কখনও কখনও আমি সরকার খুঁজি। কখনও কখনও মনে হয়, এখানে বোধকরি সরকার নেই। এদেশে খুন করেও বেকসুর খালাস পাওয়া যায়। একেবারে প্রমাণিত খুনিকেও রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দেন। ক’দিন আগে চট্টগ্রাম রেলওয়ে সিআরবি’তে টেন্ডার নিয়ে ছাত্রলীগ যুবলীগের বন্দুকযুদ্ধে দুই খুনের ঘটনা মামলার আসামী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক সাইফুল আলম ওরফে লিমন ইতোমধ্যেই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। আর একই খুনের ঘটনার প্রধান আসামী যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী ওরফে বাবর জামিন পেয়ে গেছেন। এখন বেরিয়ে আসার অপেক্ষা। তার আগে মুক্তি পেয়ে গেছেন চট্টগ্রামের দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সারওয়ার হোসেন ও নুর নবী ম্যাকসন। এই দু’জন র্যাব ও পুলিশের খাতায় শীর্ষ তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। অর্থাৎ যে ছাত্রলীগ, যুবলীগ করে সে যখন তখন যে কাউকে খুন করার অধিকার রাখে। ক’দিন পর যাত্রাবাড়িতে ঘটলো আরও মর্মান্তিক ঘটনা। মধ্যরাতে ঘরে ঢুকে সাত-আট জন খুনি পিতা-মাতার সামনেই তাদের একমাত্র পুত্রকে গুলী করে হত্যা করলো। পুলিশ তাদের টিকির নাগালও পেলো না।
চারদিকে ভয় আর ভয়। এমন কি দিনের বেলায়ও ফুটপাতে মুখোমুখি চার পাঁচজন তরুণ একসঙ্গে হেঁটে এলে ভয় করে। এরা এসে যদি পথ আটকে দাঁড়ায়। যদি বলে, আঙ্কেল মানিব্যাগ বের করেন। পকেটে এটিএম কার্ড থাকলে যদি অস্ত্রের মুখে বুথে নিয়ে টাকা তুলে নেয়। কিংবা নিছকই যদি তেমন কিছু নেই বলে রেগেমেগে গুলী করে দেয়। কার পকেটে আছে পিস্তল, কার পেছনে লুকানো আছে রাম দা, কিংবা চাপাতি-রড। ভয় ভয় লাগে। সন্ধ্যা হলে তো কথাই নেই। এরকম যুবকদের দেখলে তাড়াতাড়ি কোনো দোকানের ভেতর ঢুকে যাই। লক্ষ্য করি তারা চলে গেছে কিনা। তারপর হাঁটতে শুরু করি।
এমনই ভয় শহরে, নগরে, বন্দরে। কোথায় কার কার যুদ্ধ লাগবে। কোথায় টেন্ডারবাজের গুলী এসে লাগবে আমার বুকে। কোথায় কোন চাঁদাবাজ ঠেকাতে গিয়ে কিংবা কোনো ছিনতাইকারী ঠেকাতে গিয়ে বেঘোরে কে প্রাণ দেয়। কোন সিএনজি বা ট্যাক্সি চালককে গলা কেটে কে কখন ওগুলো ছিনতাই করে। নাকি ট্যাক্সিচালক নিজেই কোথায়ও গাড়ি থামিয়ে ছিনতাইকারীকে ডাক দেয়। এমনি ভয়।
এ ভয় নিভৃত পল্লীতেও। সেখানে পুলিশের বেশে ডাকাত হাজির হয়। কাউকে খোঁজে। তারপর ডাকাতি করে। অথবা কাউকে ধরে আনে। অথবা পুলিশই সাদা পোশাকে গিয়ে হাজির হয়, ‘দেখিলে চিনিব’ এমন যে হাজারে হাজারে আসামী আছে। তাদের নামে গ্রাম থেকে লোক তুলে আনে। যে কোনো রাজনীতিই করে না। নিতান্তই কৃষক। তাকেও ধরে আনে জামায়াত-শিবির কিংবা বিএনপি বলে। এখন আরও সুবিধা হয়েছে। যে নিতান্ত কৃষক। টুপি, দাড়ি আছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। তাকে এখন হেফাজত বলে ধরে আনা যায়। তারপর লাখ, ৫০ হাজার, ৩০ হাজার, ২০ হাজারের বিনিময়ে শেষরাতে মুক্তি। নইলে চালান। আগে পুলিশ আশ্রয় ছিল। এখন ভয়।
কয়েকদিন আগে আমার মেয়ে গিয়েছিলো কুয়াকাটায়। জেলেরা মাছ এনে যেখানে তোলে সেটা দেখতে গিয়েছিলো। তারা অনেক মাছ তীরে এনে তুলেছিলো। সে মাত্র চারটি ইলিশ কিনে নিয়ে এসেছিলো। পটুয়াখালি থেকে লঞ্চে ঢাকায়। কিন্তু মাছ নিয়ে কেবিন থেকে নামার পথেই এক চাঁদাবাজ তাকে আটকালো।
‘এই ব্যাগে কি?
আমার মেয়ে অকপটে বললো, ‘কুয়াকাটা থেকে চারটা ইলিশ এনেছি।’
চাঁদাবাজ বললো, ‘৮০০ টাকা চাঁদা দিতে হবে।
মেয়ে বললো, ‘কেনো?
সে বললো, ‘এটাই নিয়ম।’
মেয়েটি ঘাবড়ে না গিয়ে বললো, ‘চাঁদা আমি দেব না।’
চাঁদাবাজ কঠিন কণ্ঠে বললো, ‘তাহলে ইলিশ নিতে পারবেন না।’
মেয়েটি দৃঢ়তার সঙ্গে বললো, চাঁদা আমি দেব না। চারটা ইলিশই তো? দরকার হলে নদীতে ভাসিয়ে দেবো।
চাঁদাবাজ বললো, ‘জানেন? এ টাকা র্যাবকেও দিতে হয়।’
আমার মেয়ে বললো, ‘সে র্যাবের কাছে নিয়ে চলেন। আমি র্যাবের সাথে কথা বলবো।’
তার দৃঢ়তা দেখে চাঁদাবাজ পথ ছেড়ে দিলো। নিচে নেমে দেখলো, ‘ডেকে সেই দলেই তিন-চারজন মাস্তান দাঁড়িয়ে আছে। নেতা টাইপ লোকটি বললো, ‘চাঁদা দেবেনই না?
মেয়েটি বললো, ‘না।
‘ঠিক আছে চারটি মাছইতো, যান।’
ওরা চলে এলো বটে। ঘটনাটা শুনে মনে হলো, একটি লঞ্চের সকাল ৮টা, সাড়ে ৮টায় চাঁদাবাজদের এমন উপদ্রব নিশ্চয় দীর্ঘদিন ধরে চলছে। কিন্তু সরকার কোথায়? দেশে যদি সরকারই থাকতো তাহলে এমন ঘটনা ঘটতে পারতো না।
এর দুই একদিন পরে ধানম-ির দুই নম্বর রোড ধরে বাসায় ফিরছিলাম। রাত ৯টা সাড়ে নয়টা হবে। জ্যামে আর স্পিড ব্রেকারে পপুলারের সামনে গাড়ি স্লো করতেই হয়। গাড়ির দরজার কাঁচ প্রায় আধাআধি খোলা ছিলো। আমি টেলিফোনে কথা বলছিলাম। একজন তরুণ গাড়ির কাঁচের ভেতরে হাত দিয়ে ছোঁ মেরে টেলিফোনটি কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলো। ফোনটির উপরের দিকে ধরা ছিলো বলে সেটি আমার কোলের উপর পড়ে গেলো। সে দৌড় দিয়ে পালাবার চেষ্টা করেনি। পেছনের গাড়িটির দিকে এগিয়ে গেলো। ভাবখানা এমন যে, খুন করেও তো হেঁটে যাওয়া যায়। ছিনতাই করে হেঁটে যাওয়া যাবে না কেনো।
এখন কেবলই ভয় হতে থাকে। জানালার কাঁচ লাগিয়ে মোবাইলে কথা বলি। ভয়। বারান্দায় গ্রিল নেই। ফলে দরজা কতো কিছু দিয়ে যে বন্ধ করি। ভয়। বাসে করে কোন স্বজনকে দূরে পাঠাবে। ভয়। এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে বেরুবো। বের হওয়া মাত্র কেউ টাকাগুলো কেড়ে নেবে কিনা। ভয়। ব্যাংক থেকে বের হবো। অকারণে গুলী খাই কিনা। ভয়। বাচ্চাকে খেলতে পাঠাবো। কেউ নিয়ে জিম্মি করে কিনা। ভয়। গত সাড়ে চার বছরে সরকার আমাদের এমনই এক ভীতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। চতুর্দিকে ভয় আর আতঙ্ক। যেনো আমার প্রিয় স্বদেশ আজ এক আতঙ্কের জনপদ।
কিন্তু সরকার নেই। একথা তো বলতে পারবো না। বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত রাস্তায় বের হলেই কেমন চমৎকার এক সরকার দেখি। সরকারের ঠ্যাঙাড়ে পুলিশ বাহিনী হেলমেট মাথায় দিয়ে, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট গায় দিয়ে, পায়ে পট্টি বেঁধে, কী ভীষণ জিঘাংসায় যে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন সরকারকে দেখা যায়। সরকারকে দেখা যায় কোথায়ও মুসল্লিরা সমবেত হয়ে ধর্মীয় আলোচনা করতে গিয়ে তাদেরকে কোমরে দড়ি পরিয়ে কেমন গরু-ছাগলের মতো টেনে নিয়ে আসে। সরকারকে দেখা যায় বটে। কিন্তু সরকারকেও ভয়। যে মিছিলের লোক সেও যে শুধু অনিরাপদ তাও নয়। একদিন দেখলাম মিছিলের পাশে একটি রেস্টুরেন্টে খেতে বসেছিলো কিছু স্কুল ছাত্র। সরকারের দুর্দান্ত পুলিশ বাহিনী সেখানে ঢুকে তাদের কি নিষ্ঠুর পৈশাচিকভাবে পিটিয়ে শুইয়ে ফেললো। সরকার আছে। সরকারকে ভয়। আর সরকারের ভয়ে এখন মিডিয়া কর্মীরাও বুলেট-প্রুফ জ্যাকেট পরতে শুরু করেছে।
সরকারের পুলিশ বাহিনীর এক সদস্য বিরোধী দলের চীফ হুইপের ওপর বীর বিক্রমে হামলা চালিয়ে তাঁর হাড্ডি-গুড্ডি ভেঙে দেয়। স্বাভাবিকভাবেই এদেশের মানুষ আশা করেছিলো পুলিশ বাহিনীর ঐ সদস্যের কঠোর শাস্তি হবে। সরকারের নির্লজ্জ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুক ফুলিয়ে বললেন, বিরোধী দলের চীফ হুইপের উপর হামলা চালিয়েছে বলেই তাকে রাষ্ট্রপতি পদকে ভূষিত করা হয়েছে। সুতরাং পুলিশকে ভয়। এই সরকার খুনি-বান্ধব। সন্ত্রাসী-বান্ধব। নির্বাচন সামনে রেখে জেল থেকে সকল খুনি, মাস্তান, শীর্ষ সন্ত্রাসীকে নানা কৌশলে বের করে আনা হচ্ছে। যেনো নির্বাচনের সময় তারা ভোটারদের একইভাবে ভয় দেখাতে পারে। ভোট কেন্দ্রে না যেতে, বিরোধী পোলিং এজেন্টদের বের করে দিতে, নিজেদের পছন্দ মতো ভোটের ফলাফল ঘোষণা করতে।
এভাবে ভয় পেতে পেতে মানুষ আত্মহত্যা করে না। দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন বিদ্রোহ করে। সে বিদ্রোহের আগুন যখন জ্বলে, তখন তা চারদিক ভস্ম করে দেয়। সে আগুনের হাত থেকে সরকার, পুলিশ, মিলিটারি, মাস্তান কেউই রেহাই পায় না। এই কঠোর সত্য বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকার কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। কিন্তু তাদের বুঝতে হবে যে, এই মাস্তান বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, মিলিটারি বাহিনী সব মিলিয়ে যে শক্তি তার চাইতে সহস্র গুণ শক্তিশালী এদেশের মানুষ। যারা প্রতিদিন প্রতিবাদ করে না। হঠাৎ কোনোদিন কোনো নেতৃত্বে একযোগে বিশাল জলোচ্ছ্বাস হয়ে খড়-কুটোর মতো সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন