বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

আঘাতটা স্পষ্ট এবং সরাসরি

পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর আগের কথা। ঘটনাটি স্মৃতিতে এখনো একেবারে টাটকা। ইসলামপন্থী একটি দলের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে ঢুকলেন। তার গতি ছিল মেহরাবের দিকে। তাকে দেখে ইমাম সাহেব সরে দাঁড়ালেন। নেতানামাজ পড়বার প্রস্তুতি নিলেন। যথারীতি নামাজে ইমামতি করলেন। নামাজ শেষে তিনি মসজিদ ত্যাগ করে বাইরে যাচ্ছিলেন। মসজিদের সামনে দাঁড়ানো ছিল গ্লাসভর্তি পানি নিয়ে দু-তিনজন সাধারণ মহিলা ও একটি বালিকা। বালিকাটির বয়স সাত-আট বছরের মতো হবে। অন্যদের বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। তারা ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। নেতারদিকে তাদের চোখ পড়ল কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। একে একে সব নামাজি মসজিদ ত্যাগ করে চলে গেলেন। সব শেষে বের হয়ে এলেন ইমাম সাহেব। অপেক্ষমাণ মহিলারা তাদের হাতের গ্লাস ইমাম সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ইমাম সাহেবও হাত বাড়িয়ে একে একে গ্লাসভর্তি পানিতে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিলেন। পুরো বিষয়টি আমার কাছে বেশ অর্থবোধক মনে হলো। মানুষ যে ধর্মীয় নেতা ও অন্যান্য নেতাকে এক চোখে দেখে না তার একটি চাুষ প্রমাণ পেলাম। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। ধর্মভীরু। অসুখে-বিসুখে তারা মহল্লার মসজিদের ইমামের কাছে দৌড়ায়। একটু দোয়া কামনা করে। পানিপড়া, তাবিজ-তুমার কতটা কার্যকর, আদৌ কার্যকর কি না তা নিয়ে না ভেবেই হুজুরেরশরণাপন্ন হয়। পুরো বিষয়টি বিশ্বাসতাড়িত এবং স্বতঃস্ফূর্ততার বিষয়। ইমাম সাহেব বিশ্বাস ও অখণ্ড আস্থার জায়গায় অবস্থান করেনÑ এটিই মোদ্দাকথা। প্রসঙ্গে কিংবদন্তিতুল্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদের একটি ছোট্ট নাটিকার মতো মনে পড়ল। ডলি জহুর হাভাতে গৃহস্থ ঘরের বিধবা। তিন সন্তানের মা। একবার এক সন্তান ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলো। বিধবা সাহায্যের জন্য ইমাম সাহেবের শরণাপন্ন হলেন। ইমাম সাহেব দ্রুত রোগী নিয়ে থানা হেডকোয়ার্টারে রওনা হলেন। শেষ পর্যন্ত শিশুটি বাঁচল না। কিন্তু ইমাম সাহেব মানবিক আচরণের উপমা হয়ে থাকলেন। সম্ভবত ইউনিসেফ এই ডকুমেন্টারিটি তৈরি করেছিল। এটি ছিল আবহমান বাংলার একটি খণ্ডচিত্র কিন্তু যথার্থ। আমাদের বিশ্বাসের দেয়াল যতটা ক্ষয়ে যাক; কিন্তু এখনো ধর্মীয় নেতৃত্বের অবস্থানে আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, ইমাম-মোয়াজ্জিনরা অত্যন্ত মর্যাদার সাথে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। জনগণের বিশ্বাসের এই জায়গাটিতে কেউ ফাটল ধরাতে পারেনি। আধিপত্য বিস্তারের শুরুতেই ইংরেজরা আমাদের ধর্মীয় নেতৃত্বের ভিত্তি এবং শক্তি বুঝেছিল। তারা সেটি উপড়ে ফেলার জন্য বিভিন্ন ধরনের জীবনবিমুখ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মীয় তৎপরতাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল। তবে সেই ধর্ম ছিল প্রাণহীন, জীবনবিমুখ, কতকটা বিকৃতাচারও। তাতে জনগণ বিভ্রান্ত হয়েছে। হোঁচট খেয়েছে। ধর্মের প্রকৃত প্রাণস্পর্শী আবেদন বুঝতে অক্ষম থেকেছে, কিন্তু বিলম্বে হলেও ইংরেজদের ষড়যন্ত্র বুঝতে কষ্ট হয়নি। শেষ পর্যন্ত সঠিক ধারার আলেমরাই জনগণের সামনে এসে ধর্মীয় ও জাতীয় নেতৃত্ব দিয়েছেন। ইংরেজ খেদাও আন্দোলন আক্ষরিক অর্থে আলেম-ওলামারাই শুরু করেছিলেন। ইংরেজরা জানত আলেম-ওলামাদের ভেতর যে শিক্ষা আছে সেটি কোনো-না-কোনো সময় শত্রু বন্ধু চিনিয়ে দেবেই। ইংরেজদের সেই ধারণা ভুল ছিল না। ইংরেজ তাড়াবার পরও শাসকেরা আলেম-ওলামাদের বেশি সহ্য করতে চায়নি। তবে কোনো শাসকই পথ আগলে দাঁড়ায়নি। মসজিদ-খানকা ও হুজরায় আলেমদের নিরুপদ্রব জীবনকে ভীতির চোখে দেখেনি। ইংরেজদের পর এবারই প্রথম দেখলাম মহাজোট সরকার জনগণের চেনাজানা ধর্মীয় নেতৃত্বকে উপড়ে ফেলার বিভিন্ন ধরনের উপায়-উদ্যোগ নিলো। প্রকৃত ধর্মীয় নেতৃত্বকে বিতর্কিত করার জন্য কিছু আজন্ম দরবারি আলেম, কবর-মাজার ও বাজার পূজারিদের সামনে এনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল। কওমি মাদরাসার ছাত্র কমানোর বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নিলো। হেফাজত দমনের নামে দেশের সব মাদরাসা, মক্তব ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা সৃষ্টি করল। জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতা মোকাবেলার নামে মানুষের চিরায়ত বোধ-বিশ্বাসের শিকড় উপড়ে ফেলার জন্য রাষ্ট্রশক্তি নিয়োগ করল। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের মতো একটি নন্দিত প্রতিষ্ঠানকে বিভাজন, বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর কাজে লাগিয়ে দেয়া হলো। সরকার নিজেও জানে না, এর মাধ্যমে তারা আঘাতটা কোথায় করেছে। এর ক্ষতটা কত গভীর। প্রভাবটা কত বেশি সুদূরপ্রসারী। হেফাজতকে শাসাতে গিয়ে সরকার আমাদের ধর্মবিশ্বাসের স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত হেনেছে। দেশের অসংখ্য সরলপ্রাণ মানুষকে ভুল বার্তা দিয়েছে। জামায়াত-শিবির খেদাও আন্দোলনে সরকার রাজনৈতিক শত্রু বাড়িয়েছে। নিজেদের ইমেজ ুণœ করেছে। দ্বিমুখী আচরণ করে জনগণের বিশ্বাসকেও টলিয়ে দিয়েছে। আবার জামায়াত-শিবিরের সাথে যাদের সম্পর্ক ছিল না তাদেরকেও মজলুমের প্রতি সহমর্মিতা জানানোর একটা জায়গা করে দিয়েছে। তারপরও সরকার হয়তো ভাবতে পারে, জামায়াত-শিবির খেদাও আন্দোলনের একটি রাজনৈতিক অ্যাপ্রোচ আছে, কিন্তু হেফাজত ও কওমি মাদরাসা উৎখাত আন্দোলনের সাথে তেমন কোনো রাজনৈতিক অ্যাপ্রোচ জনগণ গ্রহণ করতে মোটেও চাইবে না। এ সরকার শপথ নেয়ার পর থেকেই একের পর এক শত্রু বাড়ানোর দায় কেন নিলো এখনো বোধগম্য হয়নি। ভারতবান্ধব হতে সরকার যতটা আন্তরিক, বাংলাদেশের গণবিচ্ছিন্ন ও নষ্ট বামদের কোলে তুলে নাচতে যতটা নিষ্ঠাবান কিংবা বিলাসী নাস্তিক নামের সংশয়বাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে যতটা সংবেদনশীল, বাংলাদেশের ইসলামপন্থী, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও ধর্মপ্রাণ মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে সরকার যেন ততটাই মরিয়া। সরকার কেন, কার ইন্ধনে এ ধরনের একটি নোংরা ও জাতিঘাতী খেলায় মেতে উঠল তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। ভারতের অভিসন্ধি বোঝার জন্য অনেক বেশি বোদ্ধা হতে হয় না, এটিই যথেষ্ট যে, তারা আমাদের দেশের নাগরিকদের ফাঁসিতে ঝুলাতে আগ্রহী, ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ বাধাতে উৎসাহী, বিভাজন ও বিভক্তিকে উসকানি দিতে একপায়ে খাড়া। সাধারণ বিবেকের প্রশ্ন, ১৯৫ জন চিহ্নিত পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী ও ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে জামাই আদরে ছেড়ে দিয়ে বাহবা নিতে ভারত আমাদের সরকারকে আমলে নিতে কোনো দায়বোধ করেনি। অথচ তাদের সহযোগীদের বিচারে তারা অতি উৎসাহী; এটি কোন ধরনের নৈতিক আচরণ। বাঙালি মুসলমান পরস্পর খুনোখুনি করে নিপাত যাক- এটিই কি ভারত চায়। এখন সরকার জঙ্গি প্রজনন ঠেকাতে নিজের দেশের নাগরিকদের গিনিপিগ বানাচ্ছে। একই সাথে শত্রুর প্রজনন বাড়িয়ে তুলছে। ভারতÑ সরকারের এই নীতিতে সমর্থন জোগাচ্ছে । এ উদ্দেশ্যটা কি মহৎ কিছু! একটা সরকার অনেক নিষ্ঠুর সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিকদের বিরাগভাজন হতেই পারে। দেশ জাতির স্বার্থে অনেক সময় সরকার সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেয়, যা তৎক্ষণাৎ নাগরিক মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তারপরও দেশ জাতির কল্যাণে সরকার কঠোর হয়। কিন্তু দেশকে বিভক্ত করতে এই নিষ্ঠুরতা ও কঠোরতা কেন। এ সরকার তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি; সেই স্থলে সরকার ঐক্য ভেঙে বিভেদ সৃষ্টি করছে কার স্বার্থে। শেয়ার মার্কেট, ডেসটিনি, যুবক, হলমার্কসহ প্রায় সব ইস্যুতেই সিদ্ধান্তহীনতায় লক্ষ-কোটি মানুষকে সরকার প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। অসংখ্য মানুষের আহাজারি আকাশ-বাতাস ভারী করেছে। সরকার কেন বুঝতে চাইবে না প্রতিটি খুন, গুম, হত্যা, অত্যাচার, জেল-জুলুমের বিনিময়ে সরকার শুধু অভিশাপ কিনে নেয়নি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বানিয়েছে অজস্র মানুষকে। রানা প্লাজা, পদ্মা-রেল কোথাও সরকার জনবান্ধব হতে পারল না। বিনয় এ সরকারকে কখনো স্পর্শ করেনি। সরকারের ক্ষমতার দম্ভ কোনো মানুষ উপভোগ করে না। এটি যেন দগদগে ক্ষতের ওপর নুনের ছিটার মতো কষ্ট বাড়ায়। এখন সাধারণ যোগ অঙ্ক করে বলে দেয়া যায়, এই মেয়াদে সরকার ক্ষমতাচর্চা করতে গিয়ে কত মানুষকে সুবিধাভোগী বানিয়েছে। আর কত মানুষকে নানা কারণে বিগড়ে দিয়েছে। অঙ্কে কাঁচা বালকও বলবে সরকার মাইনাসে রয়েছে। তারপরও সরকার এবং সরকারের মুখপাত্ররা কোন ভরসায় বিরোধী জোটের মুরোদ মাপতে চায়। কেনই বা ক্ষমতার অহঙ্কারকেই শেষ ভরসা বিবেচনা করতে চায় তা মোটেও বোধগম্য নয়। আমাদের কাছে স্পষ্টÑ জঙ্গিবাদ, তালেবান, আলকায়েদা, চরমপন্থী, মৌলবাদী বলে চিৎকার করলে পশ্চিমারা খুশি হয়। দেশ-জাতির কোনো উপকার হয় না। ভারতও এই এজেন্ডায় তৎক্ষণাৎ সায় দেয়। যারা আমাদের ওপর ছড়ি ঘুরাতে চায় তারা সবাই জানে ধর্মপ্রাণ মানুষ স্বাধীনচেতা হয়। সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কোনো শক্তির কাছে মাথা নোয়াতে চায় না। এরা প্রভাবক হয়, প্রভাবিত হয় কম। বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফি আগ্রাসী ও আধিপত্যবাদীদের জন্য কোনো সুখকর বিষয় নয়, যা বাংলাদেশের জন্য অহঙ্কার। সরকার ও তার দেশী-বিদেশী মিত্ররা এই অহঙ্কারটাকে ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়। তারা ভাবে ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতাসীনদের ব্যবহার করার জন্য এই অস্ত্রটাই যুৎসই। তাই আঘাতটা স্পষ্ট এবং সরাসরি।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads