শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

মনে হয় মাতৃগর্ভ থেকে তাদের জন্ম হয়নি

প্রত্যেক মানুষেরই জন্ম হয়েছে মাতৃগর্ভে; সে নারী কিংবা পুরুষ যেই হোক না কেন, এমনকি টেস্টটিউব বেবি বলতে যা আমরা বুঝি তাকেও কোনো-না-কোনো নারীর গর্ভে জন্ম নিতে হয়। ডিম্বটি শুধু নিষিক্ত হয় গর্ভের বাইরে। বাকি সব প্রাকৃতিক নিয়মেই। এই প্রক্রিয়া মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। প্রতিটি প্রাণী প্রজাতির ভেতরেই নারী-পুরুষ আছে। তা সে বিন্দুর আকারেই হোক আর তিমির আকারেই হোক। কয়েক দিন ধরে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের উসকানিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত গার্মেন্ট শিল্পে বিরাট অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা আঁতাতের নির্বাচন করে যে চমকের মন্ত্রিসভা গঠন করেন তাতে তখনই গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়। এই চমকের মন্ত্রিসভার প্রায় সবাই ছিল অনভিজ্ঞ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদ্যাহীন। কেউ কেউ বিউটি পার্লারচর্চিত। সন্দেহ নেই, চমক তাতে সৃষ্টি হয়েছিল বটে। এমন বহু লোক মন্ত্রী হয়েছেন, যাদের নামও আগে কেউ শোনেনি। জাতীয় রাজনীতিতে যাদের কোনো অবদানই নেই। আওয়ামী লীগকে মানি বা না মানি, এটি একটি বড় রাজনৈতিক দল। আর এই দলের প্রধান বৈশিষ্ট্য আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা যদি কোনো কথা বলেন, তাহলে দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে তার যে সমর্থক রয়েছেন, তারাও একই সুরে আওয়াজ তোলেন। এই দলের নেতাকর্মী, সমর্থকদের মধ্যে শিক্ষার বড় অভাব। যুক্তি এখানে পরাভূত। কিন্তু চিরদিন কি আর হুক্কাহুয়া ধ্বনি তুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে? এই যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল নগরে, শহরে বিলবোর্ড দখল করে উন্নয়নের প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে, তখন সে দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি। আহা, কী সব মিষ্টিকথা শুনেছিলাম! ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়াবেন। মহান আল্লাহ তায়ালা হয়তো সেই অবস্থায় আমাকে রাখেননি। শেখ হাসিনা যদি সত্যি সত্যিই ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়াতে পারতেন, সেই চালের লাইনে আমি হয়তো দাঁড়াতাম না। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে এ রকম মোটা চালের দীর্ঘ লাইনে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। সাবাস, শেখ হাসিনা। আমি ১০ টাকা কেজি দরের চাল খেতে চাইনি। কিন্তু এ রকম কোটি মানুষ আছে, যাদের আয় উপার্জন আমার থেকে অনেক কম। আর শেখ হাসিনা যদি সত্যি সত্যিই তাদের জন্য ১০ টাকা কেজি দরে চালের ব্যবস্থা করতে পারতেন, তবে তারা শেখ হাসিনাকে ধন্য ধন্য করতেন। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়েই তিনি একেবারে ভোল পাল্টে ফেললেন। অস্বীকার করে বসলেন, তিনি এমন প্রতিশ্রুতি কখনো দেননি। বরং বলতে শুরু করলেন, চালের কেজি ১০ টাকা করলে কৃষক মাঠে মারা যাবে। তাদের উৎপাদন খরচ পোষাবে না। সুতরাং চালের দাম বাড়াতেই হবে। আমরা তো এই ভেবে বিস্মিত হয়েছিলাম যে, শেখ হাসিনা কোন আক্কেলে এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন। যখন তিনি ওই রকম ওয়াদা করেন, তখন সাধারণ বাজারে চালের কেজি ছিল ১৭ টাকা। সেখানে ভর্তুকি দিতে হয়নি। সেটাই ছিল সাধারণ বাজার দর। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ক্ষমতায় গেলে কৃষককে বিনামূল্যে সার দেবেন। ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে। সার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পানিÑ কোনো কিছুরই অভাব হবে না কৃষকের। কিছু কিছু ঘোষণা শুনে তখন অবাক হয়েছি। ভেবেছি, এই যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন শেখ হাসিনা, সেটা রক্ষা করা কি তার পক্ষে সম্ভব হবে? ঢাকা কারওয়ানবাজারে এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, তাকে নির্বাচিত করলে, যা চান তাই তিনি দেবেন। কেউ যদি গান ধরত তোরা যে যা বলিস ভাই/ আমার সোনার হরিণ চাই’, তাহলে কি শেখ হাসিনা তাকে সোনার হরিণ এনে দিতেন। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেছিলেন, দেশ বিদ্যুতে ভাসিয়ে দেবেন। বিএনপি সরকার বিদ্যুৎ উন্নয়নের নামে শুধু খাম্বা লাগিয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি। তিনি তখন শুধু খাম্বা দেখছিলেন। বিদ্যুৎ পাচ্ছিলেন না। এই ছিল তার অভিযোগ। খাম্বার অনেক দোষের কথা শুনেছিলাম। খাম্বা কিনে নাকি তারেক রহমান ও তার বন্ধুএকেবারে লালে লাল হয়ে গিয়েছিলেন। এই খাম্বা নিয়ে হাসাহাসি কম হয়নি। এখন বিদ্যুৎ নেই। অথচ শেখ হাসিনা সরকারও হাজারে হাজারে খাম্বা কিনছেন। খাম্বা লাগাচ্ছেন। এই খাম্বা কাহিনীও পরে প্রকাশিত হয়েছিল। খাম্বার বেশির ভাগ শেয়ার ছিল এক আওয়ামী লীগারেরই। বিদ্যুৎব্যবস্থা এখন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। বিদ্যুতের জন্য যখন সাধারণ মানুষ মিছিল করেছে, সড়ক অবরোধ করেছে, তখন পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে তিনি তাদের তক্তা বানিয়ে দিয়েছেন। আর তার সরকার এমনও ঘোষণা করেছিল, বিদ্যুৎ চাইÑ এ রকম দাবি নিয়ে কোনো এলাকার লোক যদি মিছিল, সমাবেশ অবরোধ করে; তবে যেটুকু বিদ্যুৎ তাদের দেয়া হয়েছে, তাও বন্ধ করে দেয়া হবে। সরকার বলে কথা। বাব্বাহ! আসলে কোথাও কিছুই হয়নি। এই সরকারের আমলে যা হয়েছে, তা কেবল দুর্নীতি আর দুর্নীতি। সে দুর্নীতি বিশ্বব্যাংক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক শেখ হাসিনার যোগাযোগমন্ত্রীকে পদ্মা সেতু দুর্নীতির আসামি করেছে। ওরে, বাবা! বিশ্বব্যাংকের ওপর শেখ হাসিনা এমন খাপ্পা হয়ে উঠলেন যে, মনে হলো হাতে ক্ষমতা থাকলে গ্রামীণ ব্যাংকের মতোই তিনি বিশ্বব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে নিয়ে কঠোর সাজা দিতেন। শ্রমিকদের জন্য তার যে কত প্রতিশ্রুতি ছিল! সেসব প্রতিশ্রুতি কোনোটাই কাজে আসেনি। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় শ্রমিক আজ গার্মেন্ট শিল্পে। এখানে প্রধানত নারীশ্রমিকেরা কাজ করেন। এসব নারীশ্রমিকের বেশির ভাগই আগে গৃহকর্মী ছিলেন। তারা ন্যূনতম বেতনে গার্মেন্টশ্রমিক হয়েছেন। আমাদের তরুণ উদ্যোক্তারা বাজারের শত মন্দা সত্ত্বেও গার্মেন্ট শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন। শুধু টিকিয়ে রেখেছেন বললে ভুল হবে, এর পরিশীলিত বিকাশ ঘটিয়েছেন। এই শিল্প ধ্বংসের জন্য হেন কোনো ইতর কাজ নেই, যা দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীরা করেনি বা করছে না। সেসব চক্রান্ত প্রতিহত করেও আমাদের উদ্যোক্তারা এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সন্দেহ নেই, বেতন তারা কম দেন। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মালিকেরা শ্রমিকদের বেতন কম দিতে চান। এটি তো পুঁজিবাদী দুুনিয়ার নিয়মই। এরা সব সময় শ্রমিকদের ঠকাতে চান। আর সেই ঠকানো রোধ করার জন্য পৃথিবীতে মার্কসবাদের জন্ম হয়েছিল। এখন তার বিদায়ঘণ্টা বেজে উঠেছে। পৃথিবীর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ক্রমেই বাজার অর্থনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তন্ত্র দিয়ে কিছু হয় না। কিছু করতে চাইলে, এমনকি জনগণের জীবনমানে উন্নয়ন চাইলেও বাজার অর্থনীতি ছাড়া গতি নেই। গার্মেন্ট আমাদের দেশের একটি প্রধান রফতানি খাত। আগে জনশক্তি রফতানি খাত ছিল সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের পথ। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সে পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন গার্মেন্ট ভরসা। কিন্তু তাজরীন ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ড, আর রানা প্লাজা ধসের পর এই শিল্পে এক বহুমুখী বিপর্যয় নেমে আসে। এক দিকে শিল্প টিকিয়ে রাখা, অপর দিকে বাজার ধরে রাখাÑ দুটোই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রানা প্লাজার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জেএসপি সুবিধা বাতিল করে দিয়েছে। অন্যান্য জায়গায়ও পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। এর মধ্যে আবির্ভূত হলেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হওয়ার আগে কেন জানি না, আমি শাজাহান খানের নাম শুনেছি আওয়ামী শ্রমিক নেতা ও বিরাট চাঁদাবাজ হিসেবে। তাকে মন্ত্রী করার পর টিআইবির সাবেক প্রধান মরহুম অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বলেছিলেন, শাজাহান খানকে মন্ত্রী করার মানে চাঁদাবাজি জাতীয়করণ করা। তখন ভেবেছিলাম, তিনি নিশ্চয়ই শাজাহান খানকে ভালোভাবে চেনেন না। আর তাই এমন কথা বলেছেন। পরে তো দেখতেই পেলাম, শাজাহান খান কী! নৌমন্ত্রী বটে। কিন্তু বাস-ট্রাকের ড্রাইভারদের লাইসেন্স দেয়া নিয়ে কীর্তি তিনি কম করেননি। ভেবেছিলাম, এসব কারণে প্রধানমন্ত্রী তাকে ধমক দেবেন। কিন্তু ধমক তো দেনইনি, বরং শাজাহান খান তার কর্তৃত্বের আওতা বাড়িয়েই চলেছেন। এবার তিনি গার্মেন্টশ্রমিকদের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। প্রথমে তিনি গার্মেন্টশ্রমিকদের মহাসমাবেশ ডেকে বসলেন হেফাজতে ইসলামের আল্লামা শফীর বিরুদ্ধে। সেই সমাবেশে ঘোষণা করলেন, গার্মেন্টশ্রমিকদের বেতন-মজুরি কমপক্ষে আট হাজার টাকা করতে হবে। সরকারের মন্ত্রী যখন এ রকম ঘোষণা দেন, তখন গার্মেন্টশ্রমিকদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এমন আশার সঞ্চার হয় যে, তাদের মজুরি মাসিক আট হাজার টাকা হতে আর বাকি নেই। সেভাবে তিনি এই সেক্টরে বক্তৃতা দিয়েই চললেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আশা বাড়তে থাকল। তা ছাড়া প্রায় ৪০ জন আওয়ামী এমপি আছেন, যাদের গার্মেন্ট ব্যবসায় আছে। শাজাহান খানের এত মুরোদ, তাহলে অন্তত তার দলের ৪০ জন এমপির কারখানায় ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা তিনি সবার আগে চালু করে দিলেন না কেন? তা যদি পারতেন, তাহলে অন্যরা ওই এমপিদের অনুসরণ করতে বাধ্য হতেন। কিন্তু এখন দেখছি ভিন্ন চিত্র। শাজাহান খান উসকে দিলেন, শ্রমিকেরা ন্যূনতম আট হাজার টাকা বেতনের দাবিতে রাজপথে নেমে এলো। তারা গার্মেন্ট ভাঙচুর করল। গার্মেন্টে আগুন দিলো। পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ হলো। পুলিশ লাঠিচার্জ করল। নির্বিচার গুলি চালাল। রাজপথে শ্রমিকের রক্ত ঝরল। তাতে সঙ্ঘাত আরো বাড়ল। আরো কারখানা জ্বলল। সঙ্ঘাত চলছে। খেলা চালু করে দিয়ে এখন খানিকটা আড়াল হয়েছেন। সঙ্ঘাত, সংঘর্ষ, আগুন, রক্তপাত চলছেই। নিপুণ খেলোয়াড় বটে শাজাহান খান। বুর্জোয়া রাজনীতি তো এমনই নিপুণ, কুটিল দস্যুদেরই খেলা। সে ক্ষেত্রে আমরা সমস্বরে এই খেলাকে জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানাতে পারি। কিন্তু সেখানে আমি ব্যথিত হইনি। কদিনের পত্রিকায় দেখলাম, পুলিশ দুই হাতে শক্ত করে লাঠি ধরে নারীশ্রমিকদের সর্বশক্তি দিয়ে পেটাচ্ছে। আমি চমকে গিয়েছি ওইখানে। এদের কেউ চল্লিশোর্ধ্ব মাতা, কেউ বা আঠারোর কিশোরী। যেসব পুলিশ এদের আঘাত করছে, তাদের বয়স একই রকম। কারো বা ২০-২৫ বছর। কেউ বা পঞ্চাশের কাছাকাছি। বারবার মনে হতে থাকল, এরা কি কোনো মাতৃগর্ভে জন্ম নেননি। এদের ঘরে কি ওরকম কিশোরী সন্তান নেই। এরা তাহলে কারা? তবে কি এই আঘাতকারীরা পিশাচ? তবে কি এই সরকার পিশাচের সরকার? এ কথা মনে করতে করতে কেবলই মন ভারাক্রান্ত হয়েছে। মনে হয়েছে, যদি ওই মায়ের বদলে আমার পিঠ পেতে দিতে পারতাম! যদি ওই সন্তানের বদলে আমার পিঠ পেতে দিতে পারতাম! তাহলে হয়তো মানুষ হিসেবে খানিকটা দায়িত্ব পালন হতো। আমি তো তা পারিনি। আমরা সব সময় সব জায়গায় গিয়ে তা করতে পারি না। সেটাই মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের সবচেয়ে বড় বেদনা। আমি যেন আর সে বেদনার ভার বইতে পারছি না। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads