনভাবে বিনিয়োগ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে, এবং কেউ কেউ ব্যবসায় গুটিয়ে নেয়ারও পাঁয়তারা করছে, যা দেশের অর্থনীতিকে ক্রমেই হুমকির দিকে ঠেলে দিতে পারে। অন্য দিকে, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগ মুহূর্তে তৃতীয় শক্তি আতঙ্কে ভোগে। অথচ এরা একবার চিন্তা করে না এ তৃতীয় শক্তির আগমন এমনি এমনিতেই হয় না। বিশেষ করে, বড় দুই রাজনৈতিক দলের সহিংসতা ও পারস্পরিক সমঝোতার অভাবেই এর সৃষ্টি হয়। রাজনীতিবিদেরা এ তৃতীয় শক্তিকে কুনজরে দেখলেও আমি দেশের জনসাধারণের সাথে সহমত পোষণ করছি। তৃতীয় শক্তি এলে এটা নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় কমপে দেশের সাধারণ মানুষ কিছু দিন নিরাপদে চলতে পারে, শান্তিতে ঘুমোতে পারে, নিজেদের স্বাধীন দেশের নাগরিক মনে করে। কারণ দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীরা হয়তো শ্রীঘরে থাকে অথবা গা ঢাকা দেয়। দেশের অনেক অনিয়মই নিয়মের মধ্যে চলে আসে। তা ছাড়া গত ২৩ বছর ধরে দেখছি বিভিন্ন সরকারের আমলে হাতেগোনা কিছু মন্ত্রী দেশাত্মবোধ থেকে তাদের নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে কিছু কাজ করলেও, কোনো বিশেষ সরকার দেশের জন্য এককভাবে এমন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি, জনগণ তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পরপর একই দলকে মতায় দেখতে চায়। আর এখানেই বাংলাদেশের সাথে অন্যান্য দেশের রাজনীতির মধ্যে মৌলিক তফাৎ। এরই এক বাস্তব উদাহরণ আমরা দেখেছি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় নির্বাচনে। জনগণের কাছে দেয়া অনেক ওয়াদাই যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি বলে জনগণও সে মোতাবেক রায় দিয়েছে। এবং সে ব্যর্থতার দায় অবশেষে বিদায়ী সরকার হাসিমুখে বরণও করেছে। এ থেকেও আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের অনেক কিছুই এখনো শেখার আছে। গত কয়েক মাস ধরেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যকে সংলাপে বসার আহ্বান জানাচ্ছে। আবার বসছেও না। ফলে এখন চলছে একে অন্যের প্রতি দোষারোপের রাজনীতি। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেহেতু বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ কেহই কারো কথা মানতে নারাজ, তাদের সামনে এখন একটি পথই খোলা আছে। দেশের যারা নির্দলীয় বুদ্ধিজীবী ও প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক দেশের সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। এর নাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারই হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads