সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সাংবিধানিক গোলকধাঁধ


যেকোনো দেশের মূল সংবিধান জনস্বার্থে কিছু প্রজ্ঞাসংবলিত ব্যক্তি প্রণয়ন করে থাকেন। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে পরে আমাদের সংবিধানে যেসব সংশোধনী সংযোজিত হয়েছে তার বেশির ভাগই জনস্বার্থে না হয়ে শাসকগোষ্ঠীর সুবিধার্থে প্রণীত হয়েছে। ফলে মূল সংবিধানের ভাগ্যে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে যে, তাকে আর যাই বলি না কেন, জগাখিচুরি বললে অত্যুক্তি হবে না। এবার কিছুটা চুলচেরা হিসাব-নিকাশ করে দেখা যাক। আমাদের সংবিধানের দুরবস্থার দৌড় কত দূর ? সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭২(৩) এবং ১২৩ (৩) (ক) ও (খ) কী বলে? অনুচ্ছেদ ৭২(৩) বলে যে, সংসদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। কেবল যুদ্ধের কারণে ব্যতিক্রম হতে পারে। নবম সংসদের মেয়াদ ২৪ জানুয়ারি, ২০১৪ সালে পাঁচ বছর পূর্ণ হবে। সংসদ ভেঙে যাবে ২৫ জানুয়ারি ২০১৪। কাজেই মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার েেত্র আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে হবে ২৭ অক্টোবর ২০১৩ থেকে ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ এর মধ্যে। অনুরূপভাবে, আবার অনুচ্ছেদ ১২৩(৩) (খ) এর ভিত্তিতে মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার েেত্র, আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে হবে সংসদ ভেঙে দেয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে। উল্লেখ্য সংসদ মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে ভেঙে দেয়ার আহ্বান সাধারণত প্রধানমন্ত্রী করে থাকেন। বলা বাহুল্য, ওই ভেঙে দেয়ার আহ্বান সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই হতে হবে। সে েেত্র সংসদ ভেঙে দেয়ার আহ্বান ২৫ অক্টোবর ২০১৩ এর মধ্যে হতে হবে এবং জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৬ অক্টোবর ২০১৩ থেকে ২৩ জানুয়ারি ২০১৪ এর মধ্যে। বিষয়টি স্বচ্ছ ও অত্যন্ত স্পষ্ট যে, আমরা আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় পদপে নেয়ার ক্রান্তিকালে পৌঁছে গেছি। সংবিধানে প্রয়োজনবোধে কিছু সংশোধনী এনেই হোক কিংবা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে টেকসই সমঝোতার মাধ্যমেই হোকÑ এ ধরনের পদেেপর জন্য হাতে সময় খুবই কম। কারণ যা ব্যবস্থা নেয়ার তা হয় ২৫, না হয় ২৬ অক্টোবরের মধ্যেই উপরি উক্ত সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার ভিত্তিতেই করতে হবে। এখানে না বললেই নয় যে, রাজনৈতিক দলগুলো ভুল করতে পারেÑ ভোটার জনসমষ্টি কিন্তু ভুল করবে না বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। তদুপরি সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলো সুষমভাবে সাজিয়ে একসাথে পড়তে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এগুলো বিচ্ছিন্নভাবে গৃহীত হলে তা মৌলিক ভাবধারা ও সারমর্ম থেকে ছিটকে পড়বে। মনে রাখতে হবে, সংসদের মেয়াদ কিন্তু পাঁচ বছর। যুদ্ধের সময় ব্যতীত এর কোনো ব্যতিক্রম হবে না। অপর দিকে, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর ওপর সুপ্রিম কোর্টের রায় কিন্তু অত্যন্ত স্পষ্ট। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বেলায় ত্রয়োদশ সংশোধনীর আদলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। সে েেত্র অবশ্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্বে কোনো বিচারপতিকে না দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই। হাতে সীমিত সময় এবং কেবল সীমিত সংখ্যায় ব্যবস্থা গ্রহণের পথ থাকায় নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে কেউ কেউ হয়তো উদ্যোগী হতে পারেন : গ্রহণযোগ্য সমঝোতার মাধ্যমে আগামী দুটো জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে অনুষ্ঠান করা। ২. একেবারে অগত্যা, অগত্যাই বটে, অনুচ্ছেদ ৫৬(৪) এর আওতায় নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা তা চিন্তাভাবনা করে দেখা যেতে পারে : ১০ (দশ) সদস্যের (সরকারে ৫ জন এবং বিরোধী দলের ৫ জন) একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ প্রদান করা। সে েেত্র তারা (নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীসহ) সাংবিধানিক নিয়মানুযায়ী আর্থিক সুবিধাদি পাবেন। (খ) এবং সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের নিকট গ্রহণযোগ্য কোনো সংসদ সদস্যকে (প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা ব্যতীত) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ প্রদান করা। (গ) কোনো সমঝোতা না হলে সে েেত্র সংসদ সদস্য নয়, এমন কাউকে (উভয় পরে নিকট গ্রহণযোগ্য) অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা। বলা বাহুল্য, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য ওই নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সংসদের কোনো শূন্য আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন করে আনতে হবে। কোনো শূন্য আসন না থাকলে কোনো সংসদ সদস্য সমঝোতার ভিত্তিতে আসন ছেড়ে দিলে সেই আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন করে আনতে হবে। অন্যথায় যেকোনো মহিলা সংসদ সদস্য তার আসন ওই মহৎ কাজে ছেড়ে দিলে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ওই আসনে একজন মহিলাকে নির্বাচিত করে এনে সমঝোতার ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী করা যেতে পারে। উপরি উক্ত কার্যক্রমে আসল কথা কিন্তু উভয় পরে সমঝোতাঅপরিহার্য। অন্যথায় সবই হবে পণ্ডশ্রম। নির্বাচনের জন্য তফসিল ঘোষণার পর সব সংসদ সদস্য (অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ব্যতীত), সমঝোতার আলোকে আর কোনোরূপ সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। পরিশেষে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা যায় যে, ‘শুভস্য শীঘ্রম্, অশুভস্য কালহরণ। উভয় পকে অনতিবিলম্বে সাংবিধানিক সমস্যা কাটিয়ে গোলকধাঁধা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী করে নতুন প্রজন্মের জন্য এক অনবদ্য নিদর্শন রেখে যেতে হবে, যা হয়তো আগামী দিনের পাথেয় হয়ে থাকবে। (লেখাটি লেখকের ব্যক্তিগত মতামতের প্রতিফলন, দলের নয়) লেখক: উপদেষ্টা, বিএনপি চেয়ারপারসন। সভাপতি, ঢাকা জেলা বিএনপি। সাবেক : প্রতিমন্ত্রী, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় : সংসদ সদস্য (ঢাকা-২), সভাপতি, কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি : এমডি, বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইনস। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads