কোনো আপস সমঝোতা ছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ঘোষণা
দিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যত এক রাজনৈতিক যুদ্ধের ডাক দিলেন। এ যুদ্ধে কে জিতবে তা
এ মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা হয়তো সম্ভব নয়, তবে এতে যে
বাংলাদেশের হার হবে তাতে সংশয়ের খুব একটা অবকাশ নেই। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা
গণতন্ত্রের একটি অনস্বীকার্য বৈশিষ্ট্য। আবার কার্যকর গণতন্ত্রের এটিও একটি
বৈশিষ্ট্য যে, ব্যালট যুদ্ধে জয়-পরাজয়
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতি টেনে সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরি করে।
কোনো পক্ষ যখন ব্যালটের ওপর আস্থা হারিয়ে জয়কে জোর করে নিজ পক্ষে করায়ত্ত করতে
চায়, তখন সহিষ্ণু-সহাবস্থান অনিবার্যভাবে যুদ্ধের পথ তৈরি
করে। রাষ্ট্র বিচ্যুত হয় গতিময়তার লাইন থেকে। একবার এ ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭৫ সালে, আবার ২০০৭ সালে। এবার নতুন এবং আরো প্রলয়ঙ্করীভাবে যেন ঘটতে
যাচ্ছে সেটি।
নানা দৃশ্যকল্প
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী তার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে ১০ম সাধারণ নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশন আকস্মিক অথবা অন্য যেকোনো ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে। সচিবদের সভায় প্রধানমন্ত্রীর ব্রিফিং, নির্বাচনে নৌকাকে ভোট দিতে তার অবিরাম আহ্বান, হঠাৎ করে বিরোধী পক্ষের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোকে সচল করে দেয়া, ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগে প্রক্রিয়াধীন মামলার রায় নিয়ে জল্পনাÑ এসব কিছু বলে দিচ্ছে সরকার একতরফা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। তবে এ নির্বাচনে ‘তৈরি’ কোনো ফলাফলকে বৈধতা দিতে বিরোধী পক্ষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। সে প্রয়োজনকে সামনে রেখে বিরোধী পক্ষের প্রতি চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে তারা যেন নির্বাচনে অংশ নেয়।
এক সময় প্রভাবশালী এক কূটনৈতিক অংশীদারের পক্ষ থেকে বিএনপিকে বলা হয়েছিল নির্বাচনে এলে আগামী সংসদে আসন সংখ্যা বাড়িয়ে তাদের সম্মানজনক বিরোধী দলের মর্যাদা দেয়া হবে। হয়তো আসন সংখ্যা ৩০ থেকে বেড়ে ১৩০ হতে পারে। আর নির্বাচনে না এলে নেতাদের ঢোকানো হবে জেলে। কারাদণ্ড দিয়ে রাজনীতি করার অযোগ্য করা হবে। বিএনপি করার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যাবে নাÑ এমন কথাও বলা হয়। প্রভাবশালী প্রতিবেশীদের দেয়া এ প্রস্তাবে সাড়া না পেয়ে এখন নতুন প্রস্তাব প্রণয়ন করা হয়েছে। এবারের প্রস্তাবের সূত্রও সেই একই। এখন পক্ষ ভারী করার জন্য এ প্রস্তাবে আরো আন্তর্জাতিক সহযোগীকে এর সাথে আনার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।
সাদামাটাভাবে নতুন প্রস্তাব দেখলে বেশ নির্দোষই মনে হবে। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এর মধ্যে একটি ফাঁক খুঁজে পাওয়া যাবে। নতুন প্রস্তাবে বলা হচ্ছে, বিএনপিকে সরকার গঠনের মতো মোটামুটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়া হবে। আওয়ামী লীগ এত আসন পাবে যে সরকার গঠনে সমর্থ না হলেও শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে থাকবে এখনকার শাসক দল। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় বিএনপি সংবিধানে কোনো ধরনের সংশোধনী আনতে পারবে না। অবশ্য বিএনপিকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে তারা মামলা দেবে না, করবে না গ্রেফতার ও হয়রানি। কানেক্টিভিটি (ট্রানজিট/করিডোর) ও সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে আগের সরকারের মতো সহযোগিতা দিয়ে যাবে।
নতুন প্রস্তাবে বলা হচ্ছে, বিএনপি ও ১৮ দল বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে সম্মত হলেই কেবল তাদের এই নিশ্চয়তা দেয়া হবে। আর না হলে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন মামলায় এমনভাবে শাস্তি দেয়া হবে যে, এতে তাদের রাজনৈতিক জীবনের ইতি ঘটবে। বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারেরও ধ্বংস ঘটানো হবে। বিএনপি হয়ে যাবে ছিন্নভিন্ন। এসব করতে মিসরের মতো এমন এক সরকার নিয়ে আসা হবে যাদের কর্মকাণ্ডে দয়া-মায়া দেশপ্রেমের চেয়ে বাইরের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হবে মুখ্য। সেই সরকার হবে সেকুলার। তবে এ সরকারকে ক্ষমতায় আনার আগে আওয়ামী লীগকে দিয়ে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের মামলা ও শাস্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে নেয়া হবে। আদালতকে ব্যবহার করে নিষিদ্ধ করা হবে জামায়াতকে। আরো কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে ফাঁসির দণ্ডাদেশ ঘোষণা করা হবে। এক বা একাধিক দণ্ড কার্যকর করার ঘোষণা দেয়া হবে। জামায়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে। জঞ্জাল সব পরিষ্কার করা হবে আওয়ামী লীগকে দিয়ে।
এখন যে জনমত রয়েছে তাতে আওয়ামী লীগের কট্টর কোনো সমর্থকও দাবি করবে না শক্তিশালী বিরোধী দল হওয়ার মতো আসন দলটি পাবে। আর দুই-তৃতীয়াংশ আসন কোনোভাবেই ১৮ দল পাবে না। এটি কেবল তখনই সম্ভব যদি ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ফলাফলকে ভোটের জনমতের প্রতিফলনের পরিবর্তে পরিকল্পিতভাবে বিন্যাস করা হয়। ২০০৭ সালের নির্বাচনে ২০ শতাংশের মতো ব্যালট মুদ্রণ করে মহাজোটের পক্ষে নির্বাচিত আসনগুলোতে ফেলা হয়েছে বলে যে অভিযোগ রয়েছেÑ সে রকম কিছু একটা এ জন্য করতে হবে। এর জন্য দরকার আওয়ামী লীগের সরকার। সেনা প্রতিষ্ঠানের ইকুয়েশন এখন আর আগের মতো নেই যে, এ ধরনের কর্মকাণ্ডে তারা সাহায্য করবে। তবে ক্ষমতায় থাকলে আর বাইরের ক্ষমতাধরেরা চাইলে সেটি সম্ভব হলেও হতে পারে।
আর একটি বিষয়েও রয়েছে নানা সংশয়। এ রকম একটি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের আসন সম্ভাব্য ৩০ থেকে ১৩০-এ নেয়া এবং বিএনপির আসন সম্ভাব্য ২৫০ থেকে ১৫০-তে নামিয়ে আনা সম্ভব হলে আওয়ামী লীগ বা মহাজোটের আসন ১৫০-এর ওপরে নেয়া সম্ভব হবে না কেন? সেটি যদি হয় তবে বিএনপির আমও যাবে, সেই সাথে যাবে ছালাও। এ উৎকণ্ঠা দূর করতে বলা হচ্ছে, সমঝোতার বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হলে নির্বাচন তদারকিতে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততাও নিয়ে আসা যাবে। কিন্তু ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ফলাফল বিএনপিকে স্বস্তি দেয়ার মতো ছিল না। এখন যে হবে তার নিশ্চয়তা কোথায়?
কেন এই প্রস্তাব
বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার এই প্রস্তাব দেয়ার নানা কারণ থাকতে পারে। এর সব কারণ একেবারে নেতিবাচক নাও হতে পারে। প্রথমত, বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশে নির্বাচন কোনোক্রমেই আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা ও স্বীকৃতি পাবে না। এ কারণেই ২০০৭ সালে কৌশলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনা হয়েছিল। সে সময় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া একেবারে অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোটের সহযোগী দল ও কূটনৈতিক মহলের চাপে নির্বাচনে অংশ নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচনী ফলাফল নির্ধারণে সুচারুভাবে তৈরি ফাঁদে পা দেয়ায় পর বিএনপির পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব হয়নি। এবারো সে রকম একটি পরিবেশ তৈরি করে বিএনপি ও ১৮ দলকে নির্বাচনে নেয়ার চেষ্টা করা হতে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৮ দল দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এলে সংবিধানে আওয়ামী লীগের স্বার্থে আনা পরিবর্তনগুলো আবার পাল্টে যেতে পারে। সমঝোতার মাধ্যমে এমন একটি নির্বাচন যদি করা যায় যেখানে ১৮ দল ক্ষমতায় গেলেও সংবিধান সংশোধনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে নাÑ সে ক্ষেত্রে বড় ক্ষতিটাকে অন্তত নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর সামান্য ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে প্রয়োজনে কিছু এমপি ভাগিয়ে নিয়ে সময়মতো সরকারের পতনও নিশ্চিত করা যাবে।
১৮ দলকে আগামী নির্বাচনে সরকারে নেয়ার প্রস্তাবের পেছনে একটি কারণ এ-ও হতে পারে যে, শাসক বহাল রাখা বা পরিবর্তনের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে যেসব আন্তর্জাতিক শক্তিকে এক স্থানে নিয়ে আসতে হবে তারা আওয়ামী লীগকে আবারো ক্ষমতায় আনার জন্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এতটা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে রাজি নাও হতে পারে। এটি করা হলে কোনোভাবে বাংলাদেশে স্থিতিশীল পরিস্থিতি ফেরানো যাবে না বলে তারা মনে করতে পারে।
তাৎপর্যের একটি বিষয় হলো বিরোধী পক্ষকে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে আসতে এমনভাবে চাপ দেয়া হচ্ছে যেন নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি পরিকল্পনাকারীদের হাতে থাকে। এ ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টির জন্য এমন কিছু পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে যাকে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার অংশ বলে মনে হয়। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা আকস্মিকভাবে দ্রুততর করা হয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড মামলার বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সম্পৃক্ততা রয়েছে মর্মে বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্য আনুষ্ঠানিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের আমির মাওলানা নিজামীসহ অন্য কয়েকটি মামলা দ্রুত সম্পন্ন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব করে এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে একটি চাপ তৈরি করা হচ্ছে।
কী চায় আওয়ামী লীগ
দেশের পরিস্থিতি পরিবর্তনের সাথে সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্মকৌশলেও আসছে পরিবর্তন। তবে একটি ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি। সেটি হলো, বিএনপি বা ১৮ দল ক্ষমতায় আসতে পারে এমন কোনো নির্বাচন হতে না দেয়া। এক সময় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের এমন একটি ধারণা ছিল যে, তাদের বাস্তবায়ন করা উন্নয়ন কর্মসূচি, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন ও বিচার সম্পন্ন করা এবং জঙ্গিবাদ মৌলবাদবিরোধী অভিযানে জনগণ একাট্টা হয়ে ব্যাপকভাবে সমর্থন জানাচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রথম জনসমর্থনের বরফ গলার ইঙ্গিত অনুভব করে আওয়ামী লীগ নেতারা। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একই ধারাবাহিকতায় পরপর আরো সাতটি সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা হেরে যাওয়ার পর অবাধ নির্বাচনের ওপর কোনোভাবেই আর আস্থা রাখতে পারছে না আওয়ামী লীগ। ফলে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদায়ের যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল সে অবস্থানে কঠোরভাবে দাঁড়িয়ে আছে শাসক দল। এক সময় আওয়ামী লীগের সামনে যে তিনটি বিকল্প ছিল সেটি পরিবর্তিত হয়ে এখন এসেছে দু’টিতে। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়ে দুই দলের নির্বাচিতদের দিয়ে অন্তর্বর্তী নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের যে একটি ভাবনা ছিল সেটি এখন পরিত্যক্ত।
আওয়ামী লীগের সামনে এখন রয়েছে দু’টি বিকল্প। এর প্রথমটি হলো শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় পরবর্তী নির্বাচন হওয়া। বড়জোর বিএনপি চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারে তাদের জনাকয়েক প্রতিনিধি নেয়া যেতে পারে। এ প্রস্তাবে রাজি করানোর জন্য কূটনৈতিক শুভার্থীদের দিয়ে বিরোধী পক্ষকে নির্বাচনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াত রাজি হয়ে গেলে ফল কিভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে তার হিসাবও করা আছে।
কোনো কারণে বিরোধী পক্ষকে আনতে না পারলেও প্রশাসনকে ব্যবহার করে একতরফা নির্বাচনকে একটি ফলাফলের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে চায় সরকার। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের যে ব্যবস্থা করার ঘোষণা ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে, তার সাথে রয়েছে এর বিশেষ সম্পর্ক।
একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ যদি অনেক বেশি হয়ে যায় আর অভ্যন্তরীণভাবে বিরোধী দলের আন্দোলনে তৈরি হয় অচলাবস্থাÑ তাহলে বেছে নেয়া হবে দ্বিতীয় বিকল্প। সে বিকল্পের স্বরূপ হবে সেনা কর্তৃপক্ষের সাথে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব। এক এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ড. ফখরুদ্দীন আহমদ ও উপদেষ্টারা যে ক্ষমতা ভোগ করেছিলেন সে ধরনের ক্ষমতা থাকবে বর্তমান সরকারের। আর নেপথ্যে ক্ষমতা চর্চা করবে সেনা নেতৃত্ব। বড় বড় অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদনে তাদের বক্তব্যকে প্রাধান্য দেয়া হবে। পদ্মা সেতুর মতো কিছু কাজ প্রত্যক্ষভাবে সেনা তত্ত্বাবধানে হবে। ক্ষমতার অংশীদার করার বিপরীতে আওয়ামী লীগ সরকার চাইবে তারা অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জারিকৃত জরুরি অবস্থা বলবৎ করতে সহায়তা করবে। দমন করবে বিরোধীদের।
আওয়ামী লীগের এই দুই বিকল্পের কোনোটিই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হবে কি-না তা নির্ভর করবে অন্য পক্ষগুলোর ওপর। তবে পতনোন্মুখ কোনো সরকারের নানা কর্ম-অপকর্মের দায় রাষ্ট্রের ক্ষমতাশালী কোনো প্রতিষ্ঠান কেন নিতে যাবেÑ সে ব্যাপারে সন্দিহান পর্যবেক্ষকেরা। ফলে নানা পক্ষের ইচ্ছা অনিচ্ছার মাঝখানে একটা কিছু শেষ পর্যন্ত ঘটে যেতে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিএনপির সামনে বিকল্প
বিএনপি আসলেই কী করবেÑ সেটি একটি বিরাট প্রশ্ন। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই মনে করেন বিএনপি ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে। যেকোনোভাবে একটি নির্বাচন হলেই মানুষ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় নিয়ে যাবে বিএনপিকে। এ ক্ষেত্রে বাধা হলো অসংবিধানিক কোনো সরকারের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা। আন্দোলন সংগ্রাম করলে সে সম্ভাবনা আবার বেড়ে যায় কিনা সে সন্দেহ তাদের তাড়া করে ফিরছে। অসাংবিধানিক সরকার দীর্র্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতায় জেকে বসে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নকে শেষ করে দেবেÑ সরকারের বিভিন্ন পক্ষের এ প্রচার নেতৃত্বের একটি অংশকে যে ভীত করেছে তাতে সংশয় নেই। এ বিষয়টি জেনেই হয়তো আওয়ামী লীগ হাই কমান্ড মনে করছে বিএনপি নির্বাচনে না এসে যাবে কোথায়?
বিএনপির অনেক নেতা নির্বাচনে যাওয়াকে অগ্রাধিকার দেয় কিন্তু কোনোভাবেই আবার ২০০৭ সালের মতো পাতা ফাঁদে পা দিতে চায় না। এ কারণে বিরোধী জোট সামনে নির্বাচন ও আন্দোলন দু’টি বিকল্পই রেখেছে। আন্দোলনের বিকল্প তাদের জন্য অনিবার্য হয়ে উঠলে সে আন্দোলনকে সিদ্ধান্তকারী পর্যায়ে নেয়ার প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে বলে বিএনপি নেতৃত্ব ভুল্লখ করছে।
বড় ভূমিকায় বাইরের শক্তি
বাংলাদেশে অন্যান্য সময়ের মতো এবারো শাসন পরিবর্তনে বড় ভূমিকায় দেখা যেতে পারে আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোকে। এবার জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে সে ভূমিকা পালন করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব। তাদের ইচ্ছা ও স্বার্থের মধ্যে বেশ ব্যবধান থাকলেও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের ব্যাপারে এখনো ঐকমত্য রয়েছে তাদের মধ্যে। সেটি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে মোড় নেয় তা দেখতে আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। তবে সবকিছু যেন ক্রমেই পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। চলতি সেপ্টেম্বর হলো চূড়ান্ত মেরুকরণের মাস। অক্টোবরে হয়তোবা ঝড়। এই রাজনৈতিক ঝড়ের পরিণতি যেমন হতে পারে স্বস্তিকর, তেমনিভাবে ভয়ঙ্কর হওয়ার শঙ্কাটিও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন