শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

নষ্ট সংস্কৃতির অভিশাপ ঐশী


মাদকাসক্ত স্কুলপড়য়া মেয়ে ঐশীর হাতে নির্মমভাবে তার মা-বাবা খুন হয়েছে। গত কয়েক দিনের সবচেয়ে আলোচিত খবর এটি। মিডিয়ার খোরাক জোগাচ্ছে এই লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড। তবে দেশের আরো অনেক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো এই ঘটনাও একদিন মিলিয়ে যাবে। থেমে যাবে ঐশীর বিচারের তোড়জোড়। কথিত মানবাধিকারবাদীরা ইতোমধ্যে দাবি করেছেন, ঐশী আর তাদের ঘরের কাজের মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক কাজেই ওদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ বা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো মানবাধিকারের বরখেলাফ। তার মানে, তারা নিষ্পাপ। অবশ্য আদালত বলেছেন, প্রাপ্তবয়স্ক ধরে নিয়েই ঐশীর বিচার করা হবে। এর জন্য তাকে মেডিক্যালে চেকআপ করা হয়েছে। টকশোগুলোয় ঐশীর বিপথগামিতার জন্য প্রকারান্তরে দায়ী করা হচ্ছে তার মা-বাবাকে। তারা তো না-ফেরার দেশের বাসিন্দা। কাজেই যারা সস্তা উপদেশ বিলাচ্ছেন, তাদের জবাবে বলতে পারছেন না যে দায়ী আমরা নই, তোমাদের মতো তাত্ত্বিকেরাÑ যারা নষ্ট সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছে, নষ্ট সংস্কৃতির পে ওকালতি করছে তারা এ জন্য অনেকটাই দায়ী। সন্তানের প্রতি অবহেলা প্রতিকারের জন্য তাদের উপদেশ হলো, ছেলেমেয়েদের বন্ধু ভাবতে হবে। তাদের চাওয়া-পাওয়া পূরণে যতœবান হতে হবে। কথাগুলো ভালো হলেও একতরফা। তা ছাড়া যেখান থেকে পচন ধরেছে তার চিকিৎসা না করে ওপরে মলম লাগালে ঘা কী করে শুকাবে। পশ্চিমা নষ্ট সংস্কৃতি ও অবাধ যৌনাচারের অভিশাপের আগুন লেগেছে আমাদের সমাজে। ফলে ছেলেমেয়েদের মন-মানসিকতা বদলে যাচ্ছে। পিতা মাতার প্রতি কর্তব্যের চেতনা ও চর্চা উঠে যাচ্ছে। কোনো কোনো শিতি পরিবারের অসহায় মা-বাবাকে স্থান নিতে হচ্ছে ওল্ডহোমের কারাগারে। এর পেছনে দায়ী মা-বাবার প্রতি অবিশ্বাস। পশ্চিমা সমাজে অনেক সন্তান জানে না, তার জন্মদাতা পিতা কে বা কারা। অথচ ঘটা করে পালন করা হয় বাবা দিবস। মেয়েদের চোখ মেললে দেখে, মায়েরা কতজনের সাথে দুনিয়ার মজা কতভাবে লুটে নিচ্ছে। বড় হয়ে তারাও সে পথ ধরছে। বাধা দিলে বিষাক্ত সাপের মতো ফণা তুলছে। তাই ওসব দেশে টিনএজারদের যত্রতত্র বিচরণে বাধাদান দণ্ডনীয় অপরাধ। একবার টাউন সার্ভিসে এক যুবককে মহিলা যাত্রীদের সমীহ করার উপদেশ দিলেন এক ভদ্রলোক। বললেন, মা-বোন সবার আছে। ভদ্রলোকের এই উক্তি ছিল আমাদের আবহমান সমাজচেতনায় নারীসমাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের দরদি প্রকাশ। অবাক হলাম, যখন হিপ্পি মার্কা যুবকটি প্রতিবাদ করে বলল, বউ-বান্ধবীও সবার আছে। আমাদের ধর্ম ও সমাজ শিখিয়েছে, পিতামাতা মোমবাতির মতো নিজেরা গলে নিঃশেষ হয়ে সন্তানের জীবনকে আলোকিত করছেন। কাজেই তাদের প্রতি থাকতে হবে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা, সেবা, বিনয় ও প্রণতি। আর নষ্ট সভ্যতা বলছে, ওরা তো জীবনভর ফুর্তি করেছে। তার ফাঁকে হঠাৎ তুমি জন্ম নিয়েছ। কাজেই তাদের প্রতি তোমার কোনো দায় নেই। কোনো এক পত্রিকায় পশ্চিমের একটি দেশ ঘুরে আসা এক সাংবাদিকের প্রতিবেদন পড়েছিলাম। লিখেছেন, সূর্য অস্তাচলের দিকে ঝুঁকে পড়ল। সুবিশাল পার্কটি ভরে উঠল মানুষে মানুষে। বেশির ভাগই বুড়ো আর বুড়ি। প্রত্যেকের হাতে রশি। এর ওপ্রান্তে বাঁধা একটি করে কুকুর। শেষজীবনের বিশ্বস্ত সঙ্গী। কারণ জানলাম, অর্থ ও যৌবন যখন অস্তাচলে, তখন দেখা ও সেবাযতœ করার কেউ নেই। বিবাহের বন্ধন বা দায় তো ছিল না। এ বয়সে কে কার দায়িত্ব নেবে। জীবনের অনাকাক্সিত ফল, সন্তানেরাও ভুলে গেছে জন্মের ঠিকানা। সুরম্য প্রাসাদ বা ফ্যাটে যখন মরে যাবো, কুকুরটি বাইরে এসে অন্তত ঘেউ ঘেউ করে পুলিশকে জানান দেবে, আমার মনিব আর নেই।লাশ হয়ে পড়ে থেকে পচতে হবে না তখন নির্জন বাসায়। পার্কের এই দৃশ্যপট বলে দিচ্ছে, ওরা কতখানি পচে গেছে আর কত অশান্তির আগুনের লেলিহান শিখায় ভেতরে ভেতরে জ্বলছে। এখন তো অবস্থা আরো করুণ। সমকামিতাকে বৈধতা দেয় যেসব অসভ্য দেশ, তাদের তো বাইরে থেকে লোক আমদানি করে লেবার জোগাড় করা ছাড়া উপায় থাকবে না। সেই তুলনায় বউ-ঝি, নাতি-নাতনীপরিবেষ্টিত পারিবারিক উষ্ণতায় আমাদের মুরব্বিরা যে এক রকমের স্বর্গীয় পরিবেশে আছেন, তার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে অনুরোধ জানাব প্রগতিশীল ও সংস্কারমুক্ত নামে পরিচিত মহলটিকে। আমাদের গরিব পরিবারের আধাশিতি, অশিতি ছেলেরা বিদেশে যায়, খেটে দুই পয়সা আয় করার জন্য। প্রথম সুযোগেই তাদের চিন্তা থাকে, মা-বাবার প্রতি কিভাবে দায়িত্ব পালন করবে। মা-বাবা হজে যাওয়ার ব্যবস্থা করে তারা, যেন আল্লাহর ঘরকে সামনে রেখে দুই হাত তুলে প্রাণ উজাড় করে সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য দোয়া করেন। তারা বিশ্বাস করে, মা-বাবার দোয়া কবুল হয়। তাতে নিজেদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়। এই চেতনা থেকেই মরহুম মা-বাবা মুরব্বিদের জন্য দোয়া মাহফিলের সংস্কৃতিও লালিত হয়ে আসছে আমাদের সমাজে। আমাদের সমাজে বিরাজমান এই চেতনা, প্রেরণা ও সংস্কৃতিকে অবশ্যই লালন করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে বুঝাতে হবে, সন্তানের প্রতি মা-বাবার কর্তব্য আছে। তাদের দাবিও আছে। আর মা-বাবার প্রতিই সন্তানের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। এই শিা আমাদের ধর্মের সূত্রে। যেসব ধর্মবিদ্বেষী শিাব্যবস্থা থেকে ধর্মীয় শিা তুলে দেয়ার পাঁয়তারা করছেন, তারা কি ভেবে দেখবেন যে, পশ্চিমা সভ্যতার অভিশাপ ডেকে আনার জন্য তারা কিভাবে খাল কাটছেন। তাদের অভিযোগÑ ধর্মীয় শিা জিহাদ শিখায়, সন্ত্রাসী বানায়। উগ্রপন্থী জেএমবির অতি সাম্প্রতিক উত্থান ও পতনে বলুন তো, জন মাদরাসায় পড়য়া আর কতজন সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ধরা পড়েছে? আসল ব্যাপার হলো প্রকৃত ধর্মীয় শিার প্রভাবে কেউ উগ্র হয় না। আর ধর্মীয় শিার অভাবে, শূন্যতার ফাঁকে যখন কোনো উগ্রবাদী মতবাদ ঢুকে তখন তরুণ মনের ছাত্ররা বাছাই করতে পারে না কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ। একই সুযোগে মাদকও ছোবল হানে ঐশীদের ওপর। এর থেকে নিস্তার পাওয়ার একমাত্র পথ মূল্যবোধসমৃদ্ধ ধর্মীয় শিার প্রসার, যেখানে নৈতিক সূচিতা আছে, প্রেম আছে, পরস্পর দায়িত্ববোধ আছে, যার প্রতিটি দিক অত্যন্ত সুন্দর। দেখুন, পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা, বিনয় ও কর্তব্য পালনের কী শিা কুরআন দিচ্ছে। তোমার পালনকর্তা আদেশ করছেন যে, তিনি ছাড়া আর কারো ইবাদত-উপাসনা করো না। এবং পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো। তাদের মধ্যে কোনো একজন বা উভয়ে যদি তোমাদের জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উহশব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। আর তাদের সাথে সম্মান ও শিষ্টাচারপূর্ণ ভাষায় কথা বলো। আর তাদের সামনে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বিনম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলো : হে পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম করো; যেমন রহম (দয়ামায়া দিয়ে) তারা আমাকে শৈশবে লালনপালন করেছেন। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মনে যা আছে, তা ভালোই জানেন। যদি তোমরা সৎ হও, তবে তিনি তওবাকারীদের জন্য মাশীল (তোমাদের মা করবেন)। আত্মীয়স্বজনকে তার হক দান করো এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদেরকেও। এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই এবং শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।সূরা বনি ইসরাইল ২৩-২৭ এই শিার প্রভাবেই আমাদের সমাজে মাতাপিতার প্রতি কর্তব্যবোধ, শ্রদ্ধা, বিনয় ও খেদমতের চেতনা এখনো বিদ্যমান। এরই উষ্ণতায় সীমাহীন অভাব ও অস্থিরতার মাঝেও বলা যায়, আমরা পারিবারিক বন্ধনে মোটামুটি ভালো আছি, সুখে আছি। এই চেতনাকে লালন করতে হবে। সমাজকে ধ্বংসের কবল থেকে বাঁচাতে হলে এর পরিচর্যা করতে হবে। মসজিদে, মাহফিলে, স্কুলে, পাঠ্যপুস্তকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজের বিশাল বিস্তৃৃত অঙ্গনে এর চর্চা করতে হবে। এই শিার প্রভাবেই সীমাহীন অভাব ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও আমরা পারিবারিক উষ্ণতায় এখনো মোটামুটি ভালো আছি, সুখে আছি। একে লালন করতে হবে। এই শিাকে তুলে ধরতে হবে পাঠ্যপুস্তকে; চর্চা করতে হবে সমাজের বিশাল বিস্তৃত অঙ্গনে।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads