রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

স্বাধীন বিচারব্যবস্থা গণতন্ত্র ও কারাগার


সৃষ্টির সেরা মানুষ অনেক গুণের অধিকারী হলেও, এটা ধ্রুব সত্য যে, মানবগোষ্ঠীর একটি অংশ প্রতিহিংসাপরায়ণ। গোটা বিশ্বেই প্রতিহিংসা চলছে; সুজলা সুফলা বাংলাদেশও এতে পিছিয়ে নেই। পরিবার, সমাজ, রাজনীতি এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও প্রতিহিংসার চেহারা উন্মোচিত হয় বেদনাদায়কভাবে। প্রতিপক্ষকে সহ্য করার ইতিহাস পৃথিবীর সৃষ্টি থেকেই নেই। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চলে আসছে ক্রমাগত। জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে সভ্যতা ও বিজ্ঞানের উন্নয়ন হয়েছে সত্য; কিন্তু নির্যাতন, শোষণ, শাসনের একটুও ব্যত্যয় ঘটেনি। যখন মানবতা ও গণতন্ত্র নামক শব্দ দুটি পরিস্ফুট হয়নি তখনো সবল বা শাসক কর্তৃক দুর্বল বা প্রজা (বর্তমানে নাগরিক) শোষিত শাসিত হয়েছে; আধুনিক যুগেও এর পরিবর্তন হয়নি। পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। শাসনব্যবস্থায় এক সময় আইনগতভাবেই বিষ পান করানো; অগ্নিদগ্ধ করা, গ্যাস, চেম্বারে বন্দী, বাঘের খাঁচায় বন্দী, শূলে চড়ানো, ফুটন্ত গরম পানিতে নিক্ষেপ, গলা কর্তনসহ নানা উপায়ে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জব্দ করা হতো। কিন্তু সভ্যতার ক্রমবিকাশে আন্দোলনের মুখে সেসব ব্যবস্থার বিলুপ্তি হলেও বর্তমানে আইন ও আদালতকে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে দমন করা হচ্ছে। জমিদার বা রাজা বাদশাহরা লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে জনগণকে শায়েস্তা করত; বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী সে বাহিনীর ভূমিকায়। তারা শুধু লাঠিয়াল হিসেবে জনগণকে জব্দই করে না, বরং আইনকে অপব্যবহার করে তাদের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে, আর আদালতের অসহায়ত্বের কারণেই আইনিব্যবস্থা দিনে দিনে দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করছে। বাহিনীগুলো যে ভাষায় কথা বলে, আদালত এর বাইরে যেতে পারছে না। কাগজ-কলমে আদালত স্বাধীন হলেও তাদের অসহায়ত্ব কাটেনি। দুর্নীতির অভিযোগ ছাড়াও বিচার বিভাগের সুবিধামতো পোস্টিং, প্রমোশনের বিষয় রাষ্ট্রীয় কাঠামোর হাতে বন্দী এবং এ কারণেও রাষ্ট্র নিজেই সন্ত্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ। রাষ্ট্রের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করাসহ সংবিধানকে সমুন্নত রাখার দায়িত্ব যার (মাননীয় প্রধান বিচারপতি) তিনি কতটুকু তার দায়িত্বের প্রতি যতœবান এর মূল্যায়ন বর্তমানে নানা কারণে না হলেও সময় ও ভবিষ্যৎ ঠিকই মূল্যায়ন করবে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, অপরাধের কারণেই পৃথিবীর সৃষ্টি এবং পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই অপরাধপ্রবণতার শুরু। তাই অপরাধীর বিচারের মাধ্যমে শাস্তি হবেÑ এটাই সভ্যতার দাবি। কিন্তু প্রতিপক্ষ হিসেবে কোনো ব্যক্তি নিগৃহীত হওয়া সভ্যতা, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের পরিপন্থী। কিন্তু বর্তমানে গণতন্ত্রকে রক্ষার নামে বিচারব্যবস্থাকে কৌশলে ব্যবহার করেই প্রতিপক্ষকে নিগৃহীত করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে অগণিত মিথ্যা মোকদ্দমায় জড়িত করে বারবার রিমান্ডের নামে প্রতিপক্ষকে নিগৃহীত করা হচ্ছে। অন্য দিকে রাষ্ট্র বা সমাজে যিনি প্রভাবশালী তিনিও প্রতিপক্ষকে নিগৃহীত করার জন্য রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছেন যেনতেনভাবে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে শাসকগোষ্ঠী যখন বিচারব্যবস্থার (Public Trial) দিকে এগিয়ে গেল, তখন থেকেই কারাগার বা জেলখানার আনুষ্ঠানিক সৃষ্টি। অন্য দিকে, অপরাধপ্রবণতা রোধ করা এবং সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কারাগারের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। কারাবন্দী হিসেবে আইনগতভাবে একজন মানুষ যে সুযোগ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী, সে সুবিধা থেকে রাষ্ট্র তাদের বঞ্চিত রেখেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ রয়েছে দর্শকের ভূমিকায়Ñ এটাই এখন পর্যালোচনার দাবি। কারাবন্দীদের সুযোগ সুবিধার নামে জেল কোড সংশোধন করা হয়েছে অনেক বার। কিন্তু কারাকর্তৃপক্ষের ক্ষমতা যেভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে সেভাবে কারাবন্দীদের অধিকার বাস্তবায় হচ্ছে না। তাদের সাথে আচরণ করা হচ্ছে ক্রীতদাসের মতো। মূলত এটাই দৃশ্যমান যে, আইনকানুন বা জেল কোডে যা-ই থাকুক না কেন, কারাবন্দীরা ন্যূনতম অধিকার থেকেও বঞ্চিত। জেলখানায় অনেক প্রবাদের মধ্যে যে প্রবাদটি বহুল আলোচিত তা হলো- যার টাকা ও তদবিরকারক আছে তাকে জেলে থাকতে হয় না।এখন প্রশ্ন হলো, যার টাকা বা তদবিরকারক নেই তার অবস্থা কী হবে? এ হতভাগ্যদের অধিকার আদায়ে যদি এগিয়ে না আসা হয়, তবে এটা কিসের সভ্যতা? দফায় দফায় দীর্ঘ দিন জেলে থাকার কারণে কারাগারের অনেক ঘটনাই জানি। তার জন্য রাষ্ট্র যেমন, তেমনি আইন বিভাগের অভিভাবক প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। দীর্ঘমেয়াদি সাজা শেষ হওয়ার পরও রায়ে সম্মানিত বিচারপতিদের স্বাক্ষর না হওয়ার কারণে অনেকেই সময়মতো জেল থেকে বের হতে পারছেন না। এর জবাব কে দেবে? উচ্চ আদালতে মামলা শুনানি না হওয়ার কারণে দীর্ঘ দিন বিনা বিচারে কারাগারে বন্দী রয়েছেন, এর অগণিত প্রমাণ রয়েছে, যার খবর পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই প্রকাশিত হয়। অন্য দিকে কারাগার যেন মানুষ বেচাকেনার হাট। যেখানে ২০ জন লোক থাকতে পারে সেখানে পাঁচ গুণ বন্দীকে গাদাগাদি করে রাখা হয়। চিকিৎসার নামে সব রোগের জন্য প্যারাসিটামল দুবেলা। স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাতের সময়ও বাণিজ্যরয়েছে। খাদ্য সরবরাহ করা হয় অত্যন্ত নি¤œমানের। ফলে PERSONAL CASH ব্যবসা এখন জমজমাট। যার টাকা আছে সে জেলখানার গেটে P.C Account এ টাকা জমা রাখলে তার (জমাকারী কারাবন্দীর) চাহিদা মোতাবেক (টাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত) পণ্য/খাদ্য জেল কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করবে। এ ক্ষেত্রে কারা কর্তৃপক্ষের দ্বিগুণ বা তিন গুণ মুনাফা আদায়ের ব্যবস্থা হলেও বিষয়টি হতভাগ্যদের জন্য অনেক দুর্ভাগ্যের। কারণ যার টাকা রয়েছে, সে যখন P.C এর মাধ্যমে মাখন রুটি খাবে তখন হতভাগ্যদের চেয়ে চেয়ে ঢোক গেলা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। গরিব অসহায় বিচারপ্রার্থীদের জন্য জেলা জজের নেতৃত্বাধীন আইন সহায়তা দেয়ার একটি কমিটি রয়েছে। কিন্তু এর ফল ভোগ করছেন সমাজের কত পারসেন্ট? এ ধরনের একটি কমিটি জাতীয়ভাবে চোখে পড়ার মতো কার্যক্রম গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিটি কারাগারের জন্য জেল ভিজিটর রয়েছেন, যারা ক্ষমতাসীনদের দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত। ক্ষমতাসীনেরা যেখানে বিরোধীদের কারাগারে নিক্ষেপ করে নিগৃহীত করে, তখন রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগকৃত সরকারদলীয় Jail Visitor-রা নিগৃহীত বন্দীর কোন উপকারে আসবেন? কারাগার হোক সংশোধনাগার। সেখানে এমন মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক, যেখান থেকে অপরাধী নির্দোষ হয়ে বেরিয়ে আসবে, সাথে থাকবে তার প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। এ বিষয়গুলো রাষ্ট্রকে বিবেচনায় আনতে হবে। তবেই অপরাধীকে আলোর পথ দেখানো সম্ভব হবে। এ দেশে বিরোধী দলে থাকলে জেল খাটতে হয়। নিজ চোখে দেখেছি, জেলে থাকলে কারা সংস্কারের দীপ্ত শপথ করা হয়। মন্ত্রী হলে বেমালুম ভুলে আরো কঠিন আইন প্রণয়ন করেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ এখনকার অনেক মন্ত্রীর সাথেই জেল খেটেছি। তখন তাদের চোখেমুখে কারাবন্দীদের অসহায়ত্বের প্রতি সহমর্মিতা দেখেছি। এখন দেখছি তারা উল্টো। শাসক বা রাজা বাদশাহদের ইচ্ছায়ই কারাগার পরিচালিত হতো। এতে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না। যখন যা আদেশ হতো মর্জিমাফিক তাই পালিত হতো। ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশ ভারতের কারা মহাপরিদর্শক Dr. F. J. Mouat কারা আইন সংশোধন করার কাজ শুরু করেন; যা সমাপ্ত তিনি করতে পারেননি। ১৮৬৭ সালে বেঙ্গল জেল ম্যানুয়াল প্রকাশিত হয়। ১৮৭৬ সালে তৎকালীন কারা মহাপরিদর্শক W. J. Heely জেল কোডের দ্বিতীয় সংকলনের কাজ শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে কারা আইনের সংশোধন হয়েছে। এ আইনকে অধিকতর সময়োপযোগী করার জন্য ১৯১৯ সালে ইন্ডিয়ান জেল কমিটি গঠিত হয়, যার সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে বেঙ্গল কারা মহাপরিদর্শক R. E. FLOWERDEW Lt. Col. I.M.S. ৭ম সংকলন প্রকাশ করেন। কিন্তু কারাআইনের সময়োপযোগী সংস্কার হয়নি। সরকার আসে, সরকার যায়। বিভিন্ন সময়ে সরকার কারাআইনকে সংশোধন করেছে। সর্বশেষ থিম হিসেবে কারাবন্দীদের জন্য যে স্লোগানটি ব্যবহার করছে তা হলোÑ ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ।কিন্তু কারাগারে কতজন আলোর পথ দেখেছে সেটাই এখন পর্যালোচনার বিষয়। আমরা আলোর পথ দেখতে চাই। কারণ রাষ্ট্রের জন্য প্রতিটি নাগরিকের জীবন ও সময় অনেক মূল্যবান। কারাজীবনে কর্মের মাধ্যমে কারাবন্দীর জীবন আলোকিত হোকÑ এটাই জাতির কাম্য। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads