জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের জন্য অবশেষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৩৪ জনের একটি বিশাল প্রতিনিধি নিয়ে নিউইয়র্ক পৌঁছেছেন। ইতোপূর্বে কোন কোন গণমাধ্যমে সাধারণ পরিষদে তার না যাবার খবর প্রকাশিত হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে, জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসন এবং আসন্ন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকার পদ্ধতি কি হবে সে সম্পর্কে বিরোধী দলের সাথে সংলাপ অনুষ্ঠানের যে অনুরোধ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী তা অগ্রাহ্য করেছেন। এই অবস্থায় তিনি সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে গিয়ে সম্ভবত মহাসচিব বান কি মুনের মুখোমুখি হতে চান না। এ ধরনের ধারণা যারা পোষণ করতেন তাদের বিপরীতে আরেকটি গ্রুপও ছিলেন যারা মনে করতেন যে, যে প্রধানমন্ত্রী ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য কিংবা যে সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সচিবালয়ের একজন সহকারী সচিবই যথেষ্ট সেই প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যাবেন না, তা হতে পারে না। অবশেষে শেষোক্ত গ্রুপের ধারণাই ঠিক প্রমাণিত হলো। জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেত্রী হিসাবে সাধারণ অধিবেশনে অংশগ্রহণ করছেন, এতে আমরা আনন্দিত। তবে এখানে কথা উঠেছে প্রতিনিধিদের সংখ্যা নিয়ে। ১৩৪ জনের (মতান্তরে ১৪০) একটি দল যদি নিউইয়র্কের মত শহরে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যান তাহলে অবশ্যই তার আকার নিয়ে কথা উঠাটা স্বাভাবিক। তারা গেছেন দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য, দেশের খরচায় তাদের বিমান ভাড়া, ভ্রমণ কর, বিমানবন্দর থেকে হোটেল, হোটেল থেকে সম্মেলন স্থল পর্যন্ত আসা-যাওয়ার খরচ, হোটেল ভাড়া প্রভৃতির সবকিছুই রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে। এক হিসাব অনুযায়ী নিউইয়র্ক শহরের মাঝারি মানের হোটেলসমূহে অবস্থান করতে গেলেও তাদেরকে দৈনিক সিট ভাড়া বাবদ ২৭ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া আছে তাদের পকেট এলাউন্স, খাবার ও পানীয় বাবদ খরচ। এই বাবদ যদি আরো ১৩ লাখ টাকা ধরা হয় তা হলে দৈনিক খরচের পরিমাণ আসে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা। প্রতিনিধি দল যদি নিউইয়র্কে ৬ দিন অবস্থান করেন তাহলে মোট খরচের পরিমাণ দাঁড়াবে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর সাথে বিমান ভাড়া যোগ করলে মোট খরচ হবে ৫ কোটি ৮ লাখ টাকা। এই খরচের সাথে বিদেশে প্রধানমন্ত্রীর এসএসএফ নিরাপত্তা বাবদ ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে যে, প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গীদের জন্য নিউইয়র্কে অত্যন্ত ব্যয়বহুল গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে ৬১টি এবং মান হাট্টনের হ্যাম্পটন হোটেলে ৬টি বিলাসবহুল কক্ষ ভাড়া করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের অধিকাংশই সিঙ্গেল রুমে থাকবেন। তবে গণমাধ্যম ও জুনিয়র কর্মকর্তারা ২ বেডের কক্ষে অবস্থান করবেন। তার সফরসঙ্গী হিসেবে যারা নিউইয়র্ক গেছেন তাদে মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, রাষ্ট্রদূত জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী ছাড়াও সরকারি দল, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় পার্টির ৯ জন এমপি, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, যুব মহিলা লীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, জাতীয় শ্রমিক জোট ও গণতন্ত্রী পার্টি থেকে নেয়া ১৮ জন, খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বাছাইকৃত এটিএন নিউজের মুন্নি সাহাসহ ৫ জন খ্যাতনামা মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, ৪১ জন ব্যবসায়ী প্রমুখ।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে যাওয়া এই বিশাল বহর নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন যে, নিইউয়র্কে এদের সিংহভাগেরই কোনও কাজ থাকবে না। তারা রং-তামাশা, কেনাকাটা এবং দর্শনীয় স্থানসমূহ পরিদর্শন করেই সেখানে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে সময় কাটাতে গেছেন এবং আমাদের মতো দরিদ্র দেশের জন্য এটা যেমন দুঃখজনক, তেমন লজ্জার বিষয়ও। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও সেখানে গিয়ে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু বয়ে আনতে পারবেন বলে আমরা মনে করি না। সাধারণ অধিবেশন ও তৎসংশ্লিষ্ট কিছু কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ ছাড়াও ছয়দিনে তিনি যা করবেন তা হচ্ছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আধাঘণ্টা, বান কি মুনের সাথে ১৫ মিনিট এবং কাতারের আমীরের সাথে ১৫ মিনিটের বৈঠক। গত প্রায় ৫ বছরে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিশাল বিশাল লট-বহর নিয়ে ৪৭ বার বিদেশ সফর করেছেন। কিন্তু এই সফরগুলো দেশের জন্য উপকারী প্রমাণিত হয়নি। তিনি চারবার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন, কিন্তু একবারও দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ নিয়ে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে বৈঠক করতে পারেননি। বলাবাহুল্য, ২০০৯ সালে তিনি ৮১ জন, ২০১০ সালে ১০২ জন, ২০১১ সালে ৮৭ জন, ২০১২ সালে ৮৯ জন এবং এবার ১৩৪ জন নিয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন। জাতিসংঘ সফরসহ ৪৮টি বিদেশ সফরে তিনি কত টাকা ব্যয় করেছেন, তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বিদেশ সফরে কত টাকা ব্যয় করেছেন এবং দেশ তাদের এই সফর থেকে কতটুকু লাভবান হয়েছে আমরা আশা করি সরকার দেশবাসীকে তা জানাবেন। শোনা যাচ্ছে যে, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে মারাত্মক খুনি ও অপরাধীরাও বিদেশ গেছেন। এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করা জরুরি বলে আমরা মনে করি। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটা সরকারের দায়বদ্ধতা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন