বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে ফাঁসির ঘটনা অহরহই ঘটছে। নিম্নœ আদালতের রায়েও বহু লোকের ফাঁসি হয়। যাদের ফাঁসি হয় তারা অপরাধ
করেছেন ঠিকই, কিন্তু উচ্চ আদালতে আপিল করার
ক্ষমতাও বোধ করি তাদের নেই। ফলে নিম্ন আদালতের রায়ই বহাল থাকবে। নীরবে নিভৃতে
তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়ে যায়। স্বজনেরা লাশ নিয়ে দাফন করেন। নিকটাত্মীয়রা কিছু
দিন শোক পালন করেন। তারপর ভুলে যান সেই স্বজনকে। ফলে ফাঁসি নতুন কোনো ঘটনা নয়।
কিন্তু কোনো কোনো মৃত্যুদণ্ডে সারা দেশ তোলপাড় হয়। সে দ্বন্দ্ব
নিম্নœ আদালত থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
বাঘা বাঘা আইনজীবীরা আদালতে যুক্তি তুলে ধরেন ও যুক্তি খণ্ডন করেন। তারপর
বিচারকেরা রায় দেন। তখন সে রায় সবাই মেনে নিতে বাধ্য থাকেন। কিন্তু কোনো কোনো
রায়ের ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন থেকেই যায়। বহু দিন ধরে সমাজে সে রায়ের
বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলতেই থাকে। আমি এ রায় মানি না। এ কথা
যদি আড্ডায়ও বসে বলি তাহলে আদালতের সম্ভবত কিছুই করার থাকে না। কিন্তু লিখে বললে
কোর্ট আমাকে আদালত অবমাননা মামলায় অভিযুক্ত করতে পারেন। মানুষের মুখ আদালত কখনো
আদেশ দিয়ে বন্ধ রাখতে পারেন না।
বাংলাদেশে যখন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলো তখন থেকেই দেশ-বিদেশে এর কঠোর সমালোচনা শুরু হয়। বলা হয়, এটি কোনো আন্তর্জাতিক আদালত নয়। সরকারের পক্ষ থেকে তখন বলা হয় যে, এটি দেশীয় আদালত। কিন্তু যেখানে আদালত বসে, সে ভবনের সামনে এখনো লেখা আছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ ক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্ন উঠেছিল, এটি যদি আন্তর্জাতিক আদালতই হয়ে থাকে, তা হলে এখানে আন্তর্জাতিক বিচারক কোথায়? তারপর এই ট্রাইব্যুনালে বিভিন্ন ধারা নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট, গরহাজির সাক্ষীর লিখিত সাক্ষ্য আমলে নেয়া, সাক্ষীকে উপস্থিত না করা বা করতে না পারা সব কিছুই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। তখন আইনজীবীরা বলছিলেন, এই বিধান হবে ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। সরকার সেটিও আমলে নেয়নি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৩ জন পাকিস্তান বাহিনীর সেনাসদস্যকে যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করা হয়। তারপর দালাল আইনে প্রায় লক্ষাধিক লোককে আটক করে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার। দালাল আইনে আটককৃত ব্যক্তিদের মধ্যে শুধু একজনকে ফাঁসি দেয়া হয়। বাকিদের মধ্যে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় প্রায় সবাই খালাস পেয়ে যান। যারা থাকেন শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে তাদেরও মুক্তির ব্যবস্থা করেন। শুধু তাই নয়, প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী বলে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছিল তাদেরকেও তিনি ক্ষমা করে দিয়ে বলেন, বাঙালি জাতি জানে কিভাবে ক্ষমা করতে হয়।
এ দেশে সাধারণ মানুষ তখন ধরেই নিয়েছিল, বিষয়টির বোধ করি সেখানেই ইতি ঘটল। ঘটেও ছিল তাই। তারপর বিগত ৪০ বছরে এ নিয়ে আর তেমন কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি। ২০০৮ সালের ‘আঁতাতে’র নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগ এই আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ট্রাইব্যুনালের গঠন প্রক্রিয়া ও বিচার নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকে। আর এই ট্রাইব্যুনালে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তাদের বেশির ভাগই জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা। জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির ৯০ বছর বয়স্ক অধ্যাপক গোলাম আযমও তার মধ্যে রয়েছেন। রয়েছেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ নানা রোগশোকে আক্রান্ত বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমও। আর বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
এই ট্রাইব্যুনালে দ্বিতীয় শাস্তি হয় আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর। সে রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পরপরই সারা দেশে সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়ে। তাতে পুলিশের গুলিতে প্রায় দুই শ’ মানুষের মৃত্যু হয়। সাঈদী সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব জনপ্রিয় তার ওয়াজ মাহফিলের জন্য। সাঈদীর ওয়াজ মাহফিল যারা সমাবেশে গিয়ে শোনেননি তারা শুনেছেন ক্যাসেটে। তার ওয়াজ মাহফিলের ক্যাসেট লাখে লাখে বিক্রি হয়েছে। আমি নিজেও যখন ছয়-সাত ঘণ্টা ধরে কোথাও গাড়িতে গিয়েছি নানা গানের পাশে সাঈদীর একটি ক্যাসেট কিনেছি। গাড়িচালককে যদি বলেছি রাস্তা ধার থেকে একটি ক্যাসেট কিনে নিয়ে এসো। সেও নিশ্চিতভাবে সাঈদীর একটি ক্যাসেট কিনে নিয়ে এসেছে। দূরপাল্লার বাসে যেতে ড্রাইভারেরাও চালিয়ে দিয়েছে সাঈদীর ক্যাসেট। সবাই চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনেছে তার ওয়াজ। কেউ বাধা দেয়নি।
সাঈদী যে এলাকার মানুষ, সেখানে নাকি দেইলা রাজাকার নামে এক কুখ্যাত রাজাকার ছিল। সরকার বলছে, সেই রাজাকারই পরবর্তীকালে হয়েছে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। আল্লামা সাঈদীও আদালতে বারবার অস্বীকার করেছেন, তিনি সেই দেইলা নন। কিন্তু তেমন কোনো তথ্য প্রমাণ না মিললেও তাকে দেইলা রাজাকার সাজতে হলো। এবং তার মৃত্যদণ্ড হলো। বহু বিতর্কিত এই ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায় আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো। ওই আদালতের প্রধান বিচারক লন্ডনে এক পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তি ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদের সাথে স্কাইপে যে আলোচনা করেছিলেন এবং তা যখন প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল, তখন থেকেই সম্ভবত এই ট্রাইব্যুনাল সম্পূর্ণরূপে বিতর্কিত হয়ে পড়ে। তাতে ট্রাইব্যুনালের বিচারক জিয়াউদ্দিনের কাছে একেবারেই লিখিত রায় চাইছিলেন যেন তা তিনি পড়ে শোনাবেন মাত্র।
এই কেলেঙ্কারির পর ওই বিচারক ট্রাইব্যুনাল থেকে সরে যান বটে, তবে যে কালিমা তিনি লেপন করে গেছেন, তা কখনো মোচন হয়নি। মূল ট্রাইব্যুনালে আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়ার পর, যাবজ্জীবন নয়, মৃত্যুদণ্ড এই দাবি নিয়ে সরকার শাহবাগে কিছু অকর্মণ্য-লাফাঙ্গার সমাবেশ ঘটিয়ে মাস দেড়েক ধরে নর্তন-কুর্দন করে। তারপরের রায় ছিল আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায়। প্রধানমন্ত্রীও ঘোষণা করেছিলেন, রায়ে যেন জনগণের আকাক্সার প্রতিফলন ঘটে। তারপর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার কমিশনগুলো এই রায়ের তীব্র সমালোচনা করেছে। তারা ট্রাইব্যুনালকে যেমন ত্রুটিপূর্ণ বলেছে তেমনি রায়কেও ত্রুটিপূর্ণ বলেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে সুষ্ঠু বিচারের মানদণ্ড লঙ্ঘন করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। মামলায় তার বিরুদ্ধে রায় হয়ে যাওয়ার পর আইন সংশোধন করে সে আইনের অধীনে এ মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এটা সুষ্ঠু বিচারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড লঙ্ঘন। এ রকম মানদণ্ড মেনে চলার ব্যাপারে বাংলাদেশ একটি স্বাক্ষরকারী দেশ। এতে বলা হয়, আইনের যে সংশোধন করা হয়েছে, তাও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেই। বর্তমানের আইন দিয়ে পেছনের অপরাধের বিচারেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এরূপ নিরাপত্তা না থাকলে সরকার যখন দেখবে বিচারের রায় তাদের পছন্দমতো হচ্ছে না, তখন তারা আইন সংশোধন করবে। তাও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
এ দিকে আবার আপিলের জন্য আগে যে ৯০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছিল, সরকার আইন করে তা ৩০ দিনে কমিয়ে এনেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, আইনের এই সংশোধনী ইন্টারন্যাশনাল প্রভিন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের (আইসিসিপিআরএ) পরিষ্কার লঙ্ঘন। আর বাংলাদেশ আইসিসিপিআরএ-স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী যারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়, তারা যেন সুনির্দিষ্ট মৌলিক অধিকারগুলো পায়, সমতা নিশ্চিত হয় ও আইন যথাযথ প্রক্রিয়ায় চলে, সে জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে থাকা এমন সংশোধনী বাতিল হওয়া উচিত। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার-বিষয়ক কমিটি বলেছে, যে মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, সেখানে সুষ্ঠু বিচারের গ্যারান্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি সুষ্ঠু নয় এমন বিচারে কোনো মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, তা ন্যায়বিচারের লঙ্ঘন। জনগণের চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার বর্বর এই প্রথা থেকে সরে আসার যে প্রবণতা চলছে, বাংলাদেশের উচিত এখনই তা থেকে বেরিয়ে আসা। আর লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা ইকোনমিস্ট বলেছে, আবদুল কাদের মোল্লার অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে জেল না হয়ে ফাঁসি হবে, সব সময়ই এমনটা মনে করা হয়েছিল। ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট সেই কাজটিই করেছে। কাদের মোল্লার শাস্তি পর্যলোচনা করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কঠোর এক শিক্ষা দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে। ট্রাইব্যুনাল যে মামলা আমলে নেননি, সেই মামলায়ই তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, আরো যেসব মামলার রায় এখনো হয়নি, কিংবা আপিলে রয়েছে, তাদের সবারই মৃত্যুদণ্ড হবে। কাদের মোল্লার প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, তারা সুপ্রিম কোর্টের এই রায় রিভিউয়ের আবেদন করবেন। আর সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, রিভিউ আবেদনের সুযোগ নেই। দরকার হলে তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। তার ফলাফলও যে এমনই হবে, সে কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর বিচারপ্রক্রিয়া অস্বচ্ছ হলে তা যে সহিংসতায় রূপ নিতে বাধ্য সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাংলাদেশে যখন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলো তখন থেকেই দেশ-বিদেশে এর কঠোর সমালোচনা শুরু হয়। বলা হয়, এটি কোনো আন্তর্জাতিক আদালত নয়। সরকারের পক্ষ থেকে তখন বলা হয় যে, এটি দেশীয় আদালত। কিন্তু যেখানে আদালত বসে, সে ভবনের সামনে এখনো লেখা আছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ ক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্ন উঠেছিল, এটি যদি আন্তর্জাতিক আদালতই হয়ে থাকে, তা হলে এখানে আন্তর্জাতিক বিচারক কোথায়? তারপর এই ট্রাইব্যুনালে বিভিন্ন ধারা নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট, গরহাজির সাক্ষীর লিখিত সাক্ষ্য আমলে নেয়া, সাক্ষীকে উপস্থিত না করা বা করতে না পারা সব কিছুই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। তখন আইনজীবীরা বলছিলেন, এই বিধান হবে ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। সরকার সেটিও আমলে নেয়নি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৩ জন পাকিস্তান বাহিনীর সেনাসদস্যকে যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করা হয়। তারপর দালাল আইনে প্রায় লক্ষাধিক লোককে আটক করে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার। দালাল আইনে আটককৃত ব্যক্তিদের মধ্যে শুধু একজনকে ফাঁসি দেয়া হয়। বাকিদের মধ্যে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় প্রায় সবাই খালাস পেয়ে যান। যারা থাকেন শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে তাদেরও মুক্তির ব্যবস্থা করেন। শুধু তাই নয়, প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী বলে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছিল তাদেরকেও তিনি ক্ষমা করে দিয়ে বলেন, বাঙালি জাতি জানে কিভাবে ক্ষমা করতে হয়।
এ দেশে সাধারণ মানুষ তখন ধরেই নিয়েছিল, বিষয়টির বোধ করি সেখানেই ইতি ঘটল। ঘটেও ছিল তাই। তারপর বিগত ৪০ বছরে এ নিয়ে আর তেমন কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি। ২০০৮ সালের ‘আঁতাতে’র নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগ এই আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ট্রাইব্যুনালের গঠন প্রক্রিয়া ও বিচার নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকে। আর এই ট্রাইব্যুনালে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তাদের বেশির ভাগই জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা। জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির ৯০ বছর বয়স্ক অধ্যাপক গোলাম আযমও তার মধ্যে রয়েছেন। রয়েছেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ নানা রোগশোকে আক্রান্ত বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমও। আর বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
এই ট্রাইব্যুনালে দ্বিতীয় শাস্তি হয় আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর। সে রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পরপরই সারা দেশে সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়ে। তাতে পুলিশের গুলিতে প্রায় দুই শ’ মানুষের মৃত্যু হয়। সাঈদী সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব জনপ্রিয় তার ওয়াজ মাহফিলের জন্য। সাঈদীর ওয়াজ মাহফিল যারা সমাবেশে গিয়ে শোনেননি তারা শুনেছেন ক্যাসেটে। তার ওয়াজ মাহফিলের ক্যাসেট লাখে লাখে বিক্রি হয়েছে। আমি নিজেও যখন ছয়-সাত ঘণ্টা ধরে কোথাও গাড়িতে গিয়েছি নানা গানের পাশে সাঈদীর একটি ক্যাসেট কিনেছি। গাড়িচালককে যদি বলেছি রাস্তা ধার থেকে একটি ক্যাসেট কিনে নিয়ে এসো। সেও নিশ্চিতভাবে সাঈদীর একটি ক্যাসেট কিনে নিয়ে এসেছে। দূরপাল্লার বাসে যেতে ড্রাইভারেরাও চালিয়ে দিয়েছে সাঈদীর ক্যাসেট। সবাই চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনেছে তার ওয়াজ। কেউ বাধা দেয়নি।
সাঈদী যে এলাকার মানুষ, সেখানে নাকি দেইলা রাজাকার নামে এক কুখ্যাত রাজাকার ছিল। সরকার বলছে, সেই রাজাকারই পরবর্তীকালে হয়েছে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। আল্লামা সাঈদীও আদালতে বারবার অস্বীকার করেছেন, তিনি সেই দেইলা নন। কিন্তু তেমন কোনো তথ্য প্রমাণ না মিললেও তাকে দেইলা রাজাকার সাজতে হলো। এবং তার মৃত্যদণ্ড হলো। বহু বিতর্কিত এই ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায় আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো। ওই আদালতের প্রধান বিচারক লন্ডনে এক পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তি ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদের সাথে স্কাইপে যে আলোচনা করেছিলেন এবং তা যখন প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল, তখন থেকেই সম্ভবত এই ট্রাইব্যুনাল সম্পূর্ণরূপে বিতর্কিত হয়ে পড়ে। তাতে ট্রাইব্যুনালের বিচারক জিয়াউদ্দিনের কাছে একেবারেই লিখিত রায় চাইছিলেন যেন তা তিনি পড়ে শোনাবেন মাত্র।
এই কেলেঙ্কারির পর ওই বিচারক ট্রাইব্যুনাল থেকে সরে যান বটে, তবে যে কালিমা তিনি লেপন করে গেছেন, তা কখনো মোচন হয়নি। মূল ট্রাইব্যুনালে আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়ার পর, যাবজ্জীবন নয়, মৃত্যুদণ্ড এই দাবি নিয়ে সরকার শাহবাগে কিছু অকর্মণ্য-লাফাঙ্গার সমাবেশ ঘটিয়ে মাস দেড়েক ধরে নর্তন-কুর্দন করে। তারপরের রায় ছিল আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায়। প্রধানমন্ত্রীও ঘোষণা করেছিলেন, রায়ে যেন জনগণের আকাক্সার প্রতিফলন ঘটে। তারপর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার কমিশনগুলো এই রায়ের তীব্র সমালোচনা করেছে। তারা ট্রাইব্যুনালকে যেমন ত্রুটিপূর্ণ বলেছে তেমনি রায়কেও ত্রুটিপূর্ণ বলেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে সুষ্ঠু বিচারের মানদণ্ড লঙ্ঘন করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। মামলায় তার বিরুদ্ধে রায় হয়ে যাওয়ার পর আইন সংশোধন করে সে আইনের অধীনে এ মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এটা সুষ্ঠু বিচারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড লঙ্ঘন। এ রকম মানদণ্ড মেনে চলার ব্যাপারে বাংলাদেশ একটি স্বাক্ষরকারী দেশ। এতে বলা হয়, আইনের যে সংশোধন করা হয়েছে, তাও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেই। বর্তমানের আইন দিয়ে পেছনের অপরাধের বিচারেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এরূপ নিরাপত্তা না থাকলে সরকার যখন দেখবে বিচারের রায় তাদের পছন্দমতো হচ্ছে না, তখন তারা আইন সংশোধন করবে। তাও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
এ দিকে আবার আপিলের জন্য আগে যে ৯০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছিল, সরকার আইন করে তা ৩০ দিনে কমিয়ে এনেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, আইনের এই সংশোধনী ইন্টারন্যাশনাল প্রভিন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের (আইসিসিপিআরএ) পরিষ্কার লঙ্ঘন। আর বাংলাদেশ আইসিসিপিআরএ-স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী যারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়, তারা যেন সুনির্দিষ্ট মৌলিক অধিকারগুলো পায়, সমতা নিশ্চিত হয় ও আইন যথাযথ প্রক্রিয়ায় চলে, সে জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে থাকা এমন সংশোধনী বাতিল হওয়া উচিত। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার-বিষয়ক কমিটি বলেছে, যে মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, সেখানে সুষ্ঠু বিচারের গ্যারান্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি সুষ্ঠু নয় এমন বিচারে কোনো মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, তা ন্যায়বিচারের লঙ্ঘন। জনগণের চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার বর্বর এই প্রথা থেকে সরে আসার যে প্রবণতা চলছে, বাংলাদেশের উচিত এখনই তা থেকে বেরিয়ে আসা। আর লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা ইকোনমিস্ট বলেছে, আবদুল কাদের মোল্লার অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে জেল না হয়ে ফাঁসি হবে, সব সময়ই এমনটা মনে করা হয়েছিল। ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট সেই কাজটিই করেছে। কাদের মোল্লার শাস্তি পর্যলোচনা করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কঠোর এক শিক্ষা দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে। ট্রাইব্যুনাল যে মামলা আমলে নেননি, সেই মামলায়ই তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, আরো যেসব মামলার রায় এখনো হয়নি, কিংবা আপিলে রয়েছে, তাদের সবারই মৃত্যুদণ্ড হবে। কাদের মোল্লার প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, তারা সুপ্রিম কোর্টের এই রায় রিভিউয়ের আবেদন করবেন। আর সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, রিভিউ আবেদনের সুযোগ নেই। দরকার হলে তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। তার ফলাফলও যে এমনই হবে, সে কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর বিচারপ্রক্রিয়া অস্বচ্ছ হলে তা যে সহিংসতায় রূপ নিতে বাধ্য সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন