মহাজোট সরকার ক্ষমতার শেষ সময়ে এসে বিভিন্ন মহলকে খুশি করার চেষ্টা করছে। পত্রিকার পাতায় সরকারের এমন প্রচেষ্টার নাম দিয়েছে ‘তুষ্টির প্যাকেজ কর্মসূচি’। যেসব সেক্টরের দাবি-দাওয়া গত পৌনে পাঁচ বছরে পূরণ করা হয়নি, সেগুলো আগামী ৩ মাসের মধ্যেই পূরণ করতে চায় সরকার। তবে ২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণার আগেই দাবি পূরণের কাজ শেষ করতে হবে সরকারকে। এরই মধ্যে প্রশাসনের আমলা থেকে শুরু করে শিক্ষক, কৃষক, পুলিশসহ সশস্ত্র বাহিনী এমন কি সাংবাদিকদেরও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে সরকার। পদোন্নতি, পদমর্যাদা, স্থায়ী-পে কমিশন, মহার্ঘ্যভাতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। সরকারের এসব উদ্যোগে বিভিন্ন মহল খুশি, তবে বিরোধীরা বলছে ক্ষমতার শেষ বেলায় এসে সবাইকে খুশি করতে এমন উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।
উল্লেখ্য যে, গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন চলতি অক্টোবরেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য স্থায়ী-পে কমিশন গঠন করা হবে। এছাড়া মহার্ঘ্যভাতা দেয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন। প্রশাসনে কয়েক দফা গণ-পদোন্নতির পর আরেক দফা পদোন্নতি দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে বাদ যাচ্ছে না স্বাস্থ্যখাতও। প্রাথমিক শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি সরকার রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণের প্রক্রিয়াও শুরু করেছে। পুলিশের পরিদর্শকের পদকে ১ম শ্রেণীতে উন্নত করা হয়েছে। এছাড়া রেশনের দিক থেকেও পুলিশকে দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা। নাগরিকদের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ, সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি তো খুবই ভাল কাজ। এসব কাজ করার জন্যই তো মানুষ ভোট দিয়ে সরকার গঠন করে থাকে। তবে দেশের নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধার কথা উঠলে ১৬ কোটি মানুষকেই গণনার মধ্যে আনতে হবে। শুধু দেখে দেখে কিংবা বেছে বেছে ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার ক্ষেত্রে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, শুধু তাদের উন্নয়নের কথা ভাবলে চলবে না। এমন উন্নয়ন ভাবনাকে গণতান্ত্রিক উন্নয়ন ভাবনা বলে বিবেচনা করা যায় না। বিশেষ করে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে যখন বিভিন্ন মহলকে খুশি করার প্রচেষ্টা চালানো হয়, তখন তাতে নির্বাচনী-রাজনীতির গন্ধ পাওয়া যায়। এই কারণেই হয়তো বিভিন্ন মহলের দাবি দাওয়া পূরণে সরকারের বর্তমান সময়ের প্রচেষ্টাকে পত্রিকার পাতায় ‘তুষ্টির প্যাকেজ কর্মসূচি’ হিসেবে মন্তব্য করা হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর এ পর্যায়ে এসেও দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সরকারের যে রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাতে খুশি হওয়ার মত কোনো কারণ নেই। গণতন্ত্র বলতে আমরা যেন শুধু নির্বাচনকেই বুঝে নিয়েছি। আর জনগণও যেন ভোট প্রদানের একদিনের ক্ষমতাকেই গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে মেনে নিয়েছে। গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় এবং গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্বের মধ্যে যে আরো বহু বিষয় সুনির্দিষ্ট আছে তা নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না, তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে বলিষ্ঠ দাবিও উচ্চারিত হয় না। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়া-আসার খেলায় বেশ সুবিধাজনক একটি পরিস্থিতিতে আছে। শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীও নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার সম্পর্কে তেমন সচেতন নয়, সরকারও রাজনৈতিক দলগুলোর ফাঁকি-ঝুঁকি ও ফাঁক-ফোঁকড় সম্পর্কেও তেমন অবগত নয়। এসব কারণে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তায়নের পরিধি বেড়েই চলেছে। সরকার ও নির্বাচনী ইশতেহারের বিশাল বোঝা কাঁধে নিয়ে নানা ব্যর্থতার পরও আগামী নির্বাচনে আবারও বিজয়লাভের আকাক্সক্ষায় নির্বিকারভাবে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের তৎপরতা। শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা আমাদের এই জনপদে সরকারের সাহসের প্রশংসা করতে হয়। নয়তো নির্বাচনের মাত্র ৩ মাস আগে বিভিন্ন মহলকে তুষ্ট করার প্যাকেজ সরকার এভাবে ঘোষণা করে কেমন করে? বিভিন্ন সময় নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে যেসব উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের কথা টেনে আনা হয়, নির্বাচনের মাত্র ৩ মাস আগে এমন তুষ্টির প্যাকেজ কর্মসূচির কথা কি সে সব দেশে কল্পনা করা যায়? তাই বলতে হয়, নির্বাচনের আগ মুহূর্তে তুষ্টির এমন প্যাকেজকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করা গেলেও বিষয়টিকে কোনোভাবেই গণতন্ত্রসম্মত বলে বিবেচনা করা যায় না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন