শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

কিছুই না পাওয়ার পরও ভারতের বন্ধুত্বের জন্য দৌড়ঝাঁপ


ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং সেই সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রাপ্তি ও সম্ভাবনা নিয়ে নতুন পর্যায়ে আবারও কথা উঠেছে। এর একটি প্রধান কারণ হিসেবে এসেছে কুড়িগ্রামের সীমান্তে নিহত কিশোরী ফেলানী হত্যাকা-ের রায়। রায়ে বিএসএফ-এর খুনি সৈনিক অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। এর পরপর কয়েকদিনে বিএসএফ একদিকে বাংলাদেশীদের হত্যা অব্যাহত রেখেছে অন্যদিকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে কৃষকদের গরু। ৩১ জন বাংলাদেশীকেও ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ। এসব বিষয়ে বিজিবি-বিএসএফ পতাকা বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যেই ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস খবর দিয়েছে, ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে চালকবিহীন যুদ্ধ বিমান ড্রোন মোতায়েন করবে। এই ড্রোন ১০-১২ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে উড়ে সীমান্ত পাহারা দেবে। প্রয়োজনে দেখা মাত্র গুলী ও বোমাও নিক্ষেপ করবে। অর্থাৎ সব মিলিয়েই সীমান্ত পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে কিন্তু এখনো ভারতের ‘বন্ধুত্ব’ পাওয়ার চেষ্টাই চালানো হচ্ছে। এ বিষয়ে সর্বশেষ প্রমাণ দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। কিন্তু তার বক্তব্যের দিকে যাওয়ার আগে ফেলানী হত্যা মামলার উল্লেখ করা যাক।
রায়ের আড়ালে কুড়িগ্রামের নিহত কিশোরী ফেলানীকে ™ি^তীয়বার খুন করার অভিযোগ উঠেছে ভারত এবং বিএসএফ-এর বিরুদ্ধে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফেলানীকে প্রথমবার হত্যা করে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রেখেছিল বিএসএফ। পয়েন্ট ব্ল্যাংক অর্থাৎ মাত্র সাত-আট হাত দূর থেকে গুলী করেছিল অমিয় ঘোষ নামের এক বিএসএফ সৈনিক। ঝুলন্ত ফেলানির ছবিটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিশে^র দেশে দেশে ভারতের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার উঠেছিল। নিন্দায় ও বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল বিশ^বাসী। মূলত সে দাবির মুখেই ভারত শেষ পর্যন্ত খুনি অমিয় ঘোষকে গ্রেফতার করেছিল, বিভাগীয় আইনে তার বিচারের পদক্ষেপ নিয়েছিল। কোচবিহারে বিএসএফ-এর বিশেষ আদালতে এই বিচার চলেছে গত বছরের আগস্ট থেকে। সেখানে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ফেলানীর বাবা নূরুল ইসলাম এবং মামা আবদুল হানিফকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মামলার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলেন বিজিবির ৪৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়কও। কিন্তু পুরো বিষয়টিই যে ভারতের এক সাজানো নাটক ছিল তারই প্রমাণ পাওয়া গেছে গত ৬ সেপ্টেম্বর। সেদিন ঘোষিত রায়ে বিএসএফ-এর বিশেষ আদালত খুনি অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দিয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তি দেয়া হয়েছে তাকে। রায়ের বিস্তারিত প্রকাশিত না হলেও এটুকু অন্তত জানা গেছে, ফেলানীর বাবা ও মামাসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং তথ্য-প্রমাণের সবকিছুই প্রত্যাখ্যান করেছেন বিচারকরা। তারা বরং সচেষ্ট থেকেছেন অভিযুক্ত অমিয় ঘোষকে রেহাই দেয়ার জন্য। সে কারণেই খুনের অপরাধ থেকে রেহাই পেয়েছে অমিয় ঘোষ।
অথচ দেশী-বিদেশী সকল অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে, ফেলানী কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনার শিকার হয়নি। তাকে রীতিমতো টার্গেট করে এবং পয়েন্ট ব্ল্যাংক দূরত্ব থেকে গুলী করে হত্যা করেছিল অমিয় ঘোষ। বিএসএফ-এর আইনেও এ অপরাধের ন্যূনতম শাস্তি সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ড। অন্যদিকে এত নিষ্ঠুর একটি হত্যাকা-ের পরও খুনি অমিয় ঘোষকে কোনো দন্ডই দেয়া হয়নি। এর প্রতিক্রিয়াও ঘটেছে স্ব^তঃস্ফূর্তভাবে। ফেলানীর বাবা-মা ও স্বজনেরা রায়টিকে প্রত্যাখ্যান করে এ ব্যাপারে বিএসএফ-এর বিরুদ্ধে তৎপর হওয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমদ এবং বর্তমান সরকারের আমলে বিলুপ্ত বিডিআর-এর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমানসহ দেশের বিশিষ্টজনেরা একে বিচারের নামে প্রহসন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তারা বলেছেন, এর মাধ্যমে ফেলানীকে আসলে দ্বিতীয়বার খুন করেছে বিএসএফ। ভারতীয়রা কেন নাটক মঞ্চায়নের সাহস পেয়েছে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতিই এ জন্য দায়ী। তারা ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানানোর, আপিলের পাশাপাশি নতুন করে বিচারের আয়োজন করার এবং বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।  
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিচারের নামে বিএসএফ তথা ভারতের পক্ষ থেকে সত্যিকার অর্থেই নাটক সাজানো হয়েছে। কারণ, তথ্যনির্ভর যে কোনো পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বিএসএফ-এর খুনি ও সন্ত্রাসী সৈনিকরা স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের নিরীহ নাগরিকদের হত্যা করে আসছে। চাষাবাদ করার মতো কোনো জরুরি প্রয়োজনে সীমান্তের কাছাকাছি নিজেদের জমিতে গেলেও বাংলাদেশীরা বিএসএফ-এর গুলীর শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে সব জেনে-শুনেও ভারতের কাছে বলিষ্ঠভাবে প্রতিবাদ পর্যন্ত জানাচ্ছে না আওয়ামী লীগ সরকার। এ অবস্থারই সুযোগ নিচ্ছে বিএসএফ। এর খুনি ও সন্ত্রাসী সৈনিকেরা শুধু মানুষই হত্যা করছে না, কুড়িগ্রামের কিশোরী ফেলানীর মতো কাউকে কাউকে হত্যার পর কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখারও দুঃসাহস দেখাচ্ছে। ঘটনাক্রমে কখনো কখনো দুঃখ প্রকাশ করা হলেও বিএসএফ-এর হত্যা বন্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না ভারত। এদিকে বিএসএফকে প্রতিহত করার পবির্তে সরকার বরং বিডিআর-এর বিলুপ্তি ঘটানোর মধ্য দিয়ে বিএসএফ-এর হত্যাকা-কে আরো বাধাহীন করেছে। অমিয় ঘোষদের দিয়েছে প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়। স্মরণ করা দরকার, বিডিআর থাকাকালে বিএসএফ কিন্তু এত বেশি দুঃসাহস দেখাতো না। ফেলানীর আগে-পরে অসংখ্য নিরীহ বাংলাদেশিকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলেও আওয়ামী লীগ সরকার কিছুই বলছে না। মনে হচ্ছে সরকার যেন হিন্দু মুনি-ঋষীদের ঢঙে ‘সন্ন্যাসব্রত’ পালন করছে! সন্ন্যাসব্রতের আড়ালে এই ‘উদারতা’র কারণ নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানোর দরকার পড়ে না। ‘বন্ধুরাষ্ট্রের’ স্বার্থ হাসিল করে দেয়াই সরকারের উদ্দেশ্য।
এ ব্যাপারে সর্বশেষ ধারণা স্পষ্ট করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। গত ১২ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে দীপু মনি জানিয়েছেন, ভারতকে ‘কখনোই’ তারা ‘বন্ধু’ হিসেবে হারাতে চান না! ফেলানী হত্যাকান্ডের বিচারে খুনি বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ বেকসুর খালাস পেয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, বিচারের ওই রায়ে মন্ত্রী ও তাদের সরকার সন্তুষ্ট কি না এবং সন্তুষ্ট না হয়ে থাকলে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার কথা তারা ভাবছেন কি না? এর জবাবেই দীপু মনি ‘বন্ধু’ হিসেবে ভারতকে না হারানোর ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, ভারতকে তারা ‘কখনোই’ হারাতে চান না। ফেলানীর রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার ঘোষণাও প্রায় দিয়ে ফেলেছিলেন দীপু মনি। কিন্তু তখনই সাংবাদিকরা তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, বিএসএফ এবং ভারতের আইন অনুযায়ী ভারত সরকার ছাড়া বাংলাদেশসহ আর কারো পক্ষে আপিল করার কোনো সুযোগ নেই। এ কথাটা শুনেই বদলে গেছে মন্ত্রীর ভাষ্য। এবার তিনি বলেছেন, এতদিনে তারা নাকি ভারতের আইন সম্পর্কে ‘জানার চেষ্টা’ করছেন! জানার পর তারা সিদ্ধান্ত নেবেন, এ ব্যাপারে কোন ধরনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যায়! সীমান্তে ড্রোন মোতায়েনের ব্যাপারেও দীপু মনি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে বলেছেন, ভারত নাকি এ বিষয়ে তাদের কিছুই জানায়নি তবে তারা এরই মধ্যে ভারতের কাছে জানতে চেয়েছেন। বিষয়টি তিনি নাকি পত্রিকার খবরে পড়েছেন। পরের বাক্যেই অনেকাংশে ভারতের হাই কমিশনার পংকজ শরনের সুরে দীপু মনি বলেছেন, পত্রিকায় অনেক সময় ভিত্তিহীন খবর ছাপা হয়! তিস্তা চুক্তি ও সীমান্ত প্রটোকল প্রসঙ্গেও দীপু মনি নতুন কোনো খবর শোনাননিÑ আসলে শোনানোর মতো কিছু তার কাছে ছিলই না। তা সত্ত্বেও বেশ জোরের সঙ্গে তিনি বলেছেন, তিস্তা চুক্তি হবেই। কবে নাগাদ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, দিন-ক্ষণ বা তারিখ সম্পর্কে কিছু জানানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু ভারতকে তারা যেহেতু ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ মনে করেন এবং ভারতকে যেহেতু ‘কখনোই’ তারা ‘বন্ধু’ হিসেবে হারাতে চান না সেহেতু ভবিষ্যতে কোনো না কোনো এক সময়ে ভারত অবশ্যই তিস্তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে, সীমান্ত প্রটোকলও বাস্তবায়ন করবে বলে আশা করেন দীপু মনি।
বলা দরকার, দীপু মনির ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সংক্রান্ত কোনো একটি উত্তরই সন্তোষজনক হতে পারেনি। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোভাব বিষয়ক জবাব দিতে গিয়ে রীতিমতো নাজেহাল হওয়ার পরিস্থিতি হয়েছিল তার। উদাহরণ দেয়ার জন্য ফেলানীর হত্যাকা-ের রায় বিষয়ক বক্তব্যের উল্লেখ করা যেতে পারে। মন্ত্রী এমনভাবেই আপিল করার ঘোষণা দিয়ে বসেছেন যেন মামলাটি বাংলাদেশের প্রচলিত কোনো আইনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো আদালতে অনুষ্ঠিত হয়েছে! দীপু মনির জ্ঞানের বহর সম্পর্কে জানা গেছে তখনই, সাংবাদিকরা যখন বিএসএফ এবং ভারতের আইন অনুযায়ী বিচার হয়েছে কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের আপিল করার কোনো সুযোগই নেই। এ থেকে দুটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। প্রথমত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের আইন সম্পর্কে কিছু না জেনেই শস্তা রাজনীতি করার চেষ্টা করেছেন। দ্বিতীয়ত, ফেলানী হত্যাকা-ের রায়ের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া দূরে থাকুক সরকার আসলে কোনো চিন্তা পর্যন্ত করেনি। কারণ, সরকার ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতকে হারানোর ঝুঁকি নিতে চায় না। সে সাহসও নেই দীপু মনিদের।
বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। কারণ, আওয়ামী লীগ সরকার যে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা ও আইন সম্পর্কে কিছুই জানে না এবং না জেনেই যে বাংলাদেশের গলায় একের পর এক ফাঁস পরিয়ে চলেছে সেকথা জানা গেছে তিস্তাচুক্তি থেকে সীমান্ত প্রটোকল পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে। তিস্তা চুক্তির কথাই ধরা যাক। এটা আটকে গেছে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার কারণে। এই বিরোধিতা মমতা ব্যানার্জি কিন্তু আইনসম্মতভাবেই করেছেন। কারণ, ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্রÑ বাংলাদেশের মতো এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র নয়। সেখানে তিস্তার মতো যে কোনো বিষয়ে চুক্তি করতে হলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের অনুমতি নিতে হয়Ñ যে অনুমতি এখন দরকার পশ্চিম বঙ্গের। একই কথা সীমান্ত প্রটোকলের ব্যাপারেও সমান সত্য। সে জন্যই রাজধানী দিল্লীতে বসে কিংবা ঢাকায় বেড়াতে এসে ড. মনমোহন সিংরা যতো আশ্বাসের কথাই শোনান না কেন, তারা চাইলেই বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে বা তা বাস্তবায়ন করতে পারেন না। এজন্য আবার ভারতের সংবিধানও সংশোধন করতে হবে। বলা দরকার, মূলত এ কারণেই ভারত আজ পর্যন্তও ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আসলে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে প্রতারণা করার জন্য এটা ভারতীয়দের চমৎকার এক কৌশলও বটে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শেখ হাসিনা পর্যন্ত কেউই ভারতের সে কৌশল সম্পর্কে বুঝতে পারেননি অথবা সবকিছু তারা জেনেবুঝেই করেছেন! এখানে শুধু এটুকু বলে রাখাই যথেষ্ট হওয়া উচিত যে, দীপু মনিরা ভারতের যে বন্ধুত্বের জন্য ট্রানজিট-করিডোরসহ সবকিছুই ভারতকে দিয়ে ফেলেছেন এবং এখনও শুধু দিতেই ব্যস্ত রয়েছেন সে বন্ধুত্বের নাগাল তারা কোনোদিনই পাবেন না। কারণ, সেবাদাসদের ভারত শুধু সেবাদাস হিসেবেই ব্যবহার করে, কাজে লাগায়।
এ ব্যাপারে সম্প্রতি ভারত থেকেও কিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। ‘ফার্স্ট পোস্ট’ নামের একটি অনলাইন পত্রিকার এক রিপোর্টে মনমোহন সিং সরকারের ‘সাকসেস স্টোরি’ বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার কংগ্রেস সরকারের জন্য সাফল্যের বিরাট সিঁড়ি নির্মাণ করেছে। এই সিঁড়ি বেয়েই ঝুড়ি বোঝাই করে চলেছে ড. মনমোহন সিং-এর সরকার। পত্রিকাটি লিখেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করা ছাড়া পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো সফলতাই অর্জন করতে পারেনি মনমোহন সিং-এর সরকার। সরকারের একমাত্র সাফল্য বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং ওই সরকারের কাছ থেকে একের পর এক ভারতের বিভিন্ন স্বার্থ আদায় করা। নিজেরা আদায় করলেও মনমোহন সিং-এর সরকার যে বাংলাদেশের কোনো একটি অনুরোধই রক্ষা করেনি সে কথাটাও জানিয়েছে ‘ফার্স্ট পোস্ট’। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তির উল্লেখ করে বলেছে, মনমোহন সিং-এর সরকার বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতার অজুহাত দেখিয়ে তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তি করা থেকে বিরত থাকছে। এর ফলে দেশের ভেতরে শেখ হাসিনাকে প্রবল নিন্দা ও বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রিপোর্টটির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয়দের প্রকৃত মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটেছে। এ সম্পর্কে সর্বশেষ জানা গেছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির দিল্লী সফরের সময়। ভারতকে দিয়ে বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর এবং সীমান্ত প্রটোকল বাস্তবায়ন করানোর ‘শেষ চেষ্টা’ চালাতে গত ২৫ জুলাই দিল্লী গিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশীদের কাছে বহুবার শোনা আশ্বাসের বাইরে ‘এক চুল’ পরিমাণও আদায় করতে পারেননি তিনি। দু’জনই ভারতের সংবিধান, লোকসভা ও রাজ্যসভাসহ পার্লামেন্টের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান দিয়ে জানিয়েছেন, ভারত বাংলাদেশের মতো ছোট কোনো এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র নয় বরং প্রায় ৩০টি রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি যুক্তরাষ্ট্র বলেই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর এবং সীমান্ত প্রটোকলের মতো বিষয়গুলোতে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোর সম্মতি ও অনুমোদন দরকার পড়ে। তাছাড়া শুধু সরকার চাইলে চলবে না, এ ধরনের বিষয়ে বিরোধী দলেরও সমর্থন থাকতে হবে। অর্থাৎ নানা কথার মারপ্যাঁচে সব মিলিয়েই শেখ হাসিনার জন্য বিরাট একটি ‘না’ পাঠিয়েছে মনমোহন সিং-এর সরকার। দীপু মনি রাজ্য সভায় প্রধান বিরোধী দল বিজেপির সংসদীয় দলের নেতা অরুন জেটলির কাছেও ধর্না দিয়েছেন। কিন্তু তাকে অনেকাংশে পত্রপাঠে বিদায় করেছেন বিজেপির নেতা।
সব মিলিয়েই খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল দীপু মনিকে। ‘না’-এর মধ্য দিয়ে তাকে আসলে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য ভারতীয়রা নিজেদের দলীয় এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ত্যাগ করতে রাজি নন। ভারতীয়দের জন্য এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয়রা স্বাধীনতার পর থেকেই এ মনোভাব দেখিয়ে চলেছে। এবার ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার সরকার একটির পর একটি করে এমনভাবেই ভারতীয়দের ইচ্ছা পূরণ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে যে, ভারত বাংলাদেশকে আর স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বলেই মনে করছে না। স্মরণ করা দরকার, ২০১০ সালের জানুয়ারিতে দিল্লী সফরে গিয়ে ‘চাহিবা মাত্র’ ঢঙে ভারতকে সবকিছু উজাড় করে দিয়ে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে ভারত কিন্তু শেখ হাসিনার মানসম্মান বাঁচানোর জন্য তিস্তা চুক্তিও স্ব^াক্ষর করেনি। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঢাকা সফরে এসে মনমোহন সিংও মমতা ব্যানার্জির আপত্তির অজুহাত দেখিয়ে সীমান্ত প্রটোকলের ব্যাপারে ঘোল খাইয়ে গিয়েছিলেন। লজ্জা ও দুঃখের বিষয় হলো, এতকিছুর পরও শেখ হাসিনার সরকার কিন্তুু আগ বাড়িয়েই ভারতকে সবকিছু দিয়েছিল। ভারতের এই নীতি ও মনোভাব সম্পর্কে নতুন করে বলা দরকার না থাকলেও একটি কথা আবার না বলে পারা যায় নাÑ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখনো ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যকার মূল কথাটুকুই অনুধাবন করতে বা শিখে উঠতে পারেননি। সেটা হলো, দিল্লী শুধু নিতে জানে, দিতে নয়। সে কথাটাই কিছুটা ঘুরিয়ে জানিয়েছে ভারতের অনলাইন পত্রিকাটি।
দেশপ্রেমিকরা কিন্তু মনে করেন, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই সরকারের উচিত সীমান্তে বিএসএফ-এর হত্যা বন্ধ ও প্রতিহত করার কার্যকর উদ্যোগ নেয়া। এ উদ্দেশ্যে বিজিবি’র লোকবল ও মনোবল বাড়াতে হবে, বিজিবি’র জওয়ানদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তুলে দিতে হবে। সীমান্তে একই সঙ্গে সেনাবাহিনীকেও মোতায়েন করা ও তৎপর রাখা দরকার। সবচেয়ে বেশি দরকার সরকারি পর্যায়ে গুলী ও হত্যা বিরোধী সিদ্ধান্ত নেয়া। কারণ, এই অভিযোগ অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সরকারের মধ্যে ভারতকে ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ হিসেবে ‘মাথায় রাখার’ মতো লোকজনের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে বলেই বিএসএফ-এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার চিন্তা পর্যন্ত করা হচ্ছে না। এমন নীতি ও মনোভাবের সুযোগই নিচ্ছে বিএসএফ। দু-একদিন পরপর হত্যা তো করছেই, বিএসএফ এমনকি বিচারের নাটক সাজানোরও সাহস দেখাচ্ছে। বিএসএফ এই সাহস কিন্তু চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে দেখাতে পারে না। কারণ, দুটি দেশই নিরীহ মানুষ হত্যা করার ‘শখ’ মিটিয়ে দেয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের বেলায় এসে একই বিএসএফ ‘বাহাদুরি’ দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের সাফ কথা, ‘বন্ধুরাষ্ট্রের’ প্রতি ‘মহব্বত’ যথেষ্টই দেখানো হয়েছে। এবার উচিত একটু হলেও নড়েচড়ে ওঠা এবং সীমান্তে সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি কূটনৈতিক পর্যায়েও ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। ফেলানীর বিষয়টিকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উত্থাপন করতে হবে। আমরা চাই না, বাংলাদেশীরা ফেলানীর মতো হত্যাকা-ের শিকার হোক এবং মৃত্যুর পরও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকুক। বিচারের নামে ভারতীয়রা ফেলানীর মতো বাংলাদেশীদের যাতে দ্বিতীয়বার খুন করার সুযোগ না পায় সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। এমন কিছু অবশ্য বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে দিয়ে সম্ভব নয়। কারণ, সর্বশেষ উপলক্ষেও দীপু মনি তো জানিয়েই দিয়েছেন, তারা ভারতের বন্ধুত্ব খোয়াতে চান না। এই বন্ধুত্বের নাগালই যে তারা জীবনে পাবেন না সে কথাটাই বুঝতে পারছেন না দীপু মনিরা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads