বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

এই খেলা জনগণ আর দেখতে চায় না


মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যবহার করেই যে আওয়ামী লীগের রাজনীতি, ন্যূনতম বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিও তা অকপটে বুঝতে পারেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেও এই একই চেতনা আওয়ামী লীগের জন্য বড় শক্তি হিসেবে কাজ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের এই রাজনীতি, যা এখনো চলছে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন না ঘটলে রাজনীতির এই ধারা হয়তো চলতেই থাকবে। কারণ দেশের মানুষের আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার সাথে একাত্ম হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যা ভোটের রাজনীতিতে এক বড় ফ্যাক্টর বলে মনে করা হয়। দেশে বিদ্যমান হিংসা ও সঙ্ঘাতের রাজনীতিতে এখন সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করছেন কজন, আর কজনই বা এই চেতনা অপব্যবহার করছেনÑ সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। মুক্তিযুদ্ধের মহান চেতনাকে লুণ্ঠনের এই অপরাজনীতির শিকড় কতটা গভীর সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। সরলমনা মানুষের আবেগ অনুভূতিকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগাতেআজো এই কৌশল সফলভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু স্বাধীনতার মুহূর্ত থেকেই কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে অপরাজনীতি শুরু হয়েছে? এই স্পর্শকাতর বিষয়ে নিজে কোনো মন্তব্য না করে কেবল মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব:) এম এ জলিলের বিখ্যাত অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতাবইয়ের কয়েকটি অংশ বিদগ্ধ পাঠকের সামনে হুবহু তুলে ধরছি... আমার জানতে ইচ্ছে করে, কোলকাতার বিশেষ এলাকায় যুবতী নারী সম্ভোগে অধীর কামাতুর ঐ সকল আওয়ামী লীগ নেতাদের মনোসরোবরে একবারও ভেসে উঠেছে কি যুদ্ধরত পূর্ব বাঙলায় পশু পাঞ্জাবী কর্তৃক ধর্ষিতা বাঙালী মা-বোনের বীভৎস চেহারা?’ একই বইয়ের আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন : শরণার্থী শিবির থেকে অসহায় যুবতী হিন্দু মেয়েদের কোলকাতা শহরে চাকুরী দেয়ার নাম করে সেই সকল আশ্রয়হীনা যুবতীদেরকে কোলকাতার বিভিন্ন হোটেলে এনে যৌন তৃষ্ণা মেটাতে বিবেক দংশন বোধ করেনি। তারা বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের নেতা হবে না তো হবে আর কে বা কারা! হানাদার পাক বাহিনীর সুযোগ্য উত্তরসূরি তো একমাত্র তারাই-আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ।মেজর জলিলের এই লেখাই স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন হোটেলে ফূর্তি করা, অনেকেই পরে কথিত মুক্তিযোদ্ধা সেজে দেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছেন। সবচেয়ে দুঃখের কথা, এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী রাজনৈতিক দলটির প্রশ্রয়েই এমনটি করার সুযোগ পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে এই অপরাজনীতি কি বন্ধ হয়েছে আজো? নিশ্চয়ই নয়। সে কারণেই বিশেষ দলের সংস্পর্শে গেলে মুক্তিযোদ্ধা এবং তার বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেই রাজাকার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আর সে কারণেই কোনো কোনো রাজাকার বর্তমান সরকারের মন্ত্রিপরিষদে পর্যন্ত ঠাঁই পেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। চেতনা নিয়ে এই রাজনীতিতে সম্প্রতি যার আগমন ঘটেছে তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রীতনয় সজীব ওয়াজেদ জয়। একই চেতনাকে কাজে লাগিয়ে তিনিও রাজনীতির ময়দানে জনগণকে কাছে টানার কৌশল নিয়েছেন। সম্প্রতি ফেসবুকে তার একটি আহ্বান নজর কাড়ে দেশের গণমাধ্যমের। রাজাকারদের নাবলতে আমার সঙ্গে যোগ দিন : জয়”Ñ এমন শিরোনামে দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইনে গত ৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনটি হুবহু তুলে ধরা হলো : রাজাকারদের না বলতে অনুগ্রহ করে তার সাথে যোগ দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টায় জয় তার ফেসবুকের পাতায় এই আহ্বান জানান। সজীব ওয়াজেদ বলেন, ছোট্ট একটা সংবাদ আমাকে বিব্রত করেছে। খবরটি হলো : রাজকারদের ভোটাধিকার বাতিলে মন্ত্রিসভার যে সিদ্ধান্ত, তার বিরোধিতা করেছে বিএনপি। এটা অবিশ্বাস্য ঘটনা! যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরোধিতা করেছিল, তারা কী করে ভোট দেয়ার অনুমতি পায়? আমাদের বিরোধী দল তাদের ভোটাধিকার চাইছে, এটা লজ্জাজনক। এভাবে বিএনপি আবারো রাজাকারদের পক্ষে গিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে দাঁড়াচ্ছে দাবি করে জয় বলেন, এটা তাদের দেশপ্রেমহীন এবং বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান। রাজাকারদের সমর্থনকারী বিএনপিকে জানাই ধিক্কার এবং সব রাজাকারকে না বলতে অনুগ্রহ করে আমার সাথে যোগ দিন।নতুন প্রজন্মের নেতা জয়ের কাছে এখন যদি দেশবাসী জানতে চায় সরকারে ও ক্ষমতাসীন দলে যেসব চিহ্নিত রাজাকার রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে জয় কী বলবেনÑ নিশ্চয়ই সেটা খুব অযৌক্তিক প্রশ্ন হবে না। সজীব ওয়াজেদ জয়ের রাজাকারদের নাবলার আহ্বানসংবলিত সংবাদটি যখন গণমাধ্যমের শিরোনামে তখন আরেকটি শিরোনাম আমার চোখে পড়ে। রাজাকারপুত্র রিমন বরগুনায় আ. লীগের প্রার্থী’Ñ শিরোনামে অনলাইন বার্তা সংস্থা আরটিএনএন-এ ৩ সেপ্টেম্বরে আপলোড হওয়া প্রতিবেদনটিতে বরগুনা-২ আসনের উপনির্বাচনে রাজাকারপুত্র শওকত হাসানুর রহমান রিমনকে মনোনয়নের দেয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটির খানিকটা তুলে ধরা হলো : মঙ্গলবার রাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্টারি বোর্ডের মুলতবি সভায় এই মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়। বোর্ডের সদস্য ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ তার এই মনোনয়নের বিষয়টি আরটিএনএনকে নিশ্চিত করেছেন। আগামী ৩ অক্টোবর রিমন নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবেন। এ দিকে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় হাসানুর রিমনের বাবা এ কে এম খলিলুর রহমান বরগুনা (মহকুমার) রাজাকার বাহিনীর চার্জে ছিলেন। বর্তমান যুদ্ধাপরাধীদের তদন্তাধীন মামলার তালিকায় তার নাম ২৪৩ নম্বর সিরিয়ালে রয়েছে বলে জানা গেছে।... রিমনের বাবা এ কে এম খলিলুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাথরঘাটার বাসিন্দা সতীশ মণ্ডল ও মুজিবুর রহমান নামে দুজনকে হত্যার সাথে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।এমনকি ২০০৯ সালে রিমনকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উত্তোলনের সময় ওই স্থানে উপস্থিত না থাকার আদেশ জারি করেছিলÑ এমন তথ্যও উঠে আসে আরটিএনএন-এর প্রতিবেদনে। ইস্যুটি বর্তমানে হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, কথিত রাজাকারদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের যে লড়াই চলছে, তাতে সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লালন কতটা? স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব মেনে নিয়ে চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশের আনুগত্য সত্ত্বেও তাদের দৃষ্টিতে যারা রাজাকার, তাদের ভোটাধিকার না দেয়ার পক্ষে যখন দলটির দৃঢ় অবস্থান, তখন কিভাবে একজন রাজাকারের ছেলেকে সংসদ সদস্য পদে সে দল থেকে নমিনেশন দেয়া হয়। তদুপরি এই প্রার্থীর কার্যকলাপের জন্য বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারেরই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় যাকে বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উত্তোলনের সময় সেখানে না থাকতে আদেশ দিয়েছিল, তাকেই এখন সংসদ সদস্য হিসেবে দেখতে চায় দলটি। জানতে ইচ্ছে করে, শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের যে ব্রত নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল সেই চেতনা সত্যিকার অর্থে কারা লালন করছেন?


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads