সারা দেশের মানুষ সম্ভাব্য সংলাপের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে ধৈর্য ধারণ করে আছে। বিরোধী দলও সংলাপের পরিবেশ তৈরি করার প্রয়োজনে বলতে গেলে আন্দোলন স্থগিত করে সাংগঠনিক কাজে সময় কাটাচ্ছে। ঠিক এই সময় হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রী তড়িঘড়ি করে সচিবদের ডেকে নির্বাচনের রূপরেখা ঘোষণা করে দিলেন। ফলে রাজনৈতিক মহলে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। নির্বাচন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তিনি কি আসলেই নির্বাচন চান নাকি বিরোধী দলকে উস্কানি দেয়ার জন্যে কিংবা বিরোধী দলের আন্দোলনকে চাঙ্গা করার জন্য তিনি এই পদক্ষেপ নিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী রূপরেখার বৈশিষ্ট্যগুলো হলো সংবিধান সংশোধন না হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হচ্ছে না। দায়িত্ব হস্তান্তর না করা পর্যন্ত শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। এই সময় সংসদও বহাল থাকবে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদ ও এমপিগণও স্বপদে বহাল থাকবেন। দৈব-দুর্বিপাক হলে মেয়াদ শেষের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। নির্বাচন কমিশন সংবিধান অনুযায়ী কাজ করবে। এটা একটা উদ্ভট পরিকল্পনা। এ ধরনের নির্বাচনের নজীর সমসাময়িককালের ইতিহাসে কোথাও নেই।
মধ্যযুগেও কোন দেশে এই ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী কি সত্যি সত্যি নির্বাচন করার জন্য এই পরিকল্পনা করেছেন নাকি কোন অসাংবিধানিক শক্তির হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার জন্য এই পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। একথা দিবালোকের মতো সত্য সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে কোন প্রকারেই জয়লাভ করতে পারবে না। বিগত ৫ বছরে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে গণনির্যাতন চালিয়েছেন সমসাময়িককালের কোন দেশে এর নজীর নেই। ফলে নির্বাচনে পরাজিত হলে তার দল গণরোষের (ভারতীয় পত্রিকা আনন্দবাজারের ভাষায়) শিকার হবে। বস্তুত সেই আশঙ্কা থেকেই তিনি চান কোন অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতা গ্রহণ করুক। তাহলে তিনি শ্যামকুল দুই দিক রক্ষা করতে পারবেন। নির্বাচনী ওয়াদা বাস্তবায়ন না করে সারতে পারলেন অপরদিকে তার দল ঝামেলা থেকে রক্ষা পেল। অর্থাৎ এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন।
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। গণতন্ত্রের জন্যই তার জন্ম হয়েছে। গণতন্ত্রই দেশের মানুষের কাম্য। গণতান্ত্রিক শাসনই জনগণের চাহিদা। এই গণতন্ত্রের জন্যই শেখ মুজিব নিজেও সারা জীবন লড়াই করেছেন। বর্তমানে দেশের মানুষের চাহিদাও নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন। বর্তমান সরকার কর্তৃক সৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির পরিবর্তন চায় মানুষ। পরিবর্তনের জন্য দরকার নির্বাচন। এমন নির্বাচন যে নির্বাচনে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে। ২০০৮ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়নি। কোন প্রকার সাজানো বা পাতানো নির্বাচন নয়। চাই একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন যে নির্বাচনে আপামর জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে। যেহেতু এই সরকারের ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে সেহেতু এই সরকারের অধীনে মানুষের মতামত প্রতিফলিত হওয়ার মতো কোন নির্বাচন হতে পারে বাংলাদেশের মানুষ কেন বিশ্বের কোন মানুষ বিশ্বাস করে না।
বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল ব্যক্তি গোষ্ঠী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন তথা আপামর জনগণ চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এই লক্ষ্যে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠেছে। তাই নয় ইতোমধ্যে বিভিন্ন জরীপে দেখা গেছে, দেশের শতকরা ৯০% ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। সেই নির্বাচনে যেন সেনাবাহিনীর তদারকি থাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির সাথে এটাও একটা দাবি।
এই জনমতের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে আমাদের সকল বন্ধুপ্রতীম দেশ। বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর প্রতিনিধিরা ইতোমধ্যে তাদের মতামত প্রকাশ করেছে। এই লক্ষ্যে বিরোধী দলের সাথে সংলাপে বসার জন্য তারা সরকারকে বিভিন্নভাবে অনুরোধ উপরোধ করে চলছে। এজন্য উদ্বিগ্ন জাতিসংঘও। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের প্রতিনিধি কয়দিন আগে বাংলাদেশ সফরকালে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে গেছেন। কিন্তু এর ভিতরও সংলাপের ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। মাত্র কয়দিন আগে বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেত্রীর সাথে টেলিফোনে আলাপ করে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি জাতিসংঘ প্রতিনিধি দল ঢাকা আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এমনকি বিরোধী দলীয় একটি প্রতিনিধি দলকে জাতিসংঘে পাঠাবার জন্যও তিনি অনুরোধ করেছেন। এরপর সরকারি দলের মধ্যে রণে ভঙ্গ দেয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল।
হঠাৎ করে সচিবদের ডেকে এনে সংসদ বহাল রেখে মেয়াদের পূর্বেই নির্বাচনী রূপরেখা প্রকাশ করায় মানুষ স্তম্ভিত হয়ে যায়। সর্বত্র একটা হতাশার পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সংবাদপত্রগুলোর দিকে তাকালে হতাশার গভীরতা অনুধাবন করা যায়। সর্বত্র একটা গুমোট ভাব থমথমে অবস্থা। অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বাকশাল গঠনের আকস্মিকতার সাথে তুলনা করছেন। শেখ হাসিনার পিতা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৮ মে ডিসেম্বর দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। জরুরি অবস্থার ফলে সকল রাজনৈতিক কর্মকা- মিটিং মিছিল সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেল। ৭৫ সালের জানুয়ারিতে ঘোষণা করলেন তিনি সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে তাঞ্জানিয়ার আদলে একদলীয় পদ্ধতি চালু করবেন।
২৫ জানুয়ারি মাত্র ১৩ মিনিটের অধিবেশনে একদলীয় পদ্ধতির আইন পাস করলেন। ২৫ জানুয়ারি একদলীয় পদ্ধতি সংক্রান্ত আইন পাস করার প্রাক্কালে জনাব আবুল মনসুর আহমদের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমদ বিরোধী গ্রুপের নেতা জনাব আতাউর রহমান খানের কাছে একটি গোপন বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে, বিরোধী নেতা আতাউর রহমান খান ওয়াক আউট করলে অন্তত ১০০ জন আওয়ামী লীগ এমপি তাকে অনুসরণ করবে। আতাউর রহমান খান ঐ বার্তায় আস্থা স্থাপন করে আশ্বস্ত হলেন যে, একদলীয় পদ্ধতির বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ একটা বিরাট প্রতিবাদ হিসেবে কাজ করবে এবং শেখ মুজিবুর রহমান তার পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হবেন।
১৩ মিনিটের সংসদ অধিবেশনে একদলীয় বাকশাল বিল উত্থাপনের সাথে সাথে বিরোধী নেতা আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে বিরোধী সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সালাহ উদ্দিন, আব্দুল্লাহ সরকার, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ বিরোধী গ্রুপ বহু প্রতীক্ষিত ওয়াক আউট কার্যকর করে। কিন্তু না, ওয়াক আউটের পর আতাউর রহমান খান পিছন দিকে তাকিয়ে দেখেন মোড় বড়ি খাড়া সেই ৬ জন তার পিছনে দ-ায়মান। যা হোক এদিকে একদলীয় বাকশাল আইন কণ্ঠভোটে পাস হয়ে গেল। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামে একমাত্র রাজনৈতিক দল গঠিত হয়ে গেল। সংসদের মেয়াদ বিনা নির্বাচনে ৫ বৎসর বৃদ্ধি হয়ে গেল। শেখ মুজিব নিজে হলেন বাকশালের চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যান কিভাবে নির্বাচিত হবেন কিংবা শেখ মুজিব কত দিন চেয়ারম্যান থাকবেন পরবর্তী চেয়ারম্যান কিভাবে হবেন এর কোন ব্যাখ্যা বাকশাল আইনে ছিল না। বাকশাল আইনে বিধান রাখা হলো সকল সংসদ সদস্য বাকশালে যোগ দিতে হবে অন্যথায় তাদের সদস্য পদ বাতিল বলে গণ্য হবে। দৈনিক ইত্তেফাকসহ সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হলো। রাশিয়ার প্রাভদা বা চীনের পিপলস ডেইলীর আদলে সরকারি নিয়ন্ত্রণে চারটি সংবাদপত্র রাখা হলো। শেখ মুজিব এই পরিবর্তনের নাম দিলেন দ্বিতীয় বিপ্লব। দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে তিনি শোষণমুক্ত সমাজ কায়েমের ঘোষণা দিলেন। শেখ হাসিনা সেদিন সচিবদের ডেকে যেরূপ নির্বাচনী রূপরেখা ঘোষণা করলেন তা বাকশালেরই ভিন্নরূপ। মানুষের হাত পা বেঁধে নির্বাচন। নির্বাচন না হলেও শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বহাল থাকবেন।
এর আগে তার বশংবদ প্রধান বিচারপতি যে রায় দিয়েছেন তাকে বলা যায় অনাকাক্সিক্ষত রায়। এই রায়ের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক লোক দেখানোর জন্য ১০ জন এ্যামিকাস কিউরী নিয়োগ দিলেও তাদের কারোরই পরামর্শই তিনি শোনেননি। সেই রায়ের নির্দেশ মতই বাপের চতুর্থ সংশোধনীর আদলে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করেছেন। পিতা করেছেন দ্বিতীয় বিপ্লব। পিতার আদলে তিনি করলেন অঘোষিত তৃতীয় বিপ্লব। নির্বাচন করেন বা না করেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে বহাল করে নতুনভাবে নির্দেশনা জারি করবেন। তার নাম দিবেন তৃতীয় বিপ্লব। এই বিপ্লব হবে দ্বিতীয় বিপ্লবেরই ধারাবাহিকতা। পাঠক আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র গণতন্ত্র করে মুখে ফেনা তুললেও আজও তারা ৪র্থ সংশোধনী বা বাকশালের সমালোচনা করেনি। কিংবা আজও তারা বলেনি যে বাকশাল পদ্ধতি ছিল ভুল। বরং বাকশালের যথার্থতাই প্রচার করে থাকেন। এই প্রেক্ষাপটেই আ’লীগ সরকারের কর্মকা-কে দেখতে হবে। দ্বিতীয় বিপ্লবের অন্য এক শেখ হাসিনার তৃতীয় বিপ্লব আসছে কি না!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন