সরকার এদেশের জন্য এক ঘোর দুঃসময় ডেকে আনছে। আমরা অনেক আগে থেকেই এরকম দুঃসময়ের ইঙ্গিত করে আসছিলাম। কিন্তু ক্ষমতার মোহে অন্ধ সরকার তাতে মোটেও কর্ণপাত করেনি। আকণ্ঠ দুর্নীতি, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, খুন, গুম, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির এক অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। সুশাসন নির্বাসিত হয়েছে। এদিকে আবার বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমনই গুরুত্বপূর্ণ যে, সেদিকে পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলোর দৃষ্টি নিবদ্ধ আছে। সেটিও আমাদের জন্য কম বিপদের কারণ নয়।
কিন্তু এসব দিকে সরকার মোটেও নজর দিতে চায়নি। ২০০৮ সালের যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়েছে, সে নির্বাচন যে সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ মদদে হয়েছিলো সেটি এখন আর লুকানো নেই। ঐসব অপশক্তির সঙ্গে আঁতাত করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হয়। সেক্ষেত্রে সেনাপ্রধান মইন উদ্দিন আহমদ, নির্বাচন কমিশন ও পরাশক্তিগুলোর আঁতাত কাজ করেছিলো। জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে তোলা হয়েছিলো। রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে বিচার বিভাগ পর্যন্ত কোন প্রতিষ্ঠানই বাদ যায়নি। সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিলো অদৃশ্য আঙুলের উঠানামার ভেতর দিয়ে।
আমরা কিছু লোক তখনও বারবার বলছিলাম, নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করুন। সমস্যা সমাধানের জন্য দয়া করে ভিন্ন কারো দ্বারস্থ হবেন না। শুরুর দিকে পরিস্থিতি সেরকমই ছিলো। প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিলো। নির্বাচনী শিডিউল ঘোষণা করা হয়েছিলো। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী মনোনয়নও চূড়ান্ত করেছিলো। আর জোট বেঁধেছিলো স্বৈরশাসক এরশাদের সঙ্গে। কী এক মামলায় আদালত এরশাদের জামিন নামঞ্জুর করলে শেখ হাসিনা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।
আর ঘোষণা দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি। সঙ্গে সঙ্গে ২৮শে অক্টোবর থেকে লগি-বৈঠার আন্দোলন শুরু করেন। তখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের অফিসই যেনো হয়ে উঠেছিলো আওয়ামী লীগের অফিস। নির্বাচন বর্জনের জন্য তারা আওয়ামী লীগকে অমন কৌশল অবলম্বনের পরামর্শ দেয়। ভারতীয় হাই কমিশনার বীণা সিক্রি প্রায় সার্বক্ষণিকভাবেই থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসে। তার পরের কাহিনী ২৮শে অক্টোবর পল্টনে পিটিয়ে নরহত্যা থেকে শুরু করে রাজপথ, রেলপথ অবরোধ প্রভৃতি চলতে থাকে। তাতে কার্যত সারাদেশ অচল হয়ে পড়ে।
ঐ ষড়যন্ত্র প্রধানত হয়েছিলো রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি’কে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য। মাঝখানে লোক দেখানো গ্রেফতার হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ভাবখানা এমন ছিলো যে, সরকার সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে তাদের কাজ পরিচালনা করছে। কিন্তু তা যে আইওয়াশ ছিলো সেটা বুঝতে জনগণের খুব একটা দেরি হয়নি। গ্রেফতারের পর শেখ হাসিনার কানের অসুখ, চুলের অসুখ, চোখের অসুখ নানা গল্প আমরা শুনতে পেলাম। আর এসব অসুখের চিকিৎসার জন্য তার বিদেশে যাওয়া জরুরী হয়ে পড়লো। আর সরকার তা মানলোই। বিদেশে গিয়ে তিনি লম্বা লম্বা রাজনৈতিক বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন। সরকার তা শুনলো। অপরদিকে বেগম খালেদা জিয়াকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার কতো ষড়যন্ত্রই না সেদিন হয়েছিলো। কিন্তু খালেদা জিয়া অনড় ছিলেন। বিদেশে তার কোন থাকবার জায়গা নেই। স্বজন নেই। এদেশই তার জীবন-মরণ। সুতরাং দেশ ছেড়ে তিনি কিছুতেই যাবেন না। তাতে বিএনপি নেতৃবৃন্দের ওপর অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়েছিলো। তার সবচাইতে নিষ্ঠুর শিকার তৎকালে বিএনপি’র সিনিয়র নেতা তারেক রহমান।
সেনাপ্রধান মইন উদ্দিন আহমদের তাঁবেদার সরকার ভারতকে খুশি করার জন্য অল্প কিছু দিনের মধ্যে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলো। এক পর্যায়ে বোধ করি তাদের মনে হয়েছিলো যে, মজাদার ক্ষমতা বোধকরি চিরস্থায়ী হয়ে যাবে। কিন্তু সেটি আর হয়ে উঠলো না। তাদের যারা ক্ষমতায় বসালো তারা ভিন্ন চিন্তা শুরু করলো। সেই সূত্রেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে সে সখ্যতায় ফাটল ধরালেন শেখ হাসিনা। তার আগেই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাতে ঈর্ষায় জ্বলেছেন শেখ হাসিনা। যেনো নোবেল পুরস্কার তারই পাওয়া উচিত ছিলো। এই বিরোধের জের ধরে অনেক কিছুই আরো স্পষ্ট হয়ে যেতে থাকে। ড. ইউনূসের সাথে বিরোধ নিয়ে শেখ হাসিনা ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্ণধার থেকে পদচ্যুত করেন। আর এখন গ্রামীণ ব্যাংক ভেঙে দিয়ে ১৪টি ব্যাংক করার পরিকল্পনা করছে। ড. ইউনূসকে নিয়ে শেখ হাসিনার খেলার এক পর্যায়ে তাকে ফোন করেছিলেন মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন। শেখ হাসিনাকে কীভাবে ক্ষমতায় আনা হয়েছে সে কথা হিলারী শেখ হাসিনাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, দাবার প্রধান দুই ঘুঁটি যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন আশ্রয়ে রয়েছে। এর মাধ্যমে হিলারী সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসার নীলনকশা তিনি তাদের মাধ্যমে প্রকাশ করে দেবেন।
এখন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এগুলোও নতুন খেলারই অংশ। ২০০১-০৬ সালের বিএনপি শাসনামল সম্পর্কে পরাশক্তিগুলোর অভিযোগ ছিলো বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট ‘ইসলামি জঙ্গিবাদ’কে প্রশ্রয় দিচ্ছে। কিন্তু বিএনপি কঠোর হাতে এই জঙ্গিবাদীদের শাস্তি দিয়েছে। তাদের কয়েকজনের মৃত্যুদ-ও হয়েছে। ঐ দ-ের পর বাকি সময়ে ও ধরনের শক্তির উত্থান বাংলাদেশে আর ঘটেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ হঠাৎ করেই জঙ্গিবাদ দমন শুরু করেছে। এর উত্থান বা দমন সব কিছুকেই কেমন যেনো অত্যন্ত সুপরিকল্পিত প্রয়াস বলে মনে হচ্ছে। সম্প্রতি তারা চাউর করছে যে, সরকার একদল ইসলামি জঙ্গিবাদীকে গ্রেফতার করেছে। একথার মধ্যে অদ্ভুত এক ফাঁক তৈরী হয়েছে। ব্লগার রাজীব হত্যার অভিযোগে আটক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নাকি এই জঙ্গিবাদীদের কথা সরকারকে জানিয়েছিল। তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে তখনই তাদের গ্রেফতার করা হলো না কেন? এরা কেউই পলাতক ছিলেন না। অর্থাৎ সরকার বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে দেখাতে চাচ্ছে যে, বাংলাদেশে তথাকথিত জঙ্গিবাদ দমনে যোগ্য একমাত্র তারাই। অতএব, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো যেনো তাদেরকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় বসায়। এক্ষেত্রে ড. ইউনূস ইস্যু সম্ভবত একটি ‘মুরগা’ মাত্র। ক্ষমতায় যেতে যদি পশ্চিমাদের সমর্থন পাওয়া যায় তাহলে হয়তো ড. ইউনূস ইস্যু আস্তে আস্তে ধামাচাপা পড়ে যাবে।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতোই বড়াই করুন না কেন পুরনো খেলাই ফের শুরু হয়ে গেছে। সেটি অন্তত তিনি দেখতে পাচ্ছেন। আবারো খুব সক্রিয় মার্কিন রাষ্ট্রদূত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ আর খুব সতর্কভাবে সক্রিয় ভারতীয় দূতাবাস। ভারত প্রাণপণে চাইছে শেখ হাসিনাকেই আবারও ক্ষমতায় আনতে। সীমান্ত হত্যা, কিংবা ফেলানীর মামলার রায় তার একটা সিগন্যাল বটে। ভারত বাংলাদেশের মানুষকে এই বলে জানান দিতে চাচ্ছে যে, শেখ হাসিনা সরকার যেভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ভারতের কাছে ধারাবাহিকভাবে বিকিয়ে দিচ্ছে সে ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু বিপদ অন্যত্র। বিপদ হলো এই যে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তকে যেভাবে রক্তাক্ত করে তুলছে এবং আওয়ামী লীগ সরকার তাতে থাকছে প্রতিবাদহীন, সেখানে বাংলাদেশের জনগণ ভারতকে এবং আওয়ামী লীগকে সমানভাবে ঘৃণা করতে শুরু করবে। তাতে আখেরে আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার কোন লাভ হবে না।
এটা এখন প্রমাণিত হয়েছে যে, ২০০৭-০৮ সালে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের পাতানো নির্বাচনের ফাঁদে পা দেয়া বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের উচিত হয়নি। আমরা দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি, চূড়ান্ত বিচারে জনগণের শক্তি আসল শক্তি। আলাপ-আলোচনা, চা খাওয়া, নৈশভোজ এসব যে কারো সঙ্গে হতে পারে। কিন্তু তা যদি জনগণের আকাক্সক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তাহলে আরেকটি পাতানো নির্বাচনে যাওয়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষে সঠিক হবে না। সেক্ষেত্রে তাদেরকে থাকতে হবে জনগণের আকাক্সক্ষার পাশে। জনগণের শক্তি নিয়ে লড়বার প্রস্তুতি। দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন