বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার আহ্বান

বাংলাদেশে অসুস্থ রাজনীতি শুরু হয়েছে। রাজনীতি অবশ্যই রাজনীতিকদের হাতে থাকা উচিত; কিন্তু সমস্যা হলো রাজনীতিকেরা রাজনীতির বদলে অর্থনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে যত অশান্তি সৃষ্টি হয়। যতণ তারা উৎকৃষ্ট নীতি বা সর্বশ্রেষ্ঠ নীতি অনুসরণ করে চলেন, ততণ জনগণ সুখশান্তিতে থাকতে পারেন। আর উৎকৃষ্ট নীতি বা নীতির রাজা বিসর্জন দিয়ে যখন তারা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন তখন সৃষ্টি হয় নানা রকম বিপত্তি ও অশান্তি। বাংলাদেশে পরিশীলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠছে না। ২০ বছর পার হলেও সহযোগিতার সহমর্মিতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার কোনো লণ দেখা যাচ্ছে না। মতায় গেলে আর মতা ছাড়ার কথা রাজনীতিকেরা ভাবতে পারেন না। যেনতেনভাবে মতায় টিকে থাকার দুর্বার আকাক্সা মতাসীনদের মনোজগতকে গ্রাস করে ফেলে। আজীবন মতায় টিকে থাকার প্রবল আকাক্সা তাদের পেয়ে বসে। জনগণ কী চায় সে কথা ভুলে যান। জনগণের চাওয়া-পাওয়া ও প্রয়োজন-প্রত্যাশাকে সম্পূর্ণভাবে উপো করে মতায় টিকে থাকার হীন কৌশল অবলম্বন করেন। সংবিধানের দোহাই দিয়ে সরকার মতা ধরে রাখতে চায়। জনগণকে উপো করে সংবিধানের বাধ্যবাধকতা দেখিয়ে বর্তমান সরকারও নির্বাচন অনুষ্ঠানে একগুঁয়েমিভাবে অগ্রসর হচ্ছে। ২০০৬ সালের নির্বাচনে বিচারপতি কে এম হাসানের বিষয়ে আওয়ামী লীগ আপত্তি তুলে নির্বাচন বর্জন করে। কে এম হাসান নাকি একসময় বিএনপি করতেন। আমাদের প্রশ্নÑ একসময় বিএনপি করার জন্য যদি কে এম হাসানের পরিচালনায় নির্বাচন করা যাবে না বলে আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করতে পারে, তবে বিএনপি কেন দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে? আওয়ামী লীগ যেসব যুক্তি উত্থাপন করছে তার মধ্যে সারসত্তা নেই। এসব যুক্তি একসময় বিএনপি থেকেও দেয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগ কোনো যুক্তি মানেনি। কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার স্টিফেন নিনিয়ান এক মাস বাংলাদেশে অবস্থান করে নানা ফরমুলা দিয়েও আওয়ামী লীগকে বোঝাতে পারেননি। তারা তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য জনগণকে জিম্মি করে জ্বালাও-পোড়াও ও সন্ত্রাস করে ১৭৩ দিন হরতাল করে। বহু জীবন ও সম্পদ ধ্বংস করেও তারা তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতির পে জনমত গঠন করে। বিএনপি বর্তমানে একই দাবিতে প্রায় তিন বছর রাজপথে আছে। তবে তারা জীবন ও সম্পদবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড করে মানুষের বিরক্তি উৎপাদন না করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে। সরকার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনেও পদে পদে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে। বলতে গেলে বিরোধী দলকে সরকার আন্দোলনের মাঠে নামতে দিচ্ছে না। বিােভ, অবরোধ, মিটিং-মিছিল, ঘেরাও প্রভৃতি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে গিয়েও বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা নাস্তানাবুদ ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। উদ্ভট ও বানোয়াট মামলা দিয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার, মামলা-হামলা করে ব্যতিব্যস্ত রাখা হচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর, এম কে আনোয়ার, মির্জা আব্বাস, সাদেক হোসেন খোকা, ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন, আমানউল্লাহ আমান, রিজভী আহমেদমহ ৩৭ জন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে গ্রেফতার ও নির্যাতন করে সরকার আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। গাড়ি পোড়ানোর মামলায় ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে গ্রেফতার করে যেভাবে ৫৩ দিন কারাভোগ করানো হলো, তা নজিরবিহীন। বর্তমানে রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত। দেশের মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিনাতিপাত করছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও আমাদের রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় ল্েয জাতিসঙ্ঘ, ইইউ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি মতাধর ও মর্যাদাবান সংস্থা ও রাষ্ট্র অহরহ দৌড়ঝাঁপ করছে। বাংলাদেশ সরকার সবার মতামত অগ্রাহ্য ও উপো করে সংবিধান বলবৎ রাখতে বদ্ধপরিকর। এ বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে ও হচ্ছে। নানা রকম ফরমুলা দেয়া হচ্ছে। বিএনপিও শিগগিরই একটি রূপরেখা দেবে বলে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান। সরকারি তরফ থেকে অনেক রকম ভাসাভাসা প্রস্তাব দিলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কোনো প্রস্তাব করেনি। বিএনপি আলোচনায় বসতে প্রস্তুত বলে বারবার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও সরকার আলোচনায় বসার পরিবেশ সৃষ্টি করছে না। বরং সরকারি তরফ থেকে বিএনপিকে দোষারোপ করা হচ্ছে। ইইউ প্রতিনিধিদল কয়েক দিন ধরে দুই দলের সাথে বৈঠক করছে। আলোচনার অগ্রগতি কতটা হচ্ছে দেশের মানুষ আশার আলো দেখতে না পেয়ে হতাশ। গণতান্ত্রিক সরকার দেশের মানুষের প্রভু নয়, সেবক। তাদের ওপর জনগণ বিশ্বাস করে দায়িত্ব অর্পণ করে। প্রাচীন যুগে গ্রিসে প্রত্য গণতন্ত্র চালু ছিল। ছোট ছোট রাষ্ট্র হওয়ায় সেই সময় জনগণ প্রত্যভাবে শাসন, বিচার প্রভৃতি কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন। নিজেদের সমস্যা একত্রে বসে তারা সমাধান করতেন। কেন্দ্রীয় কর্তৃপরে প্রয়োজন হতো না। আধুনিক সভ্যতা বিকাশের সাথে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পরিবর্তন আসে। কোটি কোটি জনতা অধ্যুষিত রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় কর্তৃপ আবশ্যক হয়ে পড়ে। মানুষ কর্তৃত্ব শাসকশ্রেণীর হাতে সমর্পণ করে নিরাপদে শান্তিতে থাকতে চায়। পরো পদ্ধতিতে ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে সরকার গঠন করা হয়। সরকারের কাছে কর্তৃত্ব অর্পণ করলেও দেশের জনগণ কিন্তু সার্বভৌম মতা নিজ হাতে রেখে দিয়েছেন। আমাদের সংবিধানেও সকল মতার মালিক জনগণস্বীকৃত। জনগণ বাস্তবে শাসকদের প্রভু না হয়ে অধীন হয়ে পড়েছেন। জনগণের চাওয়া-পাওয়া, প্রয়োজন-প্রত্যাশা ও আশা-আকাক্সা এমনকি সুখশান্তি বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। সংবিধানকে জনগণের চাহিদা প্রত্যাশার ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। সুষ্ঠু সমাধানের ব্যবস্থা না করে সরকার যদি একচোখা নীতি অবলম্বন করে সে েেত্র দেশে সঙ্ঘাত, সংঘর্ষ, অশান্তি, বিশৃঙ্খলা অনিবার্য হয়ে উঠবে। ইদানীং সরকারি নেতাদের মুখে বিরোধী দলের মুরোদ নিয়ে কটা বিদ্রƒপ শোনা যাচ্ছে। বিরোধী দল আন্দোলনের সময় পার করে আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে বলে সরকারি কর্তা ব্যক্তিরা আত্মপ্রসাদ লাভ করছেন। কোনো কিছুতে সরকারের আত্মপ্রসাদ লাভ করার সুযোগ নেই। মানুষের শান্তি বিসর্জন দিয়ে নিজেদের জিদ বজায় রেখে আবার মতায় ফেরার পরিকল্পনা জনগণের বিশ্বাসের সাথে বেঈমানির শামিল। ইইউ প্রতিনিধিদল সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেণ করে মূল্যায়ন রিপোর্ট তৈরি করবে। ২৩ আগস্ট জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুন দুই নেত্রীর সাথে টেলিফোনে আলাপ করেছেন। ৯ সেপ্টেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুই নেত্রীর কাছে পত্র দিয়ে সংলাপে বসার তাগিদ দিয়েছেন। বান কি মুনের টেলিফোনের আগে চিনের রাষ্ট্রদূত সংলাপের তাগিদ দেন। গত এপ্রিলে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূতের নেতৃত্বে আরব দেশের কূটনীতিকেরা বিরোধীদলীয় নেত্রীর সাথে সাাৎ করে একই আহ্বান জানান। এতসব উদ্যোগে সাড়া না দেয়ায় মানুষ ুব্ধ ও হতাশ। অজানা আশঙ্কায় ফেলে দিয়ে সরকার নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। অথচ সমস্যা যেহেতু সরকার সৃষ্টি করেছে সমাধানও তাদেরই করতে হবে। সবার অনুরোধ-আহ্বান উপো করে চললে দেশে সাংঘর্ষিক কর্মকাণ্ড শুরু হবে, যার দায় সরকারের ওপর বর্তাবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের অভিমত বিবেচনায় না নিয়ে সরকার স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপাতে চায়। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সরকারকে তৈরি করতে হবে। আর এটি করতে চাইলে সংলাপের বিকল্প নেই। ২৩ তারিখে জাতিসঙ্ঘে প্রধানমন্ত্রী যাবেন। আশা করা যায়, জাতিসঙ্ঘে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী সদিচ্ছা নিয়ে সংলাপ শুরুর উদ্যোগ নেবেন। সদিচ্ছা নিয়ে শুরু করলে একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য সমাধান বেরিয়ে আসবেই। তাহলে অবসান হবে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ভয়ভীতি, বিরাজ করবে সুখশান্তি।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads