বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

বিশ্বাসের জায়গাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে


গত ১৭ আগস্ট বাংলাদেশে সংঘটিত একটি ঘটনা, সন্তানের প্রতি অনেক বাবা-মায়ের বিশ্বাসের ভিতটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে হয়তো। আধুনিক শিক্ষা আর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ১৮-১৯ বছরের রঙিন দুনিয়ার স্বপ্নে বিভোর তরুণী ঐশী তার নিজের বাবা-মাকে ছুরিকাঘাতে খুন করেছে নিজেদের বাসায়। খুন করার পর লাশ বাথরুমে ফেলে রেখে ছোট ভাই ঐহীকে নিয়ে সে পালিয়েছে। ঘটনার দুদিন পর পুলিশ খবর পেয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়েছে। খুনের এ ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর ঐশী স্বেচ্ছায় থানায় আত্মসমর্পণ করে খুনের দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়। গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, ঐশী তার বাবা-মায়ের অবাধ্য ছিল। উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত বয়ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা, ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য সেবন, গভীর রাতে বাড়ি ফেরা, কোনো কোনো দিন বাড়ি না ফেরা, বয়ফ্রেন্ডের সাথে রাত কাটানো ইত্যাদি ছিল তার নিত্যনৈমিত্তিক মামুলি ব্যাপার। ঘটনার দিন রাতে ঐশী তার বাবা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও মা স্বপ্না রহমানকে প্রথমে কফির সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ায়। বাবা-মা অচেতন হয়ে পড়লে দুজনকেই ছুরি দিয়ে হত্যা করে এবং লাশ লুকানোর জন্য কাজের মেয়ে সুমির সাহায্য নেয়। ঐশী জানায়, ইয়াবাসহ অন্যান্য নেশায় সে এতটাই আসক্ত ছিল যে, মাদকাসক্ত বন্ধুবান্ধবেরা যা বলত সেটাকেই সে বেদবাক্যের মতো গ্রহণযোগ্য বলে মনে করত। ধীরে ধীরে সে বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে বাবা-মা তার এই বখে যাওয়া জীবনের প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠেন। ঐশী ভেবেছিল বাবা-মাকে সরিয়ে দিতে পারলেই তার অবাধ চলাফেরায় আর কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। এ চিন্তা থেকেই সে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করে এক সপ্তাহ আগে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় ঐশীকে কোনো প্রকার বিচলিত কিংবা অনুশোচনা বা অনুতপ্ত হতে দেখা যায়নি। সর্বনাশা মাদকের নেশা ঐশীর হিতাহিত জ্ঞান, ন্যায়-অন্যায়বোধ, মায়া-মমতা-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। বাবার মতো পরম শ্রদ্ধেয়, মায়ের মতো অকৃত্রিম ভালোবাসার মানুষকে খুন করার রসদ জুগিয়েছে একমাত্র নেশা। সেই নেশা আজ আমাদের প্রতিটি স্তরের কোনায় কোনায় আস্তানা গেড়েছে। কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী বলেছে, তার মতো হাজার হাজার ঐশী-রনি (ঐশীর বন্ধু) ঢাকা শহরে রয়েছে, এ রকম ডজনখানেকের নাম সে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলেছে, যাদের সবাই উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান। অনুমান করা অযৌক্তিক হবে না, ঐশী যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও-লেভেলে পড়াশোনা করেছে তার পরিবেশ ঐশীকে কতটা প্রভাবিত করেছে? কারণ ঐশীর আগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিছু ধর্মীয় নিয়মকানুন তার পছন্দ না হওয়ায় তাকে স্থানান্তর করা হয় বর্তমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শুধু ঐশীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ এ রকম অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আজ নানা প্রকারের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত, যার খবরাখবর প্রায়ই পত্রপত্রিকায় পড়তে হয়। আর আমার ব্যক্তিগতভাবে দেখা অভিজ্ঞতার কথা যদি বলতে হয় তবে বলব, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে নিয়মিত মাদকাসক্ত হতে দেখেছি, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারকে দেখেছি, দেখেছি বহু রাজনীতিবিদকেও। পুলিশ সদস্য থেকে শুরু করে গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকা, বুদ্ধিজীবী-লেখক-কলামিস্ট, প্রশাসনিক কর্মকর্তার অনেকেই আজ মাদকাসক্ত অবস্থায় তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এটা অতিরিক্ত বলা নয়, এটাই আজকের বাস্তবতা। একা ঐশীকে শুধু এ ঘৃণা বহন করতে হবে কেন? যে সমাজ ঐশীকে তৈরি করল সে সমাজ পার পাবে কেন? এ পাপের ভার সংশ্লিষ্ট সবাইকে বহন করতে হবে। কিশোর অপরাধের কারণে ঐশী হয়তো মুক্তি পেয়ে, কলঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকবে; কিন্তু সুস্থ জীবনে যদি ঐশী ফিরে আসে, তাহলে কি সে সমাজকে দায়ী করবে না? ঘৃণা করবে না? যে সমাজ তার বাবা-মাকে খুন করতে বাধ্য করেছে? যে সমাজ তার বেপরোয়া জীবনযাপনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে? ঐশীর সাথে সে সমাজকেও ঘৃণার অংশ গ্রহণ করতে হবে। কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রে দেয়া অভিমতে ঐশী বলেছে, সন্তানের বখে যাওয়া বা বেপরোয়া জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার পেছনে মা-বাবাও অনেকাংশে দায়ী। বাবা-মায়ের অত্যধিক ব্যস্ততা কিশোরী ঐশীকে একাকীত্বে ফেলে দেয়। এই নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্যই সে বিকল্প পথে পা বাড়ায়; কিন্তু সে পথ যে এতটায় পঙ্কিল, পিচ্ছিল তা ১৮-১৯ বছরের কিশোরী ঐশীর জানা থাকার কথা নয়। ঐশীর মতো এ বয়সের কিশোর-কিশোরীরা আনন্দে নিরাপদে পথ চলবে সেটাই স্বাভাবিক। তাদের এই চলার পথকে যারা বন্ধুর করছে তাদেরকে আগে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশে কারা এসব পথ তৈরির পেছনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে তা দেখিয়েছে আন্তর্জাতিক দুটি সংস্থাÑ টিআইবি ও এইচআরডব্লিউ। তারা বলেছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির সাথে সরাসরি জড়িত পুলিশ আর রাজনীতিবিদেরা। এ দুটি সংস্থার মতো বাংলাদেশের বেশির ভাগ জনসাধারণও মনে করেন, সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টির পেছনে এ দুই সম্প্রদায়ের লোকেরা সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত এবং তার সাথে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমা সংস্কৃতি ও ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। বাংলাদেশের সুশীলসমাজের লোকেরাও যখন একই অভিমত পোষণ করেন তখন রাজনীতিবিদেরা বলেন, সুধীসমাজ নাকি রাজনীতিবিদদের চরিত্র হননে নেমেছে। কোনো কোনো মন্ত্রী তো বলেই বসেছেন জ্ঞানী-গুণী-সুধীসমাজ দিয়ে দেশ চলে না। মন্ত্রীদের চিন্তা-চেতনা যদি এমন হয় তাহলে মাদক আমাদের শান্তি কেড়ে নেবে তাতে কার সাধ্য আছে বাধা দেয়। পৃথিবীর কোনো ধর্মেই মাদকের স্বীকৃতি নেই। কোনো চিকিৎসা বিজ্ঞানও বলেনি মাদকে সুফল আছে। কোনো বিজ্ঞানী এখন পর্যন্ত বলতে পারেননি যে, মাদকে উপকারিতা আছে। তারপরও মাদক এত ভয়াবহভাবে সমাজে বিস্তার লাভ করে চলেছে। এ কথা দ্বিধাহীনভাবে বলা চলে, সমজের ওপরতলার অমানুষেরা অবলীলায় এর প্রতিপালনে, গ্রহণে, পৃষ্ঠপোষকতায় সচেষ্ট রয়েছে প্রশ্নাতীতভাবে। দেখা গেছে, মাদকবিরোধী প্রচারণায় যারা প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন তাদের কাছে সাঙ্গ-পাঙ্গরা মাদক সরবরাহের কাজে, মাদক ব্যবসায় ব্যস্ত থেকেছেফলে এটি আজ প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ঐশীকে গাজীপুরের কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রে রেখে জীবন সংশোধনের জন্য কিছু ধর্মীয় টিপস দেয়া হচ্ছে। শুধু কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র কেন পৃথিবীর যাবতীয় মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রেই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার শিক্ষা দেয়া হয়। হতাশায় নিমজ্জিত মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য আবিষ্কার করা হয়েছে কোয়ান্টাম মেথড। মেডিটেশন অনুশীলনে জীবনের পথ পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়। সেই কোয়ান্টাম মেথডের বেশির ভাগটা জুড়ে রয়েছে ধর্মীয় বিধিবিধান এবং তা মেনে চলার কলাকৌশল। যদি তাই হয়, তবে কেন সমাজে ধর্মীয় অনুভূতি সৃষ্টিতে এত আপত্তি? অনৈতিক মূল্যবোধ আর মাদকাসক্ত প্রতিকারে শুধু নয়, প্রতিরোধে ধর্মের প্রচার প্রসার দরকার সবার আগে। সুস্থজীবনে থাকতে চাইলে ধর্মীয় মূল্যবোধে নাক সিঁটকানোর কোনো অবকাশ নেই, সে কথা প্রমাণিত। ঐশীর মাদকাসক্ত জীবনের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে কয়েক দিন আগে ওপার বাংলার বুদ্ধিজীবী সমরেশ মজুমদার এসেছিলেন দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার আড্ডায়। সেখানে তিনি বাংলাদেশের যুবসমাজকে ইয়াবা থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানান। সাথে সাথে তিনি কৌশলে সেই অনৈতিক জীবনাচরণে অনুপ্রবেশের ইঙ্গিতও বহন করেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুরুষ মানুষ দুধরনের, জীবিত ও বিবাহিত। বিবাহিত পুরুষেরা নাকি মৃত মানুষ। আর এ তত্ত্বকে তিনি নাকি বিশ্বাস করেন। অর্থাৎ তিনি পারিবারিক জীবনকে, পরিবার প্রথাকে ভেঙে দেয়ার পক্ষে বাংলাদেশের যুবসমাজকে আহ্বান করলেন, বলা যায় প্রত্যক্ষভাবেই। তার এ বক্তব্যে ঐশীর জীবনযাত্রাকে সমর্থন করার ইঙ্গিত রয়েছে বলে অনেকেরই মনে হয়েছে। আজকের এই অশান্তির সমাজ বিনির্মাণে এ ধরনের বুদ্ধিজীবীদের অবদানকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যেই ঐশীর এ ন্যক্কারজনক ঘটনাকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর আগেও অনেক ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে আমাদের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা উড়িয়ে দিয়ে দেশের আইনশৃৃঙ্খলার উন্নতিতে আত্মতৃপ্তি খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন মাত্র। জনগণের দৃ্িষ্টকে ভিন্ন দিকে পরিচালিত করে উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরছেন। মনে রাখা উচিত, কোনো ঘটনাই ছোট কিংবা বিচ্ছিন্ন নয়, সব ঘটনাই সামাজিক মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ। সমাজ কোন দিকে এগোচ্ছে তা সংঘটিত ঘটনার ওপরই পরিমাপ করা যায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল। সুতরাং ঘটনা যত তুচ্ছই হোক সেটাকে পর্যালোচনা করে তা যেন সামনের দিকে অগ্রসর হতে না পারে সে দিকে সবারই সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। আর কাকে বিশ্বাস করা যায়? নিজের সন্তান যখন বাবা-মাকে খুন করে তখন বিশ্বাসের ভিতটা আর কতটুকু অবশিষ্ট থাকে? আমরা এমন হলাম কেন? বিশ্বাস আর আস্থা তো এক দিনে জন্মায় না। একে লালন-পালন করতে হয়। আজকে সন্তান-সন্ততিতে আস্থা নেই, স্বামী-স্ত্রীতে বিশ্বাস নেই, ভাইয়ে-ভাইয়ে বিশ্বাস নেই, রাজনীতিতে বিশ্বাস নেই। মানুষের বিশ্বাস কমতে কমতে একেবারে তলানিতে এসে পৌঁছেছে। বিশ্বাসের মাত্রাকে ফিরিয়ে আনতে হলে দরকার উন্নত ও টেকসই সমাজ কাঠামো, তা ছাড়া সম্ভব নয়। আর উন্নত সমাজ কাঠামো গঠনে চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা, স্বচ্ছতা, স্থিতিশীলতা, জবাবদিহিতা এবং পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস। আমরা আমাদের বিশ্বাসকে ফিরিয়ে আনতে চাই, সে জন্য দরকার একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ রাজনৈতিক সমাধান। তা না হলে আগামীতে ঘরে ঘরে এমন ঐশীর জন্ম হবে, যা রোধ করা সম্ভব নয়।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads