মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

নির্বাচন নিয়ে জনপ্রত্যাশ


গণতন্ত্রে জনগণের মতায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার নির্বাচন। ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণ সেই মতা প্রয়োগ করে থাকে। জনগণের এই মতা প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে করে জনগণের সেই অধিকার প্রয়োগের মতাও অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তত্ত্বাবধায়ক অথবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার না বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, তা নিয়ে মতাসীন ও বিরোধী জোটের মধ্যে বিতর্কের শেষ নেই। প্রিন্ট মিডিয়া কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়া অথবা সেমিনার- সিম্পোজিয়ামে এবং বিভিন্ন জনসভায় নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে সরকার ও বিরোধী পরে লোকেদের দাবি, পাল্টা দাবির এক মহাবাহাস চলছে। কোনো পই প্রতিপকে এক চুল ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়। চুল নিয়ে দুই শীর্ষ নেত্রীর সরস বিতর্ক জনগণ গভীর হতাশা নিয়ে পর্যবেণ করেছে। এখন মতাসীনদের অন্ধ আনুগত্যের এক মহা প্রদর্শনী চলছে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। কেন এই আনুগত্যের ছলচাতুরি, কেনই বা এসব মিথ্যার বাহাস? কেবল দলীয় নেত্রীকে খুশি করার জন্য, নাকি চোখে মতার চশমা আছে বলে সব কিছুই রঙিন দেখাচ্ছে এবং সাদা আর কালোর মধ্যে কোনো ভেদাভেদ চোখে পড়ছে না। তাদের প্রতি অনুরোধ, একটু জনপ্রত্যাশার প্রতি গুরুত্ব দিন এবং লেজুরবৃত্তি ছেড়ে একটু দেশ ও দশের কথা ভাবুনÑ যাদের ভোটে সম্মানিত ও মতাবান হয়েছেন। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় আয়েশী জীবনযাপন এবং উন্নয়ন বরাদ্দের নয়-ছয় করা অর্থে সম্পদের পাহাড় গড়া আমাদের মতাসীন রাজনীতির এক পূতিগন্ধময় বাস্তবতা। তার পরও ফি বছর তাদের প্রতি জনগণের আস্থা প্রদর্শনের মূল্য কি জনগণের ভোটাধিকার হরণ? জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন যদি গণতন্ত্র হয়, তাহলে সরকারের কি উচিত নয় জনগণের আকাক্সার প্রতিফলনে নির্দলীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা? সংবিধানের অজুহাতে জনগণের ইচ্ছার প্রতি অগ্রাহ্য গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। ব্রিটিশ মডেলের সংসদীয় গণতন্ত্রে সব মতার কেন্দ্রবিন্দু পার্লামেন্ট এবং পার্লামেন্টের মতা সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নারীকে পুরুষ এবং পুরুষকে নারী ব্যতিরেকে সব করতে পারে; কিন্তু বাস্তবতা হলো, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আজ পর্যন্ত জনগণের আকাক্সাবিরোধী কোনো আইন পাস করেনি। তাই সংবিধানের দোহাই দিয়ে জনপ্রত্যাশার প্রতি অবজ্ঞা গণতন্ত্রের প্রতি হুমকিস্বরূপ, যা এ দেশের মানুষ বারবার দেখেছে। আর এ ধরনের অবজ্ঞার ফলাফল যে কত ভয়ানক হতে পারে তা রাজনীতিবিদদের চেয়ে আর ভালো কে বুঝবেন। তাই সময় থাকতে সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করে কার্যকর সমাধানের জন্য শীর্ষ নেতৃত্বকে তাকিদ দিন। রাজনীতি যদি হয় জনগণের কল্যাণে তবে জনগণের আকাক্সাই বড় বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যিনি নিজেকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসেবে ভাবতে হয়তো পছন্দ করেন তিনি গণতন্ত্র নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলবেন, সেটা সাধারণ মানুষের কাছে প্রত্যাশিত নয়। তিনি কথায় কথায় বলেন, জনগণ যাকে ভোট দেবে তারাই মতায় আসবে। জনগণ যদি ভোট না দেয় তাহলে মতায় আসব না। জনগণের প্রতি তার যদি এমন আস্থাই থাকে তাহলে বিরোধী দলের নির্দলীয় সরকারের দাবি মানতে অসুবিধা কোথায়? আবার গত ১ সেপ্টেম্বর সচিবদের সাথে এক বৈঠকে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন ২৭ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই অন্তর্বর্তী সময়ে জাতীয় সংসদ বহাল থাকলেও অধিবেশন বসবে না। মন্ত্রিসভা থাকবে, কিন্তু কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেবে না; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যদি অধিবেশনের প্রয়োজনই না থাকে তাহলে সংসদ বহাল রাখার দরকার কী? অথবা নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত না নিলে মন্ত্রিসভা থাকার দরকার কী? কিংবা মন্ত্রিসভা যে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেবে না তারই বা গ্যারান্টি কী? বিগত পাঁচ বছর মতাচর্চার মহোৎসব পালন করে হঠাৎ করে মাননীয় মন্ত্রীরা সাধু-সন্ন্যাসীর মতো নির্বিকার থেকে নির্বাচনে পরাজিত হয়ে প্রতিপরে হাতে মতা তুলে দেবেন এমন প্রত্যাশা করা বাতুলতা নয় কি? এটা অনেকটা ভূতের মুখে রামনাম ডাকার শামিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য মানুষকে শুধু হতাশ করেছে তা নয়, বরং নির্বাচন নিয়ে গভীর শঙ্কার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। দুর্মুখেরা বলে থাকেন, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি সৃষ্টির পর থেকে যত রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ। ১৯৭৫ সালে বাকশাল কায়েমের মধ্যে দিয়ে যেমন দলটি গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরেছিল, তেমনি ১৯৮৬ সালে স্বৈরাচারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এরশাদ সরকারের বৈধতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছিল। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে তৎকালীন সরকারকে বাধ্য করে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে প্রচণ্ড অবিশ্বাস এবং আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছিল। সর্বশেষ ২০০৬ সালে লগি-বৈঠার আক্রমণে জর্জরিত গণতন্ত্র এবং এর ফলে প্রতিষ্ঠিত ১/১১-এর সরকার যে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল সে কথাও অকপটে স্বীকার করেছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেত্রী। তার এই অকপট স্বীকারোক্তি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দলটির চরিত্র ও অবস্থান নির্ধারণে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ১/১১-এর কার্যকর কুশিলব হিসেবে আওয়ামী লীগকে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে নিশ্চয়ই। নতুন করে আর কোনো ১/১১-এর জন্ম না হোক এটাই জনগণ প্রত্যাশা করে। কিন্তু এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐকমত্য প্রয়োজন তার অভাবেই সাম্প্রতিক সময়ে ১/১১-এর ত্রে প্রস্তুত হচ্ছে বলে মানুষ সন্দেহ পোষণ করছে। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ ততই ঘনীভূত হচ্ছে। সন্দেহ, অবিশ্বাস আর হিংসার এক ভয়াবহ খেলা শুরু হয়েছে রাজনীতিতে। গণমাধ্যম, সুশীলসমাজ, কূটনৈতিক মহল সর্বত্র নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ এবং ফর্মুলা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত সময় পার করছে; কিন্তু সত্যিকার অর্থেই একটি গ্রহণযোগ্য সুনির্দিষ্ট অপস ফর্মুলার প্রস্তাবনা রাজনীতির কোনো প থেকেই যেমন আসেনি, তেমনি সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকেও আসেনি। এমতাবস্থায় ভরসা একমাত্র বিদেশী কূটনৈতিক মহল ও জাতিসঙ্ঘ; কিন্তু তাদের ফর্মুলাই যে সঙ্কট সমাধানে কার্যকর হবে অথবা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, তা বলার সময় এখনো আসেনি। অবশ্য শেষ পর্যন্ত বিএনপি একটি রূপরেখা দেয়ার কথা বলছে। স্বাধীনতা-উত্তর কোনো সরকারই গণতন্ত্রের অপরিহার্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় না করিয়ে বিভিন্নভাবে সরকারের ওপর নির্ভরশীল করে রেখেছে। আর মতাসীন প্রত্যেকটি সরকারই ওই সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের অনুকূলে ব্যবহার করে মতায় যাওয়ার সিঁড়ি তৈরি করেছে। যদিও নির্মম বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো সরকারই টানা দুই মেয়াদে নির্বাচিত হয়নি। এই বাস্তবতা উপলব্ধির অযোগ্যতাই বারবার মতাসীনদের মতা টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন অপকৌশল অবলম্বনে প্রলুব্ধ করেছে। আর এতেই বিরোধী প এবং মতাসীনদের মধ্যে সঙ্ঘাত সৃষ্টি হয়েছে। পরিণামে রাষ্ট্রের জানমালের প্রভূত তি সাধিত হয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। সরকার ও বিরোধী জোটের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক এই অচলাবস্থার স্থায়ী সমাধানে পৌঁছাতে হবে। স্বল্পমেয়াদি আলোচনার মাধ্যমে অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক জটিলতা অবসানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পরবর্তী সময়ে সেই নির্বাচনে নির্বাচিত সরকার তার মেয়াদকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সমস্যার বিষয়ে স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করবেÑ এমনটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads