বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সাংবিধানিক সঙ্কটের আবর্তে জাতীয় নির্বাচন

আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থাকে অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, Elections are key way for citizens in a democracy to communicate with representatives.. তাত্ত্বিক দিক দিয়ে যাই থাকুক না কেন বাংলাদেশের জন্য দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪২ বছরেও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি বা করতে দেয়া হয়নি। নির্বাচন যখনই ঘনিয়ে আসে তখনই সাংবিধানিক বিতর্কের বিষয়টি মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যদিও এ সংবিধান নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ধারণার মাত্রা অত্যন্ত দুর্বল। আর হাতেগোনা যে কজন সংবিধান নিয়ে কাজ করেন, কথা বলেনÑ তারা নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে তাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তুলে ধরেন, যা রাজনৈতিক সঙ্কটকে আরো তীব্রতর করে তোলে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় চারটি পদ্ধতিতে সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। প্রথমত : অনুমোদনের মাধ্যমে বা রাজার আদেশের মাধ্যমে; দ্বিতীয়ত : সুপরিকল্পিত রচনার মাধ্যমে; তৃতীয়ত : বিপ্লবের মাধ্যমে এবং চতুর্থত : ধারাবাহিক বিবর্তনের মাধ্যমে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছে তা তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে হবে গণপরিষদের মাধ্যমে সুপরিকল্পিত রচনাশৈলীতে রচিত হয়েছে; কিন্তু বাস্তবিক অর্থে দেখা গেছে, এ সংবিধানে গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও গণতন্ত্রচর্চার পরিবেশকে বিভিন্ন অনুচ্ছেদ ও উপ-অনুচ্ছেদের মারপ্যাঁচে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। যার ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রতিটি সরকারকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করতে দেখা যায়। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড় করিয়েছে যে, একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এখন সুদূরপরাহত। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর একক সীমাহীন ক্ষমতা সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক সীমাহীন ক্ষমতার সাথে যোগ হয়েছে যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনিই আবার দলীয় প্রধান হওয়ার বিষয়টি। একই ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান হওয়াতে দোষের কিছু ছিল না যদি তিনি দলীয়ভাবে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতেন এবং যদি তিনি দলীয় কাউন্সিল ও কার্যনির্বাহী পরিষদে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকতেন। সুতরাং এক ব্যক্তির পছন্দ ও অপছন্দের ওপর রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সিদ্ধান্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে এক দিকে যেমন সরকারব্যবস্থা গণতান্ত্রিক আচরণ দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে, অপর দিকে অভ্যন্তরীণভাবে দলের ভেতরকার গণতন্ত্রচর্চাও হচ্ছে ব্যাহত। আসন্ন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তার মূলেই রয়েছে এক ব্যক্তির ইচ্ছা ও অভিপ্রায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংবিধানে ব্যাপকভিত্তিক সংশোধন আনতে গঠন করা হয় সংবিধান সংশোধনে বিশেষ কমিটি। বিশেষ কমিটি দেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজনের মতামত নিয়েছে। তাদের কেউ তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে মত দেয়নি। তা ছাড়া বিশেষ কমিটির কোনো সদস্যও এ বিষয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটাননি। বিশেষ কমিটি তাদের সভায় যে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি বা মতামত প্রকাশ করেনি প্রধানমন্ত্রী তার একক সিদ্ধান্তে বাতিল করে দেন সর্বদল গৃহীত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি ফিরে যাওয়া হয় বাহাত্তরের মূল সাংবিধানিক ধারায়। এখান থেকেই সঙ্কটের শুরু। আর এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতার কারণেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সাথে সাথেই বেশ কয়েকটি সাংবিধানিক সঙ্কটের মুখে পড়ে দেশ। প্রথমত : নির্বাচনের সময়কাল কী হবে? দ্বিতীয়ত : বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হলে সংসদ কি বহাল থাকবে? তৃতীয়ত : সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করলে সংসদ সদস্যরা কি আদৌ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন? চতুর্থত : প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার রূপ কী হবে? পঞ্চমত : রাজনৈতিক সরকারের অধীনে প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য দল নির্বাচনে যাবে কি না? এখানে প্রথম চারটি সরাসরি সাংবিধানিক সঙ্কট আর শেষেরটি রাজনৈতিক সঙ্কট। উপরিউক্ত পাঁচটি সঙ্কট নিয়ে ধারণা লাভ করতে সংবিধানের ৫৭, ৫৮, ৭২, ১২৩ ও ১৪১ অনুচ্ছেদের ওপর বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর নির্বাচনকালীন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তা বলা চলে বাংলাদেশের জন্য নতুন একটি ব্যবস্থা। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৩ এর (৩)ক অনুসারে, ‘মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে। অর্থাৎ ২৪ অক্টোবর থেকে নির্বাচনকালীন সময় শুরু হবে। উক্ত অনুচ্ছেদের খ উপধারা অনুসারে, মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদে ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।এখন যেহেতু সংসদ ভেঙে দেয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারাধীন সেহেতু আদৌ কি সংসদ ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত চলবে নাকি এর এক দিন আগে ভেঙে দেয়া হবে তা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। একটি ব্যাখ্যা এমনও রয়েছে যে, যদি ২৪ জানুয়ারির এক দিন আগেও প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাহলে সাংবিধানিকভাবেই সরকারের মেয়াদ আরো ৯০ দিন বাড়িয়ে নেয়া সম্ভব। সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভেঙে দেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা থাকলেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর লিখিতভাবে প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করার বাধ্যবাধকতার মধ্যে রয়েছেন। আর এখানেই প্রধানমন্ত্রীর সীমাহীন ক্ষমতার বিষয়টি ফুটে উঠেছে। সংবিধানের এ ক্ষমতা সরকারের মেয়াদ কত দিন হবে, সরকারের রূপ কী হবে, নির্বাচন কবে হবে তা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার অধীন। সংবিধানের ১২৩ এর (৩)ক অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ইচ্ছা প্রধানমন্ত্রী সচিবদের কাছে ইতোমধ্যে ব্যক্ত করেছেন তাতে আরেকটি সঙ্কট সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তা হচ্ছে, সংসদ বহাল রেখেই কি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে? যদি সংসদ বহালই থাকে তাহলে এই সংসদের উপনেতা, চিফ হুইপ, হুইপ ও সংসদ সদস্যরা কি নির্বাচন করতে পারবেন? কারণ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ১২ ধারা অনুসারে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী কিংবা লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত কোনো ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। স্বাধীনতার এই ৪২ বছরেও এটা এখনো নির্ধারণ করা যায়নি যে, সংসদ সদস্যদের পদ প্রজাতন্ত্রের চাকরিকিংবা লাভজনক পদকি না। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশন এখনো পর্যন্ত সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য দেয়নি। কিংবা উচ্চ আদালত থেকেও এ নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। নির্বাচনকালীন এ নিয়ে যেকোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর আদালতের বিচারাধীন বিষয়কে কেন্দ্র করে এতে নির্বাচন প্রলম্বিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এত গেল আইনি দিক। অন্য দিকে সংসদ সদস্য পদে বহাল একজন প্রার্থী আর পদে বহাল নেই এমন প্রার্থীর নির্বাচনী মাঠ কি সমান্তরাল হবে? এ প্রশ্ন অবশ্য খোদ মহাজোটের সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন সংসদে উত্থাপন করে রীতিমতো বিতর্কের ঝড় ইতোমধ্যেই বইয়ে দিয়েছেন। সংবিধানের ৫৭ এর ৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে, প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ করা না পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী স্বীয় পদে বহাল থাকতে আইনগত কোনো বাধা নেই। সুতরাং পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী যত দিন পর্যন্ত নির্বাচিত না হবেন তত দিন পর্যন্ত বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নিজ পদে বহাল থাকার ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা নেই। সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে উৎসাহিত করতে পারে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্তমান সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরও যদি নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব-কলহ ব্যাপক আকার ধারণ করে তাহলে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে সংবিধানের ৭২-এর ৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি বর্তমান সংসদকে আবারো পুনর্বহাল করতে পারবেন। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিরোধী দলকে আন্দোলন থেকে ফিরিয়ে আনতে সংসদে দেয়া এক বক্তব্যে সংবিধানের এ অনুচ্ছেদটি স্মরণ করিয়ে দেন। বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া এতসব ক্ষমতার মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরোধী দলের নির্বাচনে আসা বিরাট এখন প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রীর সীমাহীন ক্ষমতার অধীনে বিরোধী দলের নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়টি আকাশকুসুম কল্পনার মতো। উদাহরণ হিসেবে এ সরকারের আমলে ভোলা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপনির্বাচনের কথা বলা যেতে পারে। ভোলা-৩ উপনির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের হামলায় বিরোধীদলীয় প্রার্থীর নির্বাচনী অফিসগুলো হাসপাতালে পরিণত হয়েছিল। জাতীয় গণমাধ্যমগুলোতে বিষয়গুলো আসার পরও তাতে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করার ছিল না। আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ উপনির্বাচনে সরেজমিনে দেখা গেছে, দুপুর ১২টার পর বিরোধী দলের প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্রে খুঁজে পাওয়া ছিল খুবই দুষ্কর। আর স্থানীয় সরকারের যেসব নির্বাচনে সুষ্ঠু হওয়ার কথা বলা হয়, বাস্তবিকপক্ষে এ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে হাজারো আবেদন পড়ে নির্বাচন কমিশনে; কিন্তু স্থানীয় নির্বাচন হওয়াতে এসব খবর জাতীয় গণমাধ্যমে খুব কমই গুরুত্ব পেয়েছে। এমনি একটি বাস্তবতায় দেশের এই বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছা সময়ের দাবি। বিশেষ করে সাংবিধানিক যেসব সঙ্কট দেখা দিয়েছে এসব সঙ্কট থেকে দেশকে চিরস্থায়ীভাবে বের করে নিয়ে আসতে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনে সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন করে সংবিধানের অগণতান্ত্রিক ধারাগুলো সংশোধনে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। যেখানে সঙ্ঘাতময় পাকিস্তান ও নেপাল নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে সেখানে বাংলাদেশ ঐকমত্যে পৌঁছতে পারবে না এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads