শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

আমরা মহৎ কাজের স্বীকৃতি দিতে জানি না


পৃথিবীর অন্যান্য দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সাথে আমাদের স্বাধীনতা-যুদ্ধের অনেক তফাৎ। প্রত্যেক দেশের স্বাধীনতাকামীদের সামনে থাকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। এর ওপর ভিত্তি করেই স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হয়ে থাকে। প্রথমেই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। আমাদের আন্দোলন ছিল ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে। ৭১-এ যেদিন ঢাকার বুকে আর্মি ক্র্যাকডাউন হয়, সেদিনও স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়া হয়নি। সেদিন বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের ময়দানে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব না দিয়ে ২৫ মার্চ আর্মির কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দিলেন। উল্লেখ্য, ২৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আলোচনার সমাপ্তি ঘটে। মুজিব বেরিয়ে এসে বলেন, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। আগামীকাল রাত ১২টার পর আর্মি ক্র্যাকডাউন হবে। রাস্তায় ট্যাংক নামবে।তিনি সব পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের ঢাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে ২৫ তারিখে আওয়ামী লীগের বেশ কিছু সিনিয়র নেতা উপস্থিত ছিলেন। এরা তাকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছিলেন। তারা বলেন, আর বিলম্ব করা ঠিক হবে না, চলুন, আমরা বেরিয়ে পড়ি। বঙ্গবন্ধু বললেন, কোথায় যাবো? আমাকে না পেলে আর্মি ঢাকা শহর ধ্বংস করে দেবে। শুনে তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ক্র্যাকডাউন হলে এমনিতেই আর্মি ঢাকা শহর ধ্বংস করে দেবে। আপনি আমাদের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। এখন আপনার নেতৃত্বের আরো বেশি প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু বললেন, তোরা বেরিয়ে পড়। আমার বাড়ি কমান্ডোরা ঘিরে রেখেছে। তাজউদ্দীন বললেন, আমরা ভারতে গিয়ে কী বলব। আপনি তো স্বাধীনতা ঘোষণা দেননি। মুজিব তখন বললেন, আমি ফজলুল হক মণি আর সিরাজুল আলম খানকে চিত্তরঞ্জন সুতারের কাছে পাঠিয়েছিলাম, সে তোদের জন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছে কলকাতায়। তাজউদ্দীন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন, আপনি ভারতের সরকারি পর্যায়ের কারো সাথে আলাপ করেননি। বঙ্গবন্ধু মুজিব আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। সবাইকে ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যেতে বললেন। ক্র্যাকডাউন হলো রাত ১২টার পর। ঢাকার বস্তি ও বাজার ধ্বংস করা হলো। শাঁখারীবাজারসহ বহু জনপদ ধ্বংস করে দিলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের সে বাসভবনে আর্মি গিয়ে পৌঁছল রাত পৌনে ১টায়। প্রথমে তারা গেটের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করল। বঙ্গবন্ধু নিচে তাদের অপেক্ষায় ছিলেন। কর্নেল তাকে স্যালুট করল। বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে কর্নেলের সাথে জিপে গিয়ে উঠলেন। পরের দিন তাকে বিমানে রাওয়াল পিন্ডি পাঠানো হলো। এদিকে আর্মি ঢাকা শহর লণ্ডভণ্ড করে ছাড়ল। দেশের মানুষ হাহাকার করতে লাগল, এখন কী হবে। সামনে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ক্র্যাকডাউনের পৈশাচিক হামলার পর পাকিস্তানের সাথে একত্রে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু মানুষের মনে প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু কেন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না? কারো মনে প্রশ্ন, তবে কি তিনি পাকিস্তানেই থাকতে চেয়েছিলেন। এ দিকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান তার রেজিমেন্টের জোয়ানদের নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছিলেন, are at war with Pak army তিনি বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে কালুরঘাট রেডিও স্টেশনের কাছাকাছি গিয়ে অবস্থান নিলেন। রেডিও স্টেশনের টেকনিশিয়ানদের ধরে আনা হলো। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা আব্দুল হান্নান সহায়তা দিয়েছেন। রেডিওতে ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন জিয়া। এই ঘোষণায় মানুষের মনোবল চাঙ্গা হয়ে উঠল। যুবসমাজ দেশকে মুক্ত করার শপথ নিলো। এরপর মুক্তিযুদ্ধকে সুসংহত করল তাজউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। জিয়াউর রহমান শুধু যে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন তা নয়, তিনি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। অসম সাহসিকতার সাথে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। কিন্তু সেই জিয়াউর রহমানের অবদানের স্বীকৃতি না দিয়ে একটি মহল থেকে বলা হলো, ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসে স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার জন্য চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার ভূমিকার মর্যাদা দেয়ার পরিবর্তে তাকে হেয় করার চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ দল ও তাদের সরকার। তাকে রাজাকার বলেও টিটকারি করা হয়েছে আওয়ামী লীগ থেকে। জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তুঙ্গে। বঙ্গবন্ধু সেদিন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। তাই যুদ্ধে অবদান রাখা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। নমাস পর দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। তিনি পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিলেন। তার সময় থেকেই জিয়াউর রহমানকে হেয় করার চেষ্টা চলেছে। যেসব প্রতিষ্ঠানে জিয়ার নাম প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল সেসব স্থান থেকে জিয়াউর রহমানের নাম মুছে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর নাম বসান। দলীয় স্বার্থে জিয়াকে সর্বতোভাবে বাংলার বুক থেকে নির্বাসন দেয়ার চেষ্টা চলছে। কিছু দিন আগে কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাবেক চিফ বেলাল মোহাম্মদ ইন্তেকাল করেছেন। অনেকেই শোকবার্তা পাঠিয়েছেন বিভিন্ন পত্রিকায়। বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ক্ষেত্রে বেলাল মোহাম্মদের নাম অমর হয়ে থাকবে। কিন্তু আশ্চর্য, সেখানে জিয়াউর রহমানের নামের উল্লেখ নেই। আমরা কত অকৃতজ্ঞ। স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর পরে যাকে সর্বোচ্চ আসনে বসানো উচিত ছিল, তাকে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসন দেয়ার চেষ্টা চলছে। বঙ্গবন্ধু ৬ দফার আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশকে মূল পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন করার কথা প্রথমে নেভির কমান্ডার মোয়াজ্জম হোসেন চিন্তা করেছিলেন। তিনি নৌবাহিনী, স্থল বাহিনী ও বিমানবাহিনীর বাঙালি জুনিয়র অফিসারদের নিয়ে একটি ইউনিট গঠন করেন। এদের উপদেষ্টা ছিলেন ঝানু সিএসপি অফিসার রুহুল কুদ্দুস, খান শামসুর রহমান, আহমাদ ফজলুর রহমান প্রমুখ। তাদের পরামর্শে মোয়াজ্জম হোসেন শেখ মুজিব ও মন্ত্রী সবুর খানের সাথে দেখা করে তাদের পরিকল্পনার কথা জানান। তারা উভয়েই মোয়াজ্জমকে উৎসাহিত করেন। ইতোমধ্যে শেখ মুজিব ৬ দফা আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে তখন কারাগারে। এ সময় আইয়ুব খান চিটাগাংয়ে আসেন, তখন তাকে নাকি হত্যা করার ষড়যন্ত্র করা হয়। মোয়াজ্জমের একজন কর্মী ধরা পড়ে। সে স্বীকারোক্তিতে আইয়ুব খানকে হত্যা করে বাংলাদেশ স্বাধীন করার কথা বলে ফেলে। সে শেখ মুজিবের সাথে মোয়াজ্জমের যোগাযোগের কথাও প্রকাশ করে দেয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয় এর ভিত্তিতে। শেখ মুজিবের সম্পৃক্ততা না থাকলেও তাকে ১ নম্বর আসামি করা হয় মামলাটিতে। মোয়াজ্জম ২ নম্বর আসামি। মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। মামলার ধারা বিবরণী খবরের কাগজে প্রকাশিত হলে দেখা গেল, শেখ মুজিবের ষড়যন্ত্র মামলার সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তার রাজনৈতিক জীবনকে নিঃশেষ করার জন্য এই মামলায় তাকে জড়িত করা হয়েছিল। আন্দোলন শুরু হয়ে গেলÑ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করো, শেখ মুজিবকে মুক্তি দাও।ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯ সালে ১১ দফা দাবি নিয়ে এগিয়ে এলো। ছাত্রদের প্রচণ্ড আন্দোলনে ঢাকা শহর প্রকম্পিত হয়ে উঠল। মামলা প্রত্যাহার হলো। তখন শেখ মুজিব বলেছিলেন, আমার ৬ দফা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার মধ্যে লীন হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি ৬ দফা নিয়েই এগিয়ে গেছেন। পিন্ডিতে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে তিনি ১১ দফার কথা না বলে ৬ দফার কথা বলেন। ফলে আলোচনা ভণ্ডুল হয়ে যায়। এ দিকে যে মোয়াজ্জম দেশকে স্বাধীন করার প্রথম চেষ্টা করেছিলেন, তিনি ২৫ মার্চ চিরতরে হারিয়ে গেলেন; তার কোনো খবরই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাখেনি। তাকে সম্মান দেখানো হয় না। স্মরণ করা হয় না। ক্র্যাকডাউনের সময় পাক আর্মি তার বাসায় ঢুকে তাকে হত্যা করে সাথে সাথে। বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় যার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকার কথা, ইতিহাসে তার অস্তিত্ব মুছে ফেলার চেষ্টাই হয়েছে।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads