বৃটিশ শাসনামলে কোনো এক স্টেটের দায়িত্বশীল ছিলেন খুবই বন্ধুসুলভ এবং পরোপকারী। তাঁর নিকট কোনো আবদার নিয়ে কেউ কখনো রিক্ত হস্তে ফেরেনি। কিন্তু উক্ত সাহেবের মেম সাহেব প্রকাশ্য দিবালোকে বাঙ্গালী কর্মচারীদের সামনে প্রস্রাব করতেন। এটি দেখে বাঙ্গালী কর্মচারীরা লজ্জায় লাল হয়ে যেতো। কিন্তু কর্মচারীরা কি আর করবে? সাহেব যতোই অমায়িক হোক তাঁর নিকট তো আর তাঁর স্বীয় সহধর্মিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যায় না? আবার নির্দ্বিধায় এটি কেউ মেনেও নিতে পারে না। অবশেষে বুকভরা সাহস নিয়ে সবার পক্ষ থেকে কয়েকজনকে দায়িত্বশীল গোছের লোক সাহেবের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্যে চেম্বারে গিয়ে হাত কচলিয়ে অতি ভক্তি এবং তাজিমের সাথে বলল ‘স্যার আপনি আমাদের দ-মু-ের মালিক, আপনার সহযোগিতায়ই আমরা কিছু গরীব কর্মচারী অন্নসংস্থানের সুযোগ পেয়ে বাল-বাচ্চা নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে আছি। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে একটি বিষয় মহানুভবের নিকট আরজ করতে চাই।’ সাহেব বললেন ‘কোনো ভয় নেই যা বলতে চাও নির্ভয়ে বলতে পারো।’ এরপর বেগম সাহেবের উক্ত বিষয়টি সবিস্তারে বর্ণনার পর বললেন ‘বেগম সাহেব একজন সম্মানিতা রমণী তাঁর উক্ত বিষয়টিতে আমরা ভীষণ লজ্জা পাই।’ সাহেব তাঁর চিরাচরিত স্বভাবসুলভ রসিকতাপূর্ণ ভঙ্গিতে বললেন, ‘এই কথা? এটি তো কোনো ব্যাপারই নয়! এ মামুলি কথাটি বলার জন্যে তোমরা এতো সঙ্কোচ করছ?’ সবাই তো হতভম্ব। তখন সাহেব বললেন, ‘তোমরা যখন ক্ষেতে খামারে বিভিন্ন কাজকর্মে নিয়োজিত থাকো তখন তোমাদের চারপাশে গরু-ছাগল চরে বেড়ায় না? তখন তোমাদের প্রস্রাবের প্রয়োজন হলে তোমরা গরু-ছাগলকে লজ্জা পেয়ে প্রস্রাব করতে বাড়ি চলে এসো নাকি ক্ষেতে-খামারেই তা সেরে নাও।’ সমস্বরে সবাই উত্তর দেয় ‘ক্ষেতে-খামারেই সেরে নেই।’ তখন সাহেব বললেন, ‘আমার মেম সাহেবও তোমাদেরকে গরু-ছাগলের চেয়ে বড় কিছু মনে করেন না। তাই তোমাদের সামনেই ঐ কাজটি করেন।’
অভিজ্ঞ মহলের অভিমত, মহাজোট সরকারও জনগণকে তদ্রƒপ মনে করে বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল, কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ৪২ বছর পূর্বে নন-ইস্যুকে ইস্যু বানানো, রাষ্ট্র পরিচালনায় সীমাহীন ব্যর্থতা এবং দুর্নীতির স্বাক্ষরস্বরূপ সাংবাদিক হত্যাকা- ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি, রেলের কালো বিড়ালের টাকার বস্তা, হলমার্কের অবৈধ ঋণ এবং ব্যাংকিং খাতের লুটপাট, বিরোধী রাজনীতিক ইলিয়াস আলীকে গুম, হেফাযতকে নির্যাতন, জিএসপি স্থগিত, গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা, ইসিকে আজ্ঞাবহে পরিণত করে নির্বাচনী বৈতরণী পারের চেষ্টা, বিরোধী দলের হরতালে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলী করে মানুষ হত্যাসহ গুম, খুন দেশের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তারপরও মহাজোট সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, এখন নাকি গণতন্ত্রের উৎকৃষ্ট সময় চলছে।
মহাজোট সরকার দশ টাকা কেজি চাল খাওয়ানো, ঘরে ঘরে চাকরি দেয়া, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে ব্যর্থতা, দুর্নীতি ধামাচাপা দিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো ৪২ বছর পূর্বের একটি মীমাংসিত নন ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের নতুন নাটক মঞ্চস্থ করেছে। (এ সংক্রান্ত বিস্তারিত রিপোর্ট জানতে পড়–ন ২৬-৭-২০১৩ দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত সম্মানিত লেখক সৈয়দ মাসুদ মোস্তফার লেখা ‘যুদ্ধাপরাধের মুলা ও পাঁচীর ঘা!’ নামক প্রতিবেদনটি।) স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চিহ্নিত তালিকাভুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর বিচার করতে গেলে দু’দেশের (পাকিস্তান-বাংলাদেশ) সম্পর্কে ফাটল দেখা দেয়ার আশঙ্কায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার উক্ত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিল। পাকিস্তানীদের সহযোগিতায় শান্তি কমিটিতে যারা জড়িত ছিল তাদের বিচার করতে গিয়ে দেখা গেছে, পিতা শান্তি কমিটির সদস্য কিন্তু ছেলে মুক্তিযোদ্ধা। এরকম একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে অগ্রসর হলে যে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তাতে নব্য স্বাধীন বাংলাদেশে আরেকটি বিপর্যয়ের সমূহ আশঙ্কা থেকে যায়। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে তৎকালীন সরকার কথিত যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগিতাকারীদেরও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিল। তবে যুদ্ধাপরাধে সহযোগিতাকারীদের বিচারের জন্য সংবিধানে একটি ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন বা ইনডেমনিটি আইন’ বহাল ছিল। আওয়ামী সরকারের পরে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও জামায়াতের কোনো নেতা তো দূরের কথা ঐ আইনের আওতায় জামায়াতের কোনো কর্মীর বিরুদ্ধেও কোনো অভিযোগ নিয়ে কেউ বিচার চাইতে আসেনি বা মামলা করেনি। তাই পরবর্তী সরকার সংবিধান থেকে ‘বিশেষ ক্ষমতা আইনটি’ রহিত করেছিলেন। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো বর্তমান সরকার ৪২ বছর পূর্বের একটি মীমাংসিত নন ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের নতুন নাটক মঞ্চস্থ করেছে।
কিন্তু কেনো জামায়াতের বিরুদ্ধে এ সাজানো নাটক? জামায়াত কেনা-বেচার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। জান-মালের বিনিময়ে এ জমিনে আল্লাহ্র দ্বীন (ইসলাম) কায়েমের আন্দোলনে বদ্ধপরিকর তারা। বিগত সরকারে জামায়াতের যে দুজন মন্ত্রী ছিলেন তাঁরা প্রমাণ করেছিলেন মন্ত্রীত্বে থেকেও আমানতদারিতার সাথে জনগণের খেদমত করা যায়। মন্ত্রীত্বে থেকেও অন্যান্যের মতো জামায়াতের মন্ত্রীপুত্রদের কোনো দৌরাত্ম্য পরিলক্ষিত হয়নি। এ সরকার সংবিধান থেকে সকল কাজে আল্লাহ্র উপর বিশ্বাস ও আস্থা এবং কেয়ারটেকারের ফর্মূলা বাদ দিয়েছে। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ কর্তৃক একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনকে অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হয়েছে। নিবন্ধন বাতিলের পক্ষে অন্যতম যুক্তি : দলটি সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মনে করে আল্লাহকে অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলা হয়েছে জনগণকে। এটি সংবিধানের ৭ ও ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। সংবিধানে দল করার মৌলিক অধিকার দেয়া হয়েছে; তবে কোনো দলের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলে, দলের নীতিতে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ বৈষম্যমূলক সংগঠন বা দল করা যাবে না। অর্থাৎ জামায়াতের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জামায়াতের আমীরের দায়িত্বে কোনো অমুসলিম এবং নারী আসতে পারবে না। এটি বাংলাদেশের সংবিধান বিরোধী। এর কারণে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার যোগ্য। বর্তমান সরকার যদি হাইকোর্টকে দিয়ে এটি বাস্তবায়ন করেন তাহলে ইসির কি কোন অস্তিত্ব থাকে? আর এ অজুহাতে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করতে হলে তো আওয়ামী লীগ আর জাসদ ছাড়া বাকী সব দলের নিবন্ধনই বাতিল করতে হবে। তাহলে এ দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত কি? নিবন্ধন বাতিল করে, ষড়যন্ত্রমূলক বিচারের নামে আপিল নিষ্পত্তির আগেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীপরিষদের কিছু কিছু সদস্য আগাম বিচারের রায় কার্যকরি করার দিনক্ষণ নির্ধারণের সাজানো নাটক করে ক্ষমতার জোরে শীর্ষ জামায়াত নেতাদেরকে শাস্তি দিতে পারলেও কোটি কোটি ইসলামপ্রিয় জনগণের হৃদয় থেকে ইসলামের শিকড় উপড়ে ফেলতে পারবে না।
স্বাধীনতার রূপকার মরহুম শেখ মুজিবর রহমানও বিশ টাকা মণ চাউল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পরবর্তীতে স্বীয় নেতা-কর্মীদের দুর্নীতির শিকার হয়ে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন ‘সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ আন্তর্জাতিক মহল তখনকার আওয়ামী সরকারকে আখ্যায়িত করেছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে প্রথম বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় আসার পর পুরস্কার হিসেবে জাতি পেয়েছিল ‘দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নের খেতাব।’ বর্তমান সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতায় কী খেতাব পাওয়া উচিত তার দায়িত্ব জনগণের উপর থাকল। তবে মহাজোট সরকারের মন্ত্রীপরিষদের অযোগ্যতা ও অসততার প্রতি ইঙ্গিত করে সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন ‘আপনার এসব ছাগল-পাগল মন্ত্রীদের বাদ দেন।’ পুকুরে বা কূপে মড়ক পড়লে পানি দুষণমুক্ত করার জন্যে অবস্থাভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি ফেলে দিতে হয়। তার জন্যে পূর্বশর্ত হলো প্রথমেই মড়কটিকে অপসারণ করা। তা না করে শুধু পানি ফেললে দুর্গন্ধ পুর্বের চেয়ে আরো বেড়ে যায়। তদ্রƒপ এ সরকার একটি ইস্যু শেষ না হতেই আরেকটি তৈরি করে আগেরটাকে ধামাচাপা দেয়ায় কোনোটিরই সুরাহা হচ্ছে না। কারণ এতে অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এ পরিস্থিতি মোটেও সুখকর নয়। মিথ্যা তো মিথ্যাই। একটি মিথ্যাকে সত্যে পরিণতের জন্যে অসংখ্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়ার পরও মিথ্যাটি মিথ্যাই থেকে যায়। এ সত্যটি সরকার উপলব্ধি করতে পারলে তা দেশ ও জাতির জন্যে অফুরন্ত কল্যাণ বয়ে আনবে। বিগত দিনের ভুল সংশোধনের মাধ্যমে সরকার সে কর্তব্য সুন্দরভাবে পালন করতে পারে। ভুল স্বীকার করে সংশোধিত হলে জনগণের ক্ষোভের মাত্রাও হ্রাস পায়। কিন্তু দু:খের বিষয় হলো এতোসব কেলেঙ্কারি এবং পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পরও সরকারি মহলের যেনো কোনো বোধোদয় ঘটছেনা। কিছু রাজনৈতিক এতিম চালচুলোহীন বাম নেতা যাঁদের কেউ কেউ এক সময় বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাতে চেয়েছিলেন। তাদের ছত্রছায়ায়ই বর্তমান সরকার জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো এড়িয়ে চাতুর্যের নৌকায় চড়ে আগামীতে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চান। কিন্তু ইতিহাসের কঠিন সত্য হলো, যথাকর্ম পরিহার করে শুধু চাতুর্যের গুণে এই পৃথিবীতে বেশিদিন কেউ টিকে থাকতে পারেনি। পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, সরকারের এখন বোধোদয়ের পথে হাঁটা উচিত। বর্তমান সময়ে সে পথটি হলো, ছলচাতুরির পথ পরিহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। কারণ জনগণ এমনটাই চায়। ক্ষমতায় যেই থাকুক তাকে জনগণের ভাষা বুঝতে হবে। জন-আকাঙ্খার বিপরীতে গেলে কোন সরকারের পরিণতি ভাল হয় না। এই সরকারের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি সরকার যতো তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে ততোই দেশ এবং জাতির জন্যে মঙ্গল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন